Ajker Patrika

সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

আব্দুল্লাহ আলমামুন আশরাফী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়া সাল্লাম

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন পরশপাথর। তাঁর ছোঁয়ায় মাটির মানুষ পরিণত হতো খাঁটি সোনায়। আরবের এক গোলযোগপূর্ণ সময়ে তাঁর আগমন ঘটেছিল পৃথিবীতে। মানুষ হানাহানি, যুদ্ধ, অহংকার ও অমানবিকতায় ডুবে ছিল। আল্লাহ তাঁকে সেই অন্ধকার সমাজে হিদায়াতের প্রদীপ বানিয়ে পাঠালেন। তাঁকে দান করলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চারিত্রিক মাধুর্য। শৈশব থেকে তাঁর চারিত্রিক সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ করত। যৌবনে মক্কার সবচেয়ে বিশ্বস্ত যুবক তথা আল-আমিন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন খোদ মক্কার নেতৃস্থানীয় মানুষের কাছ থেকে। নবুওয়ত লাভের পর তাঁর অনুপম ব্যক্তিত্বের কথা ছড়িয়ে পড়ে আরবের পথে-প্রান্তরে। তাঁর মানবিক আচরণে মুগ্ধ হয়ে শত্রুরাও নির্দ্বিধায় তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে পাঠ করেছেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’ তাঁর জীবদ্দশাতেই সেকালের অনেক বড় শাসকও তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও অন্যান্য আলামত দেখে তাঁকে আল্লাহর প্রেরিত নবী বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। যুগে যুগে সত্যসন্ধানী অনেক অমুসলিম গবেষকও তাঁর অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে এনেছেন।

ওমানের বাদশাহ জুলানদি ছিলেন সত্যানুসন্ধানী বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর কাছে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলামের দাওয়াত পাঠান। সাহাবি আমর ইবনুল আস (রা.) দাওয়াত নিয়ে যান। বিচক্ষণ এই বাদশাহ নবীজি (সা.)-এর সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘আল্লাহর কসম, (দূত) আমাকে এমন একজন উম্মি নবীর কথা বলেছেন, তিনি যখনই কোনো ভালো কাজের আদেশ করেন, প্রথমে তিনি নিজেই সেই কাজটি করেন। আর যে কাজ তিনি নিষেধ করেন, প্রথমে তিনি নিজেই তা বর্জন করেন। তিনি বিজয়ী হয়েও অহংকার করেন না। কেউ তাঁর ওপর প্রতাপ দেখালে রুষ্ট হন না। তিনি ওয়াদা পালন করেন। চুক্তিসমূহ বাস্তবায়ন করেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, নিঃসন্দেহে তিনি একজন সত্য নবী।’ (আশ-শিফা: ১/ ২৪৮)  

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্রমাধুর্যের খানিক ঝলক বাদশাহ জুলানদির এই মন্তব্যে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। নবীজির চরিত্র ছিল পূর্ণতা ও পরিব্যাপ্তিতে বিভাসিত। তাঁর চরিত্রের প্রতিটি দিক ছিল ষোলোকলায় পূর্ণ। পাহাড়সম ধৈর্য ও দুর্বার সাহসিকতার অপূর্ব সমন্বয় ছিল তাঁর যাপিত জীবনের ছত্রে ছত্রে। দয়ামায়া, সহনশীলতা ও আমানতদারির সর্বোচ্চ চূড়ায় ছিল তাঁর অবস্থান। সময়ের আবর্তনে তাঁর চরিত্রিক মাধুর্যে তারতম্য ঘটেনি। জীবনের কোনো সময়ে একটু বেশি আবার কখনো একটু কম—এমনটা ঘটেনি। তিনি ছাড়া জগতের আর কোনো মানুষের মধ্যে একসঙ্গে এত চারিত্রিক গুণের সমাবেশ পরিলক্ষিত হয়নি। বিখ্যাত জার্মান লেখক ও দার্শনিক কবি জোহান গ্যাটে বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘ইতিহাসের পাতায় আমি তন্ন তন্ন করে সর্বোচ্চ শ্রেষ্ঠ মানুষের দৃষ্টান্ত খুঁজেছি, অবশেষে তা পেয়েছি আরবের নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যে।’ (শামসুল আরব তাসতায়ু আলাল গারব: ৪৬৫)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উত্তম চরিত্রাবলির মূল উৎস কী ছিল? কোন সে প্রেরণায় চরিত্রমাধুর্যে তিনি আকাশের উচ্চতাকেও হার মানিয়েছেন? তা ছিল পবিত্র কোরআন। হ্যাঁ, কোরআনই ছিল তাঁর অনন্য চরিত্র মাধুর্যের উৎস। তিনি পবিত্র কোরআন থেকেই তাঁর চারিত্রিক গুণাবলি আহরণ ও সমৃদ্ধ করেছেন। ফলে কোরআনই তাঁর পূর্ণ গুণাবলিকে পোঁছে দিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। তাঁর সুন্দর শিষ্টাচারকে করেছে আরও সৌন্দর্যময়। এটা সম্ভব হয়েছে কোরআনের প্রতি তাঁর আত্মনিবেদনের বদৌলতে। তিনি নিজেকে কোরআনের প্রতিটি কল্যাণের দিকেই সমর্পণ করে দিয়েছিলেন। কোরআনের অনুপম নির্দেশনামালা তাঁর যাপিত জীবনে বাস্তবায়িত হয়েছে চমৎকারভাবে। যেন তিনি ছিলেন কোরআনের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তাই তো হজরত সাদ ইবনে হিশাম ইবনে আমের (রা.) যখন উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.)কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন, তখন তিনি জবাবে বলেছিলেন, ‘তুমি কি কোরআন পড়োনি?’ সাদ ইবনে হিশাম বললেন, ‘পড়েছি।’ হজরত আয়েশা (রা.) বললেন, ‘কোরআনই ছিল তাঁর চরিত্র-শিষ্টাচার।’ (মুসলিম: ৭৪৬)  

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উত্তম চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর পরিবারে, সাথি-সঙ্গী মুমিনদের মাঝে, সমাজে বসবাসরত অমুসলিমদের মাঝে। এমনকি যুদ্ধরত শত্রুদলের মাঝেও তাঁর সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতাপূর্ণ আচরণ তাঁর চরিত্রকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। কুরাইশ সরদার আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণের আগেই তাঁর উত্তম চরিত্রের নমুনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি অকপটে স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘আপনার ওপর আমার বাবা-মা কোরবান হোক। আল্লাহর কসম, নিশ্চয়ই আপনি একজন মহান ব্যক্তি। আমি যুদ্ধ করেছি আপনার বিরুদ্ধে, আপনি কত-ই না উত্তম যোদ্ধা ছিলেন! আমি আপনার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি, আপনি কতই না উত্তম চুক্তিকারী ছিলেন! মহান আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।’ (মারিফাতুস সাহাবাহ: ৩/ ১৫০৯)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উত্তম চরিত্র এতটা ব্যাপক যে, তা যেন এক বিশাল দরিয়া। তাঁর চরিত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করে বিস্মিত ও বিমুগ্ধ হয়েছেন মুসলিম থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক অমুসলিম পণ্ডিতও। তারা নির্দ্বিধায় তাঁর অনন্য চরিত্রের কথা স্বীকার করেছেন। বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক উইলিয়াম ম্যুর বলেন, ‘তাঁর পুরো জীবন ছিল সহজ ও স্বাভাবিকতার নান্দনিক চিত্র। তাঁর অনন্য রুচি ও ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর বহু অনুসারীর কথায়। বিনয়, নম্রতা, সহানুভূতি, ধৈর্য, অন্যকে নিজের ওপর প্রাধান্যদান এবং প্রচুর দানশীলতা তাঁর চরিত্রকে দিয়েছিল এক অনন্যসাধারণ সৌন্দর্য। তাঁর ভালোবাসার আকর্ষণ চারপাশের সবাইকে মোহিত করে রাখত...।’ (হায়াতু মুহাম্মদ)

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সংক্রামক। এটি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংক্রমিত হয়। শুদ্ধ ব্যক্তির প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে শুদ্ধ হয় আশপাশের মানুষ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চারিত্রিক পূর্ণতা তাঁর সাহাবিদেরও পূর্ণ মানুষে পরিণত করেছিল। ফলে তাঁরা আমাদের উপহার দিয়েছিলেন অনুপম এক পৃথিবী। তাই নিজেকে শুদ্ধ করতে হলে, সমাজকে উন্নত ও মানবিক করতে হলে তাঁর চরিত্র ধারণ ও বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া গাফুরিয়া মাখযানুল উলুম টঙ্গী, গাজীপুর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

লুটপাটে শেষ ৫ কোটির প্রকল্প

‘ওরা সোনার তৈরি, আমরা মাটির’, কারখানার ভেতর আত্মহত্যার আগে শ্রমিকের ফেসবুক পোস্ট

দিনাজপুরে হিন্দু নেতাকে অপহরণ করে হত্যা: ভারত সরকার ও বিরোধী দল কংগ্রেসের উদ্বেগ

যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল, বেশির ভাগই ভারতীয়, আছে বাংলাদেশিও

আজ থেকে ৫০০ টাকায় মিলবে ১০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত