
উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দত্ত। এই লেখক সদ্য গত হয়েছেন। আর তাই সাক্ষাৎকারগ্রহীতা ও বন্ধ সাপ্তাহিকটির তখনকার নির্বাহী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকারের সম্মতিক্রমে আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।
তাপস কুমার দত্ত: ওপার বাংলার বাঙালিদের সঙ্গে এপার বাংলার বাঙালিদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যে পার্থক্য, সেটা যত দিন যাচ্ছে ততই কি দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: দুটো ঘটনা ঘটেছে এখানে, সেটা হচ্ছে—১৯৪৭ সালের আগে যে বাংলা, একত্র দুই বাংলা, যেখানের হিন্দু আর বাঙালিরা ছিল সম্পূর্ণ কলকাতামুখী। মুসলমান বাঙালিদের মধ্যে দুটো শ্রেণি ছিল—একটা শ্রেণি অত্যন্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ, শিক্ষিত লোক এবং বেশির ভাগই ছিল অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মুসলমান। এ অল্প ও অশিক্ষিত মুসলমানদের ওপর স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিরা ডমিনেট করল। ফলে যখন দেশ ভাগ হলো, তখন অল্পশিক্ষিত অশিক্ষিত মুসলমানেরা উল্লসিত হলো, কারণ, শিক্ষিত বাঙালিরা ভয় পেল, দু-একটা জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলো। আমি বাংলাদেশের অনেক জেলার কথা জানি, যেখানে আজ অবধি কোনো মানুষ খুন হয়নি দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে। যেমন ধরুন, রংপুর। সেখানে আজ অবধি কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত না ঘটা সত্ত্বেও রংপুর থেকে অনেক মানুষ চলে এসেছে ভারতবর্ষে। তখন এ রকম একটা প্রচারণা এসেছিল—পূর্ব পাকিস্তান মুসলমানদের জায়গা। অতএব, হিন্দুরা সেখানে থাকলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। তাই ছোটো ইন্ডিয়া। সেই ছোটার কাহিনিটা গত ৫৫ বছরের। সেই ছোটার কাহিনিতে অনেক মানুষ একেবারে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে তলিয়ে গেছে। আবার অনেক মানুষ সংগ্রাম করে করে ওপরে উঠেছে।...
তাপস কুমার দত্ত: এরপর থেকেও তো অনেক সংখ্যালঘু ওপারে চলে গেছে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এপার থেকেও গেছে, তবে তা আনুপাতিক হারে যথেষ্ট কম। যা বলছিলাম, এ ৫৫ বছরে যদি কেউ লাভবান হয়ে থাকে, আমি এপার বাংলার কথা বলছি—তা হলে হয়েছে পশ্চিম বাংলার মেয়েরা। এই যারা পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিল—সংগ্রাম করেছে, কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে, বস্তি বা কলোনিতে কোনোক্রমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে; তাদের দেখাদেখি পশ্চিম বাংলার কনজারভেটিভ পরিবার—যারা মেয়েদের অন্দরমহলে ফেলে রেখেছিল এবং অফিস-কাছারিতে যাওয়া তো স্বপ্নের বাইরে ছিল। যখন পূর্ববঙ্গের মেয়েরা জীবনসংগ্রামের বাধ্যবাধকতায় গ্র্যাজুয়েশন করে স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন অফিসে চাকরিতে ঢুকল; তখন এখানকার মেয়েরা উৎসাহিত হলো। আমরা যখন কলেজে পড়তাম; সন্ধ্যা ৬টার পর ট্রামে-বাসে কোনো মেয়েকে দেখা যেত না; যদি কোনো মেয়েকে দেখা যেত তা হলে সে নিশ্চয়ই বাঙাল (পূর্ববঙ্গীয়) হতো। কিন্তু এ পশ্চাৎপট একদম পাল্টে গেল ১৯৬৮ সালের পর থেকে। তখন বাস্তবিক নিষ্পেষণে পশ্চিম বাংলার মেয়েরাও বেরোতে শুরু করল, যেটা বলতে গিয়ে সরে এসেছি—সেটা হলো, এই দেশবিভাগ এবং এ দেশে উদ্বাস্তু স্রোত আসার অনেক খারাপ দিকের এই একটা ভালো দিক, আমাদের মেয়েরা অর্গল ভেঙে বেরোতে পেরেছিল। কিন্তু ওখানে (বাংলাদেশে) যারা রয়ে গেল (হিন্দু সম্প্রদায়) তাদেরও, আমরা দেখেছি, কেউ ১৯৬৭, কেউ ১৯৭০, কেউ ১৯৭৬-এ চলে আসতে লাগল।
তাপস কুমার দত্ত: এখনো কি অল্পবিস্তর চলে আসছে?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এখনো আসছে এবং এদের একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে এরা আওয়ামীপন্থী ছিল। অর্থাৎ এ দলটির কাছে ওরা নিরাপদ বোধ করত।
তাপস কুমার দত্ত: দেশভাগের পর ওপার বাংলার কী কী বিশেষ পরিবর্তন আপনার কাছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়েছে?
সমরেশ মজুমদার: ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এ ২৪ বছরে বাঙালির জীবনে পূর্ববঙ্গে একটা জিনিসেরই আমদানি ঘটেছে, সেটা হলো ইসলাম এবং ইসলামকেন্দ্রিক আরবি-ফারসি শব্দ। ওই সময় যাঁরা লেখালেখি করতেন, যেমন ধরুন—শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস—এঁরা যে বাংলা লিখতেন, তা ছিল পশ্চিম বাংলার বাংলা; অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারকৃত বাংলা। এঁরা বাংলার প্রাচীন সাহিত্য এবং রামায়ণ-মহাভারত ও আরও সব পৌরাণিক...প্রাচ্য ও পশ্চিমের সাহিত্যের ওপর ভালো দখল রাখতেন এবং সেটা তাঁদের ভেতরে লালন করতেন। ১৯৭১ সালের পর একটা আবেগ এল, আবেগের সঙ্গে ভয় এল। ভয়টা এই—আমরা এত দিন উনুনে পুড়ছিলাম, উনুন থেকে লাফিয়ে গরম তেলে পড়লাম না তো? অর্থাৎ আমরা পাকিস্তানের অত্যাচারে জর্জরিত হচ্ছিলাম, এখন ভারত বড়দাদার মতো দাদাগিরি করবে না তো? আমাদের দখল করবে না তো? তার কিছু কিছু ইন্ধন—আপনারা জানেন—ভারত যে সম্পূর্ণ বৈষ্ণব হয়ে ছিল তা নয়, ভারতের তরফ থেকে যারা দু-একটা বদমায়েশি কাজ করেছে, সেসব বাংলাদেশের কাছে প্রবল হয়ে ধরা দিল। ১৯৭১ সালের ওই আবেগ যখন কমতে শুরু করল, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর ওখানকার রাজনৈতিক দলগুলো জনসাধারণকে সস্তা পথে পাওয়ার জন্য অ্যান্টি-ভারত আবহাওয়া তৈরি করল এবং সেটা তাদের ভোট অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়কও হলো। এ সময় থেকে আমরা দেখতে শুরু করলাম, বাংলা সাহিত্যে যা লেখালেখি হচ্ছে, খবরের কাগজে রিপোর্টিংয়ে যে বাংলায় লেখালেখি হচ্ছে, সেখানে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। এর একটা উদাহরণ হলো জিম্মা। এ ‘জিম্মা’ শব্দটা আগে ওপার-এপার, কোনো বাংলায়ই ব্যবহৃত হতো না। যেমন খাবারটা খেয়ে দারুণ ‘মজা’ লাগল। এ ‘মজা’ শব্দটা হলো রসে-বসে আনন্দে আছি। তা খাবারটা খেয়ে ‘মজা’ লাগবে কেন আমার? খাবারটা খেয়ে আমার দারুণ ভালো লাগবে, অথবা আমি খুব আনন্দ পেলাম খেয়ে। কিন্তু ‘মজা’ লাগা বলতে কোথাও যেন একটু কৌতুক মেশানো থাকে। এ ধরনের কিছু শব্দ তৈরি হতে লাগল। এসব সচেতনভাবে তৈরি হতে লাগল, যাতে পশ্চিম বাংলার ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষা আস্তে আস্তে একটু একটু করে আলাদা হতে থাকে। আবার, আমরা দেখতে পাই, ১৯৬০ বা ’৬৫ সাল অবধি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের আগ অবধি যেকোনো মুসলিম পরিবারে আরবি বা ফারসি নাম দেওয়া হতো। কিন্তু এর পর থেকে দেখা গেল তাদের নামের পাশে ব্র্যাকেট করে একটা ডাকনাম দেওয়া হলো। ১৯৪০-৫০ সালের দিকে কোনো মুসলমানের ডাকনামের তেমন প্রচলন ছিল না। ক্রমে এ ডাকনামই তার হাইলাইটস পেত বেশি, আসল নামটা আড়ালে থাকত। যেমন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। আমরা সবাই জানি ‘বন্যা’। এটা কিন্তু পাশাপাশি সচেতনভাবে বাঙালিত্ব ধরে রাখার প্রচেষ্টা। এর পরবর্তী প্রজন্ম, সত্তরের দশক থেকে যে প্রজন্ম শুরু হলো—তারা আরও অদ্ভুত হলো। তাদের আবার নাম হয়তো আবুল হায়াত, মেয়ের নাম বিপাশা হায়াত বা সুবর্ণা মুস্তাফা। হায়াত বা মুস্তাফা তার পারিবারিক পদবি কিন্তু নামটা বাংলা শব্দ। অর্থাৎ আগে যেটা ব্র্যাকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেটা এখন নামের সাইনবোর্ডে এসে প্রকাশ হলো। পাশাপাশি আরও একটা অদ্ভুত ছবি আছে; ছবিটা হলো—চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মানুষ, ধরুন একজন মা; তার ছেলে হয়তো ঢাকায় চাকরি করে। তিনি যখন তার ছেলেকে চিঠি লিখছেন, তখন চট্টগ্রামের ভাষায় লিখছেন না। তিনি বইয়ের ভাষায় চিঠি লিখছেন এবং ছেলেও তা-ই করছে। কিন্তু ছেলে আর মায়ের যখন পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয়, তখন কিন্তু তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলেন, যা ঢাকার লোক বুঝবে না। তা হলে চিঠিতে কেন বাংলা বর্ণমালায় চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার করছে না? এ নিয়ে আমার নিজস্ব অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু এ বাঙালিত্ব বজায় রাখার জন্য একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি, একবার এক অনুষ্ঠানে একজন লোকের সঙ্গে—তাকে বাংলাদেশের মনে হওয়ায়—কথা বলতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বাংলাদেশের? কোন জেলায় বাড়ি?’ তিন-চারবার প্রশ্ন করার পরও কোনো উত্তর পেলাম না। লোকজন অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার, তুমিও বাঙালি, সে-ও বাঙালি অথচ একে অন্যের ভাষা বুঝতে পারছ না?’ আসলে সে সিলেটের বাঙালি। সে আমাদের ভাষা ভালোভাবে জানে না এবং নিজে যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষা আমাদের কাছে অজানা, তাই কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে। এই যে এত পার্থক্য—এসব পার্থক্যের সুযোগ নিয়েছে—আমার মনে হয়, কিছু ধর্মান্ধ মৌলবাদী, যাতে বাংলা ভাষাকে ভাঙা যায়, নষ্ট করা যায়। একটা নতুন ভাষা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধরুন, যদি মসজিদে যান, মসজিদে যে প্রার্থনা হয় তা বাংলায়। যেখানে একদম পরিষ্কারভাবে, ‘হে পরম পিতা!’—এভাবে শুরু করে।...‘আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি; আমাদের প্রিয়জন তোমার কাছে গিয়েছে, বাসা থেকে কেউ যদি বিদেশে যায়, তবে তার চিঠিপত্তর, টেলিফোনে খবর পাওয়া যায়। তিনি আজ যেখানে গেছেন, সেখানে এসব কোনো পথ নেই; কিন্তু আমরা জানি, তিনি তোমার কাছে গেছেন। অতএব, তুমি তাকে ভালো রাখবে...। আমিন!’ এ কথাগুলো অতি পরিষ্কার সিম্পল বাংলা কথা, এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না; অশিক্ষিত লোকও স্পষ্ট বুঝতে পারছে; কিন্তু ‘আমিন’ শব্দটা উচ্চারণ হওয়ামাত্র একটা অন্যরকম গন্ধ এল। আমিন কথাটা খ্রিষ্টানরা বলে। খ্রিষ্টানরা ‘পরম পিতা’ও বলে। কোরআনকে তো পৃথিবীর সব দেশের সব মুসলমান যথাযথ অনুসরণ করে না। আজকের পৃথিবীর সব মুসলমানের...বাংলাদেশের মুসলমানদের আইডিয়াল হচ্ছে ‘আরবি’ এবং আরবের লোকজন। অথচ আরবরা যে বুর্জোয়া জীবনযাপন করেন—মেয়েদের ক্ষেত্রে পার্টিকুলারলি—সেটা মানতে পারেন না ঢাকার মুসলমানরা; কিন্তু এরপরও ওরা আইডিয়াল। আজ যদি তুমি ঢাকা বা ফরিদপুরের রাস্তায় রোজার সময় যাও, তাহলে দেখবে, পর্দা টানিয়ে হোটেলে খাওয়াদাওয়া চলছে। অর্থাৎ পর্দা টানিয়ে দুপুরে খাওয়া যায়। আমার বন্ধুবান্ধব, যাঁরা আমার কাছে রোজার সময় আসছেন, তাঁরা প্রায়ই বলতেন, ভাই, আমি অসুস্থ, রোজা রাখতে পারছি না। কেউ বলতেন, আমি তো এখন পর্যটক! কারও হাঁটুতে ব্যথা, একটা অজুহাত, যেহেতু নামাজ পড়তে পারবে না...এসব অজুহাত বা ছুতো—এগুলো সবই কিন্তু বেরিয়ে আসার চেষ্টা। কিন্তু তারা ভয়ে থাকে, বেরিয়ে আসতে ভয় পায়। ফলে আমাদের সঙ্গে ওদের যে ডিফারেন্স, সেই ডিফারেন্সটা যথেষ্ট বড়। কারণ, আমরা যারা জন্মসূত্রে হিন্দু, তাদের ৮০ ভাগ হিন্দুধর্মের এ-বি-সি-ও পালন করি না। অথচ আমরা হিন্দু। বলতে হয়, তাই হিন্দু। আমাদের ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়ার মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মাচরণ নেই। দুর্গাপূজা এলে আমরা প্ল্যান করি কোথায় বেড়াতে যাব। পুজোর আচার-আচরণের মধ্যে আমরা নেই। আমরা নানা খাবার দিয়ে, বিস্কুট, চাল-ডাল, চকলেট দিয়ে মূর্তি গড়ি, ছেলেখেলার মতো। কালীপূজার সময় আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখি, পটকাবাজির ভয়ে। তাহলে আমরা হিন্দু হলাম কোথায়? আমরা ধর্ম থেকে সরে গেছি আস্তে আস্তে। তবে এ ধর্ম আমাদের কিছু দেয় না, আমাদের থেকে কিছু নেয়ও না। যখন রামকে নিয়ে সারা ভারতে এত হইচই কাণ্ড চলত, তখন আমরা পশ্চিম বাংলার মানুষজন রামকে একবারও দেবতা বলে মনে করি না। আমরা হনুমানকে দেখে ঠাট্টা করি, ‘কলা খাবি’ বলে। কিন্তু হনুমান ওদের কাছে ঈশ্বরের অবতার। ঘটনা যখন এ রকম ঘটে যায়, তখন বাংলাদেশের মুসলমান যারা; যারা সত্যিকার অর্থে কোরআন মানে, ধর্মান্ধ নয়, তারা কিন্তু আমাদের থেকে অনেক ডিসিপ্লিনড। ধর্ম ডিসিপ্লিন তৈরি করতে সাহায্য করে। ধর্ম একত্র করে মানুষকে। কিন্তু সেই একত্র করার মাঝখানে ধর্মান্ধ বা ধর্ম ব্যবসায়ীরা যত গণ্ডগোল পাকায়। ফলে আমাদের মধ্যে ক্রমেই পার্থক্য বাড়ছে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার কি মনে হয়, কয়েক দশক আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে রাজনীতিতে যে রকম মন্দির-মসজিদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, তাতে করে আগামী কয়েক দশক পর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রকম ধর্মরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে?
সমরেশ মজুমদার: আমার তো উল্টো মনে হয়। আমার মনে হয়, ধর্মান্ধ যারা—সে হিন্দু বা মুসলমান হোক, খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা কখনো শুনিনি। যদিও ক্রিশ্চিয়ানিটি পৃথিবীজুড়ে ছিল, কিন্তু আজ অবধি খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা শুনিনি, বৌদ্ধ ধর্মান্ধ শুনিনি।
তাপস কুমার দত্ত: ইউরোপে এককালে খ্রিষ্টানরাই ব্লাসফেমির মতো ঘৃণ্য আইন ধর্মের বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছিল—ওসব কি ধর্মান্ধতা নয়?
সমরেশ মজুমদার: খ্রিষ্টানরা এখন অনেক শ্রেণির হয়ে গেছে, সেখানে তারা একত্র নয়।
তাপস কুমার দত্ত: না, সেটা অন্য ব্যাপার, প্রশ্নটা হলো...
সমরেশ মজুমদার: আমাদের ভারতবর্ষেও তো হিন্দু ধর্ম একেক জায়গায় একেক রকম। আপনি সাউথ বা নর্থ ইন্ডিয়ায় বা অন্য প্রান্তে যে হিন্দু ধর্ম দেখবেন, তা পশ্চিম বাংলায় পাবেন না; এক জায়গার সঙ্গে অন্য জায়গায় ধর্মীয় অমিলই বেশি।
তাপস কুমার দত্ত: প্রশ্নটা তা নয়। একটা ধর্ম সম্প্রদায় নানা খণ্ডে বহু ধারায় বিভক্ত হতেই পারে। কিন্তু যেকোনো ধারারই একটা প্রচ্ছন্ন গোঁড়ামি আছে, মৌলবাদ আছে; আর সেটাই দিন দিন বিশ্বের ওপর বেশি পরিমাণে চেপে বসছে। আপনি কী মনে করেন?
সমরেশ মজুমদার: না, আমি এর সঙ্গে একমত নই। আমার তো মনে হয়, ধর্ম পৃথিবী থেকে আস্তে আস্তে লোপ পেতে চলেছে। এখন যে চিৎকারটা আমরা শুনতে পাচ্ছি—কারণ, ধর্মবাদীরা আতঙ্কগ্রস্ত বলে চিৎকার করছে।
তাপস কুমার দত্ত: প্রথাগত ধর্মে আপনার বিশ্বাস কতটুকু?
সমরেশ মজুমদার: আমি ধর্মে একদম বিশ্বাসী নই।
তাপস কুমার দত্ত: আর বিবাহ প্রথায়?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, বিবাহ প্রথায় বিশ্বাসী। তবে বিয়ে কীভাবে হবে, সেটা নির্ভর করছে যারা বিয়ে করছে, তাদের ওপর।
তাপস কুমার দত্ত: তৃতীয় বিশ্বে বসবাস করার একটা মানসিক যন্ত্রণা আছে। বিশেষ করে, শিল্পী-সাহিত্যিক...যেকোনো সৃজনশীল মানুষের। আপনি তা কতটা অনুভব করেন?
সমরেশ মজুমদার: এটা ভারতবর্ষে, মানে পশ্চিম বাংলায় নেই, আমি কখনো অনুভব করিনি। এটা গুজরাটে থাকতে পারে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার লেখালেখিতে বা ভাবনায় কখনো সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনো প্রতিবন্ধকতা আসেনি বলছেন?
সমরেশ মজুমদার: সিপিএম যখন ক্ষমতায় এল, তখন আমি নকশাল আন্দোলন নিয়ে উপন্যাস লিখলাম—কালবেলা। তো কালবেলার নায়ক অনিমেষ তখন কিন্তু সিপিএমের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। বলেছে, সিপিএম ভ্রষ্টাচারী। আমাকে কিন্তু ও রকমভাবে কোনো সরকার বা শক্তি আপত্তি করেনি।
তাপস কুমার দত্ত: নিজের বিচারে আপনার প্রিয় লেখা কোনটি?
সমরেশ মজুমদার: তিনটি লেখা আমার খুব প্রিয়। সেটা হচ্ছে—‘উত্তরাধিকার’...
তাপস কুমার দত্ত: এ সিরিজটা? অর্থাৎ ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’?
সমরেশ মজুমদার: না, ‘কালবেলা’ আমার প্রিয় নয়। ‘এখনও সময় আছে’ বলে আমার একটা উপন্যাস আছে, আমার ভীষণ প্রিয়। আর গত বছর আমি ‘দেশ’-এ একটা উপন্যাস লিখেছি—‘উৎসারিত আলো’—এ তিনটি।
তাপস কুমার দত্ত: লেখালেখিতে কতটা অসন্তুষ্টি বা অতৃপ্তি রয়ে গেছে?
সমরেশ মজুমদার: প্রতিটি লেখায়ই আমার অসন্তুষ্টি রয়ে যায়। আমার মনে হয়, আবার লিখলে ভালো করতাম। কিন্তু একবার বই আকারে...।

তাপস কুমার দত্ত: সেটা ওই বইটার নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর। আমার জিজ্ঞাসা হলো, এমন কোনো প্রিয় লেখা কি আপনার ভেতরে লালিত আছে, যা এখনো আপনি লিখে উঠতে পারেননি?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এই যে আপনাকে এর আগে যে কথাগুলো বললাম। আমি হুমায়ূন (আহমেদ)-কে বারবার বলেছিলাম, দ্যাখো, তুমি এত জনপ্রিয় একজন লেখক, তোমার এত হাজার হাজার বই বিক্রি হয়, তোমার তো এখন হারানোর কোনো ভয় নেই। তা তুমি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ২০০৪ সালের এই সময়কাল পর্যন্ত কয়েকটা খণ্ডে লেখো না, উপন্যাস আকারে। সে বলল, আমার লিখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সাহস পাই না। আমি অ্যাকসিডেন্টলি আপনাদের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিচিত ছিলাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আমার কাছে এরশাদ খুব কালারফুল চরিত্র। ঘৃণ্য, কিন্তু কালারফুল। কেউ ওর সঙ্গে দেখা করার সাহস পায়নি, যেতে চায়নি; আমি গিয়েছিলাম ওর আমন্ত্রণে। আমার বিপুল অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এটা নিয়ে তিনটি পর্বে ভাগ করে লিখতে আমার খুব ইচ্ছা হয়। ১৯৪৭ থেকে ’৬৯, শেখ মুজিবুর যখন স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, সেই অবধি। এরপর ১৯৬৯ থেকে ’৭১ এবং ’৭১ থেকে এখন অবধি। এ তিনটি পর্বে বাংলাদেশের পটভূমিতে যদি পারি, তো কখনো লিখব। আমি জানি, এ লেখা এই সরকার থাকলে ওখানে যাবে না।...এই যে দ্যাখো, ‘এত রক্ত কেন’ বইটা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে; ঢাকার ফুটপাতে কিন্তু বইটা পাওয়া যায়। তো ব্যান্ড করে লাভটা কী হলো?
তাপস কুমার দত্ত: এ বইটার জন্য বাংলাদেশের একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে ও-দেশে যাওয়ার ভিসা আপনাকে আটকে দেওয়া হয়। এখন যদি এ জাতীয় সমস্যা না থাকে, তা হলেও কি বাংলাদেশে যেতে কোনো আপত্তি থাকবে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি জানি, এ সরকার যদি এটা তুলেও দেয়, তবু সরকারের যারা অনুচর, তারা আমাকে আক্রমণ করবে।
তাপস কুমার দত্ত: অর্থাৎ আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন?
সমরেশ মজুমদার: অফ কোর্স। আমি শেষবার যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, তখন এত রক্ত কেন বেরিয়েছে, কিন্তু ব্যান হয়নি; সেদিন ঢাকায় এয়ারপোর্টে নেমেই বেশ সমস্যায় পড়েছিলাম। আমাকে নিয়ে অফিসাররা হঠাৎ তটস্থ হয়ে উঠলেন, কেন আমি এসেছি? কী উদ্দেশ্যে এসেছি? তো, আমাকে রিসিভ করতে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদ। আমাকে নিয়ে সে সোজা চলে গেল নুহাশ পল্লীতে। ওখানে তিন রাত ছিলাম। এরপর রাতের অন্ধকারে ঢাকায় এলাম।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অন্য কোনো ভয় পাচ্ছিলেন?
সমরেশ মজুমদার: পুলিশ বোধ হয় ভাবছিল, আমাকে অ্যারেস্ট করা উচিত কি উচিত না। একদিন একটা অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে সেখান থেকে সোজা এয়ারপোর্টে। এরপর আমি যখন অনুষ্ঠানে যাওয়ার পরবর্তী আমন্ত্রণ পেলাম, তখন তারা আমাকে ভিসা দিল না।
তাপস কুমার দত্ত: এখন আপনি কী ধরনের বই পড়ছেন?
সমরেশ মজুমদার: কয়েক দিন আগে ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ হুমায়ুন আজাদের বইটা সকাল থেকে পড়তে শুরু করেছিলাম। সেদিনই সকাল ৯টায়—বইটা পড়ছি, হাতে; খবর এল হুমায়ুন আজাদ মারা গেছেন। ওই বইটাতেই একটা জায়গায় লেখা ছিল, যেকোনো দিন তার মৃত্যু হতে পারে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। এ বইটা খুব বড় বা দামি লেখা নয়। খুব আবেগের লেখা, একই কথা বারবার লেখা; কিন্তু কথাগুলো লিখতে সাহস পায়নি তেমন কেউ।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি কি তাঁর আর কোনো উপন্যাস পড়েছেন?
সমরেশ মজুমদার: একটা পড়েছিলাম অনেক আগে, নামটা ভুলে গেছি। দাঁড়াও, নামটা মনে করি...
তাপস কুমার দত্ত: ‘শুভব্রত’, তার সম্পর্কিত সুসমাচার?
সমরেশ মজুমদার: না, আর কয়েকটা নাম বলো তো।
তাপস কুমার দত্ত: ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, সবকিছু ভেঙে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, হ্যাঁ, ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, বইগুলো বেশির ভাগ সময়ই কলকাতায় সহজে পাওয়া যায় না।
তাপস কুমার দত্ত: বয়স তো যথেষ্ট হলো। একদিন চলে যেতে হবে, তার দিনক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে...কোনো আতঙ্ক বা আক্ষেপ?
সমরেশ মজুমদার: না, না। আজ রাতেও চলে যেতে পারি; আবার হয়তো দশ বা কুড়ি বছর পরও যেতে পারি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অবশ্যই দীর্ঘায়ু হবেন, আমি এর দার্শনিক দিকটা জানতে চাচ্ছি।
সমরেশ মজুমদার: আমি খুব বাস্তববাদী মানুষ। আমি আজকে লেখালেখি করে যেটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি, সেটুকু আমার পাওয়ার কথা ছিল না। আমার লেখক হওয়ারই কথা ছিল না।
তাপস কুমার দত্ত: অনেক বছর আগে বাংলাদেশের একটা সাপ্তাহিক কাগজে আপনি বলেছিলেন, এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেবেন।
সমরেশ মজুমদার: ওসব কথা বাড়িয়ে লিখতে ভালোবাসে কিছু সাংবাদিক। যেমন অন্য একটা জায়গায় আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তসলিমার ‘ক’ পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে? আমি এর উত্তরে বলেছিলাম, আমি ‘ক’ পড়েছি এবং আমার মনে হয়েছে, একটা বারবনিতাকে যদি বলা হয়, তোমার আত্মজীবনী লেখ, সে তার অনেক কষ্টের কথা লিখবে; কিন্তু যেসব ক্লায়েন্ট তার কাছে আসে, তাদের বিস্তৃত পরিচয় দেবে না সে, এটুকু সৌজন্য দেখাবে। এ উত্তরটা তারা এভাবে লিখেছে যে, সমরেশ মজুমদার বলেছেন, তসলিমা নাসরিন বেশ্যা। এর উত্তরে তসলিমা লিখলেন আনন্দবাজারে, সমরেশ মজুমদারের গলায় গলা মিলিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, তসলিমা বেশ্যা। এর উত্তরে আমি আবার চিঠি লিখলাম আনন্দবাজারে—কোথায়, কখন বলেছি? কাকে বলেছি? যদি দয়া করে আমাকে জানানো হয়...। অতএব, যদি কোথাও কখনো লেখা হয়ে থাকে, আমি বলেছি এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেব—এগুলো বাজে কথা। হয়তো এভাবে বলেছি, লিখে টাকা পাওয়া যায়, জানতাম না। যখন লিখে টাকা পেতে শুরু করলাম, তখন আমাকে যদি বলা হয়, কেন লেখেন? আমি বলি, টাকার জন্য লিখি।
তাপস কুমার দত্ত: কথাটা এভাবে বলেছিলেন, একজন কৃষক যে কারণে চাষাবাদ করেন, একজন...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম, একজন কৃষক যখন চাষাবাদ করেন, তিনি তো দেশ গড়ার জন্য চাষ করেন না; তিনি তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য চাষাবাদ করেন। একজন মাস্টার যখন পড়ান, তখন মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার চেয়ে তার সন্তানসন্ততিকে বড় করার জন্য পড়ান। তো, একজন লেখকের কী দায় আছে, তিনি দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন? আমাদের দেশে কোনো লেখক যদি জনপ্রিয় হন, তখন ধরেই নেওয়া হয়, ওগুলো ভুসিমাল। যদি সে ধরনের লেখক জনপ্রিয়তা না পান বা বিক্রি না হয়, তখন তিনি একজন বিরাট লেখক। প্রশ্ন হলো, জনপ্রিয়তা যদি কেউ বেশি পান, কেন পান? কারণ, পাঠকদের ভালো লাগছে বলেই। কোনো একটা বই হয়তো বেশি পাঠকের ভালো লেগেছে। এমন নয় যে বছরের পর বছর তিনি জনপ্রিয় হয়ে থাকেন। তা হলে যিনি পাঠককে সহজে স্পর্শ করতে পারছেন না, তার কোথাও খুঁত আছে নিশ্চয়ই। ভালো একটা ছবি তিন দিন সিনেমা হলে থেকে চলে গেল। আর একটা ছবি ‘বাবা কেন চাকর’ মাসের পর মাস চলল, জনপ্রিয় হলো। আবার ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর যখন হাজারটা শো চলে, তখন বলতেই হয়, গুপী গাইন বাঘা বাইন খারাপ ছবি? চার্লি চ্যাপলিন তা হলে খারাপ ছবির নাম? ‘পথের পাঁচালী’ও ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল—ওটাও তা হলে খারাপ ছবি?

তাপস কুমার দত্ত: ধরুন, হাইপোথেটিক্যালি আমরা ধরে নিলাম, কোনো ধনকুবের আপনার যাবতীয় চাহিদার স্পন্সরশিপের দায়িত্ব নিল। একজন কৃষক যে কারণে কৃষিকাজ করেন বা আর দশজন পেশাজীবী মানুষ যে কারণে পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, সেই প্রয়োজনটা আপনার আর রইল না। তখন কি লেখালেখি আপনি ছেড়ে দেবেন?
সমরেশ মজুমদার: চাহিদার কিন্তু শেষ নেই। আগে বাস-ট্রামে চড়তাম, আমার এখন বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। এখনো অবশ্য ইচ্ছা করে মাঝেমধ্যে বাস-ট্রামে উঠি। তো, আগে আমি জলপাইগুড়ি আমার বাড়ি যেতাম সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে, রিজারভেশন ছাড়া। এরপর রিজারভেশনে। এরপর এসি থ্রি-টিয়ার, এরপর এসি টু-টিয়ার। এর মানে এই নয়, আমি এখন এসি টু-টিয়ার ছাড়া যেতে পারব না। কিন্তু যদি কমফোর্ট পাই, তা আমি নেব না কেন?
তাপস কুমার দত্ত: আমি বলতে চাচ্ছি, শুধু ভরণপোষণ আর কমফোর্ট—এসব কারণেই লেখালেখি? ভোগবাদী ব্যাপার ছাড়া তা কি নিজের ভেতর থেকে উঠে আসে না?
সমরেশ মজুমদার: শুনুন, আমাকে যদি এক কোটি টাকা দেওয়া হয় একটা উপন্যাস লেখার জন্য—সাত দিন চেষ্টা করেও লিখে উঠতে পারব না। আবার, আমাকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি, আমি লিখতে বসলাম, হয়তো দুদিনেই লেখাটা শেষ করে ফেলতে পারব।
তাপস কুমার দত্ত: তা হলে লেখালেখিটা শুধু হালচাষির হালচাষের মতো জীবিকা নির্বাহ নয়, আলাদা একটা ভেতরের তাগিদও...
সমরেশ মজুমদার: অবশ্যই।
তাপস কুমার দত্ত: বেশির ভাগ জনপ্রিয় লেখকের লেখায় দেখা যায়, কতগুলো পাগলামোর ঘটনা, কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনা, কিছু সুখকর ঘটনা ও একটু বেদনাদায়ক ঘটনা। যেন ছাঁচে ঢেলে গরম তেলে ভেজে তোলা হট কেক...
সমরেশ মজুমদার: এটা আমার কাছে খুব অস্পষ্ট। ধরুন, আমার একটা বই, ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে এক লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। সেই বইটা কলকাতায় ৫০-৬০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। ধরে নিতে পারি, বইটা জনপ্রিয়।
তাপস কুমার দত্ত: বইটার নাম কী?
সমরেশ মজুমদার: ‘গর্ভধারিণী’। তা ওটা কোন ফর্মুলায় লেখা, বলুন তো?
তাপস কুমার দত্ত: ওই বইটাতে আসলে এমন একটা সাসপেন্স বা থ্রিল এবং এর সঙ্গে আবেগ, বর্তমান সমাজব্যবস্থার কিছু মানুষের অমানবিক নোংরা দিকের প্রতি...।
সমরেশ মজুমদার: এসব তো অনেক বইতেই আছে।
তাপস কুমার দত্ত: হ্যাঁ, তা ঠিক, ‘মেঘ ছিল, ‘বৃষ্টিও’-তেও আছে। ‘আট কুঠুরী নয় দরজা’তেও।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে সেগুলো ওভাবে বিক্রি হয়নি কেন?
তাপস কুমার দত্ত: না, আমি বলছি ‘গর্ভধারিণী’র মতো বিশাল জনপ্রিয়তা না পেলেও ওই লেখাগুলোও বেশ জনপ্রিয়।
সমরেশ মজুমদার: যদি জানতাম, গর্ভধারিণীর মতো ওভাবে সাসপেন্স মেশালে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হবে, তা হলে তো সব বই ওভাবেই লেখা হতো। তা হলে ‘সাতকাহন’ কেন এত বিক্রি হলো? স্ট্রাগল করা মেয়েদের গল্প তো আমি আগেও লিখেছি, পরেও লিখেছি, সেগুলো কেন সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হলো না? আমি যদি আরেকটা দীপাবলীকে নিয়ে লিখি, সেটা কি সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হবেই?
তাপস কুমার দত্ত: সাতকাহনের দ্বিতীয় পর্ব কিন্তু প্রথম পর্বের মতো অত জনপ্রিয় নয়।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে? আসলে আমার কাছে মনে হয়, যেকোনো...আমি আপনাকে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখাটার কথা বললাম, ‘এখনো সময় আছে’ বইটা তিন থেকে চার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। লোকে না পড়লে আমার কষ্ট হয়, আমি তো লোকে লোকে গিয়ে বলতে পারি না, আপনি বইটা পড়ুন। কোত্থেকে ‘কালবেলা’ এক লাখ কপি বিক্রি হলো! ‘উত্তরাধিকার’ বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার। অথচ উত্তরাধিকার ওটার চেয়ে অনেক বেটার উপন্যাস। তাই কোন লেখাটা জনপ্রিয় হবে, তা আগে থেকে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। একটা লেখা জনপ্রিয় হতে পারে। একটা মেমসাহেব, একটা দৃষ্টিপাত, একটা মরুতীর্থ হিংলাজ জনপ্রিয় হতে পারে। কয়েকটা নয়।
তাপস কুমার দত্ত: ওপারের লেখকদের লেখা সম্পর্কে...
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, ওপারের এক নম্বরের সঙ্গে দুই নম্বরের ব্যবধান এত বিস্তর...জাফর ইকবাল সম্প্রতি সেই ব্যবধান একটু কমিয়ে এনেছেন। তো, গতবার যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, তখন একজন লেখক আমাকে এসে বললেন, সমরেশ দা, আপনাকে একটা ভালো খবর দিই।
আমি বললাম, কী?
বলল, আমি এখন তিন নম্বরে।
আমি জানতে চাইলাম, কিসের তিন নম্বর? সে জানাল, জনপ্রিয়তার। তার পেছনে নাকি মিলন চলে গেছে, অমুক-তমুক অনেকে চলে গেছে। আমি হাসব না কাঁদব, ভেবে পাচ্ছিলাম না।
তাপস কুমার দত্ত: কে?
সমরেশ মজুমদার: নামটা নাই-বা বললাম।
তাপস কুমার দত্ত: বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের রুচিবোধ আপনার কতটা উঁচুদরের বলে মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: আপনি যা ইচ্ছা তা-ই লিখে পাঠকদের ভোলাতে পারবেন না। পাঠকদের বিচারশক্তি দারুণ প্রখর। একটা লেখা দিয়ে ভোলাতে পারবেন, পরের দুটোয় হাফ ভোলাতে পারবেন; তৃতীয়টায় আর পারবেন না।
তাপস কুমার দত্ত: পাঠকেরা আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমাকে তেমন প্রভাবিত করতে পারে না। তবে কিছু কিছু ঘটনায় মাঝেমধ্যে কষ্ট হয়। একবার বইমেলায় এক ভদ্রমহিলা তিনখানা (বড় ক্যানভাসের) বই বইতে পারছিলেন না, চেহারা দেখে বোঝা যায়, যথেষ্ট (আর্থিক) অসচ্ছল পরিবার। আমি বললাম, আপনি কী করেন?
তিনি বললেন, আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়াই।
আমার খুব খারাপ লাগল, আপনি এত দামি তিনটি বই কিনলেন?
তিনি বললেন, সারা বছর আমরা অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছি।
এরপর দেখলাম, দূরে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। ক্রাচ হাতে, একটা পা ডিফেক্টেড। ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে যেতেই তিনি বললেন, আমি আপনার অনিমেষ।
আমি বললাম, তার মানে?
তিনি জানালেন, তিনি নকশাল আন্দোলন করতেন এবং হাওড়া জেলে পুলিশের অত্যাচারে একটা পা নষ্ট হয়ে (অনিমেষের মতোই) গেছে। আমরা একসঙ্গে থাকি। (অনিমেষ-মাধবীলতার মতো), আমরা বিয়ে করিনি।
আরেকটা ঘটনা বলে শেষ করি—হ্যাঁ, একবার বিদেশে রাতে আমার খুব খিদে পেয়েছে, একটা বড় রেস্টুরেন্ট দেখে ভেতরে ঢুকে পড়ি। এরপর মেনু কার্ডের সবচেয়ে ছোট আইটেম যেটা, সেটার অর্ডার দিলাম। বেয়ারাগুলোকে দেখে মনে হলো এশিয়ান। তো, একটা বেয়ারা এসে বলল, স্যার! আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?
আমি বললাম, ইয়েস।
স্যার! আর ইউ ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল?
আমি আবার বললাম, ইয়েস।
বেয়ারা গিয়ে হোটেল মালিককে তথ্যগুলো জানাতেই হোটেল মালিক উঠে এসে বললেন, নমস্কার স্যার! আপনি বোধ হয় সমরেশ বাবু। আমি আপনার একটাই মাত্র বই পড়েছি। একবার একটা বাস টার্মিনালে দেখলাম একটা বই পড়ে আছে—বাংলা বই, নামটা ‘দৌড়’।
এরপর যতই বলছি, আমার খাওয়া হয়ে গেছে, তবু তিনি আমাকে জোর করে খাওয়াবেন। বিল দিতে গেলাম, বিল নিলেন না। এই অবধি ঠিক আছে। বেয়ারা এরপর বলল, সাহেব, একবার ভেতরে আসবেন? আপায় কইছিল, আপনি সমরেশ মজুমদার কি না জিজ্ঞেস করতে। তো, আমি ভেতরে ঢুকলাম। একজন ভদ্রমহিলা খাটের ওপর বসে নমস্কার জানিয়ে আমার দিকে একটা বই এগিয়ে দিলেন—‘গর্ভধারিণী’। আমার পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। দেখুন, কারোর জানার কথা নয়, আমি ওখানে যাব। কাকতালীয়ভাবে।
তাপস কুমার দত্ত: একবার কবি সম্মেলনে আপনাকে দেশের বাইরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল—কবি হিসেবে, ভুল করে। ঠিক এ রকমই একটা ঘটনার কথা...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আপনি সবই জানেন দেখছি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি বই বাজেয়াপ্ত করাটা কতটা সমর্থন করেন?
সমরেশ মজুমদার: যে কারণে তসলিমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, সেটাকে আমি সমর্থন করি না। তবে আমার হাতে আইন থাকলে তসলিমাকে অভিযুক্ত করতাম। আজ একটা ছেলের সঙ্গে একটা মেয়ের ভালো সম্পর্ক; সম্পর্কটা দুজনকেই আনন্দিত করছে। যদি ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো তিক্ততা আসে, আজকের এ আনন্দটা কিন্তু মিথ্যা হয়ে যাবে না এবং সেই ছেলেটা ও মেয়েটার কোনো রাইট নেই ভবিষ্যতে এই আনন্দিত সম্পর্ককে নিয়ে খোলামেলা...ব্যঙ্গ করে লেখা বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে লেখা। যে ক্ষেত্রে তারা একে অন্যকে ছোট ও অপমান করছে। মিলনের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গিয়ে কী হয়েছে বা অমুকের সঙ্গে অমুকের আর কী হয়েছে—এর ডিটেইলস নিয়ে আমরা আদৌ আগ্রহী নই। আমরা তসলিমার ব্যাপারে এখানেই আগ্রহী যে সে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কী লড়াই করেছিল। তা না করে তার শারীরিক আনন্দের বিবরণ দিয়ে লিখছে—এটা এক ধরনের অসুখ। আমি জানি, আমার বাবা-মায়ের মিলনের ফলে আমি পৃথিবীতে এসেছি; এখন সেই মিলনটা কী রকম ছিল, তার বিবরণ দিয়ে যদি লিখতে যাই, তো আমার জন্মটাকেই আমি সবচেয়ে বেশি কুৎসিত করছি। আমার জন্মের বিবরণের জন্য আমার বাবা-মায়ের শয্যা বিবরণ কি আমি দিতে পারি? নাকি তা আমি ভাবতে চাই? বা ভাবতে পারি?
তাপস কুমার দত্ত: আপনি আপনার খোলামেলা বা বিতর্কিত ভাবনা প্রকাশ করতে কতটা ভয় পান?
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, এ মুহূর্তে বোধ হয় আমিই সবচেয়ে সরাসরি লিখি। ‘পত্রপাঠ’ বলে একটা পত্রিকা আছে, মাসে বেরোয়—সেটায় আমি কলাম লিখি। সেখানে সরাসরি সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে লিখি। একজন কলেজ অধ্যাপককে পুলিশ অ্যারেস্ট করে—জনযুদ্ধগোষ্ঠীর ডায়েরি থেকে নাম পেয়ে তাকে অ্যারেস্ট করে। সারা দিন অত্যাচার করে সন্ধ্যায় তাকে ছেড়ে দেয়। এলাকার লোকজন মনে করে, সে জনযুদ্ধগোষ্ঠীর লোক। সে রেললাইনে আত্মহত্যা করে, তার স্ত্রী এ নিয়ে কেস করে। এ ঘটনা নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। আমি এ-ও লিখেছিলাম, কয়েক দিন আগে ভোটের সময় একজন সাংবাদিক একটা গ্রামে গেছেন। সেখানে এক চায়ের দোকানে নানা আলোচনায় উঠে আসে, আমাদের দেশে যত মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই অবিবাহিত। বিবাহিত ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়, জ্যোতিবাবু। সিদ্ধার্থবাবু, জ্যোতিবাবু কখনো বাজারে যাননি। বুদ্ধবাবু রিকশায় চাপেন, বাজারে যান। আর নামটা দেখুন, বুদ্ধদেব।...বিধানচন্দ্র, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থ হচ্ছে সংসারী নাম।...এ রকম নাম যার, তাকে আমরা ভোট দেব না, তো অন্য লোককে ভোট দেব? সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কেমন আছেন? ওরা বলল, এই যে রাস্তাটা দেখছেন, এর নাম সুচেতনা (‘সুচেতনা’ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মেয়ের নাম)। আমাদের এখানে একটা ভাটিখানা আছে, খুব মারপিট চলত আগে, মদ খেতে খেতে। আমরা সেটার নাম দিয়েছি সুচেতনা...বাংলা বারের প্রতিশব্দ আর কি। ওখানে মদ খেয়ে এখন আর কেউ চেতনা হারাচ্ছে না। ফলে বুঝতেই পারছেন, আমরা সবই বুদ্ধবাবুর লোক। এ গল্পটা বের হওয়ার পর বুদ্ধবাবু আমায় বললেন, আমাকে নিয়ে লিখলেন, ঠিক আছে; আমার মেয়েকে জড়ালেন কেন? আমি বললাম, ‘হাওড়ার একটা লাইব্রেরি উদ্বোধন করতে তোমার মেয়ে আর তোমার স্ত্রী গিয়েছিলেন, লাইব্রেরিটার নাম রাখা হয়েছে সুচেতনা পাঠাগার। তোমার মেয়ে এখনই এমন কী যোগ্যতা অর্জন করেছে যে তার নামে একটা পাঠাগার রাখা হবে? যেহেতু সে তোমার মেয়ে, তাই রাখা হয়েছে।’ এখন, আপনি কী মনে করেন না, এর চেয়ে সরাসরি আক্রমণ করে লেখা—আর বড়াই করে বলি, আমাদের কোনো লেখকই লিখছেন না। লিখতে পারেন, কিন্তু লিখছেন না।
তাপস কুমার দত্ত: এত সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সমরেশ মজুমদার: থ্যাঙ্ক ইউ।

উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দত্ত। এই লেখক সদ্য গত হয়েছেন। আর তাই সাক্ষাৎকারগ্রহীতা ও বন্ধ সাপ্তাহিকটির তখনকার নির্বাহী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকারের সম্মতিক্রমে আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।
তাপস কুমার দত্ত: ওপার বাংলার বাঙালিদের সঙ্গে এপার বাংলার বাঙালিদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যে পার্থক্য, সেটা যত দিন যাচ্ছে ততই কি দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: দুটো ঘটনা ঘটেছে এখানে, সেটা হচ্ছে—১৯৪৭ সালের আগে যে বাংলা, একত্র দুই বাংলা, যেখানের হিন্দু আর বাঙালিরা ছিল সম্পূর্ণ কলকাতামুখী। মুসলমান বাঙালিদের মধ্যে দুটো শ্রেণি ছিল—একটা শ্রেণি অত্যন্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ, শিক্ষিত লোক এবং বেশির ভাগই ছিল অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মুসলমান। এ অল্প ও অশিক্ষিত মুসলমানদের ওপর স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিরা ডমিনেট করল। ফলে যখন দেশ ভাগ হলো, তখন অল্পশিক্ষিত অশিক্ষিত মুসলমানেরা উল্লসিত হলো, কারণ, শিক্ষিত বাঙালিরা ভয় পেল, দু-একটা জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলো। আমি বাংলাদেশের অনেক জেলার কথা জানি, যেখানে আজ অবধি কোনো মানুষ খুন হয়নি দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে। যেমন ধরুন, রংপুর। সেখানে আজ অবধি কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত না ঘটা সত্ত্বেও রংপুর থেকে অনেক মানুষ চলে এসেছে ভারতবর্ষে। তখন এ রকম একটা প্রচারণা এসেছিল—পূর্ব পাকিস্তান মুসলমানদের জায়গা। অতএব, হিন্দুরা সেখানে থাকলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। তাই ছোটো ইন্ডিয়া। সেই ছোটার কাহিনিটা গত ৫৫ বছরের। সেই ছোটার কাহিনিতে অনেক মানুষ একেবারে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে তলিয়ে গেছে। আবার অনেক মানুষ সংগ্রাম করে করে ওপরে উঠেছে।...
তাপস কুমার দত্ত: এরপর থেকেও তো অনেক সংখ্যালঘু ওপারে চলে গেছে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এপার থেকেও গেছে, তবে তা আনুপাতিক হারে যথেষ্ট কম। যা বলছিলাম, এ ৫৫ বছরে যদি কেউ লাভবান হয়ে থাকে, আমি এপার বাংলার কথা বলছি—তা হলে হয়েছে পশ্চিম বাংলার মেয়েরা। এই যারা পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিল—সংগ্রাম করেছে, কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে, বস্তি বা কলোনিতে কোনোক্রমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে; তাদের দেখাদেখি পশ্চিম বাংলার কনজারভেটিভ পরিবার—যারা মেয়েদের অন্দরমহলে ফেলে রেখেছিল এবং অফিস-কাছারিতে যাওয়া তো স্বপ্নের বাইরে ছিল। যখন পূর্ববঙ্গের মেয়েরা জীবনসংগ্রামের বাধ্যবাধকতায় গ্র্যাজুয়েশন করে স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন অফিসে চাকরিতে ঢুকল; তখন এখানকার মেয়েরা উৎসাহিত হলো। আমরা যখন কলেজে পড়তাম; সন্ধ্যা ৬টার পর ট্রামে-বাসে কোনো মেয়েকে দেখা যেত না; যদি কোনো মেয়েকে দেখা যেত তা হলে সে নিশ্চয়ই বাঙাল (পূর্ববঙ্গীয়) হতো। কিন্তু এ পশ্চাৎপট একদম পাল্টে গেল ১৯৬৮ সালের পর থেকে। তখন বাস্তবিক নিষ্পেষণে পশ্চিম বাংলার মেয়েরাও বেরোতে শুরু করল, যেটা বলতে গিয়ে সরে এসেছি—সেটা হলো, এই দেশবিভাগ এবং এ দেশে উদ্বাস্তু স্রোত আসার অনেক খারাপ দিকের এই একটা ভালো দিক, আমাদের মেয়েরা অর্গল ভেঙে বেরোতে পেরেছিল। কিন্তু ওখানে (বাংলাদেশে) যারা রয়ে গেল (হিন্দু সম্প্রদায়) তাদেরও, আমরা দেখেছি, কেউ ১৯৬৭, কেউ ১৯৭০, কেউ ১৯৭৬-এ চলে আসতে লাগল।
তাপস কুমার দত্ত: এখনো কি অল্পবিস্তর চলে আসছে?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এখনো আসছে এবং এদের একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে এরা আওয়ামীপন্থী ছিল। অর্থাৎ এ দলটির কাছে ওরা নিরাপদ বোধ করত।
তাপস কুমার দত্ত: দেশভাগের পর ওপার বাংলার কী কী বিশেষ পরিবর্তন আপনার কাছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়েছে?
সমরেশ মজুমদার: ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এ ২৪ বছরে বাঙালির জীবনে পূর্ববঙ্গে একটা জিনিসেরই আমদানি ঘটেছে, সেটা হলো ইসলাম এবং ইসলামকেন্দ্রিক আরবি-ফারসি শব্দ। ওই সময় যাঁরা লেখালেখি করতেন, যেমন ধরুন—শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস—এঁরা যে বাংলা লিখতেন, তা ছিল পশ্চিম বাংলার বাংলা; অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারকৃত বাংলা। এঁরা বাংলার প্রাচীন সাহিত্য এবং রামায়ণ-মহাভারত ও আরও সব পৌরাণিক...প্রাচ্য ও পশ্চিমের সাহিত্যের ওপর ভালো দখল রাখতেন এবং সেটা তাঁদের ভেতরে লালন করতেন। ১৯৭১ সালের পর একটা আবেগ এল, আবেগের সঙ্গে ভয় এল। ভয়টা এই—আমরা এত দিন উনুনে পুড়ছিলাম, উনুন থেকে লাফিয়ে গরম তেলে পড়লাম না তো? অর্থাৎ আমরা পাকিস্তানের অত্যাচারে জর্জরিত হচ্ছিলাম, এখন ভারত বড়দাদার মতো দাদাগিরি করবে না তো? আমাদের দখল করবে না তো? তার কিছু কিছু ইন্ধন—আপনারা জানেন—ভারত যে সম্পূর্ণ বৈষ্ণব হয়ে ছিল তা নয়, ভারতের তরফ থেকে যারা দু-একটা বদমায়েশি কাজ করেছে, সেসব বাংলাদেশের কাছে প্রবল হয়ে ধরা দিল। ১৯৭১ সালের ওই আবেগ যখন কমতে শুরু করল, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর ওখানকার রাজনৈতিক দলগুলো জনসাধারণকে সস্তা পথে পাওয়ার জন্য অ্যান্টি-ভারত আবহাওয়া তৈরি করল এবং সেটা তাদের ভোট অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়কও হলো। এ সময় থেকে আমরা দেখতে শুরু করলাম, বাংলা সাহিত্যে যা লেখালেখি হচ্ছে, খবরের কাগজে রিপোর্টিংয়ে যে বাংলায় লেখালেখি হচ্ছে, সেখানে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। এর একটা উদাহরণ হলো জিম্মা। এ ‘জিম্মা’ শব্দটা আগে ওপার-এপার, কোনো বাংলায়ই ব্যবহৃত হতো না। যেমন খাবারটা খেয়ে দারুণ ‘মজা’ লাগল। এ ‘মজা’ শব্দটা হলো রসে-বসে আনন্দে আছি। তা খাবারটা খেয়ে ‘মজা’ লাগবে কেন আমার? খাবারটা খেয়ে আমার দারুণ ভালো লাগবে, অথবা আমি খুব আনন্দ পেলাম খেয়ে। কিন্তু ‘মজা’ লাগা বলতে কোথাও যেন একটু কৌতুক মেশানো থাকে। এ ধরনের কিছু শব্দ তৈরি হতে লাগল। এসব সচেতনভাবে তৈরি হতে লাগল, যাতে পশ্চিম বাংলার ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষা আস্তে আস্তে একটু একটু করে আলাদা হতে থাকে। আবার, আমরা দেখতে পাই, ১৯৬০ বা ’৬৫ সাল অবধি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের আগ অবধি যেকোনো মুসলিম পরিবারে আরবি বা ফারসি নাম দেওয়া হতো। কিন্তু এর পর থেকে দেখা গেল তাদের নামের পাশে ব্র্যাকেট করে একটা ডাকনাম দেওয়া হলো। ১৯৪০-৫০ সালের দিকে কোনো মুসলমানের ডাকনামের তেমন প্রচলন ছিল না। ক্রমে এ ডাকনামই তার হাইলাইটস পেত বেশি, আসল নামটা আড়ালে থাকত। যেমন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। আমরা সবাই জানি ‘বন্যা’। এটা কিন্তু পাশাপাশি সচেতনভাবে বাঙালিত্ব ধরে রাখার প্রচেষ্টা। এর পরবর্তী প্রজন্ম, সত্তরের দশক থেকে যে প্রজন্ম শুরু হলো—তারা আরও অদ্ভুত হলো। তাদের আবার নাম হয়তো আবুল হায়াত, মেয়ের নাম বিপাশা হায়াত বা সুবর্ণা মুস্তাফা। হায়াত বা মুস্তাফা তার পারিবারিক পদবি কিন্তু নামটা বাংলা শব্দ। অর্থাৎ আগে যেটা ব্র্যাকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেটা এখন নামের সাইনবোর্ডে এসে প্রকাশ হলো। পাশাপাশি আরও একটা অদ্ভুত ছবি আছে; ছবিটা হলো—চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মানুষ, ধরুন একজন মা; তার ছেলে হয়তো ঢাকায় চাকরি করে। তিনি যখন তার ছেলেকে চিঠি লিখছেন, তখন চট্টগ্রামের ভাষায় লিখছেন না। তিনি বইয়ের ভাষায় চিঠি লিখছেন এবং ছেলেও তা-ই করছে। কিন্তু ছেলে আর মায়ের যখন পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয়, তখন কিন্তু তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলেন, যা ঢাকার লোক বুঝবে না। তা হলে চিঠিতে কেন বাংলা বর্ণমালায় চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার করছে না? এ নিয়ে আমার নিজস্ব অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু এ বাঙালিত্ব বজায় রাখার জন্য একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি, একবার এক অনুষ্ঠানে একজন লোকের সঙ্গে—তাকে বাংলাদেশের মনে হওয়ায়—কথা বলতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বাংলাদেশের? কোন জেলায় বাড়ি?’ তিন-চারবার প্রশ্ন করার পরও কোনো উত্তর পেলাম না। লোকজন অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার, তুমিও বাঙালি, সে-ও বাঙালি অথচ একে অন্যের ভাষা বুঝতে পারছ না?’ আসলে সে সিলেটের বাঙালি। সে আমাদের ভাষা ভালোভাবে জানে না এবং নিজে যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষা আমাদের কাছে অজানা, তাই কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে। এই যে এত পার্থক্য—এসব পার্থক্যের সুযোগ নিয়েছে—আমার মনে হয়, কিছু ধর্মান্ধ মৌলবাদী, যাতে বাংলা ভাষাকে ভাঙা যায়, নষ্ট করা যায়। একটা নতুন ভাষা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধরুন, যদি মসজিদে যান, মসজিদে যে প্রার্থনা হয় তা বাংলায়। যেখানে একদম পরিষ্কারভাবে, ‘হে পরম পিতা!’—এভাবে শুরু করে।...‘আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি; আমাদের প্রিয়জন তোমার কাছে গিয়েছে, বাসা থেকে কেউ যদি বিদেশে যায়, তবে তার চিঠিপত্তর, টেলিফোনে খবর পাওয়া যায়। তিনি আজ যেখানে গেছেন, সেখানে এসব কোনো পথ নেই; কিন্তু আমরা জানি, তিনি তোমার কাছে গেছেন। অতএব, তুমি তাকে ভালো রাখবে...। আমিন!’ এ কথাগুলো অতি পরিষ্কার সিম্পল বাংলা কথা, এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না; অশিক্ষিত লোকও স্পষ্ট বুঝতে পারছে; কিন্তু ‘আমিন’ শব্দটা উচ্চারণ হওয়ামাত্র একটা অন্যরকম গন্ধ এল। আমিন কথাটা খ্রিষ্টানরা বলে। খ্রিষ্টানরা ‘পরম পিতা’ও বলে। কোরআনকে তো পৃথিবীর সব দেশের সব মুসলমান যথাযথ অনুসরণ করে না। আজকের পৃথিবীর সব মুসলমানের...বাংলাদেশের মুসলমানদের আইডিয়াল হচ্ছে ‘আরবি’ এবং আরবের লোকজন। অথচ আরবরা যে বুর্জোয়া জীবনযাপন করেন—মেয়েদের ক্ষেত্রে পার্টিকুলারলি—সেটা মানতে পারেন না ঢাকার মুসলমানরা; কিন্তু এরপরও ওরা আইডিয়াল। আজ যদি তুমি ঢাকা বা ফরিদপুরের রাস্তায় রোজার সময় যাও, তাহলে দেখবে, পর্দা টানিয়ে হোটেলে খাওয়াদাওয়া চলছে। অর্থাৎ পর্দা টানিয়ে দুপুরে খাওয়া যায়। আমার বন্ধুবান্ধব, যাঁরা আমার কাছে রোজার সময় আসছেন, তাঁরা প্রায়ই বলতেন, ভাই, আমি অসুস্থ, রোজা রাখতে পারছি না। কেউ বলতেন, আমি তো এখন পর্যটক! কারও হাঁটুতে ব্যথা, একটা অজুহাত, যেহেতু নামাজ পড়তে পারবে না...এসব অজুহাত বা ছুতো—এগুলো সবই কিন্তু বেরিয়ে আসার চেষ্টা। কিন্তু তারা ভয়ে থাকে, বেরিয়ে আসতে ভয় পায়। ফলে আমাদের সঙ্গে ওদের যে ডিফারেন্স, সেই ডিফারেন্সটা যথেষ্ট বড়। কারণ, আমরা যারা জন্মসূত্রে হিন্দু, তাদের ৮০ ভাগ হিন্দুধর্মের এ-বি-সি-ও পালন করি না। অথচ আমরা হিন্দু। বলতে হয়, তাই হিন্দু। আমাদের ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়ার মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মাচরণ নেই। দুর্গাপূজা এলে আমরা প্ল্যান করি কোথায় বেড়াতে যাব। পুজোর আচার-আচরণের মধ্যে আমরা নেই। আমরা নানা খাবার দিয়ে, বিস্কুট, চাল-ডাল, চকলেট দিয়ে মূর্তি গড়ি, ছেলেখেলার মতো। কালীপূজার সময় আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখি, পটকাবাজির ভয়ে। তাহলে আমরা হিন্দু হলাম কোথায়? আমরা ধর্ম থেকে সরে গেছি আস্তে আস্তে। তবে এ ধর্ম আমাদের কিছু দেয় না, আমাদের থেকে কিছু নেয়ও না। যখন রামকে নিয়ে সারা ভারতে এত হইচই কাণ্ড চলত, তখন আমরা পশ্চিম বাংলার মানুষজন রামকে একবারও দেবতা বলে মনে করি না। আমরা হনুমানকে দেখে ঠাট্টা করি, ‘কলা খাবি’ বলে। কিন্তু হনুমান ওদের কাছে ঈশ্বরের অবতার। ঘটনা যখন এ রকম ঘটে যায়, তখন বাংলাদেশের মুসলমান যারা; যারা সত্যিকার অর্থে কোরআন মানে, ধর্মান্ধ নয়, তারা কিন্তু আমাদের থেকে অনেক ডিসিপ্লিনড। ধর্ম ডিসিপ্লিন তৈরি করতে সাহায্য করে। ধর্ম একত্র করে মানুষকে। কিন্তু সেই একত্র করার মাঝখানে ধর্মান্ধ বা ধর্ম ব্যবসায়ীরা যত গণ্ডগোল পাকায়। ফলে আমাদের মধ্যে ক্রমেই পার্থক্য বাড়ছে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার কি মনে হয়, কয়েক দশক আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে রাজনীতিতে যে রকম মন্দির-মসজিদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, তাতে করে আগামী কয়েক দশক পর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রকম ধর্মরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে?
সমরেশ মজুমদার: আমার তো উল্টো মনে হয়। আমার মনে হয়, ধর্মান্ধ যারা—সে হিন্দু বা মুসলমান হোক, খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা কখনো শুনিনি। যদিও ক্রিশ্চিয়ানিটি পৃথিবীজুড়ে ছিল, কিন্তু আজ অবধি খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা শুনিনি, বৌদ্ধ ধর্মান্ধ শুনিনি।
তাপস কুমার দত্ত: ইউরোপে এককালে খ্রিষ্টানরাই ব্লাসফেমির মতো ঘৃণ্য আইন ধর্মের বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছিল—ওসব কি ধর্মান্ধতা নয়?
সমরেশ মজুমদার: খ্রিষ্টানরা এখন অনেক শ্রেণির হয়ে গেছে, সেখানে তারা একত্র নয়।
তাপস কুমার দত্ত: না, সেটা অন্য ব্যাপার, প্রশ্নটা হলো...
সমরেশ মজুমদার: আমাদের ভারতবর্ষেও তো হিন্দু ধর্ম একেক জায়গায় একেক রকম। আপনি সাউথ বা নর্থ ইন্ডিয়ায় বা অন্য প্রান্তে যে হিন্দু ধর্ম দেখবেন, তা পশ্চিম বাংলায় পাবেন না; এক জায়গার সঙ্গে অন্য জায়গায় ধর্মীয় অমিলই বেশি।
তাপস কুমার দত্ত: প্রশ্নটা তা নয়। একটা ধর্ম সম্প্রদায় নানা খণ্ডে বহু ধারায় বিভক্ত হতেই পারে। কিন্তু যেকোনো ধারারই একটা প্রচ্ছন্ন গোঁড়ামি আছে, মৌলবাদ আছে; আর সেটাই দিন দিন বিশ্বের ওপর বেশি পরিমাণে চেপে বসছে। আপনি কী মনে করেন?
সমরেশ মজুমদার: না, আমি এর সঙ্গে একমত নই। আমার তো মনে হয়, ধর্ম পৃথিবী থেকে আস্তে আস্তে লোপ পেতে চলেছে। এখন যে চিৎকারটা আমরা শুনতে পাচ্ছি—কারণ, ধর্মবাদীরা আতঙ্কগ্রস্ত বলে চিৎকার করছে।
তাপস কুমার দত্ত: প্রথাগত ধর্মে আপনার বিশ্বাস কতটুকু?
সমরেশ মজুমদার: আমি ধর্মে একদম বিশ্বাসী নই।
তাপস কুমার দত্ত: আর বিবাহ প্রথায়?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, বিবাহ প্রথায় বিশ্বাসী। তবে বিয়ে কীভাবে হবে, সেটা নির্ভর করছে যারা বিয়ে করছে, তাদের ওপর।
তাপস কুমার দত্ত: তৃতীয় বিশ্বে বসবাস করার একটা মানসিক যন্ত্রণা আছে। বিশেষ করে, শিল্পী-সাহিত্যিক...যেকোনো সৃজনশীল মানুষের। আপনি তা কতটা অনুভব করেন?
সমরেশ মজুমদার: এটা ভারতবর্ষে, মানে পশ্চিম বাংলায় নেই, আমি কখনো অনুভব করিনি। এটা গুজরাটে থাকতে পারে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার লেখালেখিতে বা ভাবনায় কখনো সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনো প্রতিবন্ধকতা আসেনি বলছেন?
সমরেশ মজুমদার: সিপিএম যখন ক্ষমতায় এল, তখন আমি নকশাল আন্দোলন নিয়ে উপন্যাস লিখলাম—কালবেলা। তো কালবেলার নায়ক অনিমেষ তখন কিন্তু সিপিএমের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। বলেছে, সিপিএম ভ্রষ্টাচারী। আমাকে কিন্তু ও রকমভাবে কোনো সরকার বা শক্তি আপত্তি করেনি।
তাপস কুমার দত্ত: নিজের বিচারে আপনার প্রিয় লেখা কোনটি?
সমরেশ মজুমদার: তিনটি লেখা আমার খুব প্রিয়। সেটা হচ্ছে—‘উত্তরাধিকার’...
তাপস কুমার দত্ত: এ সিরিজটা? অর্থাৎ ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’?
সমরেশ মজুমদার: না, ‘কালবেলা’ আমার প্রিয় নয়। ‘এখনও সময় আছে’ বলে আমার একটা উপন্যাস আছে, আমার ভীষণ প্রিয়। আর গত বছর আমি ‘দেশ’-এ একটা উপন্যাস লিখেছি—‘উৎসারিত আলো’—এ তিনটি।
তাপস কুমার দত্ত: লেখালেখিতে কতটা অসন্তুষ্টি বা অতৃপ্তি রয়ে গেছে?
সমরেশ মজুমদার: প্রতিটি লেখায়ই আমার অসন্তুষ্টি রয়ে যায়। আমার মনে হয়, আবার লিখলে ভালো করতাম। কিন্তু একবার বই আকারে...।

তাপস কুমার দত্ত: সেটা ওই বইটার নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর। আমার জিজ্ঞাসা হলো, এমন কোনো প্রিয় লেখা কি আপনার ভেতরে লালিত আছে, যা এখনো আপনি লিখে উঠতে পারেননি?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এই যে আপনাকে এর আগে যে কথাগুলো বললাম। আমি হুমায়ূন (আহমেদ)-কে বারবার বলেছিলাম, দ্যাখো, তুমি এত জনপ্রিয় একজন লেখক, তোমার এত হাজার হাজার বই বিক্রি হয়, তোমার তো এখন হারানোর কোনো ভয় নেই। তা তুমি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ২০০৪ সালের এই সময়কাল পর্যন্ত কয়েকটা খণ্ডে লেখো না, উপন্যাস আকারে। সে বলল, আমার লিখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সাহস পাই না। আমি অ্যাকসিডেন্টলি আপনাদের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিচিত ছিলাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আমার কাছে এরশাদ খুব কালারফুল চরিত্র। ঘৃণ্য, কিন্তু কালারফুল। কেউ ওর সঙ্গে দেখা করার সাহস পায়নি, যেতে চায়নি; আমি গিয়েছিলাম ওর আমন্ত্রণে। আমার বিপুল অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এটা নিয়ে তিনটি পর্বে ভাগ করে লিখতে আমার খুব ইচ্ছা হয়। ১৯৪৭ থেকে ’৬৯, শেখ মুজিবুর যখন স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, সেই অবধি। এরপর ১৯৬৯ থেকে ’৭১ এবং ’৭১ থেকে এখন অবধি। এ তিনটি পর্বে বাংলাদেশের পটভূমিতে যদি পারি, তো কখনো লিখব। আমি জানি, এ লেখা এই সরকার থাকলে ওখানে যাবে না।...এই যে দ্যাখো, ‘এত রক্ত কেন’ বইটা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে; ঢাকার ফুটপাতে কিন্তু বইটা পাওয়া যায়। তো ব্যান্ড করে লাভটা কী হলো?
তাপস কুমার দত্ত: এ বইটার জন্য বাংলাদেশের একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে ও-দেশে যাওয়ার ভিসা আপনাকে আটকে দেওয়া হয়। এখন যদি এ জাতীয় সমস্যা না থাকে, তা হলেও কি বাংলাদেশে যেতে কোনো আপত্তি থাকবে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি জানি, এ সরকার যদি এটা তুলেও দেয়, তবু সরকারের যারা অনুচর, তারা আমাকে আক্রমণ করবে।
তাপস কুমার দত্ত: অর্থাৎ আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন?
সমরেশ মজুমদার: অফ কোর্স। আমি শেষবার যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, তখন এত রক্ত কেন বেরিয়েছে, কিন্তু ব্যান হয়নি; সেদিন ঢাকায় এয়ারপোর্টে নেমেই বেশ সমস্যায় পড়েছিলাম। আমাকে নিয়ে অফিসাররা হঠাৎ তটস্থ হয়ে উঠলেন, কেন আমি এসেছি? কী উদ্দেশ্যে এসেছি? তো, আমাকে রিসিভ করতে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদ। আমাকে নিয়ে সে সোজা চলে গেল নুহাশ পল্লীতে। ওখানে তিন রাত ছিলাম। এরপর রাতের অন্ধকারে ঢাকায় এলাম।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অন্য কোনো ভয় পাচ্ছিলেন?
সমরেশ মজুমদার: পুলিশ বোধ হয় ভাবছিল, আমাকে অ্যারেস্ট করা উচিত কি উচিত না। একদিন একটা অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে সেখান থেকে সোজা এয়ারপোর্টে। এরপর আমি যখন অনুষ্ঠানে যাওয়ার পরবর্তী আমন্ত্রণ পেলাম, তখন তারা আমাকে ভিসা দিল না।
তাপস কুমার দত্ত: এখন আপনি কী ধরনের বই পড়ছেন?
সমরেশ মজুমদার: কয়েক দিন আগে ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ হুমায়ুন আজাদের বইটা সকাল থেকে পড়তে শুরু করেছিলাম। সেদিনই সকাল ৯টায়—বইটা পড়ছি, হাতে; খবর এল হুমায়ুন আজাদ মারা গেছেন। ওই বইটাতেই একটা জায়গায় লেখা ছিল, যেকোনো দিন তার মৃত্যু হতে পারে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। এ বইটা খুব বড় বা দামি লেখা নয়। খুব আবেগের লেখা, একই কথা বারবার লেখা; কিন্তু কথাগুলো লিখতে সাহস পায়নি তেমন কেউ।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি কি তাঁর আর কোনো উপন্যাস পড়েছেন?
সমরেশ মজুমদার: একটা পড়েছিলাম অনেক আগে, নামটা ভুলে গেছি। দাঁড়াও, নামটা মনে করি...
তাপস কুমার দত্ত: ‘শুভব্রত’, তার সম্পর্কিত সুসমাচার?
সমরেশ মজুমদার: না, আর কয়েকটা নাম বলো তো।
তাপস কুমার দত্ত: ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, সবকিছু ভেঙে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, হ্যাঁ, ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, বইগুলো বেশির ভাগ সময়ই কলকাতায় সহজে পাওয়া যায় না।
তাপস কুমার দত্ত: বয়স তো যথেষ্ট হলো। একদিন চলে যেতে হবে, তার দিনক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে...কোনো আতঙ্ক বা আক্ষেপ?
সমরেশ মজুমদার: না, না। আজ রাতেও চলে যেতে পারি; আবার হয়তো দশ বা কুড়ি বছর পরও যেতে পারি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অবশ্যই দীর্ঘায়ু হবেন, আমি এর দার্শনিক দিকটা জানতে চাচ্ছি।
সমরেশ মজুমদার: আমি খুব বাস্তববাদী মানুষ। আমি আজকে লেখালেখি করে যেটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি, সেটুকু আমার পাওয়ার কথা ছিল না। আমার লেখক হওয়ারই কথা ছিল না।
তাপস কুমার দত্ত: অনেক বছর আগে বাংলাদেশের একটা সাপ্তাহিক কাগজে আপনি বলেছিলেন, এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেবেন।
সমরেশ মজুমদার: ওসব কথা বাড়িয়ে লিখতে ভালোবাসে কিছু সাংবাদিক। যেমন অন্য একটা জায়গায় আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তসলিমার ‘ক’ পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে? আমি এর উত্তরে বলেছিলাম, আমি ‘ক’ পড়েছি এবং আমার মনে হয়েছে, একটা বারবনিতাকে যদি বলা হয়, তোমার আত্মজীবনী লেখ, সে তার অনেক কষ্টের কথা লিখবে; কিন্তু যেসব ক্লায়েন্ট তার কাছে আসে, তাদের বিস্তৃত পরিচয় দেবে না সে, এটুকু সৌজন্য দেখাবে। এ উত্তরটা তারা এভাবে লিখেছে যে, সমরেশ মজুমদার বলেছেন, তসলিমা নাসরিন বেশ্যা। এর উত্তরে তসলিমা লিখলেন আনন্দবাজারে, সমরেশ মজুমদারের গলায় গলা মিলিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, তসলিমা বেশ্যা। এর উত্তরে আমি আবার চিঠি লিখলাম আনন্দবাজারে—কোথায়, কখন বলেছি? কাকে বলেছি? যদি দয়া করে আমাকে জানানো হয়...। অতএব, যদি কোথাও কখনো লেখা হয়ে থাকে, আমি বলেছি এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেব—এগুলো বাজে কথা। হয়তো এভাবে বলেছি, লিখে টাকা পাওয়া যায়, জানতাম না। যখন লিখে টাকা পেতে শুরু করলাম, তখন আমাকে যদি বলা হয়, কেন লেখেন? আমি বলি, টাকার জন্য লিখি।
তাপস কুমার দত্ত: কথাটা এভাবে বলেছিলেন, একজন কৃষক যে কারণে চাষাবাদ করেন, একজন...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম, একজন কৃষক যখন চাষাবাদ করেন, তিনি তো দেশ গড়ার জন্য চাষ করেন না; তিনি তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য চাষাবাদ করেন। একজন মাস্টার যখন পড়ান, তখন মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার চেয়ে তার সন্তানসন্ততিকে বড় করার জন্য পড়ান। তো, একজন লেখকের কী দায় আছে, তিনি দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন? আমাদের দেশে কোনো লেখক যদি জনপ্রিয় হন, তখন ধরেই নেওয়া হয়, ওগুলো ভুসিমাল। যদি সে ধরনের লেখক জনপ্রিয়তা না পান বা বিক্রি না হয়, তখন তিনি একজন বিরাট লেখক। প্রশ্ন হলো, জনপ্রিয়তা যদি কেউ বেশি পান, কেন পান? কারণ, পাঠকদের ভালো লাগছে বলেই। কোনো একটা বই হয়তো বেশি পাঠকের ভালো লেগেছে। এমন নয় যে বছরের পর বছর তিনি জনপ্রিয় হয়ে থাকেন। তা হলে যিনি পাঠককে সহজে স্পর্শ করতে পারছেন না, তার কোথাও খুঁত আছে নিশ্চয়ই। ভালো একটা ছবি তিন দিন সিনেমা হলে থেকে চলে গেল। আর একটা ছবি ‘বাবা কেন চাকর’ মাসের পর মাস চলল, জনপ্রিয় হলো। আবার ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর যখন হাজারটা শো চলে, তখন বলতেই হয়, গুপী গাইন বাঘা বাইন খারাপ ছবি? চার্লি চ্যাপলিন তা হলে খারাপ ছবির নাম? ‘পথের পাঁচালী’ও ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল—ওটাও তা হলে খারাপ ছবি?

তাপস কুমার দত্ত: ধরুন, হাইপোথেটিক্যালি আমরা ধরে নিলাম, কোনো ধনকুবের আপনার যাবতীয় চাহিদার স্পন্সরশিপের দায়িত্ব নিল। একজন কৃষক যে কারণে কৃষিকাজ করেন বা আর দশজন পেশাজীবী মানুষ যে কারণে পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, সেই প্রয়োজনটা আপনার আর রইল না। তখন কি লেখালেখি আপনি ছেড়ে দেবেন?
সমরেশ মজুমদার: চাহিদার কিন্তু শেষ নেই। আগে বাস-ট্রামে চড়তাম, আমার এখন বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। এখনো অবশ্য ইচ্ছা করে মাঝেমধ্যে বাস-ট্রামে উঠি। তো, আগে আমি জলপাইগুড়ি আমার বাড়ি যেতাম সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে, রিজারভেশন ছাড়া। এরপর রিজারভেশনে। এরপর এসি থ্রি-টিয়ার, এরপর এসি টু-টিয়ার। এর মানে এই নয়, আমি এখন এসি টু-টিয়ার ছাড়া যেতে পারব না। কিন্তু যদি কমফোর্ট পাই, তা আমি নেব না কেন?
তাপস কুমার দত্ত: আমি বলতে চাচ্ছি, শুধু ভরণপোষণ আর কমফোর্ট—এসব কারণেই লেখালেখি? ভোগবাদী ব্যাপার ছাড়া তা কি নিজের ভেতর থেকে উঠে আসে না?
সমরেশ মজুমদার: শুনুন, আমাকে যদি এক কোটি টাকা দেওয়া হয় একটা উপন্যাস লেখার জন্য—সাত দিন চেষ্টা করেও লিখে উঠতে পারব না। আবার, আমাকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি, আমি লিখতে বসলাম, হয়তো দুদিনেই লেখাটা শেষ করে ফেলতে পারব।
তাপস কুমার দত্ত: তা হলে লেখালেখিটা শুধু হালচাষির হালচাষের মতো জীবিকা নির্বাহ নয়, আলাদা একটা ভেতরের তাগিদও...
সমরেশ মজুমদার: অবশ্যই।
তাপস কুমার দত্ত: বেশির ভাগ জনপ্রিয় লেখকের লেখায় দেখা যায়, কতগুলো পাগলামোর ঘটনা, কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনা, কিছু সুখকর ঘটনা ও একটু বেদনাদায়ক ঘটনা। যেন ছাঁচে ঢেলে গরম তেলে ভেজে তোলা হট কেক...
সমরেশ মজুমদার: এটা আমার কাছে খুব অস্পষ্ট। ধরুন, আমার একটা বই, ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে এক লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। সেই বইটা কলকাতায় ৫০-৬০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। ধরে নিতে পারি, বইটা জনপ্রিয়।
তাপস কুমার দত্ত: বইটার নাম কী?
সমরেশ মজুমদার: ‘গর্ভধারিণী’। তা ওটা কোন ফর্মুলায় লেখা, বলুন তো?
তাপস কুমার দত্ত: ওই বইটাতে আসলে এমন একটা সাসপেন্স বা থ্রিল এবং এর সঙ্গে আবেগ, বর্তমান সমাজব্যবস্থার কিছু মানুষের অমানবিক নোংরা দিকের প্রতি...।
সমরেশ মজুমদার: এসব তো অনেক বইতেই আছে।
তাপস কুমার দত্ত: হ্যাঁ, তা ঠিক, ‘মেঘ ছিল, ‘বৃষ্টিও’-তেও আছে। ‘আট কুঠুরী নয় দরজা’তেও।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে সেগুলো ওভাবে বিক্রি হয়নি কেন?
তাপস কুমার দত্ত: না, আমি বলছি ‘গর্ভধারিণী’র মতো বিশাল জনপ্রিয়তা না পেলেও ওই লেখাগুলোও বেশ জনপ্রিয়।
সমরেশ মজুমদার: যদি জানতাম, গর্ভধারিণীর মতো ওভাবে সাসপেন্স মেশালে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হবে, তা হলে তো সব বই ওভাবেই লেখা হতো। তা হলে ‘সাতকাহন’ কেন এত বিক্রি হলো? স্ট্রাগল করা মেয়েদের গল্প তো আমি আগেও লিখেছি, পরেও লিখেছি, সেগুলো কেন সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হলো না? আমি যদি আরেকটা দীপাবলীকে নিয়ে লিখি, সেটা কি সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হবেই?
তাপস কুমার দত্ত: সাতকাহনের দ্বিতীয় পর্ব কিন্তু প্রথম পর্বের মতো অত জনপ্রিয় নয়।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে? আসলে আমার কাছে মনে হয়, যেকোনো...আমি আপনাকে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখাটার কথা বললাম, ‘এখনো সময় আছে’ বইটা তিন থেকে চার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। লোকে না পড়লে আমার কষ্ট হয়, আমি তো লোকে লোকে গিয়ে বলতে পারি না, আপনি বইটা পড়ুন। কোত্থেকে ‘কালবেলা’ এক লাখ কপি বিক্রি হলো! ‘উত্তরাধিকার’ বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার। অথচ উত্তরাধিকার ওটার চেয়ে অনেক বেটার উপন্যাস। তাই কোন লেখাটা জনপ্রিয় হবে, তা আগে থেকে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। একটা লেখা জনপ্রিয় হতে পারে। একটা মেমসাহেব, একটা দৃষ্টিপাত, একটা মরুতীর্থ হিংলাজ জনপ্রিয় হতে পারে। কয়েকটা নয়।
তাপস কুমার দত্ত: ওপারের লেখকদের লেখা সম্পর্কে...
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, ওপারের এক নম্বরের সঙ্গে দুই নম্বরের ব্যবধান এত বিস্তর...জাফর ইকবাল সম্প্রতি সেই ব্যবধান একটু কমিয়ে এনেছেন। তো, গতবার যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, তখন একজন লেখক আমাকে এসে বললেন, সমরেশ দা, আপনাকে একটা ভালো খবর দিই।
আমি বললাম, কী?
বলল, আমি এখন তিন নম্বরে।
আমি জানতে চাইলাম, কিসের তিন নম্বর? সে জানাল, জনপ্রিয়তার। তার পেছনে নাকি মিলন চলে গেছে, অমুক-তমুক অনেকে চলে গেছে। আমি হাসব না কাঁদব, ভেবে পাচ্ছিলাম না।
তাপস কুমার দত্ত: কে?
সমরেশ মজুমদার: নামটা নাই-বা বললাম।
তাপস কুমার দত্ত: বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের রুচিবোধ আপনার কতটা উঁচুদরের বলে মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: আপনি যা ইচ্ছা তা-ই লিখে পাঠকদের ভোলাতে পারবেন না। পাঠকদের বিচারশক্তি দারুণ প্রখর। একটা লেখা দিয়ে ভোলাতে পারবেন, পরের দুটোয় হাফ ভোলাতে পারবেন; তৃতীয়টায় আর পারবেন না।
তাপস কুমার দত্ত: পাঠকেরা আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমাকে তেমন প্রভাবিত করতে পারে না। তবে কিছু কিছু ঘটনায় মাঝেমধ্যে কষ্ট হয়। একবার বইমেলায় এক ভদ্রমহিলা তিনখানা (বড় ক্যানভাসের) বই বইতে পারছিলেন না, চেহারা দেখে বোঝা যায়, যথেষ্ট (আর্থিক) অসচ্ছল পরিবার। আমি বললাম, আপনি কী করেন?
তিনি বললেন, আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়াই।
আমার খুব খারাপ লাগল, আপনি এত দামি তিনটি বই কিনলেন?
তিনি বললেন, সারা বছর আমরা অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছি।
এরপর দেখলাম, দূরে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। ক্রাচ হাতে, একটা পা ডিফেক্টেড। ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে যেতেই তিনি বললেন, আমি আপনার অনিমেষ।
আমি বললাম, তার মানে?
তিনি জানালেন, তিনি নকশাল আন্দোলন করতেন এবং হাওড়া জেলে পুলিশের অত্যাচারে একটা পা নষ্ট হয়ে (অনিমেষের মতোই) গেছে। আমরা একসঙ্গে থাকি। (অনিমেষ-মাধবীলতার মতো), আমরা বিয়ে করিনি।
আরেকটা ঘটনা বলে শেষ করি—হ্যাঁ, একবার বিদেশে রাতে আমার খুব খিদে পেয়েছে, একটা বড় রেস্টুরেন্ট দেখে ভেতরে ঢুকে পড়ি। এরপর মেনু কার্ডের সবচেয়ে ছোট আইটেম যেটা, সেটার অর্ডার দিলাম। বেয়ারাগুলোকে দেখে মনে হলো এশিয়ান। তো, একটা বেয়ারা এসে বলল, স্যার! আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?
আমি বললাম, ইয়েস।
স্যার! আর ইউ ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল?
আমি আবার বললাম, ইয়েস।
বেয়ারা গিয়ে হোটেল মালিককে তথ্যগুলো জানাতেই হোটেল মালিক উঠে এসে বললেন, নমস্কার স্যার! আপনি বোধ হয় সমরেশ বাবু। আমি আপনার একটাই মাত্র বই পড়েছি। একবার একটা বাস টার্মিনালে দেখলাম একটা বই পড়ে আছে—বাংলা বই, নামটা ‘দৌড়’।
এরপর যতই বলছি, আমার খাওয়া হয়ে গেছে, তবু তিনি আমাকে জোর করে খাওয়াবেন। বিল দিতে গেলাম, বিল নিলেন না। এই অবধি ঠিক আছে। বেয়ারা এরপর বলল, সাহেব, একবার ভেতরে আসবেন? আপায় কইছিল, আপনি সমরেশ মজুমদার কি না জিজ্ঞেস করতে। তো, আমি ভেতরে ঢুকলাম। একজন ভদ্রমহিলা খাটের ওপর বসে নমস্কার জানিয়ে আমার দিকে একটা বই এগিয়ে দিলেন—‘গর্ভধারিণী’। আমার পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। দেখুন, কারোর জানার কথা নয়, আমি ওখানে যাব। কাকতালীয়ভাবে।
তাপস কুমার দত্ত: একবার কবি সম্মেলনে আপনাকে দেশের বাইরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল—কবি হিসেবে, ভুল করে। ঠিক এ রকমই একটা ঘটনার কথা...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আপনি সবই জানেন দেখছি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি বই বাজেয়াপ্ত করাটা কতটা সমর্থন করেন?
সমরেশ মজুমদার: যে কারণে তসলিমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, সেটাকে আমি সমর্থন করি না। তবে আমার হাতে আইন থাকলে তসলিমাকে অভিযুক্ত করতাম। আজ একটা ছেলের সঙ্গে একটা মেয়ের ভালো সম্পর্ক; সম্পর্কটা দুজনকেই আনন্দিত করছে। যদি ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো তিক্ততা আসে, আজকের এ আনন্দটা কিন্তু মিথ্যা হয়ে যাবে না এবং সেই ছেলেটা ও মেয়েটার কোনো রাইট নেই ভবিষ্যতে এই আনন্দিত সম্পর্ককে নিয়ে খোলামেলা...ব্যঙ্গ করে লেখা বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে লেখা। যে ক্ষেত্রে তারা একে অন্যকে ছোট ও অপমান করছে। মিলনের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গিয়ে কী হয়েছে বা অমুকের সঙ্গে অমুকের আর কী হয়েছে—এর ডিটেইলস নিয়ে আমরা আদৌ আগ্রহী নই। আমরা তসলিমার ব্যাপারে এখানেই আগ্রহী যে সে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কী লড়াই করেছিল। তা না করে তার শারীরিক আনন্দের বিবরণ দিয়ে লিখছে—এটা এক ধরনের অসুখ। আমি জানি, আমার বাবা-মায়ের মিলনের ফলে আমি পৃথিবীতে এসেছি; এখন সেই মিলনটা কী রকম ছিল, তার বিবরণ দিয়ে যদি লিখতে যাই, তো আমার জন্মটাকেই আমি সবচেয়ে বেশি কুৎসিত করছি। আমার জন্মের বিবরণের জন্য আমার বাবা-মায়ের শয্যা বিবরণ কি আমি দিতে পারি? নাকি তা আমি ভাবতে চাই? বা ভাবতে পারি?
তাপস কুমার দত্ত: আপনি আপনার খোলামেলা বা বিতর্কিত ভাবনা প্রকাশ করতে কতটা ভয় পান?
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, এ মুহূর্তে বোধ হয় আমিই সবচেয়ে সরাসরি লিখি। ‘পত্রপাঠ’ বলে একটা পত্রিকা আছে, মাসে বেরোয়—সেটায় আমি কলাম লিখি। সেখানে সরাসরি সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে লিখি। একজন কলেজ অধ্যাপককে পুলিশ অ্যারেস্ট করে—জনযুদ্ধগোষ্ঠীর ডায়েরি থেকে নাম পেয়ে তাকে অ্যারেস্ট করে। সারা দিন অত্যাচার করে সন্ধ্যায় তাকে ছেড়ে দেয়। এলাকার লোকজন মনে করে, সে জনযুদ্ধগোষ্ঠীর লোক। সে রেললাইনে আত্মহত্যা করে, তার স্ত্রী এ নিয়ে কেস করে। এ ঘটনা নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। আমি এ-ও লিখেছিলাম, কয়েক দিন আগে ভোটের সময় একজন সাংবাদিক একটা গ্রামে গেছেন। সেখানে এক চায়ের দোকানে নানা আলোচনায় উঠে আসে, আমাদের দেশে যত মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই অবিবাহিত। বিবাহিত ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়, জ্যোতিবাবু। সিদ্ধার্থবাবু, জ্যোতিবাবু কখনো বাজারে যাননি। বুদ্ধবাবু রিকশায় চাপেন, বাজারে যান। আর নামটা দেখুন, বুদ্ধদেব।...বিধানচন্দ্র, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থ হচ্ছে সংসারী নাম।...এ রকম নাম যার, তাকে আমরা ভোট দেব না, তো অন্য লোককে ভোট দেব? সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কেমন আছেন? ওরা বলল, এই যে রাস্তাটা দেখছেন, এর নাম সুচেতনা (‘সুচেতনা’ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মেয়ের নাম)। আমাদের এখানে একটা ভাটিখানা আছে, খুব মারপিট চলত আগে, মদ খেতে খেতে। আমরা সেটার নাম দিয়েছি সুচেতনা...বাংলা বারের প্রতিশব্দ আর কি। ওখানে মদ খেয়ে এখন আর কেউ চেতনা হারাচ্ছে না। ফলে বুঝতেই পারছেন, আমরা সবই বুদ্ধবাবুর লোক। এ গল্পটা বের হওয়ার পর বুদ্ধবাবু আমায় বললেন, আমাকে নিয়ে লিখলেন, ঠিক আছে; আমার মেয়েকে জড়ালেন কেন? আমি বললাম, ‘হাওড়ার একটা লাইব্রেরি উদ্বোধন করতে তোমার মেয়ে আর তোমার স্ত্রী গিয়েছিলেন, লাইব্রেরিটার নাম রাখা হয়েছে সুচেতনা পাঠাগার। তোমার মেয়ে এখনই এমন কী যোগ্যতা অর্জন করেছে যে তার নামে একটা পাঠাগার রাখা হবে? যেহেতু সে তোমার মেয়ে, তাই রাখা হয়েছে।’ এখন, আপনি কী মনে করেন না, এর চেয়ে সরাসরি আক্রমণ করে লেখা—আর বড়াই করে বলি, আমাদের কোনো লেখকই লিখছেন না। লিখতে পারেন, কিন্তু লিখছেন না।
তাপস কুমার দত্ত: এত সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সমরেশ মজুমদার: থ্যাঙ্ক ইউ।

উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দত্ত। এই লেখক সদ্য গত হয়েছেন। আর তাই সাক্ষাৎকারগ্রহীতা ও বন্ধ সাপ্তাহিকটির তখনকার নির্বাহী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকারের সম্মতিক্রমে আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।
তাপস কুমার দত্ত: ওপার বাংলার বাঙালিদের সঙ্গে এপার বাংলার বাঙালিদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যে পার্থক্য, সেটা যত দিন যাচ্ছে ততই কি দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: দুটো ঘটনা ঘটেছে এখানে, সেটা হচ্ছে—১৯৪৭ সালের আগে যে বাংলা, একত্র দুই বাংলা, যেখানের হিন্দু আর বাঙালিরা ছিল সম্পূর্ণ কলকাতামুখী। মুসলমান বাঙালিদের মধ্যে দুটো শ্রেণি ছিল—একটা শ্রেণি অত্যন্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ, শিক্ষিত লোক এবং বেশির ভাগই ছিল অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মুসলমান। এ অল্প ও অশিক্ষিত মুসলমানদের ওপর স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিরা ডমিনেট করল। ফলে যখন দেশ ভাগ হলো, তখন অল্পশিক্ষিত অশিক্ষিত মুসলমানেরা উল্লসিত হলো, কারণ, শিক্ষিত বাঙালিরা ভয় পেল, দু-একটা জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলো। আমি বাংলাদেশের অনেক জেলার কথা জানি, যেখানে আজ অবধি কোনো মানুষ খুন হয়নি দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে। যেমন ধরুন, রংপুর। সেখানে আজ অবধি কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত না ঘটা সত্ত্বেও রংপুর থেকে অনেক মানুষ চলে এসেছে ভারতবর্ষে। তখন এ রকম একটা প্রচারণা এসেছিল—পূর্ব পাকিস্তান মুসলমানদের জায়গা। অতএব, হিন্দুরা সেখানে থাকলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। তাই ছোটো ইন্ডিয়া। সেই ছোটার কাহিনিটা গত ৫৫ বছরের। সেই ছোটার কাহিনিতে অনেক মানুষ একেবারে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে তলিয়ে গেছে। আবার অনেক মানুষ সংগ্রাম করে করে ওপরে উঠেছে।...
তাপস কুমার দত্ত: এরপর থেকেও তো অনেক সংখ্যালঘু ওপারে চলে গেছে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এপার থেকেও গেছে, তবে তা আনুপাতিক হারে যথেষ্ট কম। যা বলছিলাম, এ ৫৫ বছরে যদি কেউ লাভবান হয়ে থাকে, আমি এপার বাংলার কথা বলছি—তা হলে হয়েছে পশ্চিম বাংলার মেয়েরা। এই যারা পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিল—সংগ্রাম করেছে, কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে, বস্তি বা কলোনিতে কোনোক্রমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে; তাদের দেখাদেখি পশ্চিম বাংলার কনজারভেটিভ পরিবার—যারা মেয়েদের অন্দরমহলে ফেলে রেখেছিল এবং অফিস-কাছারিতে যাওয়া তো স্বপ্নের বাইরে ছিল। যখন পূর্ববঙ্গের মেয়েরা জীবনসংগ্রামের বাধ্যবাধকতায় গ্র্যাজুয়েশন করে স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন অফিসে চাকরিতে ঢুকল; তখন এখানকার মেয়েরা উৎসাহিত হলো। আমরা যখন কলেজে পড়তাম; সন্ধ্যা ৬টার পর ট্রামে-বাসে কোনো মেয়েকে দেখা যেত না; যদি কোনো মেয়েকে দেখা যেত তা হলে সে নিশ্চয়ই বাঙাল (পূর্ববঙ্গীয়) হতো। কিন্তু এ পশ্চাৎপট একদম পাল্টে গেল ১৯৬৮ সালের পর থেকে। তখন বাস্তবিক নিষ্পেষণে পশ্চিম বাংলার মেয়েরাও বেরোতে শুরু করল, যেটা বলতে গিয়ে সরে এসেছি—সেটা হলো, এই দেশবিভাগ এবং এ দেশে উদ্বাস্তু স্রোত আসার অনেক খারাপ দিকের এই একটা ভালো দিক, আমাদের মেয়েরা অর্গল ভেঙে বেরোতে পেরেছিল। কিন্তু ওখানে (বাংলাদেশে) যারা রয়ে গেল (হিন্দু সম্প্রদায়) তাদেরও, আমরা দেখেছি, কেউ ১৯৬৭, কেউ ১৯৭০, কেউ ১৯৭৬-এ চলে আসতে লাগল।
তাপস কুমার দত্ত: এখনো কি অল্পবিস্তর চলে আসছে?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এখনো আসছে এবং এদের একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে এরা আওয়ামীপন্থী ছিল। অর্থাৎ এ দলটির কাছে ওরা নিরাপদ বোধ করত।
তাপস কুমার দত্ত: দেশভাগের পর ওপার বাংলার কী কী বিশেষ পরিবর্তন আপনার কাছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়েছে?
সমরেশ মজুমদার: ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এ ২৪ বছরে বাঙালির জীবনে পূর্ববঙ্গে একটা জিনিসেরই আমদানি ঘটেছে, সেটা হলো ইসলাম এবং ইসলামকেন্দ্রিক আরবি-ফারসি শব্দ। ওই সময় যাঁরা লেখালেখি করতেন, যেমন ধরুন—শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস—এঁরা যে বাংলা লিখতেন, তা ছিল পশ্চিম বাংলার বাংলা; অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারকৃত বাংলা। এঁরা বাংলার প্রাচীন সাহিত্য এবং রামায়ণ-মহাভারত ও আরও সব পৌরাণিক...প্রাচ্য ও পশ্চিমের সাহিত্যের ওপর ভালো দখল রাখতেন এবং সেটা তাঁদের ভেতরে লালন করতেন। ১৯৭১ সালের পর একটা আবেগ এল, আবেগের সঙ্গে ভয় এল। ভয়টা এই—আমরা এত দিন উনুনে পুড়ছিলাম, উনুন থেকে লাফিয়ে গরম তেলে পড়লাম না তো? অর্থাৎ আমরা পাকিস্তানের অত্যাচারে জর্জরিত হচ্ছিলাম, এখন ভারত বড়দাদার মতো দাদাগিরি করবে না তো? আমাদের দখল করবে না তো? তার কিছু কিছু ইন্ধন—আপনারা জানেন—ভারত যে সম্পূর্ণ বৈষ্ণব হয়ে ছিল তা নয়, ভারতের তরফ থেকে যারা দু-একটা বদমায়েশি কাজ করেছে, সেসব বাংলাদেশের কাছে প্রবল হয়ে ধরা দিল। ১৯৭১ সালের ওই আবেগ যখন কমতে শুরু করল, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর ওখানকার রাজনৈতিক দলগুলো জনসাধারণকে সস্তা পথে পাওয়ার জন্য অ্যান্টি-ভারত আবহাওয়া তৈরি করল এবং সেটা তাদের ভোট অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়কও হলো। এ সময় থেকে আমরা দেখতে শুরু করলাম, বাংলা সাহিত্যে যা লেখালেখি হচ্ছে, খবরের কাগজে রিপোর্টিংয়ে যে বাংলায় লেখালেখি হচ্ছে, সেখানে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। এর একটা উদাহরণ হলো জিম্মা। এ ‘জিম্মা’ শব্দটা আগে ওপার-এপার, কোনো বাংলায়ই ব্যবহৃত হতো না। যেমন খাবারটা খেয়ে দারুণ ‘মজা’ লাগল। এ ‘মজা’ শব্দটা হলো রসে-বসে আনন্দে আছি। তা খাবারটা খেয়ে ‘মজা’ লাগবে কেন আমার? খাবারটা খেয়ে আমার দারুণ ভালো লাগবে, অথবা আমি খুব আনন্দ পেলাম খেয়ে। কিন্তু ‘মজা’ লাগা বলতে কোথাও যেন একটু কৌতুক মেশানো থাকে। এ ধরনের কিছু শব্দ তৈরি হতে লাগল। এসব সচেতনভাবে তৈরি হতে লাগল, যাতে পশ্চিম বাংলার ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষা আস্তে আস্তে একটু একটু করে আলাদা হতে থাকে। আবার, আমরা দেখতে পাই, ১৯৬০ বা ’৬৫ সাল অবধি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের আগ অবধি যেকোনো মুসলিম পরিবারে আরবি বা ফারসি নাম দেওয়া হতো। কিন্তু এর পর থেকে দেখা গেল তাদের নামের পাশে ব্র্যাকেট করে একটা ডাকনাম দেওয়া হলো। ১৯৪০-৫০ সালের দিকে কোনো মুসলমানের ডাকনামের তেমন প্রচলন ছিল না। ক্রমে এ ডাকনামই তার হাইলাইটস পেত বেশি, আসল নামটা আড়ালে থাকত। যেমন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। আমরা সবাই জানি ‘বন্যা’। এটা কিন্তু পাশাপাশি সচেতনভাবে বাঙালিত্ব ধরে রাখার প্রচেষ্টা। এর পরবর্তী প্রজন্ম, সত্তরের দশক থেকে যে প্রজন্ম শুরু হলো—তারা আরও অদ্ভুত হলো। তাদের আবার নাম হয়তো আবুল হায়াত, মেয়ের নাম বিপাশা হায়াত বা সুবর্ণা মুস্তাফা। হায়াত বা মুস্তাফা তার পারিবারিক পদবি কিন্তু নামটা বাংলা শব্দ। অর্থাৎ আগে যেটা ব্র্যাকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেটা এখন নামের সাইনবোর্ডে এসে প্রকাশ হলো। পাশাপাশি আরও একটা অদ্ভুত ছবি আছে; ছবিটা হলো—চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মানুষ, ধরুন একজন মা; তার ছেলে হয়তো ঢাকায় চাকরি করে। তিনি যখন তার ছেলেকে চিঠি লিখছেন, তখন চট্টগ্রামের ভাষায় লিখছেন না। তিনি বইয়ের ভাষায় চিঠি লিখছেন এবং ছেলেও তা-ই করছে। কিন্তু ছেলে আর মায়ের যখন পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয়, তখন কিন্তু তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলেন, যা ঢাকার লোক বুঝবে না। তা হলে চিঠিতে কেন বাংলা বর্ণমালায় চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার করছে না? এ নিয়ে আমার নিজস্ব অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু এ বাঙালিত্ব বজায় রাখার জন্য একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি, একবার এক অনুষ্ঠানে একজন লোকের সঙ্গে—তাকে বাংলাদেশের মনে হওয়ায়—কথা বলতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বাংলাদেশের? কোন জেলায় বাড়ি?’ তিন-চারবার প্রশ্ন করার পরও কোনো উত্তর পেলাম না। লোকজন অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার, তুমিও বাঙালি, সে-ও বাঙালি অথচ একে অন্যের ভাষা বুঝতে পারছ না?’ আসলে সে সিলেটের বাঙালি। সে আমাদের ভাষা ভালোভাবে জানে না এবং নিজে যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষা আমাদের কাছে অজানা, তাই কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে। এই যে এত পার্থক্য—এসব পার্থক্যের সুযোগ নিয়েছে—আমার মনে হয়, কিছু ধর্মান্ধ মৌলবাদী, যাতে বাংলা ভাষাকে ভাঙা যায়, নষ্ট করা যায়। একটা নতুন ভাষা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধরুন, যদি মসজিদে যান, মসজিদে যে প্রার্থনা হয় তা বাংলায়। যেখানে একদম পরিষ্কারভাবে, ‘হে পরম পিতা!’—এভাবে শুরু করে।...‘আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি; আমাদের প্রিয়জন তোমার কাছে গিয়েছে, বাসা থেকে কেউ যদি বিদেশে যায়, তবে তার চিঠিপত্তর, টেলিফোনে খবর পাওয়া যায়। তিনি আজ যেখানে গেছেন, সেখানে এসব কোনো পথ নেই; কিন্তু আমরা জানি, তিনি তোমার কাছে গেছেন। অতএব, তুমি তাকে ভালো রাখবে...। আমিন!’ এ কথাগুলো অতি পরিষ্কার সিম্পল বাংলা কথা, এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না; অশিক্ষিত লোকও স্পষ্ট বুঝতে পারছে; কিন্তু ‘আমিন’ শব্দটা উচ্চারণ হওয়ামাত্র একটা অন্যরকম গন্ধ এল। আমিন কথাটা খ্রিষ্টানরা বলে। খ্রিষ্টানরা ‘পরম পিতা’ও বলে। কোরআনকে তো পৃথিবীর সব দেশের সব মুসলমান যথাযথ অনুসরণ করে না। আজকের পৃথিবীর সব মুসলমানের...বাংলাদেশের মুসলমানদের আইডিয়াল হচ্ছে ‘আরবি’ এবং আরবের লোকজন। অথচ আরবরা যে বুর্জোয়া জীবনযাপন করেন—মেয়েদের ক্ষেত্রে পার্টিকুলারলি—সেটা মানতে পারেন না ঢাকার মুসলমানরা; কিন্তু এরপরও ওরা আইডিয়াল। আজ যদি তুমি ঢাকা বা ফরিদপুরের রাস্তায় রোজার সময় যাও, তাহলে দেখবে, পর্দা টানিয়ে হোটেলে খাওয়াদাওয়া চলছে। অর্থাৎ পর্দা টানিয়ে দুপুরে খাওয়া যায়। আমার বন্ধুবান্ধব, যাঁরা আমার কাছে রোজার সময় আসছেন, তাঁরা প্রায়ই বলতেন, ভাই, আমি অসুস্থ, রোজা রাখতে পারছি না। কেউ বলতেন, আমি তো এখন পর্যটক! কারও হাঁটুতে ব্যথা, একটা অজুহাত, যেহেতু নামাজ পড়তে পারবে না...এসব অজুহাত বা ছুতো—এগুলো সবই কিন্তু বেরিয়ে আসার চেষ্টা। কিন্তু তারা ভয়ে থাকে, বেরিয়ে আসতে ভয় পায়। ফলে আমাদের সঙ্গে ওদের যে ডিফারেন্স, সেই ডিফারেন্সটা যথেষ্ট বড়। কারণ, আমরা যারা জন্মসূত্রে হিন্দু, তাদের ৮০ ভাগ হিন্দুধর্মের এ-বি-সি-ও পালন করি না। অথচ আমরা হিন্দু। বলতে হয়, তাই হিন্দু। আমাদের ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়ার মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মাচরণ নেই। দুর্গাপূজা এলে আমরা প্ল্যান করি কোথায় বেড়াতে যাব। পুজোর আচার-আচরণের মধ্যে আমরা নেই। আমরা নানা খাবার দিয়ে, বিস্কুট, চাল-ডাল, চকলেট দিয়ে মূর্তি গড়ি, ছেলেখেলার মতো। কালীপূজার সময় আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখি, পটকাবাজির ভয়ে। তাহলে আমরা হিন্দু হলাম কোথায়? আমরা ধর্ম থেকে সরে গেছি আস্তে আস্তে। তবে এ ধর্ম আমাদের কিছু দেয় না, আমাদের থেকে কিছু নেয়ও না। যখন রামকে নিয়ে সারা ভারতে এত হইচই কাণ্ড চলত, তখন আমরা পশ্চিম বাংলার মানুষজন রামকে একবারও দেবতা বলে মনে করি না। আমরা হনুমানকে দেখে ঠাট্টা করি, ‘কলা খাবি’ বলে। কিন্তু হনুমান ওদের কাছে ঈশ্বরের অবতার। ঘটনা যখন এ রকম ঘটে যায়, তখন বাংলাদেশের মুসলমান যারা; যারা সত্যিকার অর্থে কোরআন মানে, ধর্মান্ধ নয়, তারা কিন্তু আমাদের থেকে অনেক ডিসিপ্লিনড। ধর্ম ডিসিপ্লিন তৈরি করতে সাহায্য করে। ধর্ম একত্র করে মানুষকে। কিন্তু সেই একত্র করার মাঝখানে ধর্মান্ধ বা ধর্ম ব্যবসায়ীরা যত গণ্ডগোল পাকায়। ফলে আমাদের মধ্যে ক্রমেই পার্থক্য বাড়ছে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার কি মনে হয়, কয়েক দশক আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে রাজনীতিতে যে রকম মন্দির-মসজিদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, তাতে করে আগামী কয়েক দশক পর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রকম ধর্মরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে?
সমরেশ মজুমদার: আমার তো উল্টো মনে হয়। আমার মনে হয়, ধর্মান্ধ যারা—সে হিন্দু বা মুসলমান হোক, খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা কখনো শুনিনি। যদিও ক্রিশ্চিয়ানিটি পৃথিবীজুড়ে ছিল, কিন্তু আজ অবধি খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা শুনিনি, বৌদ্ধ ধর্মান্ধ শুনিনি।
তাপস কুমার দত্ত: ইউরোপে এককালে খ্রিষ্টানরাই ব্লাসফেমির মতো ঘৃণ্য আইন ধর্মের বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছিল—ওসব কি ধর্মান্ধতা নয়?
সমরেশ মজুমদার: খ্রিষ্টানরা এখন অনেক শ্রেণির হয়ে গেছে, সেখানে তারা একত্র নয়।
তাপস কুমার দত্ত: না, সেটা অন্য ব্যাপার, প্রশ্নটা হলো...
সমরেশ মজুমদার: আমাদের ভারতবর্ষেও তো হিন্দু ধর্ম একেক জায়গায় একেক রকম। আপনি সাউথ বা নর্থ ইন্ডিয়ায় বা অন্য প্রান্তে যে হিন্দু ধর্ম দেখবেন, তা পশ্চিম বাংলায় পাবেন না; এক জায়গার সঙ্গে অন্য জায়গায় ধর্মীয় অমিলই বেশি।
তাপস কুমার দত্ত: প্রশ্নটা তা নয়। একটা ধর্ম সম্প্রদায় নানা খণ্ডে বহু ধারায় বিভক্ত হতেই পারে। কিন্তু যেকোনো ধারারই একটা প্রচ্ছন্ন গোঁড়ামি আছে, মৌলবাদ আছে; আর সেটাই দিন দিন বিশ্বের ওপর বেশি পরিমাণে চেপে বসছে। আপনি কী মনে করেন?
সমরেশ মজুমদার: না, আমি এর সঙ্গে একমত নই। আমার তো মনে হয়, ধর্ম পৃথিবী থেকে আস্তে আস্তে লোপ পেতে চলেছে। এখন যে চিৎকারটা আমরা শুনতে পাচ্ছি—কারণ, ধর্মবাদীরা আতঙ্কগ্রস্ত বলে চিৎকার করছে।
তাপস কুমার দত্ত: প্রথাগত ধর্মে আপনার বিশ্বাস কতটুকু?
সমরেশ মজুমদার: আমি ধর্মে একদম বিশ্বাসী নই।
তাপস কুমার দত্ত: আর বিবাহ প্রথায়?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, বিবাহ প্রথায় বিশ্বাসী। তবে বিয়ে কীভাবে হবে, সেটা নির্ভর করছে যারা বিয়ে করছে, তাদের ওপর।
তাপস কুমার দত্ত: তৃতীয় বিশ্বে বসবাস করার একটা মানসিক যন্ত্রণা আছে। বিশেষ করে, শিল্পী-সাহিত্যিক...যেকোনো সৃজনশীল মানুষের। আপনি তা কতটা অনুভব করেন?
সমরেশ মজুমদার: এটা ভারতবর্ষে, মানে পশ্চিম বাংলায় নেই, আমি কখনো অনুভব করিনি। এটা গুজরাটে থাকতে পারে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার লেখালেখিতে বা ভাবনায় কখনো সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনো প্রতিবন্ধকতা আসেনি বলছেন?
সমরেশ মজুমদার: সিপিএম যখন ক্ষমতায় এল, তখন আমি নকশাল আন্দোলন নিয়ে উপন্যাস লিখলাম—কালবেলা। তো কালবেলার নায়ক অনিমেষ তখন কিন্তু সিপিএমের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। বলেছে, সিপিএম ভ্রষ্টাচারী। আমাকে কিন্তু ও রকমভাবে কোনো সরকার বা শক্তি আপত্তি করেনি।
তাপস কুমার দত্ত: নিজের বিচারে আপনার প্রিয় লেখা কোনটি?
সমরেশ মজুমদার: তিনটি লেখা আমার খুব প্রিয়। সেটা হচ্ছে—‘উত্তরাধিকার’...
তাপস কুমার দত্ত: এ সিরিজটা? অর্থাৎ ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’?
সমরেশ মজুমদার: না, ‘কালবেলা’ আমার প্রিয় নয়। ‘এখনও সময় আছে’ বলে আমার একটা উপন্যাস আছে, আমার ভীষণ প্রিয়। আর গত বছর আমি ‘দেশ’-এ একটা উপন্যাস লিখেছি—‘উৎসারিত আলো’—এ তিনটি।
তাপস কুমার দত্ত: লেখালেখিতে কতটা অসন্তুষ্টি বা অতৃপ্তি রয়ে গেছে?
সমরেশ মজুমদার: প্রতিটি লেখায়ই আমার অসন্তুষ্টি রয়ে যায়। আমার মনে হয়, আবার লিখলে ভালো করতাম। কিন্তু একবার বই আকারে...।

তাপস কুমার দত্ত: সেটা ওই বইটার নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর। আমার জিজ্ঞাসা হলো, এমন কোনো প্রিয় লেখা কি আপনার ভেতরে লালিত আছে, যা এখনো আপনি লিখে উঠতে পারেননি?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এই যে আপনাকে এর আগে যে কথাগুলো বললাম। আমি হুমায়ূন (আহমেদ)-কে বারবার বলেছিলাম, দ্যাখো, তুমি এত জনপ্রিয় একজন লেখক, তোমার এত হাজার হাজার বই বিক্রি হয়, তোমার তো এখন হারানোর কোনো ভয় নেই। তা তুমি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ২০০৪ সালের এই সময়কাল পর্যন্ত কয়েকটা খণ্ডে লেখো না, উপন্যাস আকারে। সে বলল, আমার লিখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সাহস পাই না। আমি অ্যাকসিডেন্টলি আপনাদের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিচিত ছিলাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আমার কাছে এরশাদ খুব কালারফুল চরিত্র। ঘৃণ্য, কিন্তু কালারফুল। কেউ ওর সঙ্গে দেখা করার সাহস পায়নি, যেতে চায়নি; আমি গিয়েছিলাম ওর আমন্ত্রণে। আমার বিপুল অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এটা নিয়ে তিনটি পর্বে ভাগ করে লিখতে আমার খুব ইচ্ছা হয়। ১৯৪৭ থেকে ’৬৯, শেখ মুজিবুর যখন স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, সেই অবধি। এরপর ১৯৬৯ থেকে ’৭১ এবং ’৭১ থেকে এখন অবধি। এ তিনটি পর্বে বাংলাদেশের পটভূমিতে যদি পারি, তো কখনো লিখব। আমি জানি, এ লেখা এই সরকার থাকলে ওখানে যাবে না।...এই যে দ্যাখো, ‘এত রক্ত কেন’ বইটা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে; ঢাকার ফুটপাতে কিন্তু বইটা পাওয়া যায়। তো ব্যান্ড করে লাভটা কী হলো?
তাপস কুমার দত্ত: এ বইটার জন্য বাংলাদেশের একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে ও-দেশে যাওয়ার ভিসা আপনাকে আটকে দেওয়া হয়। এখন যদি এ জাতীয় সমস্যা না থাকে, তা হলেও কি বাংলাদেশে যেতে কোনো আপত্তি থাকবে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি জানি, এ সরকার যদি এটা তুলেও দেয়, তবু সরকারের যারা অনুচর, তারা আমাকে আক্রমণ করবে।
তাপস কুমার দত্ত: অর্থাৎ আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন?
সমরেশ মজুমদার: অফ কোর্স। আমি শেষবার যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, তখন এত রক্ত কেন বেরিয়েছে, কিন্তু ব্যান হয়নি; সেদিন ঢাকায় এয়ারপোর্টে নেমেই বেশ সমস্যায় পড়েছিলাম। আমাকে নিয়ে অফিসাররা হঠাৎ তটস্থ হয়ে উঠলেন, কেন আমি এসেছি? কী উদ্দেশ্যে এসেছি? তো, আমাকে রিসিভ করতে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদ। আমাকে নিয়ে সে সোজা চলে গেল নুহাশ পল্লীতে। ওখানে তিন রাত ছিলাম। এরপর রাতের অন্ধকারে ঢাকায় এলাম।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অন্য কোনো ভয় পাচ্ছিলেন?
সমরেশ মজুমদার: পুলিশ বোধ হয় ভাবছিল, আমাকে অ্যারেস্ট করা উচিত কি উচিত না। একদিন একটা অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে সেখান থেকে সোজা এয়ারপোর্টে। এরপর আমি যখন অনুষ্ঠানে যাওয়ার পরবর্তী আমন্ত্রণ পেলাম, তখন তারা আমাকে ভিসা দিল না।
তাপস কুমার দত্ত: এখন আপনি কী ধরনের বই পড়ছেন?
সমরেশ মজুমদার: কয়েক দিন আগে ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ হুমায়ুন আজাদের বইটা সকাল থেকে পড়তে শুরু করেছিলাম। সেদিনই সকাল ৯টায়—বইটা পড়ছি, হাতে; খবর এল হুমায়ুন আজাদ মারা গেছেন। ওই বইটাতেই একটা জায়গায় লেখা ছিল, যেকোনো দিন তার মৃত্যু হতে পারে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। এ বইটা খুব বড় বা দামি লেখা নয়। খুব আবেগের লেখা, একই কথা বারবার লেখা; কিন্তু কথাগুলো লিখতে সাহস পায়নি তেমন কেউ।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি কি তাঁর আর কোনো উপন্যাস পড়েছেন?
সমরেশ মজুমদার: একটা পড়েছিলাম অনেক আগে, নামটা ভুলে গেছি। দাঁড়াও, নামটা মনে করি...
তাপস কুমার দত্ত: ‘শুভব্রত’, তার সম্পর্কিত সুসমাচার?
সমরেশ মজুমদার: না, আর কয়েকটা নাম বলো তো।
তাপস কুমার দত্ত: ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, সবকিছু ভেঙে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, হ্যাঁ, ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, বইগুলো বেশির ভাগ সময়ই কলকাতায় সহজে পাওয়া যায় না।
তাপস কুমার দত্ত: বয়স তো যথেষ্ট হলো। একদিন চলে যেতে হবে, তার দিনক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে...কোনো আতঙ্ক বা আক্ষেপ?
সমরেশ মজুমদার: না, না। আজ রাতেও চলে যেতে পারি; আবার হয়তো দশ বা কুড়ি বছর পরও যেতে পারি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অবশ্যই দীর্ঘায়ু হবেন, আমি এর দার্শনিক দিকটা জানতে চাচ্ছি।
সমরেশ মজুমদার: আমি খুব বাস্তববাদী মানুষ। আমি আজকে লেখালেখি করে যেটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি, সেটুকু আমার পাওয়ার কথা ছিল না। আমার লেখক হওয়ারই কথা ছিল না।
তাপস কুমার দত্ত: অনেক বছর আগে বাংলাদেশের একটা সাপ্তাহিক কাগজে আপনি বলেছিলেন, এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেবেন।
সমরেশ মজুমদার: ওসব কথা বাড়িয়ে লিখতে ভালোবাসে কিছু সাংবাদিক। যেমন অন্য একটা জায়গায় আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তসলিমার ‘ক’ পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে? আমি এর উত্তরে বলেছিলাম, আমি ‘ক’ পড়েছি এবং আমার মনে হয়েছে, একটা বারবনিতাকে যদি বলা হয়, তোমার আত্মজীবনী লেখ, সে তার অনেক কষ্টের কথা লিখবে; কিন্তু যেসব ক্লায়েন্ট তার কাছে আসে, তাদের বিস্তৃত পরিচয় দেবে না সে, এটুকু সৌজন্য দেখাবে। এ উত্তরটা তারা এভাবে লিখেছে যে, সমরেশ মজুমদার বলেছেন, তসলিমা নাসরিন বেশ্যা। এর উত্তরে তসলিমা লিখলেন আনন্দবাজারে, সমরেশ মজুমদারের গলায় গলা মিলিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, তসলিমা বেশ্যা। এর উত্তরে আমি আবার চিঠি লিখলাম আনন্দবাজারে—কোথায়, কখন বলেছি? কাকে বলেছি? যদি দয়া করে আমাকে জানানো হয়...। অতএব, যদি কোথাও কখনো লেখা হয়ে থাকে, আমি বলেছি এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেব—এগুলো বাজে কথা। হয়তো এভাবে বলেছি, লিখে টাকা পাওয়া যায়, জানতাম না। যখন লিখে টাকা পেতে শুরু করলাম, তখন আমাকে যদি বলা হয়, কেন লেখেন? আমি বলি, টাকার জন্য লিখি।
তাপস কুমার দত্ত: কথাটা এভাবে বলেছিলেন, একজন কৃষক যে কারণে চাষাবাদ করেন, একজন...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম, একজন কৃষক যখন চাষাবাদ করেন, তিনি তো দেশ গড়ার জন্য চাষ করেন না; তিনি তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য চাষাবাদ করেন। একজন মাস্টার যখন পড়ান, তখন মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার চেয়ে তার সন্তানসন্ততিকে বড় করার জন্য পড়ান। তো, একজন লেখকের কী দায় আছে, তিনি দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন? আমাদের দেশে কোনো লেখক যদি জনপ্রিয় হন, তখন ধরেই নেওয়া হয়, ওগুলো ভুসিমাল। যদি সে ধরনের লেখক জনপ্রিয়তা না পান বা বিক্রি না হয়, তখন তিনি একজন বিরাট লেখক। প্রশ্ন হলো, জনপ্রিয়তা যদি কেউ বেশি পান, কেন পান? কারণ, পাঠকদের ভালো লাগছে বলেই। কোনো একটা বই হয়তো বেশি পাঠকের ভালো লেগেছে। এমন নয় যে বছরের পর বছর তিনি জনপ্রিয় হয়ে থাকেন। তা হলে যিনি পাঠককে সহজে স্পর্শ করতে পারছেন না, তার কোথাও খুঁত আছে নিশ্চয়ই। ভালো একটা ছবি তিন দিন সিনেমা হলে থেকে চলে গেল। আর একটা ছবি ‘বাবা কেন চাকর’ মাসের পর মাস চলল, জনপ্রিয় হলো। আবার ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর যখন হাজারটা শো চলে, তখন বলতেই হয়, গুপী গাইন বাঘা বাইন খারাপ ছবি? চার্লি চ্যাপলিন তা হলে খারাপ ছবির নাম? ‘পথের পাঁচালী’ও ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল—ওটাও তা হলে খারাপ ছবি?

তাপস কুমার দত্ত: ধরুন, হাইপোথেটিক্যালি আমরা ধরে নিলাম, কোনো ধনকুবের আপনার যাবতীয় চাহিদার স্পন্সরশিপের দায়িত্ব নিল। একজন কৃষক যে কারণে কৃষিকাজ করেন বা আর দশজন পেশাজীবী মানুষ যে কারণে পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, সেই প্রয়োজনটা আপনার আর রইল না। তখন কি লেখালেখি আপনি ছেড়ে দেবেন?
সমরেশ মজুমদার: চাহিদার কিন্তু শেষ নেই। আগে বাস-ট্রামে চড়তাম, আমার এখন বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। এখনো অবশ্য ইচ্ছা করে মাঝেমধ্যে বাস-ট্রামে উঠি। তো, আগে আমি জলপাইগুড়ি আমার বাড়ি যেতাম সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে, রিজারভেশন ছাড়া। এরপর রিজারভেশনে। এরপর এসি থ্রি-টিয়ার, এরপর এসি টু-টিয়ার। এর মানে এই নয়, আমি এখন এসি টু-টিয়ার ছাড়া যেতে পারব না। কিন্তু যদি কমফোর্ট পাই, তা আমি নেব না কেন?
তাপস কুমার দত্ত: আমি বলতে চাচ্ছি, শুধু ভরণপোষণ আর কমফোর্ট—এসব কারণেই লেখালেখি? ভোগবাদী ব্যাপার ছাড়া তা কি নিজের ভেতর থেকে উঠে আসে না?
সমরেশ মজুমদার: শুনুন, আমাকে যদি এক কোটি টাকা দেওয়া হয় একটা উপন্যাস লেখার জন্য—সাত দিন চেষ্টা করেও লিখে উঠতে পারব না। আবার, আমাকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি, আমি লিখতে বসলাম, হয়তো দুদিনেই লেখাটা শেষ করে ফেলতে পারব।
তাপস কুমার দত্ত: তা হলে লেখালেখিটা শুধু হালচাষির হালচাষের মতো জীবিকা নির্বাহ নয়, আলাদা একটা ভেতরের তাগিদও...
সমরেশ মজুমদার: অবশ্যই।
তাপস কুমার দত্ত: বেশির ভাগ জনপ্রিয় লেখকের লেখায় দেখা যায়, কতগুলো পাগলামোর ঘটনা, কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনা, কিছু সুখকর ঘটনা ও একটু বেদনাদায়ক ঘটনা। যেন ছাঁচে ঢেলে গরম তেলে ভেজে তোলা হট কেক...
সমরেশ মজুমদার: এটা আমার কাছে খুব অস্পষ্ট। ধরুন, আমার একটা বই, ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে এক লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। সেই বইটা কলকাতায় ৫০-৬০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। ধরে নিতে পারি, বইটা জনপ্রিয়।
তাপস কুমার দত্ত: বইটার নাম কী?
সমরেশ মজুমদার: ‘গর্ভধারিণী’। তা ওটা কোন ফর্মুলায় লেখা, বলুন তো?
তাপস কুমার দত্ত: ওই বইটাতে আসলে এমন একটা সাসপেন্স বা থ্রিল এবং এর সঙ্গে আবেগ, বর্তমান সমাজব্যবস্থার কিছু মানুষের অমানবিক নোংরা দিকের প্রতি...।
সমরেশ মজুমদার: এসব তো অনেক বইতেই আছে।
তাপস কুমার দত্ত: হ্যাঁ, তা ঠিক, ‘মেঘ ছিল, ‘বৃষ্টিও’-তেও আছে। ‘আট কুঠুরী নয় দরজা’তেও।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে সেগুলো ওভাবে বিক্রি হয়নি কেন?
তাপস কুমার দত্ত: না, আমি বলছি ‘গর্ভধারিণী’র মতো বিশাল জনপ্রিয়তা না পেলেও ওই লেখাগুলোও বেশ জনপ্রিয়।
সমরেশ মজুমদার: যদি জানতাম, গর্ভধারিণীর মতো ওভাবে সাসপেন্স মেশালে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হবে, তা হলে তো সব বই ওভাবেই লেখা হতো। তা হলে ‘সাতকাহন’ কেন এত বিক্রি হলো? স্ট্রাগল করা মেয়েদের গল্প তো আমি আগেও লিখেছি, পরেও লিখেছি, সেগুলো কেন সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হলো না? আমি যদি আরেকটা দীপাবলীকে নিয়ে লিখি, সেটা কি সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হবেই?
তাপস কুমার দত্ত: সাতকাহনের দ্বিতীয় পর্ব কিন্তু প্রথম পর্বের মতো অত জনপ্রিয় নয়।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে? আসলে আমার কাছে মনে হয়, যেকোনো...আমি আপনাকে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখাটার কথা বললাম, ‘এখনো সময় আছে’ বইটা তিন থেকে চার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। লোকে না পড়লে আমার কষ্ট হয়, আমি তো লোকে লোকে গিয়ে বলতে পারি না, আপনি বইটা পড়ুন। কোত্থেকে ‘কালবেলা’ এক লাখ কপি বিক্রি হলো! ‘উত্তরাধিকার’ বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার। অথচ উত্তরাধিকার ওটার চেয়ে অনেক বেটার উপন্যাস। তাই কোন লেখাটা জনপ্রিয় হবে, তা আগে থেকে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। একটা লেখা জনপ্রিয় হতে পারে। একটা মেমসাহেব, একটা দৃষ্টিপাত, একটা মরুতীর্থ হিংলাজ জনপ্রিয় হতে পারে। কয়েকটা নয়।
তাপস কুমার দত্ত: ওপারের লেখকদের লেখা সম্পর্কে...
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, ওপারের এক নম্বরের সঙ্গে দুই নম্বরের ব্যবধান এত বিস্তর...জাফর ইকবাল সম্প্রতি সেই ব্যবধান একটু কমিয়ে এনেছেন। তো, গতবার যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, তখন একজন লেখক আমাকে এসে বললেন, সমরেশ দা, আপনাকে একটা ভালো খবর দিই।
আমি বললাম, কী?
বলল, আমি এখন তিন নম্বরে।
আমি জানতে চাইলাম, কিসের তিন নম্বর? সে জানাল, জনপ্রিয়তার। তার পেছনে নাকি মিলন চলে গেছে, অমুক-তমুক অনেকে চলে গেছে। আমি হাসব না কাঁদব, ভেবে পাচ্ছিলাম না।
তাপস কুমার দত্ত: কে?
সমরেশ মজুমদার: নামটা নাই-বা বললাম।
তাপস কুমার দত্ত: বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের রুচিবোধ আপনার কতটা উঁচুদরের বলে মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: আপনি যা ইচ্ছা তা-ই লিখে পাঠকদের ভোলাতে পারবেন না। পাঠকদের বিচারশক্তি দারুণ প্রখর। একটা লেখা দিয়ে ভোলাতে পারবেন, পরের দুটোয় হাফ ভোলাতে পারবেন; তৃতীয়টায় আর পারবেন না।
তাপস কুমার দত্ত: পাঠকেরা আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমাকে তেমন প্রভাবিত করতে পারে না। তবে কিছু কিছু ঘটনায় মাঝেমধ্যে কষ্ট হয়। একবার বইমেলায় এক ভদ্রমহিলা তিনখানা (বড় ক্যানভাসের) বই বইতে পারছিলেন না, চেহারা দেখে বোঝা যায়, যথেষ্ট (আর্থিক) অসচ্ছল পরিবার। আমি বললাম, আপনি কী করেন?
তিনি বললেন, আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়াই।
আমার খুব খারাপ লাগল, আপনি এত দামি তিনটি বই কিনলেন?
তিনি বললেন, সারা বছর আমরা অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছি।
এরপর দেখলাম, দূরে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। ক্রাচ হাতে, একটা পা ডিফেক্টেড। ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে যেতেই তিনি বললেন, আমি আপনার অনিমেষ।
আমি বললাম, তার মানে?
তিনি জানালেন, তিনি নকশাল আন্দোলন করতেন এবং হাওড়া জেলে পুলিশের অত্যাচারে একটা পা নষ্ট হয়ে (অনিমেষের মতোই) গেছে। আমরা একসঙ্গে থাকি। (অনিমেষ-মাধবীলতার মতো), আমরা বিয়ে করিনি।
আরেকটা ঘটনা বলে শেষ করি—হ্যাঁ, একবার বিদেশে রাতে আমার খুব খিদে পেয়েছে, একটা বড় রেস্টুরেন্ট দেখে ভেতরে ঢুকে পড়ি। এরপর মেনু কার্ডের সবচেয়ে ছোট আইটেম যেটা, সেটার অর্ডার দিলাম। বেয়ারাগুলোকে দেখে মনে হলো এশিয়ান। তো, একটা বেয়ারা এসে বলল, স্যার! আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?
আমি বললাম, ইয়েস।
স্যার! আর ইউ ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল?
আমি আবার বললাম, ইয়েস।
বেয়ারা গিয়ে হোটেল মালিককে তথ্যগুলো জানাতেই হোটেল মালিক উঠে এসে বললেন, নমস্কার স্যার! আপনি বোধ হয় সমরেশ বাবু। আমি আপনার একটাই মাত্র বই পড়েছি। একবার একটা বাস টার্মিনালে দেখলাম একটা বই পড়ে আছে—বাংলা বই, নামটা ‘দৌড়’।
এরপর যতই বলছি, আমার খাওয়া হয়ে গেছে, তবু তিনি আমাকে জোর করে খাওয়াবেন। বিল দিতে গেলাম, বিল নিলেন না। এই অবধি ঠিক আছে। বেয়ারা এরপর বলল, সাহেব, একবার ভেতরে আসবেন? আপায় কইছিল, আপনি সমরেশ মজুমদার কি না জিজ্ঞেস করতে। তো, আমি ভেতরে ঢুকলাম। একজন ভদ্রমহিলা খাটের ওপর বসে নমস্কার জানিয়ে আমার দিকে একটা বই এগিয়ে দিলেন—‘গর্ভধারিণী’। আমার পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। দেখুন, কারোর জানার কথা নয়, আমি ওখানে যাব। কাকতালীয়ভাবে।
তাপস কুমার দত্ত: একবার কবি সম্মেলনে আপনাকে দেশের বাইরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল—কবি হিসেবে, ভুল করে। ঠিক এ রকমই একটা ঘটনার কথা...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আপনি সবই জানেন দেখছি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি বই বাজেয়াপ্ত করাটা কতটা সমর্থন করেন?
সমরেশ মজুমদার: যে কারণে তসলিমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, সেটাকে আমি সমর্থন করি না। তবে আমার হাতে আইন থাকলে তসলিমাকে অভিযুক্ত করতাম। আজ একটা ছেলের সঙ্গে একটা মেয়ের ভালো সম্পর্ক; সম্পর্কটা দুজনকেই আনন্দিত করছে। যদি ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো তিক্ততা আসে, আজকের এ আনন্দটা কিন্তু মিথ্যা হয়ে যাবে না এবং সেই ছেলেটা ও মেয়েটার কোনো রাইট নেই ভবিষ্যতে এই আনন্দিত সম্পর্ককে নিয়ে খোলামেলা...ব্যঙ্গ করে লেখা বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে লেখা। যে ক্ষেত্রে তারা একে অন্যকে ছোট ও অপমান করছে। মিলনের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গিয়ে কী হয়েছে বা অমুকের সঙ্গে অমুকের আর কী হয়েছে—এর ডিটেইলস নিয়ে আমরা আদৌ আগ্রহী নই। আমরা তসলিমার ব্যাপারে এখানেই আগ্রহী যে সে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কী লড়াই করেছিল। তা না করে তার শারীরিক আনন্দের বিবরণ দিয়ে লিখছে—এটা এক ধরনের অসুখ। আমি জানি, আমার বাবা-মায়ের মিলনের ফলে আমি পৃথিবীতে এসেছি; এখন সেই মিলনটা কী রকম ছিল, তার বিবরণ দিয়ে যদি লিখতে যাই, তো আমার জন্মটাকেই আমি সবচেয়ে বেশি কুৎসিত করছি। আমার জন্মের বিবরণের জন্য আমার বাবা-মায়ের শয্যা বিবরণ কি আমি দিতে পারি? নাকি তা আমি ভাবতে চাই? বা ভাবতে পারি?
তাপস কুমার দত্ত: আপনি আপনার খোলামেলা বা বিতর্কিত ভাবনা প্রকাশ করতে কতটা ভয় পান?
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, এ মুহূর্তে বোধ হয় আমিই সবচেয়ে সরাসরি লিখি। ‘পত্রপাঠ’ বলে একটা পত্রিকা আছে, মাসে বেরোয়—সেটায় আমি কলাম লিখি। সেখানে সরাসরি সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে লিখি। একজন কলেজ অধ্যাপককে পুলিশ অ্যারেস্ট করে—জনযুদ্ধগোষ্ঠীর ডায়েরি থেকে নাম পেয়ে তাকে অ্যারেস্ট করে। সারা দিন অত্যাচার করে সন্ধ্যায় তাকে ছেড়ে দেয়। এলাকার লোকজন মনে করে, সে জনযুদ্ধগোষ্ঠীর লোক। সে রেললাইনে আত্মহত্যা করে, তার স্ত্রী এ নিয়ে কেস করে। এ ঘটনা নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। আমি এ-ও লিখেছিলাম, কয়েক দিন আগে ভোটের সময় একজন সাংবাদিক একটা গ্রামে গেছেন। সেখানে এক চায়ের দোকানে নানা আলোচনায় উঠে আসে, আমাদের দেশে যত মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই অবিবাহিত। বিবাহিত ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়, জ্যোতিবাবু। সিদ্ধার্থবাবু, জ্যোতিবাবু কখনো বাজারে যাননি। বুদ্ধবাবু রিকশায় চাপেন, বাজারে যান। আর নামটা দেখুন, বুদ্ধদেব।...বিধানচন্দ্র, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থ হচ্ছে সংসারী নাম।...এ রকম নাম যার, তাকে আমরা ভোট দেব না, তো অন্য লোককে ভোট দেব? সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কেমন আছেন? ওরা বলল, এই যে রাস্তাটা দেখছেন, এর নাম সুচেতনা (‘সুচেতনা’ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মেয়ের নাম)। আমাদের এখানে একটা ভাটিখানা আছে, খুব মারপিট চলত আগে, মদ খেতে খেতে। আমরা সেটার নাম দিয়েছি সুচেতনা...বাংলা বারের প্রতিশব্দ আর কি। ওখানে মদ খেয়ে এখন আর কেউ চেতনা হারাচ্ছে না। ফলে বুঝতেই পারছেন, আমরা সবই বুদ্ধবাবুর লোক। এ গল্পটা বের হওয়ার পর বুদ্ধবাবু আমায় বললেন, আমাকে নিয়ে লিখলেন, ঠিক আছে; আমার মেয়েকে জড়ালেন কেন? আমি বললাম, ‘হাওড়ার একটা লাইব্রেরি উদ্বোধন করতে তোমার মেয়ে আর তোমার স্ত্রী গিয়েছিলেন, লাইব্রেরিটার নাম রাখা হয়েছে সুচেতনা পাঠাগার। তোমার মেয়ে এখনই এমন কী যোগ্যতা অর্জন করেছে যে তার নামে একটা পাঠাগার রাখা হবে? যেহেতু সে তোমার মেয়ে, তাই রাখা হয়েছে।’ এখন, আপনি কী মনে করেন না, এর চেয়ে সরাসরি আক্রমণ করে লেখা—আর বড়াই করে বলি, আমাদের কোনো লেখকই লিখছেন না। লিখতে পারেন, কিন্তু লিখছেন না।
তাপস কুমার দত্ত: এত সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সমরেশ মজুমদার: থ্যাঙ্ক ইউ।

উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দত্ত। এই লেখক সদ্য গত হয়েছেন। আর তাই সাক্ষাৎকারগ্রহীতা ও বন্ধ সাপ্তাহিকটির তখনকার নির্বাহী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকারের সম্মতিক্রমে আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।
তাপস কুমার দত্ত: ওপার বাংলার বাঙালিদের সঙ্গে এপার বাংলার বাঙালিদের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যে পার্থক্য, সেটা যত দিন যাচ্ছে ততই কি দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: দুটো ঘটনা ঘটেছে এখানে, সেটা হচ্ছে—১৯৪৭ সালের আগে যে বাংলা, একত্র দুই বাংলা, যেখানের হিন্দু আর বাঙালিরা ছিল সম্পূর্ণ কলকাতামুখী। মুসলমান বাঙালিদের মধ্যে দুটো শ্রেণি ছিল—একটা শ্রেণি অত্যন্ত সংখ্যালঘিষ্ঠ, শিক্ষিত লোক এবং বেশির ভাগই ছিল অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মুসলমান। এ অল্প ও অশিক্ষিত মুসলমানদের ওপর স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিরা ডমিনেট করল। ফলে যখন দেশ ভাগ হলো, তখন অল্পশিক্ষিত অশিক্ষিত মুসলমানেরা উল্লসিত হলো, কারণ, শিক্ষিত বাঙালিরা ভয় পেল, দু-একটা জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলো। আমি বাংলাদেশের অনেক জেলার কথা জানি, যেখানে আজ অবধি কোনো মানুষ খুন হয়নি দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে। যেমন ধরুন, রংপুর। সেখানে আজ অবধি কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘাত না ঘটা সত্ত্বেও রংপুর থেকে অনেক মানুষ চলে এসেছে ভারতবর্ষে। তখন এ রকম একটা প্রচারণা এসেছিল—পূর্ব পাকিস্তান মুসলমানদের জায়গা। অতএব, হিন্দুরা সেখানে থাকলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। তাই ছোটো ইন্ডিয়া। সেই ছোটার কাহিনিটা গত ৫৫ বছরের। সেই ছোটার কাহিনিতে অনেক মানুষ একেবারে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে তলিয়ে গেছে। আবার অনেক মানুষ সংগ্রাম করে করে ওপরে উঠেছে।...
তাপস কুমার দত্ত: এরপর থেকেও তো অনেক সংখ্যালঘু ওপারে চলে গেছে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এপার থেকেও গেছে, তবে তা আনুপাতিক হারে যথেষ্ট কম। যা বলছিলাম, এ ৫৫ বছরে যদি কেউ লাভবান হয়ে থাকে, আমি এপার বাংলার কথা বলছি—তা হলে হয়েছে পশ্চিম বাংলার মেয়েরা। এই যারা পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিল—সংগ্রাম করেছে, কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে, বস্তি বা কলোনিতে কোনোক্রমে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে; তাদের দেখাদেখি পশ্চিম বাংলার কনজারভেটিভ পরিবার—যারা মেয়েদের অন্দরমহলে ফেলে রেখেছিল এবং অফিস-কাছারিতে যাওয়া তো স্বপ্নের বাইরে ছিল। যখন পূর্ববঙ্গের মেয়েরা জীবনসংগ্রামের বাধ্যবাধকতায় গ্র্যাজুয়েশন করে স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন অফিসে চাকরিতে ঢুকল; তখন এখানকার মেয়েরা উৎসাহিত হলো। আমরা যখন কলেজে পড়তাম; সন্ধ্যা ৬টার পর ট্রামে-বাসে কোনো মেয়েকে দেখা যেত না; যদি কোনো মেয়েকে দেখা যেত তা হলে সে নিশ্চয়ই বাঙাল (পূর্ববঙ্গীয়) হতো। কিন্তু এ পশ্চাৎপট একদম পাল্টে গেল ১৯৬৮ সালের পর থেকে। তখন বাস্তবিক নিষ্পেষণে পশ্চিম বাংলার মেয়েরাও বেরোতে শুরু করল, যেটা বলতে গিয়ে সরে এসেছি—সেটা হলো, এই দেশবিভাগ এবং এ দেশে উদ্বাস্তু স্রোত আসার অনেক খারাপ দিকের এই একটা ভালো দিক, আমাদের মেয়েরা অর্গল ভেঙে বেরোতে পেরেছিল। কিন্তু ওখানে (বাংলাদেশে) যারা রয়ে গেল (হিন্দু সম্প্রদায়) তাদেরও, আমরা দেখেছি, কেউ ১৯৬৭, কেউ ১৯৭০, কেউ ১৯৭৬-এ চলে আসতে লাগল।
তাপস কুমার দত্ত: এখনো কি অল্পবিস্তর চলে আসছে?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এখনো আসছে এবং এদের একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে এরা আওয়ামীপন্থী ছিল। অর্থাৎ এ দলটির কাছে ওরা নিরাপদ বোধ করত।
তাপস কুমার দত্ত: দেশভাগের পর ওপার বাংলার কী কী বিশেষ পরিবর্তন আপনার কাছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়েছে?
সমরেশ মজুমদার: ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এ ২৪ বছরে বাঙালির জীবনে পূর্ববঙ্গে একটা জিনিসেরই আমদানি ঘটেছে, সেটা হলো ইসলাম এবং ইসলামকেন্দ্রিক আরবি-ফারসি শব্দ। ওই সময় যাঁরা লেখালেখি করতেন, যেমন ধরুন—শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস—এঁরা যে বাংলা লিখতেন, তা ছিল পশ্চিম বাংলার বাংলা; অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারকৃত বাংলা। এঁরা বাংলার প্রাচীন সাহিত্য এবং রামায়ণ-মহাভারত ও আরও সব পৌরাণিক...প্রাচ্য ও পশ্চিমের সাহিত্যের ওপর ভালো দখল রাখতেন এবং সেটা তাঁদের ভেতরে লালন করতেন। ১৯৭১ সালের পর একটা আবেগ এল, আবেগের সঙ্গে ভয় এল। ভয়টা এই—আমরা এত দিন উনুনে পুড়ছিলাম, উনুন থেকে লাফিয়ে গরম তেলে পড়লাম না তো? অর্থাৎ আমরা পাকিস্তানের অত্যাচারে জর্জরিত হচ্ছিলাম, এখন ভারত বড়দাদার মতো দাদাগিরি করবে না তো? আমাদের দখল করবে না তো? তার কিছু কিছু ইন্ধন—আপনারা জানেন—ভারত যে সম্পূর্ণ বৈষ্ণব হয়ে ছিল তা নয়, ভারতের তরফ থেকে যারা দু-একটা বদমায়েশি কাজ করেছে, সেসব বাংলাদেশের কাছে প্রবল হয়ে ধরা দিল। ১৯৭১ সালের ওই আবেগ যখন কমতে শুরু করল, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর ওখানকার রাজনৈতিক দলগুলো জনসাধারণকে সস্তা পথে পাওয়ার জন্য অ্যান্টি-ভারত আবহাওয়া তৈরি করল এবং সেটা তাদের ভোট অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়কও হলো। এ সময় থেকে আমরা দেখতে শুরু করলাম, বাংলা সাহিত্যে যা লেখালেখি হচ্ছে, খবরের কাগজে রিপোর্টিংয়ে যে বাংলায় লেখালেখি হচ্ছে, সেখানে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। এর একটা উদাহরণ হলো জিম্মা। এ ‘জিম্মা’ শব্দটা আগে ওপার-এপার, কোনো বাংলায়ই ব্যবহৃত হতো না। যেমন খাবারটা খেয়ে দারুণ ‘মজা’ লাগল। এ ‘মজা’ শব্দটা হলো রসে-বসে আনন্দে আছি। তা খাবারটা খেয়ে ‘মজা’ লাগবে কেন আমার? খাবারটা খেয়ে আমার দারুণ ভালো লাগবে, অথবা আমি খুব আনন্দ পেলাম খেয়ে। কিন্তু ‘মজা’ লাগা বলতে কোথাও যেন একটু কৌতুক মেশানো থাকে। এ ধরনের কিছু শব্দ তৈরি হতে লাগল। এসব সচেতনভাবে তৈরি হতে লাগল, যাতে পশ্চিম বাংলার ভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষা আস্তে আস্তে একটু একটু করে আলাদা হতে থাকে। আবার, আমরা দেখতে পাই, ১৯৬০ বা ’৬৫ সাল অবধি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের আগ অবধি যেকোনো মুসলিম পরিবারে আরবি বা ফারসি নাম দেওয়া হতো। কিন্তু এর পর থেকে দেখা গেল তাদের নামের পাশে ব্র্যাকেট করে একটা ডাকনাম দেওয়া হলো। ১৯৪০-৫০ সালের দিকে কোনো মুসলমানের ডাকনামের তেমন প্রচলন ছিল না। ক্রমে এ ডাকনামই তার হাইলাইটস পেত বেশি, আসল নামটা আড়ালে থাকত। যেমন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। আমরা সবাই জানি ‘বন্যা’। এটা কিন্তু পাশাপাশি সচেতনভাবে বাঙালিত্ব ধরে রাখার প্রচেষ্টা। এর পরবর্তী প্রজন্ম, সত্তরের দশক থেকে যে প্রজন্ম শুরু হলো—তারা আরও অদ্ভুত হলো। তাদের আবার নাম হয়তো আবুল হায়াত, মেয়ের নাম বিপাশা হায়াত বা সুবর্ণা মুস্তাফা। হায়াত বা মুস্তাফা তার পারিবারিক পদবি কিন্তু নামটা বাংলা শব্দ। অর্থাৎ আগে যেটা ব্র্যাকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেটা এখন নামের সাইনবোর্ডে এসে প্রকাশ হলো। পাশাপাশি আরও একটা অদ্ভুত ছবি আছে; ছবিটা হলো—চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মানুষ, ধরুন একজন মা; তার ছেলে হয়তো ঢাকায় চাকরি করে। তিনি যখন তার ছেলেকে চিঠি লিখছেন, তখন চট্টগ্রামের ভাষায় লিখছেন না। তিনি বইয়ের ভাষায় চিঠি লিখছেন এবং ছেলেও তা-ই করছে। কিন্তু ছেলে আর মায়ের যখন পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয়, তখন কিন্তু তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলেন, যা ঢাকার লোক বুঝবে না। তা হলে চিঠিতে কেন বাংলা বর্ণমালায় চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার করছে না? এ নিয়ে আমার নিজস্ব অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু এ বাঙালিত্ব বজায় রাখার জন্য একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছি, একবার এক অনুষ্ঠানে একজন লোকের সঙ্গে—তাকে বাংলাদেশের মনে হওয়ায়—কথা বলতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বাংলাদেশের? কোন জেলায় বাড়ি?’ তিন-চারবার প্রশ্ন করার পরও কোনো উত্তর পেলাম না। লোকজন অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার, তুমিও বাঙালি, সে-ও বাঙালি অথচ একে অন্যের ভাষা বুঝতে পারছ না?’ আসলে সে সিলেটের বাঙালি। সে আমাদের ভাষা ভালোভাবে জানে না এবং নিজে যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষা আমাদের কাছে অজানা, তাই কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে। এই যে এত পার্থক্য—এসব পার্থক্যের সুযোগ নিয়েছে—আমার মনে হয়, কিছু ধর্মান্ধ মৌলবাদী, যাতে বাংলা ভাষাকে ভাঙা যায়, নষ্ট করা যায়। একটা নতুন ভাষা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ধরুন, যদি মসজিদে যান, মসজিদে যে প্রার্থনা হয় তা বাংলায়। যেখানে একদম পরিষ্কারভাবে, ‘হে পরম পিতা!’—এভাবে শুরু করে।...‘আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি; আমাদের প্রিয়জন তোমার কাছে গিয়েছে, বাসা থেকে কেউ যদি বিদেশে যায়, তবে তার চিঠিপত্তর, টেলিফোনে খবর পাওয়া যায়। তিনি আজ যেখানে গেছেন, সেখানে এসব কোনো পথ নেই; কিন্তু আমরা জানি, তিনি তোমার কাছে গেছেন। অতএব, তুমি তাকে ভালো রাখবে...। আমিন!’ এ কথাগুলো অতি পরিষ্কার সিম্পল বাংলা কথা, এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না; অশিক্ষিত লোকও স্পষ্ট বুঝতে পারছে; কিন্তু ‘আমিন’ শব্দটা উচ্চারণ হওয়ামাত্র একটা অন্যরকম গন্ধ এল। আমিন কথাটা খ্রিষ্টানরা বলে। খ্রিষ্টানরা ‘পরম পিতা’ও বলে। কোরআনকে তো পৃথিবীর সব দেশের সব মুসলমান যথাযথ অনুসরণ করে না। আজকের পৃথিবীর সব মুসলমানের...বাংলাদেশের মুসলমানদের আইডিয়াল হচ্ছে ‘আরবি’ এবং আরবের লোকজন। অথচ আরবরা যে বুর্জোয়া জীবনযাপন করেন—মেয়েদের ক্ষেত্রে পার্টিকুলারলি—সেটা মানতে পারেন না ঢাকার মুসলমানরা; কিন্তু এরপরও ওরা আইডিয়াল। আজ যদি তুমি ঢাকা বা ফরিদপুরের রাস্তায় রোজার সময় যাও, তাহলে দেখবে, পর্দা টানিয়ে হোটেলে খাওয়াদাওয়া চলছে। অর্থাৎ পর্দা টানিয়ে দুপুরে খাওয়া যায়। আমার বন্ধুবান্ধব, যাঁরা আমার কাছে রোজার সময় আসছেন, তাঁরা প্রায়ই বলতেন, ভাই, আমি অসুস্থ, রোজা রাখতে পারছি না। কেউ বলতেন, আমি তো এখন পর্যটক! কারও হাঁটুতে ব্যথা, একটা অজুহাত, যেহেতু নামাজ পড়তে পারবে না...এসব অজুহাত বা ছুতো—এগুলো সবই কিন্তু বেরিয়ে আসার চেষ্টা। কিন্তু তারা ভয়ে থাকে, বেরিয়ে আসতে ভয় পায়। ফলে আমাদের সঙ্গে ওদের যে ডিফারেন্স, সেই ডিফারেন্সটা যথেষ্ট বড়। কারণ, আমরা যারা জন্মসূত্রে হিন্দু, তাদের ৮০ ভাগ হিন্দুধর্মের এ-বি-সি-ও পালন করি না। অথচ আমরা হিন্দু। বলতে হয়, তাই হিন্দু। আমাদের ঘুম থেকে উঠে ঘুমোতে যাওয়ার মধ্যে কোনো প্রকার ধর্মাচরণ নেই। দুর্গাপূজা এলে আমরা প্ল্যান করি কোথায় বেড়াতে যাব। পুজোর আচার-আচরণের মধ্যে আমরা নেই। আমরা নানা খাবার দিয়ে, বিস্কুট, চাল-ডাল, চকলেট দিয়ে মূর্তি গড়ি, ছেলেখেলার মতো। কালীপূজার সময় আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখি, পটকাবাজির ভয়ে। তাহলে আমরা হিন্দু হলাম কোথায়? আমরা ধর্ম থেকে সরে গেছি আস্তে আস্তে। তবে এ ধর্ম আমাদের কিছু দেয় না, আমাদের থেকে কিছু নেয়ও না। যখন রামকে নিয়ে সারা ভারতে এত হইচই কাণ্ড চলত, তখন আমরা পশ্চিম বাংলার মানুষজন রামকে একবারও দেবতা বলে মনে করি না। আমরা হনুমানকে দেখে ঠাট্টা করি, ‘কলা খাবি’ বলে। কিন্তু হনুমান ওদের কাছে ঈশ্বরের অবতার। ঘটনা যখন এ রকম ঘটে যায়, তখন বাংলাদেশের মুসলমান যারা; যারা সত্যিকার অর্থে কোরআন মানে, ধর্মান্ধ নয়, তারা কিন্তু আমাদের থেকে অনেক ডিসিপ্লিনড। ধর্ম ডিসিপ্লিন তৈরি করতে সাহায্য করে। ধর্ম একত্র করে মানুষকে। কিন্তু সেই একত্র করার মাঝখানে ধর্মান্ধ বা ধর্ম ব্যবসায়ীরা যত গণ্ডগোল পাকায়। ফলে আমাদের মধ্যে ক্রমেই পার্থক্য বাড়ছে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার কি মনে হয়, কয়েক দশক আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে রাজনীতিতে যে রকম মন্দির-মসজিদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, তাতে করে আগামী কয়েক দশক পর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রকম ধর্মরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে?
সমরেশ মজুমদার: আমার তো উল্টো মনে হয়। আমার মনে হয়, ধর্মান্ধ যারা—সে হিন্দু বা মুসলমান হোক, খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা কখনো শুনিনি। যদিও ক্রিশ্চিয়ানিটি পৃথিবীজুড়ে ছিল, কিন্তু আজ অবধি খ্রিষ্টান ধর্মান্ধ কথাটা শুনিনি, বৌদ্ধ ধর্মান্ধ শুনিনি।
তাপস কুমার দত্ত: ইউরোপে এককালে খ্রিষ্টানরাই ব্লাসফেমির মতো ঘৃণ্য আইন ধর্মের বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছিল—ওসব কি ধর্মান্ধতা নয়?
সমরেশ মজুমদার: খ্রিষ্টানরা এখন অনেক শ্রেণির হয়ে গেছে, সেখানে তারা একত্র নয়।
তাপস কুমার দত্ত: না, সেটা অন্য ব্যাপার, প্রশ্নটা হলো...
সমরেশ মজুমদার: আমাদের ভারতবর্ষেও তো হিন্দু ধর্ম একেক জায়গায় একেক রকম। আপনি সাউথ বা নর্থ ইন্ডিয়ায় বা অন্য প্রান্তে যে হিন্দু ধর্ম দেখবেন, তা পশ্চিম বাংলায় পাবেন না; এক জায়গার সঙ্গে অন্য জায়গায় ধর্মীয় অমিলই বেশি।
তাপস কুমার দত্ত: প্রশ্নটা তা নয়। একটা ধর্ম সম্প্রদায় নানা খণ্ডে বহু ধারায় বিভক্ত হতেই পারে। কিন্তু যেকোনো ধারারই একটা প্রচ্ছন্ন গোঁড়ামি আছে, মৌলবাদ আছে; আর সেটাই দিন দিন বিশ্বের ওপর বেশি পরিমাণে চেপে বসছে। আপনি কী মনে করেন?
সমরেশ মজুমদার: না, আমি এর সঙ্গে একমত নই। আমার তো মনে হয়, ধর্ম পৃথিবী থেকে আস্তে আস্তে লোপ পেতে চলেছে। এখন যে চিৎকারটা আমরা শুনতে পাচ্ছি—কারণ, ধর্মবাদীরা আতঙ্কগ্রস্ত বলে চিৎকার করছে।
তাপস কুমার দত্ত: প্রথাগত ধর্মে আপনার বিশ্বাস কতটুকু?
সমরেশ মজুমদার: আমি ধর্মে একদম বিশ্বাসী নই।
তাপস কুমার দত্ত: আর বিবাহ প্রথায়?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, বিবাহ প্রথায় বিশ্বাসী। তবে বিয়ে কীভাবে হবে, সেটা নির্ভর করছে যারা বিয়ে করছে, তাদের ওপর।
তাপস কুমার দত্ত: তৃতীয় বিশ্বে বসবাস করার একটা মানসিক যন্ত্রণা আছে। বিশেষ করে, শিল্পী-সাহিত্যিক...যেকোনো সৃজনশীল মানুষের। আপনি তা কতটা অনুভব করেন?
সমরেশ মজুমদার: এটা ভারতবর্ষে, মানে পশ্চিম বাংলায় নেই, আমি কখনো অনুভব করিনি। এটা গুজরাটে থাকতে পারে।
তাপস কুমার দত্ত: আপনার লেখালেখিতে বা ভাবনায় কখনো সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনো প্রতিবন্ধকতা আসেনি বলছেন?
সমরেশ মজুমদার: সিপিএম যখন ক্ষমতায় এল, তখন আমি নকশাল আন্দোলন নিয়ে উপন্যাস লিখলাম—কালবেলা। তো কালবেলার নায়ক অনিমেষ তখন কিন্তু সিপিএমের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। বলেছে, সিপিএম ভ্রষ্টাচারী। আমাকে কিন্তু ও রকমভাবে কোনো সরকার বা শক্তি আপত্তি করেনি।
তাপস কুমার দত্ত: নিজের বিচারে আপনার প্রিয় লেখা কোনটি?
সমরেশ মজুমদার: তিনটি লেখা আমার খুব প্রিয়। সেটা হচ্ছে—‘উত্তরাধিকার’...
তাপস কুমার দত্ত: এ সিরিজটা? অর্থাৎ ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’?
সমরেশ মজুমদার: না, ‘কালবেলা’ আমার প্রিয় নয়। ‘এখনও সময় আছে’ বলে আমার একটা উপন্যাস আছে, আমার ভীষণ প্রিয়। আর গত বছর আমি ‘দেশ’-এ একটা উপন্যাস লিখেছি—‘উৎসারিত আলো’—এ তিনটি।
তাপস কুমার দত্ত: লেখালেখিতে কতটা অসন্তুষ্টি বা অতৃপ্তি রয়ে গেছে?
সমরেশ মজুমদার: প্রতিটি লেখায়ই আমার অসন্তুষ্টি রয়ে যায়। আমার মনে হয়, আবার লিখলে ভালো করতাম। কিন্তু একবার বই আকারে...।

তাপস কুমার দত্ত: সেটা ওই বইটার নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর। আমার জিজ্ঞাসা হলো, এমন কোনো প্রিয় লেখা কি আপনার ভেতরে লালিত আছে, যা এখনো আপনি লিখে উঠতে পারেননি?
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ। এই যে আপনাকে এর আগে যে কথাগুলো বললাম। আমি হুমায়ূন (আহমেদ)-কে বারবার বলেছিলাম, দ্যাখো, তুমি এত জনপ্রিয় একজন লেখক, তোমার এত হাজার হাজার বই বিক্রি হয়, তোমার তো এখন হারানোর কোনো ভয় নেই। তা তুমি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ২০০৪ সালের এই সময়কাল পর্যন্ত কয়েকটা খণ্ডে লেখো না, উপন্যাস আকারে। সে বলল, আমার লিখতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সাহস পাই না। আমি অ্যাকসিডেন্টলি আপনাদের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিচিত ছিলাম। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আমার কাছে এরশাদ খুব কালারফুল চরিত্র। ঘৃণ্য, কিন্তু কালারফুল। কেউ ওর সঙ্গে দেখা করার সাহস পায়নি, যেতে চায়নি; আমি গিয়েছিলাম ওর আমন্ত্রণে। আমার বিপুল অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এটা নিয়ে তিনটি পর্বে ভাগ করে লিখতে আমার খুব ইচ্ছা হয়। ১৯৪৭ থেকে ’৬৯, শেখ মুজিবুর যখন স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, সেই অবধি। এরপর ১৯৬৯ থেকে ’৭১ এবং ’৭১ থেকে এখন অবধি। এ তিনটি পর্বে বাংলাদেশের পটভূমিতে যদি পারি, তো কখনো লিখব। আমি জানি, এ লেখা এই সরকার থাকলে ওখানে যাবে না।...এই যে দ্যাখো, ‘এত রক্ত কেন’ বইটা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে; ঢাকার ফুটপাতে কিন্তু বইটা পাওয়া যায়। তো ব্যান্ড করে লাভটা কী হলো?
তাপস কুমার দত্ত: এ বইটার জন্য বাংলাদেশের একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে ও-দেশে যাওয়ার ভিসা আপনাকে আটকে দেওয়া হয়। এখন যদি এ জাতীয় সমস্যা না থাকে, তা হলেও কি বাংলাদেশে যেতে কোনো আপত্তি থাকবে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি জানি, এ সরকার যদি এটা তুলেও দেয়, তবু সরকারের যারা অনুচর, তারা আমাকে আক্রমণ করবে।
তাপস কুমার দত্ত: অর্থাৎ আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন?
সমরেশ মজুমদার: অফ কোর্স। আমি শেষবার যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, তখন এত রক্ত কেন বেরিয়েছে, কিন্তু ব্যান হয়নি; সেদিন ঢাকায় এয়ারপোর্টে নেমেই বেশ সমস্যায় পড়েছিলাম। আমাকে নিয়ে অফিসাররা হঠাৎ তটস্থ হয়ে উঠলেন, কেন আমি এসেছি? কী উদ্দেশ্যে এসেছি? তো, আমাকে রিসিভ করতে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদ। আমাকে নিয়ে সে সোজা চলে গেল নুহাশ পল্লীতে। ওখানে তিন রাত ছিলাম। এরপর রাতের অন্ধকারে ঢাকায় এলাম।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অন্য কোনো ভয় পাচ্ছিলেন?
সমরেশ মজুমদার: পুলিশ বোধ হয় ভাবছিল, আমাকে অ্যারেস্ট করা উচিত কি উচিত না। একদিন একটা অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে সেখান থেকে সোজা এয়ারপোর্টে। এরপর আমি যখন অনুষ্ঠানে যাওয়ার পরবর্তী আমন্ত্রণ পেলাম, তখন তারা আমাকে ভিসা দিল না।
তাপস কুমার দত্ত: এখন আপনি কী ধরনের বই পড়ছেন?
সমরেশ মজুমদার: কয়েক দিন আগে ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ হুমায়ুন আজাদের বইটা সকাল থেকে পড়তে শুরু করেছিলাম। সেদিনই সকাল ৯টায়—বইটা পড়ছি, হাতে; খবর এল হুমায়ুন আজাদ মারা গেছেন। ওই বইটাতেই একটা জায়গায় লেখা ছিল, যেকোনো দিন তার মৃত্যু হতে পারে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম। এ বইটা খুব বড় বা দামি লেখা নয়। খুব আবেগের লেখা, একই কথা বারবার লেখা; কিন্তু কথাগুলো লিখতে সাহস পায়নি তেমন কেউ।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি কি তাঁর আর কোনো উপন্যাস পড়েছেন?
সমরেশ মজুমদার: একটা পড়েছিলাম অনেক আগে, নামটা ভুলে গেছি। দাঁড়াও, নামটা মনে করি...
তাপস কুমার দত্ত: ‘শুভব্রত’, তার সম্পর্কিত সুসমাচার?
সমরেশ মজুমদার: না, আর কয়েকটা নাম বলো তো।
তাপস কুমার দত্ত: ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, সবকিছু ভেঙে...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, হ্যাঁ, ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল’, বইগুলো বেশির ভাগ সময়ই কলকাতায় সহজে পাওয়া যায় না।
তাপস কুমার দত্ত: বয়স তো যথেষ্ট হলো। একদিন চলে যেতে হবে, তার দিনক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে...কোনো আতঙ্ক বা আক্ষেপ?
সমরেশ মজুমদার: না, না। আজ রাতেও চলে যেতে পারি; আবার হয়তো দশ বা কুড়ি বছর পরও যেতে পারি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি অবশ্যই দীর্ঘায়ু হবেন, আমি এর দার্শনিক দিকটা জানতে চাচ্ছি।
সমরেশ মজুমদার: আমি খুব বাস্তববাদী মানুষ। আমি আজকে লেখালেখি করে যেটুকু জনপ্রিয়তা পেয়েছি, সেটুকু আমার পাওয়ার কথা ছিল না। আমার লেখক হওয়ারই কথা ছিল না।
তাপস কুমার দত্ত: অনেক বছর আগে বাংলাদেশের একটা সাপ্তাহিক কাগজে আপনি বলেছিলেন, এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেবেন।
সমরেশ মজুমদার: ওসব কথা বাড়িয়ে লিখতে ভালোবাসে কিছু সাংবাদিক। যেমন অন্য একটা জায়গায় আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তসলিমার ‘ক’ পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে? আমি এর উত্তরে বলেছিলাম, আমি ‘ক’ পড়েছি এবং আমার মনে হয়েছে, একটা বারবনিতাকে যদি বলা হয়, তোমার আত্মজীবনী লেখ, সে তার অনেক কষ্টের কথা লিখবে; কিন্তু যেসব ক্লায়েন্ট তার কাছে আসে, তাদের বিস্তৃত পরিচয় দেবে না সে, এটুকু সৌজন্য দেখাবে। এ উত্তরটা তারা এভাবে লিখেছে যে, সমরেশ মজুমদার বলেছেন, তসলিমা নাসরিন বেশ্যা। এর উত্তরে তসলিমা লিখলেন আনন্দবাজারে, সমরেশ মজুমদারের গলায় গলা মিলিয়ে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, তসলিমা বেশ্যা। এর উত্তরে আমি আবার চিঠি লিখলাম আনন্দবাজারে—কোথায়, কখন বলেছি? কাকে বলেছি? যদি দয়া করে আমাকে জানানো হয়...। অতএব, যদি কোথাও কখনো লেখা হয়ে থাকে, আমি বলেছি এক কোটি টাকা পেলে লেখালেখি ছেড়ে দেব—এগুলো বাজে কথা। হয়তো এভাবে বলেছি, লিখে টাকা পাওয়া যায়, জানতাম না। যখন লিখে টাকা পেতে শুরু করলাম, তখন আমাকে যদি বলা হয়, কেন লেখেন? আমি বলি, টাকার জন্য লিখি।
তাপস কুমার দত্ত: কথাটা এভাবে বলেছিলেন, একজন কৃষক যে কারণে চাষাবাদ করেন, একজন...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম, একজন কৃষক যখন চাষাবাদ করেন, তিনি তো দেশ গড়ার জন্য চাষ করেন না; তিনি তার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য চাষাবাদ করেন। একজন মাস্টার যখন পড়ান, তখন মানুষ গড়ার কারিগর হওয়ার চেয়ে তার সন্তানসন্ততিকে বড় করার জন্য পড়ান। তো, একজন লেখকের কী দায় আছে, তিনি দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন? আমাদের দেশে কোনো লেখক যদি জনপ্রিয় হন, তখন ধরেই নেওয়া হয়, ওগুলো ভুসিমাল। যদি সে ধরনের লেখক জনপ্রিয়তা না পান বা বিক্রি না হয়, তখন তিনি একজন বিরাট লেখক। প্রশ্ন হলো, জনপ্রিয়তা যদি কেউ বেশি পান, কেন পান? কারণ, পাঠকদের ভালো লাগছে বলেই। কোনো একটা বই হয়তো বেশি পাঠকের ভালো লেগেছে। এমন নয় যে বছরের পর বছর তিনি জনপ্রিয় হয়ে থাকেন। তা হলে যিনি পাঠককে সহজে স্পর্শ করতে পারছেন না, তার কোথাও খুঁত আছে নিশ্চয়ই। ভালো একটা ছবি তিন দিন সিনেমা হলে থেকে চলে গেল। আর একটা ছবি ‘বাবা কেন চাকর’ মাসের পর মাস চলল, জনপ্রিয় হলো। আবার ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর যখন হাজারটা শো চলে, তখন বলতেই হয়, গুপী গাইন বাঘা বাইন খারাপ ছবি? চার্লি চ্যাপলিন তা হলে খারাপ ছবির নাম? ‘পথের পাঁচালী’ও ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল—ওটাও তা হলে খারাপ ছবি?

তাপস কুমার দত্ত: ধরুন, হাইপোথেটিক্যালি আমরা ধরে নিলাম, কোনো ধনকুবের আপনার যাবতীয় চাহিদার স্পন্সরশিপের দায়িত্ব নিল। একজন কৃষক যে কারণে কৃষিকাজ করেন বা আর দশজন পেশাজীবী মানুষ যে কারণে পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, সেই প্রয়োজনটা আপনার আর রইল না। তখন কি লেখালেখি আপনি ছেড়ে দেবেন?
সমরেশ মজুমদার: চাহিদার কিন্তু শেষ নেই। আগে বাস-ট্রামে চড়তাম, আমার এখন বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। এখনো অবশ্য ইচ্ছা করে মাঝেমধ্যে বাস-ট্রামে উঠি। তো, আগে আমি জলপাইগুড়ি আমার বাড়ি যেতাম সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে, রিজারভেশন ছাড়া। এরপর রিজারভেশনে। এরপর এসি থ্রি-টিয়ার, এরপর এসি টু-টিয়ার। এর মানে এই নয়, আমি এখন এসি টু-টিয়ার ছাড়া যেতে পারব না। কিন্তু যদি কমফোর্ট পাই, তা আমি নেব না কেন?
তাপস কুমার দত্ত: আমি বলতে চাচ্ছি, শুধু ভরণপোষণ আর কমফোর্ট—এসব কারণেই লেখালেখি? ভোগবাদী ব্যাপার ছাড়া তা কি নিজের ভেতর থেকে উঠে আসে না?
সমরেশ মজুমদার: শুনুন, আমাকে যদি এক কোটি টাকা দেওয়া হয় একটা উপন্যাস লেখার জন্য—সাত দিন চেষ্টা করেও লিখে উঠতে পারব না। আবার, আমাকে কোনো টাকা দেওয়া হয়নি, আমি লিখতে বসলাম, হয়তো দুদিনেই লেখাটা শেষ করে ফেলতে পারব।
তাপস কুমার দত্ত: তা হলে লেখালেখিটা শুধু হালচাষির হালচাষের মতো জীবিকা নির্বাহ নয়, আলাদা একটা ভেতরের তাগিদও...
সমরেশ মজুমদার: অবশ্যই।
তাপস কুমার দত্ত: বেশির ভাগ জনপ্রিয় লেখকের লেখায় দেখা যায়, কতগুলো পাগলামোর ঘটনা, কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনা, কিছু সুখকর ঘটনা ও একটু বেদনাদায়ক ঘটনা। যেন ছাঁচে ঢেলে গরম তেলে ভেজে তোলা হট কেক...
সমরেশ মজুমদার: এটা আমার কাছে খুব অস্পষ্ট। ধরুন, আমার একটা বই, ইত্তেফাকের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে এক লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। সেই বইটা কলকাতায় ৫০-৬০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। ধরে নিতে পারি, বইটা জনপ্রিয়।
তাপস কুমার দত্ত: বইটার নাম কী?
সমরেশ মজুমদার: ‘গর্ভধারিণী’। তা ওটা কোন ফর্মুলায় লেখা, বলুন তো?
তাপস কুমার দত্ত: ওই বইটাতে আসলে এমন একটা সাসপেন্স বা থ্রিল এবং এর সঙ্গে আবেগ, বর্তমান সমাজব্যবস্থার কিছু মানুষের অমানবিক নোংরা দিকের প্রতি...।
সমরেশ মজুমদার: এসব তো অনেক বইতেই আছে।
তাপস কুমার দত্ত: হ্যাঁ, তা ঠিক, ‘মেঘ ছিল, ‘বৃষ্টিও’-তেও আছে। ‘আট কুঠুরী নয় দরজা’তেও।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে সেগুলো ওভাবে বিক্রি হয়নি কেন?
তাপস কুমার দত্ত: না, আমি বলছি ‘গর্ভধারিণী’র মতো বিশাল জনপ্রিয়তা না পেলেও ওই লেখাগুলোও বেশ জনপ্রিয়।
সমরেশ মজুমদার: যদি জানতাম, গর্ভধারিণীর মতো ওভাবে সাসপেন্স মেশালে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হবে, তা হলে তো সব বই ওভাবেই লেখা হতো। তা হলে ‘সাতকাহন’ কেন এত বিক্রি হলো? স্ট্রাগল করা মেয়েদের গল্প তো আমি আগেও লিখেছি, পরেও লিখেছি, সেগুলো কেন সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হলো না? আমি যদি আরেকটা দীপাবলীকে নিয়ে লিখি, সেটা কি সাতকাহনের মতো জনপ্রিয় হবেই?
তাপস কুমার দত্ত: সাতকাহনের দ্বিতীয় পর্ব কিন্তু প্রথম পর্বের মতো অত জনপ্রিয় নয়।
সমরেশ মজুমদার: তা হলে? আসলে আমার কাছে মনে হয়, যেকোনো...আমি আপনাকে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখাটার কথা বললাম, ‘এখনো সময় আছে’ বইটা তিন থেকে চার হাজার কপি বিক্রি হয়েছে। লোকে না পড়লে আমার কষ্ট হয়, আমি তো লোকে লোকে গিয়ে বলতে পারি না, আপনি বইটা পড়ুন। কোত্থেকে ‘কালবেলা’ এক লাখ কপি বিক্রি হলো! ‘উত্তরাধিকার’ বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার। অথচ উত্তরাধিকার ওটার চেয়ে অনেক বেটার উপন্যাস। তাই কোন লেখাটা জনপ্রিয় হবে, তা আগে থেকে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। একটা লেখা জনপ্রিয় হতে পারে। একটা মেমসাহেব, একটা দৃষ্টিপাত, একটা মরুতীর্থ হিংলাজ জনপ্রিয় হতে পারে। কয়েকটা নয়।
তাপস কুমার দত্ত: ওপারের লেখকদের লেখা সম্পর্কে...
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, ওপারের এক নম্বরের সঙ্গে দুই নম্বরের ব্যবধান এত বিস্তর...জাফর ইকবাল সম্প্রতি সেই ব্যবধান একটু কমিয়ে এনেছেন। তো, গতবার যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, তখন একজন লেখক আমাকে এসে বললেন, সমরেশ দা, আপনাকে একটা ভালো খবর দিই।
আমি বললাম, কী?
বলল, আমি এখন তিন নম্বরে।
আমি জানতে চাইলাম, কিসের তিন নম্বর? সে জানাল, জনপ্রিয়তার। তার পেছনে নাকি মিলন চলে গেছে, অমুক-তমুক অনেকে চলে গেছে। আমি হাসব না কাঁদব, ভেবে পাচ্ছিলাম না।
তাপস কুমার দত্ত: কে?
সমরেশ মজুমদার: নামটা নাই-বা বললাম।
তাপস কুমার দত্ত: বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের রুচিবোধ আপনার কতটা উঁচুদরের বলে মনে হয়?
সমরেশ মজুমদার: আপনি যা ইচ্ছা তা-ই লিখে পাঠকদের ভোলাতে পারবেন না। পাঠকদের বিচারশক্তি দারুণ প্রখর। একটা লেখা দিয়ে ভোলাতে পারবেন, পরের দুটোয় হাফ ভোলাতে পারবেন; তৃতীয়টায় আর পারবেন না।
তাপস কুমার দত্ত: পাঠকেরা আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?
সমরেশ মজুমদার: না, আমাকে তেমন প্রভাবিত করতে পারে না। তবে কিছু কিছু ঘটনায় মাঝেমধ্যে কষ্ট হয়। একবার বইমেলায় এক ভদ্রমহিলা তিনখানা (বড় ক্যানভাসের) বই বইতে পারছিলেন না, চেহারা দেখে বোঝা যায়, যথেষ্ট (আর্থিক) অসচ্ছল পরিবার। আমি বললাম, আপনি কী করেন?
তিনি বললেন, আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়াই।
আমার খুব খারাপ লাগল, আপনি এত দামি তিনটি বই কিনলেন?
তিনি বললেন, সারা বছর আমরা অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছি।
এরপর দেখলাম, দূরে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। ক্রাচ হাতে, একটা পা ডিফেক্টেড। ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে যেতেই তিনি বললেন, আমি আপনার অনিমেষ।
আমি বললাম, তার মানে?
তিনি জানালেন, তিনি নকশাল আন্দোলন করতেন এবং হাওড়া জেলে পুলিশের অত্যাচারে একটা পা নষ্ট হয়ে (অনিমেষের মতোই) গেছে। আমরা একসঙ্গে থাকি। (অনিমেষ-মাধবীলতার মতো), আমরা বিয়ে করিনি।
আরেকটা ঘটনা বলে শেষ করি—হ্যাঁ, একবার বিদেশে রাতে আমার খুব খিদে পেয়েছে, একটা বড় রেস্টুরেন্ট দেখে ভেতরে ঢুকে পড়ি। এরপর মেনু কার্ডের সবচেয়ে ছোট আইটেম যেটা, সেটার অর্ডার দিলাম। বেয়ারাগুলোকে দেখে মনে হলো এশিয়ান। তো, একটা বেয়ারা এসে বলল, স্যার! আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?
আমি বললাম, ইয়েস।
স্যার! আর ইউ ফ্রম ওয়েস্ট বেঙ্গল?
আমি আবার বললাম, ইয়েস।
বেয়ারা গিয়ে হোটেল মালিককে তথ্যগুলো জানাতেই হোটেল মালিক উঠে এসে বললেন, নমস্কার স্যার! আপনি বোধ হয় সমরেশ বাবু। আমি আপনার একটাই মাত্র বই পড়েছি। একবার একটা বাস টার্মিনালে দেখলাম একটা বই পড়ে আছে—বাংলা বই, নামটা ‘দৌড়’।
এরপর যতই বলছি, আমার খাওয়া হয়ে গেছে, তবু তিনি আমাকে জোর করে খাওয়াবেন। বিল দিতে গেলাম, বিল নিলেন না। এই অবধি ঠিক আছে। বেয়ারা এরপর বলল, সাহেব, একবার ভেতরে আসবেন? আপায় কইছিল, আপনি সমরেশ মজুমদার কি না জিজ্ঞেস করতে। তো, আমি ভেতরে ঢুকলাম। একজন ভদ্রমহিলা খাটের ওপর বসে নমস্কার জানিয়ে আমার দিকে একটা বই এগিয়ে দিলেন—‘গর্ভধারিণী’। আমার পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। দেখুন, কারোর জানার কথা নয়, আমি ওখানে যাব। কাকতালীয়ভাবে।
তাপস কুমার দত্ত: একবার কবি সম্মেলনে আপনাকে দেশের বাইরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল—কবি হিসেবে, ভুল করে। ঠিক এ রকমই একটা ঘটনার কথা...
সমরেশ মজুমদার: হ্যাঁ, আপনি সবই জানেন দেখছি।
তাপস কুমার দত্ত: আপনি বই বাজেয়াপ্ত করাটা কতটা সমর্থন করেন?
সমরেশ মজুমদার: যে কারণে তসলিমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, সেটাকে আমি সমর্থন করি না। তবে আমার হাতে আইন থাকলে তসলিমাকে অভিযুক্ত করতাম। আজ একটা ছেলের সঙ্গে একটা মেয়ের ভালো সম্পর্ক; সম্পর্কটা দুজনকেই আনন্দিত করছে। যদি ভবিষ্যতে তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোনো তিক্ততা আসে, আজকের এ আনন্দটা কিন্তু মিথ্যা হয়ে যাবে না এবং সেই ছেলেটা ও মেয়েটার কোনো রাইট নেই ভবিষ্যতে এই আনন্দিত সম্পর্ককে নিয়ে খোলামেলা...ব্যঙ্গ করে লেখা বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে লেখা। যে ক্ষেত্রে তারা একে অন্যকে ছোট ও অপমান করছে। মিলনের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গিয়ে কী হয়েছে বা অমুকের সঙ্গে অমুকের আর কী হয়েছে—এর ডিটেইলস নিয়ে আমরা আদৌ আগ্রহী নই। আমরা তসলিমার ব্যাপারে এখানেই আগ্রহী যে সে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কী লড়াই করেছিল। তা না করে তার শারীরিক আনন্দের বিবরণ দিয়ে লিখছে—এটা এক ধরনের অসুখ। আমি জানি, আমার বাবা-মায়ের মিলনের ফলে আমি পৃথিবীতে এসেছি; এখন সেই মিলনটা কী রকম ছিল, তার বিবরণ দিয়ে যদি লিখতে যাই, তো আমার জন্মটাকেই আমি সবচেয়ে বেশি কুৎসিত করছি। আমার জন্মের বিবরণের জন্য আমার বাবা-মায়ের শয্যা বিবরণ কি আমি দিতে পারি? নাকি তা আমি ভাবতে চাই? বা ভাবতে পারি?
তাপস কুমার দত্ত: আপনি আপনার খোলামেলা বা বিতর্কিত ভাবনা প্রকাশ করতে কতটা ভয় পান?
সমরেশ মজুমদার: দেখুন, এ মুহূর্তে বোধ হয় আমিই সবচেয়ে সরাসরি লিখি। ‘পত্রপাঠ’ বলে একটা পত্রিকা আছে, মাসে বেরোয়—সেটায় আমি কলাম লিখি। সেখানে সরাসরি সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে লিখি। একজন কলেজ অধ্যাপককে পুলিশ অ্যারেস্ট করে—জনযুদ্ধগোষ্ঠীর ডায়েরি থেকে নাম পেয়ে তাকে অ্যারেস্ট করে। সারা দিন অত্যাচার করে সন্ধ্যায় তাকে ছেড়ে দেয়। এলাকার লোকজন মনে করে, সে জনযুদ্ধগোষ্ঠীর লোক। সে রেললাইনে আত্মহত্যা করে, তার স্ত্রী এ নিয়ে কেস করে। এ ঘটনা নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। আমি এ-ও লিখেছিলাম, কয়েক দিন আগে ভোটের সময় একজন সাংবাদিক একটা গ্রামে গেছেন। সেখানে এক চায়ের দোকানে নানা আলোচনায় উঠে আসে, আমাদের দেশে যত মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই অবিবাহিত। বিবাহিত ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়, জ্যোতিবাবু। সিদ্ধার্থবাবু, জ্যোতিবাবু কখনো বাজারে যাননি। বুদ্ধবাবু রিকশায় চাপেন, বাজারে যান। আর নামটা দেখুন, বুদ্ধদেব।...বিধানচন্দ্র, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থ হচ্ছে সংসারী নাম।...এ রকম নাম যার, তাকে আমরা ভোট দেব না, তো অন্য লোককে ভোট দেব? সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কেমন আছেন? ওরা বলল, এই যে রাস্তাটা দেখছেন, এর নাম সুচেতনা (‘সুচেতনা’ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মেয়ের নাম)। আমাদের এখানে একটা ভাটিখানা আছে, খুব মারপিট চলত আগে, মদ খেতে খেতে। আমরা সেটার নাম দিয়েছি সুচেতনা...বাংলা বারের প্রতিশব্দ আর কি। ওখানে মদ খেয়ে এখন আর কেউ চেতনা হারাচ্ছে না। ফলে বুঝতেই পারছেন, আমরা সবই বুদ্ধবাবুর লোক। এ গল্পটা বের হওয়ার পর বুদ্ধবাবু আমায় বললেন, আমাকে নিয়ে লিখলেন, ঠিক আছে; আমার মেয়েকে জড়ালেন কেন? আমি বললাম, ‘হাওড়ার একটা লাইব্রেরি উদ্বোধন করতে তোমার মেয়ে আর তোমার স্ত্রী গিয়েছিলেন, লাইব্রেরিটার নাম রাখা হয়েছে সুচেতনা পাঠাগার। তোমার মেয়ে এখনই এমন কী যোগ্যতা অর্জন করেছে যে তার নামে একটা পাঠাগার রাখা হবে? যেহেতু সে তোমার মেয়ে, তাই রাখা হয়েছে।’ এখন, আপনি কী মনে করেন না, এর চেয়ে সরাসরি আক্রমণ করে লেখা—আর বড়াই করে বলি, আমাদের কোনো লেখকই লিখছেন না। লিখতে পারেন, কিন্তু লিখছেন না।
তাপস কুমার দত্ত: এত সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সমরেশ মজুমদার: থ্যাঙ্ক ইউ।

ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকে এই কার্যক্রমে যুক্ত। আমরা ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মুদারাবা স্কুল স্টুডেন্ট সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ চালু করেছি, যেখানে অভিভাবকেরা সন্তানদের পক্ষ থেকে হিসাব পরিচালনা করেন। মূল লক্ষ্য হলো শিশু-কিশোরদের সুদমুক্ত অর্থনীতিতে যুক্ত করা এবং ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল...
৪ দিন আগে
ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি (ইবিএল) নিয়মিতভাবে স্কুলে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং বিশেষ অফারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচেতন করছে এবং তাদের হিসাব খোলায় উৎসাহ দিচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং জ্ঞান ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব বোঝাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করি।
৪ দিন আগে
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি।
১৯ দিন আগে
দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে আগামী নির্বাচনে দলের কৌশল, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও তাদের নেতা-কর্মীদের বিচার...
২০ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

আজকের পত্রিকা: কবে থেকে স্কুল ব্যাংকিংয়ে যুক্ত ইসলামী ব্যাংক?
ওমর ফারুক খাঁন: ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকে এই কার্যক্রমে যুক্ত। আমরা ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মুদারাবা স্কুল স্টুডেন্ট সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ চালু করেছি, যেখানে অভিভাবকেরা সন্তানদের পক্ষ থেকে হিসাব পরিচালনা করেন। মূল লক্ষ্য হলো শিশু-কিশোরদের সুদমুক্ত অর্থনীতিতে যুক্ত করা এবং ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল ব্যাংক গ্রাহক হিসেবে গড়ে তোলা।
আজকের পত্রিকা: তাহলে এ খাতে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান কীভাবে দেখছেন?
ওমর ফারুক খাঁন: বর্তমানে আমাদের ৬ লাখ ৬১ হাজার শিক্ষার্থী হিসাব রয়েছে, যা দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে বিস্তৃত শাখা নেটওয়ার্ক, গ্রামীণ পর্যায়ে সেবা সম্প্রসারণ এবং ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। মাত্র ১০০ টাকায় হিসাব খোলা যায়, কোনো বার্ষিক চার্জ নেই, শিক্ষার্থীরা বিনা মূল্যে ডেবিট কার্ডও পায়। ফলে আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারের সন্তানেরাও সহজে এই সুযোগ নিতে পারছে।
আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিং বিস্তারে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ওমর ফারুক খাঁন: এখন ৬১ ব্যাংকের মধ্যে ৫৯টি এই কার্যক্রমে যুক্ত; যা বলে দেয় ব্যাংকগুলো কতটা সক্রিয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি শাখা অন্তত একটি স্কুলে স্কুল ব্যাংকিং পরিচালনা করছে; পাশাপাশি ব্যাংকগুলো সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী ও প্রশিক্ষণ আয়োজন করছে, যাতে শিক্ষার্থীরা সঞ্চয়ের গুরুত্ব এবং ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পায়। আশাব্যঞ্জক দিক হলো, এই হিসাবগুলোর ৫৪ শতাংশই গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের নামে।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষার্থীরা সাধারণত কোথা থেকে সঞ্চয়ের অর্থ পায়?
ওমর ফারুক খাঁন: বেশির ভাগ টিফিনের টাকা, হাতখরচ, উপহার অথবা বৃত্তির অর্থ থেকে সঞ্চয় করে। কেউ কেউ টিউশন বা ছোটখাটো অনলাইন কাজ থেকে আয় করে জমা রাখে। অভিভাবকেরাও সন্তানদের সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে নিয়মিত কিছু টাকা জমা দেন। এই ছোট ছোট জমা মিলিয়েই তৈরি হচ্ছে একটি বড় আর্থিক ভিত্তি।
আজকের পত্রিকা: তবে সাম্প্রতিক সময়ে জমার প্রবাহ কিছুটা কমে এসেছে। কেন?
ওমর ফারুক খাঁন: এর পেছনে প্রধান কারণ অর্থনৈতিক চাপ ও সচেতনতার অভাব। অনেক পরিবার আগের মতো সঞ্চয়ের জন্য আলাদা অর্থ রাখতে পারছে না। অন্যদিকে কিছু ব্যাংক করপোরেট খাতে বেশি মনোযোগ দেওয়ায় এই খাতের উদ্যোগও কিছুটা কমেছে। তবে নীতিগত সহায়তা, ডিজিটাল সুবিধা এবং প্রচার বাড়ানো গেলে দ্রুতই তা ঘুরে দাঁড়াবে।
আজকের পত্রিকা: জাতীয় অর্থনীতিতে খুদে শিক্ষার্থীদের সঞ্চয় কতটা শক্তি জোগাচ্ছে?
ওমর ফারুক খাঁন: এই ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলো একত্রে ব্যাংকের আমানত বাড়াচ্ছে, যা পরে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এতে কর্মসংস্থান বাড়ে, অর্থনীতি সচল হয়। একই সঙ্গে শিশুরা ছোটবেলা থেকে অর্থের মূল্য, সঞ্চয় ও আর্থিক শৃঙ্খলা শেখে। আমার বিশ্বাস, এটি শুধু ব্যাংক উদ্যোগ নয়; এক সামাজিক পরিবর্তনের আন্দোলন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অর্থনৈতিকভাবে সচেতন এবং আত্মনির্ভর করে গড়ে তুলবে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি
আজকের পত্রিকা: কবে থেকে স্কুল ব্যাংকিংয়ে যুক্ত ইসলামী ব্যাংক?
ওমর ফারুক খাঁন: ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকে এই কার্যক্রমে যুক্ত। আমরা ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মুদারাবা স্কুল স্টুডেন্ট সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ চালু করেছি, যেখানে অভিভাবকেরা সন্তানদের পক্ষ থেকে হিসাব পরিচালনা করেন। মূল লক্ষ্য হলো শিশু-কিশোরদের সুদমুক্ত অর্থনীতিতে যুক্ত করা এবং ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল ব্যাংক গ্রাহক হিসেবে গড়ে তোলা।
আজকের পত্রিকা: তাহলে এ খাতে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান কীভাবে দেখছেন?
ওমর ফারুক খাঁন: বর্তমানে আমাদের ৬ লাখ ৬১ হাজার শিক্ষার্থী হিসাব রয়েছে, যা দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে বিস্তৃত শাখা নেটওয়ার্ক, গ্রামীণ পর্যায়ে সেবা সম্প্রসারণ এবং ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। মাত্র ১০০ টাকায় হিসাব খোলা যায়, কোনো বার্ষিক চার্জ নেই, শিক্ষার্থীরা বিনা মূল্যে ডেবিট কার্ডও পায়। ফলে আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারের সন্তানেরাও সহজে এই সুযোগ নিতে পারছে।
আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিং বিস্তারে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ওমর ফারুক খাঁন: এখন ৬১ ব্যাংকের মধ্যে ৫৯টি এই কার্যক্রমে যুক্ত; যা বলে দেয় ব্যাংকগুলো কতটা সক্রিয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি শাখা অন্তত একটি স্কুলে স্কুল ব্যাংকিং পরিচালনা করছে; পাশাপাশি ব্যাংকগুলো সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী ও প্রশিক্ষণ আয়োজন করছে, যাতে শিক্ষার্থীরা সঞ্চয়ের গুরুত্ব এবং ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পায়। আশাব্যঞ্জক দিক হলো, এই হিসাবগুলোর ৫৪ শতাংশই গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের নামে।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষার্থীরা সাধারণত কোথা থেকে সঞ্চয়ের অর্থ পায়?
ওমর ফারুক খাঁন: বেশির ভাগ টিফিনের টাকা, হাতখরচ, উপহার অথবা বৃত্তির অর্থ থেকে সঞ্চয় করে। কেউ কেউ টিউশন বা ছোটখাটো অনলাইন কাজ থেকে আয় করে জমা রাখে। অভিভাবকেরাও সন্তানদের সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে নিয়মিত কিছু টাকা জমা দেন। এই ছোট ছোট জমা মিলিয়েই তৈরি হচ্ছে একটি বড় আর্থিক ভিত্তি।
আজকের পত্রিকা: তবে সাম্প্রতিক সময়ে জমার প্রবাহ কিছুটা কমে এসেছে। কেন?
ওমর ফারুক খাঁন: এর পেছনে প্রধান কারণ অর্থনৈতিক চাপ ও সচেতনতার অভাব। অনেক পরিবার আগের মতো সঞ্চয়ের জন্য আলাদা অর্থ রাখতে পারছে না। অন্যদিকে কিছু ব্যাংক করপোরেট খাতে বেশি মনোযোগ দেওয়ায় এই খাতের উদ্যোগও কিছুটা কমেছে। তবে নীতিগত সহায়তা, ডিজিটাল সুবিধা এবং প্রচার বাড়ানো গেলে দ্রুতই তা ঘুরে দাঁড়াবে।
আজকের পত্রিকা: জাতীয় অর্থনীতিতে খুদে শিক্ষার্থীদের সঞ্চয় কতটা শক্তি জোগাচ্ছে?
ওমর ফারুক খাঁন: এই ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলো একত্রে ব্যাংকের আমানত বাড়াচ্ছে, যা পরে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এতে কর্মসংস্থান বাড়ে, অর্থনীতি সচল হয়। একই সঙ্গে শিশুরা ছোটবেলা থেকে অর্থের মূল্য, সঞ্চয় ও আর্থিক শৃঙ্খলা শেখে। আমার বিশ্বাস, এটি শুধু ব্যাংক উদ্যোগ নয়; এক সামাজিক পরিবর্তনের আন্দোলন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অর্থনৈতিকভাবে সচেতন এবং আত্মনির্ভর করে গড়ে তুলবে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দ
১১ মে ২০২৩
ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি (ইবিএল) নিয়মিতভাবে স্কুলে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং বিশেষ অফারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচেতন করছে এবং তাদের হিসাব খোলায় উৎসাহ দিচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং জ্ঞান ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব বোঝাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করি।
৪ দিন আগে
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি।
১৯ দিন আগে
দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে আগামী নির্বাচনে দলের কৌশল, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও তাদের নেতা-কর্মীদের বিচার...
২০ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিংয়ের প্রসারে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা কী?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি (ইবিএল) নিয়মিতভাবে স্কুলে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং বিশেষ অফারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচেতন করছে এবং তাদের হিসাব খোলায় উৎসাহ দিচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং জ্ঞান ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব বোঝাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করি।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষার্থীদের হিসাব খুলতে কী কী বিশেষ উদ্যোগ রয়েছে?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সুবিধাসহ স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খোলার সুযোগ দিচ্ছে। ন্যূনতম জমা দিয়ে হিসাব খোলা যায়, পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা পায় বিনা মূল্যে ডেবিট কার্ডসহ আকর্ষণীয় উপহার।
আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিংয়ে ইবিএলের শেয়ার কত?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্কুল ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। আমরা ধারাবাহিকভাবে নতুন নতুন স্কুলে অংশগ্রহণ বাড়াচ্ছি, যাতে আরও বেশি শিক্ষার্থী এই উদ্যোগের আওতায় আসে। বর্তমানে দেশের স্কুল ব্যাংকিং খাতে ইবিএলের উল্লেখযোগ্য শেয়ার রয়েছে, যা আমাদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাংকিং সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রতিফলন।
আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল বিশ্বাস করে, স্কুল ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময়। আমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আরও আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা দিতে কাজ করছি, যাতে তারা ছোটবেলা থেকেই স্মার্ট ব্যাংকিংয়ে অভ্যস্ত হয়।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষার্থীদের হিসাবে বাড়তি কী সুবিধা রয়েছে?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ের পাশাপাশি আর্থিক সচেতনতা বৃদ্ধি, স্কলারশিপ, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের মাধ্যমে উৎসাহিত করে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বিশেষ ডিজিটাল সুবিধা যুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
আজকের পত্রিকা: নতুন কোনো অফার দেবেন কি?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: হ্যাঁ, ইবিএল নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় অফার ও পুরস্কার কার্যক্রম আয়োজন করে। যেমন সেরা সঞ্চয়কারী শিক্ষার্থীদের জন্য উপহার, আর্থিক সচেতনতা কর্মশালা ইত্যাদি।
উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, হেড অব রিটেইল অ্যান্ড এসএমই ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্ট, ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি
আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিংয়ের প্রসারে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা কী?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি (ইবিএল) নিয়মিতভাবে স্কুলে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং বিশেষ অফারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচেতন করছে এবং তাদের হিসাব খোলায় উৎসাহ দিচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং জ্ঞান ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব বোঝাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করি।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষার্থীদের হিসাব খুলতে কী কী বিশেষ উদ্যোগ রয়েছে?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সুবিধাসহ স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খোলার সুযোগ দিচ্ছে। ন্যূনতম জমা দিয়ে হিসাব খোলা যায়, পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা পায় বিনা মূল্যে ডেবিট কার্ডসহ আকর্ষণীয় উপহার।
আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিংয়ে ইবিএলের শেয়ার কত?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল বর্তমানে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্কুল ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। আমরা ধারাবাহিকভাবে নতুন নতুন স্কুলে অংশগ্রহণ বাড়াচ্ছি, যাতে আরও বেশি শিক্ষার্থী এই উদ্যোগের আওতায় আসে। বর্তমানে দেশের স্কুল ব্যাংকিং খাতে ইবিএলের উল্লেখযোগ্য শেয়ার রয়েছে, যা আমাদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাংকিং সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রতিফলন।
আজকের পত্রিকা: স্কুল ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল বিশ্বাস করে, স্কুল ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময়। আমরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আরও আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা দিতে কাজ করছি, যাতে তারা ছোটবেলা থেকেই স্মার্ট ব্যাংকিংয়ে অভ্যস্ত হয়।
আজকের পত্রিকা: শিক্ষার্থীদের হিসাবে বাড়তি কী সুবিধা রয়েছে?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: ইবিএল শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়ের পাশাপাশি আর্থিক সচেতনতা বৃদ্ধি, স্কলারশিপ, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের মাধ্যমে উৎসাহিত করে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বিশেষ ডিজিটাল সুবিধা যুক্ত করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
আজকের পত্রিকা: নতুন কোনো অফার দেবেন কি?
এম. খোরশেদ আনোয়ার: হ্যাঁ, ইবিএল নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় অফার ও পুরস্কার কার্যক্রম আয়োজন করে। যেমন সেরা সঞ্চয়কারী শিক্ষার্থীদের জন্য উপহার, আর্থিক সচেতনতা কর্মশালা ইত্যাদি।
উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, হেড অব রিটেইল অ্যান্ড এসএমই ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্ট, ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি

উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দ
১১ মে ২০২৩
ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকে এই কার্যক্রমে যুক্ত। আমরা ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মুদারাবা স্কুল স্টুডেন্ট সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ চালু করেছি, যেখানে অভিভাবকেরা সন্তানদের পক্ষ থেকে হিসাব পরিচালনা করেন। মূল লক্ষ্য হলো শিশু-কিশোরদের সুদমুক্ত অর্থনীতিতে যুক্ত করা এবং ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল...
৪ দিন আগে
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি।
১৯ দিন আগে
দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে আগামী নির্বাচনে দলের কৌশল, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও তাদের নেতা-কর্মীদের বিচার...
২০ দিন আগে
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি। তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এই সাক্ষাৎকার দেন। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব আজ।
আজকের পত্রিকা ডেস্ক

বিবিসি বাংলা: এখন বাংলাদেশের সরকার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
তারেক রহমান: বিষয়টি তো রাজনৈতিক। এটি তো কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়। আমরা প্রথম থেকে যে কথাটি বলছি, আমরা চাই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সফল হোক। অর্থাৎ, অনেক কিছুর মতো বিভিন্ন বিষয় আছে। যেমন—আমরা যদি মূল দুটো বিষয় বলি যে, কিছু সংস্কারের বিষয় আছে, একই সাথে প্রত্যাশিত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, স্বাধীন নির্বাচনের একটি বিষয় আছে।
মূলত কিছু সংস্কারসহ যে সংস্কারগুলো না করলেই নয়, এরকম সংস্কারসহ একটি স্বাভাবিক সুষ্ঠু, স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাই হচ্ছে বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য। আমরা প্রত্যাশা করি, ওনারা উনাদের ওপরে যেটা মূল দায়িত্ব, সেটি ওনারা সঠিকভাবে সম্পাদন করবেন। এটাই তো তাঁদের কাছে আমাদের চাওয়া রাজনৈতিক দল হিসেবে।
আমরা আশা রাখি, প্রত্যাশা করি যে, ওনারা কাজটি সুন্দরভাবে করবেন। স্বাভাবিকভাবে এই কাজের সৌন্দর্য বা কতটুকু ভালো, কতটুকু ভালো বা মন্দভাবে করতে পারছেন, তার ওপরেই মনে হয় সম্পর্কের উষ্ণতা বা শীতলতা যেটাই বলেন, সেটা নির্ভর করবে।
বিবিসি বাংলা: আপনি কয়েক মাস আগে একটি মন্তব্য করেছিলেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আপনার এই মন্তব্য নিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, এ বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী? তিনি তখন বলেছিলেন, সন্দেহটা ওনার মনে। অর্থাৎ, আপনার মনে সন্দেহ আছে কি না, সেটা তিনি জানতে চান। আপনার মনে কি সেই সন্দেহ আছে?
তারেক রহমান: দেখুন, আমি যখন কথাটি বলেছিলাম, এই মুহূর্তে আমার যতটুকু মনে পড়ে, সেই সময় পর্যন্ত ওনারা কিন্তু নির্বাচনের ব্যাপারে সঠিক কোনো টাইম ফ্রেম বা কোনো কিছু বলেননি।
রোডম্যাপ বলতে যা বোঝায়, আমরা নরমালি যা বুঝে থাকি, এরকম কিছু বলেননি। এবং সে কারণেই শুধু আমার মনের মধ্যেই নয়, আমরা যদি সেই সময় বিভিন্ন মিডিয়া দেখি, বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব দেখি, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা করেন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে, প্রায় সবার মনের মধ্যেই সন্দেহ ছিল।
আমরা যখন দেখলাম যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ডক্টর ইউনূস, উনি মোটামুটিভাবে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করলেন। এবং পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার উনি ওনার যে সিদ্ধান্ত, সেটির ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তারপর থেকেই খুব স্বাভাবিকভাবেই এই সন্দেহ বহু মানুষের মন থেকে ধীরে ধীরে চলে যেতে ধরেছে।
আমি মনে করি, ওনারা যা বলেছেন, ওনারা যতক্ষণ পর্যন্ত দৃঢ় থাকবেন, ওনাদের বক্তব্যে, ওনাদের কাজে যত বেশি দৃঢ় থাকবেন, ততই সন্দেহ চলে যাবে আস্তে আস্তে।
বিবিসি বাংলা: সেই সন্দেহ মনে কিছুটা দূরীভূত হয়েছিল লন্ডনে যখন তিনি আপনার সঙ্গে বৈঠক করলেন। তার পরেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা এসেছিল। তো সেই বৈঠকে নির্বাচনের কথা তো হয়েছিল, যেহেতু সেটি পরে এসেছে। এর বাইরে কি আপনাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়েছে? আর কোনো বিষয়ে কোনো চিন্তাভাবনা বা সমঝোতা কিছু হয়েছে?
তারেক রহমান: এর বাইরে স্বাভাবিকভাবেই উনি একজন অত্যন্ত স্বনামধন্য মানুষ। অত্যন্ত বিজ্ঞ মানুষ উনি। এর বাইরে তো অবশ্যই স্বাভাবিকভাবে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হয়েছে। এর বাইরেও উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন যে, জনগণ যদি আপনাদের সুযোগ দেয়, তাহলে আপনারা কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য—এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
আমার কিছু চিন্তাভাবনা দেশের মানুষকে নিয়ে, দেশের জনগণকে নিয়ে, দেশকে নিয়ে আমরা যদি সুযোগ পাই, জনগণ আমাদের যদি সেই সুযোগ দেন, তাহলে আমরা কী কী বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করব, সে বিষয়গুলো নিয়ে কিছু কিছু আলোচনা হয়েছে।
বিবিসি বাংলা: নির্বাচনের বিষয়টি তো আপনি বললেন, এর বাইরে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে গত এক বছরে যে ভূমিকা রেখেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সেটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
তারেক রহমান: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানে ইন্টেরিম, মানে এটা তো ক্ষণস্থায়ী বিষয়। তো খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি দেশ পরিচালনা তো একটি বিশাল বিষয়। আমরা হয়তো ভূখণ্ডের ভিত্তিতে যদি বিবেচনা করি, হয়তো বাংলাদেশকে অনেকে বলবে ছোট দেশ। কিন্তু আমরা যদি জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিবেচনা করি, বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক ভূখণ্ডের চেয়ে বড় দেশ।
ইউকের (যুক্তরাজ্য) জনসংখ্যা ৭ কোটির মতো, বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্লাস-মাইনাস ২০ কোটির মতো এখন। কাজেই ইউকের তিন গুণ বড়। এরকম একটি দেশ পরিচালনা করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই জনগণের ম্যান্ডেটসহ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকার প্রয়োজন। বিভিন্ন বিষয় থাকে, ইস্যুজ থাকে, বিভিন্ন বিষয় আছে।
তো এখন নির্বাচনের বাইরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পারফরমেন্স আপনি যেটা বললেন, আমরা সবকিছু বিবেচনা করলে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, হয়তো ওনারা চেষ্টা করেছেন অনেক বিষয়ে। সব ক্ষেত্রে সবাই তো আর সফল হতে পারে না, স্বাভাবিকভাবে ওনাদের লিমিটেশনস কিছু আছে। সেই লিমিটেশনসের মধ্যে ওনারা হয়তো চেষ্টা করেছেন, যতটুকু পেরেছেন হয়তো চেষ্টা করছেন।
এক এগারোর সরকার নিয়ে মূল্যায়ন কী?
বিবিসি বাংলা: আমি একটু পিছনে তাকাতে চাই।
তারেক রহমান: ভাই, আমরা তো সামনে যেতে চাই। আপনি পেছনে কেন যাচ্ছেন? দেশকে সামনে নিতে হবে।
বিবিসি বাংলা: মানে, পেছন থেকেই তো শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে হয়। তো পেছনের একটা বিষয়, সেটা হচ্ছে, এক-এগারোর সরকার বা সেনাসমর্থিত সরকারের সেই সময়টা নিয়ে রাজনীতিতে অনেক আলোচনা আছে। সে সময়টাকে ঘিরে আপনার মূল্যায়ন কী?
তারেক রহমান: এক বাক্যে বা সংক্ষেপে যদি বলতে হয়, এক-এগারোর সরকার তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি সরকার ছিল।
আমরা দেখেছি, সেই সরকার আসলে কীভাবে দেশের যতটুকু যেমনই হোক বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যতটুকুই রাজনীতি গড়ে উঠেছিল, গণতান্ত্রিক ভিত্তি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল ভুল-ত্রুটি সবকিছুর ভিতর দিয়েই। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, কীভাবে তারা সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, বিরাজনীতিকরণ করতে চেয়েছিল। দেশকে একটি অন্ধকার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দেখেছি যে, খুব সম্ভবত তাদেরই ভিন্ন আরেকটি রূপ; অন্যভাবে দেখেছি আমরা ’ইন দ্য নেম অব ডেমোক্রেসি’।
বিএনপির রাজনীতিতে পরিবর্তন হয়েছে কতটা
বিবিসি বাংলা: ২০০৪ সালে আমি আপনার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ঢাকায়। সে সময় আপনি বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করবেন। তো বিএনপির রাজনীতিতে আসলে কতটা পরিবর্তন হয়েছে; ভবিষ্যৎ বিএনপিই বা কেমন হবে?
তারেক রহমান: আমাদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণ, দেশ এবং দেশের সার্বভৌমত্ব। আমরা দুটো বিষয় নিয়ে বাংলাদেশে খুবই গর্ব করি, অহংকার করি। একটি হচ্ছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প, আরেকটি হচ্ছে প্রবাসীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান—এ দুটোই কিন্তু বিএনপি শুরু করেছিল।
আমরা দেখেছি, বিএনপির সময়ে শুরু হয়েছিল প্রবাসীদের বিদেশ যাওয়া, একই সাথে গার্মেন্ট শিল্পের প্রসার। এর বাইরেও যদি আমরা দেখি, ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষটা হয়েছিল, পরবর্তীতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন, আমরা দেখেছি কীভাবে ধীরে ধীরে দুর্ভিক্ষপীড়িত একটি দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসপূর্ণ করে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ না, অল্প পরিমাণ করে হলেও আমরা কিন্তু সেই সময় বিদেশে খাদ্য রপ্তানি, চাল রপ্তানি করেছিলাম।
আর রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা দেখি, যেখানে একসময় সকল দলকে নিষিদ্ধ করে একটি দল বাকশাল করা হয়েছিল। আমরা দেখেছি যে, বিএনপির কাঁধে যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে, তখন কীভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চালু আবার করা হয়েছিল।
কাজেই আপনি বললেন, অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ইয়েস, আমরা অতীতে এই ভালো কাজগুলো করেছি। ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ এ বিষয়গুলো কনসিডারেশন (বিবেচনায়) রেখেই সামনে এগিয়ে যাব। আমাদের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে ভবিষ্যৎ বিএনপির গণতন্ত্রের যে বুনিয়াদ, একটি শক্তিশালী বুনিয়াদ তৈরি করা। জবাবদিহি তৈরি করা।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অভিযোগ সব সময় থাকে। যখন যারা চেয়ারে বসে, জবাবদিহিতার প্রশ্নটা তখন থাকে না। মানে, এড়িয়ে যায়—এ ধরনের একটা অভিযোগ সব সময় ছিল। সব রাজনৈতিক দল বা যারাই সরকারে এসেছে।
তারেক রহমান: দেখুন, অভিযোগ থাকতেই পারে। আমি আগেই তো বলেছি, একটি বিষয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম অভিযোগ থাকতে পারে। এখন অভিযোগ নিয়ে তো আর বলা যাবে না। কিন্তু অভিযোগটা কনসিডারেশনে (বিবেচনায়) অবশ্যই রাখব। আপনি যেহেতু আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, আমি আপনাকে এটাই বলেছি। আপনি জানতে চেয়েছেন ভবিষ্যৎ কেমন হবে।
আমি আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে যা দেখেছি, বুঝেছি, জেনেছি, আমি আপনার সামনে সেটিই তুলে ধরলাম। অভিযোগ এ দেশেও আছে, কিন্তু আপনি যা জানতে চাইছেন, এটি তো আমি একমাত্র সুযোগ যদি পাই, আমি ইনশআল্লাহ সুযোগ পেলে পরে তখন আস্তে আস্তে জিনিসটি প্রমাণ করা সম্ভব হবে।
হ্যাঁ, এটাও বাস্তবতা। প্রাগমেটিক কথা যেটা, বাস্তব কথা যেটা, আমি সুযোগ পেলে যে সাথে সাথেই বিষয়টি হবে তা না। কারণ, আমি সুযোগ পেলে আপনাকেও বুঝতে হবে। আপনিও কিন্তু দেশ গঠনের একটা পার্ট। কাজেই আপনার মতো এরকম লক্ষকোটি মানুষকে বিষয়টি বুঝতে হবে। এতটুকু বলতে পারি যে, ইয়েস, উই আর কমিটেড। উই উইল ট্রাই আওয়ার বেস্ট টু ডু পারফরম বেস্ট ডু দ্যাট।
বিবিসি বাংলা: জবাবদিহির কথা বলছিলেন। এ প্রসঙ্গে বলি, গত ১৫ বছর আপনি নির্বাসনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ায়, এটা একটা ভিন্ন পরিস্থিতি। নেতৃত্ব নিয়ে আপনার চিন্তাধারায় কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে? আপনি কী অনুভব করেন, অনুধাবন করেন?
তারেক রহমান: গত ১৭ বছর প্রবাসজীবনে আছি এবং অনেকগুলো বছর আমি বাংলাদেশের সাথে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা টাইম ডিফারেন্স, ডিস্টেন্স ডিফারেন্স তো আছেই। রিচিং ডিফারেন্স তো একটা ডিফিকাল্টিস তো আছেই। এটি একটি বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আমি আমার পরিবার অর্থাৎ, আমার স্ত্রী এবং আমার সন্তানকে এখানে ধন্যবাদ দিতে চাই। কারণ তাদের সহযোগিতা না থাকলে হয়তো এই ডিফিকাল্ট কাজটি করা আমার জন্য আরও ডিফিকাল্ট হতো। ওনাদের সহযোগিতা ছিল, সে জন্য আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
একই সাথে আমি আবারও ধন্যবাদ দিতে চাই আমার হাজারো-লক্ষ নেতাকর্মীকে। যাঁরা এই ডিফিকাল্টিজের মধ্যে থেকেও আমাকে সহযোগিতা করেছেন দলকে সুসংগঠিত রাখতে, দলকে রাজপথে নিয়ে যেতে শত অত্যাচার, বাধাবিঘ্নের মাঝেও জনগণের কথা তুলে ধরতে, জনগণের দাবির ব্যাপারে সোচ্চার থাকতে। আপনি জিজ্ঞেস করেছেন মনে হয় যে, এখানে (যুক্তরাজ্যে) থেকে কী কী দেখেছি, শিখেছি বা জেনেছি। আমি মনে করি, এই দেশ থেকে ভালো যা কিছু দেখেছি বা শিখেছি। দেশের নাগরিক হিসেবে এবং যেহেতু আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী, হয়তো আমার একটি সুযোগ আছে দেশের জন্য ভালো কিছু করার।
যদি আমি ইনশাআল্লাহ সেই সুযোগ পাই, তাহলে যতটুকু সম্ভব দেশের মানুষের জন্য বা দেশের জন্য কিছু করার, এভাবে বিষয়টিকে আমি বিবেচনা করি।
কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির মূলনীতি কী হবে?
বিবিসি বাংলা: কূটনীতির প্রসঙ্গে আসি। বিএনপি যদি সরকার গঠন করে, তাহলে কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির মূলনীতি কী হবে?
তারেক রহমান: গুড কোশ্চেন। বিএনপির মূলনীতি একটাই—সবার আগে বাংলাদেশ। কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির নীতি সবার আগে বাংলাদেশ। আমার জনগণ, আমার দেশ, আমার সার্বভৌমত্ব। এটিকে অক্ষুণ্ন রেখে, এর স্বার্থ বিবেচনা করে, এই স্বার্থকে অটুট রেখে বাকি সবকিছু।
বিবিসি বাংলা: এটাকে বৈশ্বিক রাজনীতির একটা প্রভাব বলা যায়? কারণ আপনি যদি বিভিন্ন দেশে দেখেন, এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পও আমেরিকা ফার্স্ট একটা স্লোগান দিয়ে এসেছিলেন।
তারেক রহমান: না, ওদেরটা ওরা বলেছে, আমি ভাই বাংলাদেশি। আমার কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ বড়, আমার কাছে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ বড়। কাজেই কে কী বলল...সবার আগে বাংলাদেশ, সিম্পল, কমপ্লিকেট (জটিল) করার কিছু নাই, এটা সিম্পল ব্যাপার।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে অবস্থান কী?
বিবিসি বাংলা: বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে যে সম্পর্ক ছিল, সেটা নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। তো ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে আপনাদের নীতি কী হবে?
তারেক রহমান: আমার মনে হয়, আপনি একটু আগে যে প্রশ্নগুলো করেছেন, সেখানে বোধহয় আমি ক্লিয়ার করেছি পুরো ব্যাপারটা। সবার আগে বাংলাদেশ। এখানে তো আপনি পার্টিকুলার (সুনির্দিষ্ট) একটি দেশের কথা বলেছেন।
এখানে ওই দেশ বা অন্য দেশ তো বিষয় না। বিষয় তো হচ্ছে, ভাই, বাংলাদেশ আমার কাছে আমার স্বার্থ, আমি আগে আমার দেশের মানুষের স্বার্থ দেখব, আমার দেশের স্বার্থ দেখব। ওটাকে আমি রেখে আপহোল্ড করে আমি যা যা করতে পারব, আমি তা-ই করব।
বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশের স্বার্থ আপনারা সবার আগে নেবেন, সেটা আপনি পরিষ্কার করেছেন। ভারতের কথা বিশেষভাবে আসছে, যেহেতু সেটি বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ এবং বাংলাদেশের তিন পাশেই এই দেশের সীমান্ত রয়েছে। এবং এটি নিয়ে আপনিও জানেন যে, বিভিন্ন সময়ে কথা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও কথা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সময় তো সম্পর্ক নিয়ে বললামই, সেটা নিয়ে কথা হয়েছে। তাদের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বা কেমন থাকা প্রয়োজন—এ নিয়ে আপনার চিন্তা কী?
তারেক রহমান: অবশ্যই আমি আমার পানির হিস্যা চাই। অবশ্যই আমি দেখতে চাই না যে, আরেক ফেলানী ঝুলে আছে। অবশ্যই আমরা এটা মেনে নিব না।
বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশের স্বার্থের প্রসঙ্গে আপনি বলছেন যে, পানির হিস্যা চাওয়া এবং সীমান্ত হত্যার বিষয়টি নিয়ে আপনারা সোচ্চার থাকবেন।
তারেক রহমান: না না, আমি উদাহরণ দিয়ে বললাম। দুটো উদাহরণ দিয়ে বোঝালাম আপনাকে যে আমাদের স্ট্যান্ডটা কী হবে। আমরা আমাদের পানির হিস্যা চাই। অর্থাৎ আমার দেশের হিস্যা, মানুষের হিস্যা আমি চাই, হিসাব আমি চাই।
আমার যেটা ন্যায্য, সেটা আমি চাই। অবশ্যই ফেলানী হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আমি বোঝাতে চেয়েছি যে, আমার মানুষের ওপরে আঘাত আসলে অবশ্যই সেই আঘাতকে এভাবে আমি মেনে নেব না।
বিবিসি বাংলা: একটা বিষয় যদি বলি, ৫ অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবং আপনিও জানেন যে, শেখ হাসিনা দিল্লিতে গেছেন এবং সেখানে আছেন। ভারতের সাথে একটা সম্পর্কের শীতলতা দেখা গেছে গত এক বছর ধরে। যেমন ধরুন, সেটি যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে, ব্যবসার ক্ষেত্রে নানা রকম, সেই ক্ষেত্রে কি কোনো পরিবর্তন আপনারা সরকারে এলে হবে বা পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন—এমন কোনো চিন্তা কি আপনাদের আছে?
তারেক রহমান: এখন তারা যদি স্বৈরাচারকে সেখানে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়, সেখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। এটা বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাদের সাথে শীতল থাকবে। সো, আমাকে আমার দেশের মানুষের সাথে থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর সংসদ ও দলীয় নেতৃত্বের প্রশ্নে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: সংস্কারের প্রশ্নে আসি। এখন খুব আলোচিত ইস্যু। সংস্কারের কিছু বিষয়ে দেখা যাচ্ছে যে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের কিছুটা মতপার্থক্য বা মতবিরোধ হচ্ছে। যেমন—এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা বা দলের প্রধান থাকতে পারবেন না, এরকম একটা প্রস্তাব এসেছে, যেখানে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। যদি এক ব্যক্তি তিন পদে একই সাথে থাকেন, সেটা স্বৈরতান্ত্রিক একটা ব্যবস্থা তৈরির সুযোগ দেয় কি না?
তারেক রহমান: সকলের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এই যে বাংলাদেশে রাষ্ট্র মেরামতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, থাকবেন না—এরকম আরও যে বিষয়গুলো আছে, এগুলো বাংলাদেশে যখন স্বৈরাচার ছিল তাদের মুখের ওপরে, তাদের চোখের দিকে চোখ রেখে আমরা বিএনপিই বলেছিলাম।
এখন হয়তো অনেকে সংস্কারের কথা বলছেন। সেদিন কিন্তু সংস্কারের ’স’-ও তারা বলেননি। তার পরেও সকলের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে আমি বলতে চাই যে, বিএনপি ’নোট অব ডিসেন্ট’ দিলে সেটি সমস্যা, অর্থাৎ বিএনপিকে অ্যাগ্রি (সম্মত) করতে হবে সবার সাথে, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু বিএনপি যদি কোনোটার সাথে একমত না হয়, তাহলে বেঠিক। এটি তো গণতন্ত্র হলো না।
মানে, আমাকে অন্যের সাথে একমত হতে হবে, তাহলে গণতন্ত্র। আমি যদি অন্যের সাথে দ্বিমত করি, তাহলে গণতন্ত্র না। এটি কেমন গণতন্ত্র? কারণ গণতন্ত্রের মানেই তো হচ্ছে, বিভিন্ন মতামত থাকবে। আমরা অনেক ব্যাপারেই একমত হব হয়তো। সকল ব্যাপারে একমত হবো না, কিছু ব্যাপারে হয়তো দ্বিমত থাকতেই পারে। এটাই তো গণতন্ত্র, এটাই তো এসেন্স অব গণতন্ত্র।
আমরা তো কোনো হাইড অ্যান্ড সিক করছি না। আমি যেটা মনে করছি যে ভাই, আমি মনে করছি যেটা আমার দৃষ্টিতে ঠিক না, আমি বলছি ঠিক না।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু দুই বছর আগে ২০২৩ সালে আপনারা ৩১ দফা দিয়েছেন। সেই ৩১ দফাতেই আপনারা সংস্কারের যেসব বিষয় এনেছেন, সেখানে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলেছেন। তাহলে এ বিষয়গুলোতে আপত্তি কেন?
তারেক রহমান: না, আমরা যেটাতে বলেছিলাম, আমরা সেখানে এখনো আছি। যতটুকু ভারসাম্য হওয়া উচিত, যে যে বিষয়ে যতটুকু বিবেচনা করা উচিত, আমরা সে বিষয়ের মধ্যে এখনো কমবেশি আছি। আমাদের অবস্থান থেকে তো আমরা অবস্থান পরিবর্তন করিনি।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু মূল যে বিষয়গুলো, যেমন যেটা বড় বিরোধ হিসেবে আসছে, বড় মতপার্থক্য হিসেবে আসছে যে, এক ব্যক্তির তিন পদে একসাথে থাকা, সেখানেই তো আপত্তিটা থাকছে বিএনপির।
তারেক রহমান: না, আমরা তো তখনো বলিনি যে এক ব্যক্তি তিন পদে থাকতে পারবে না। এটা অন্যরা কেউ বলেছে যে, এক ব্যক্তি তিন পদে থাকতে পারবে না। আমরা মনে করি না যে, এটাতে স্বৈরাচারী হওয়ার কোনো কারণ আছে।
আমরা তো দেখেছি, স্বৈরাচারের সময়ও এবং তার আগে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তাদের টু থার্ড মেজরিটি ছিল। টু থার্ড মেজরিটি ২০০৮ সালে তারা নিয়েছিল। তারা ওটাকে চেঞ্জ করে ফেলেছে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাখেনি।
২০০১ সালে তো বিএনপিরও টু থার্ড মেজরিটি ছিল, বিএনপি তো চেঞ্জ করেনি। যেহেতু জনগণ মনে করে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে; বিএনপি টু থার্ড মেজরিটি থাকার পরেও তো চেঞ্জ করেনি।
কাজেই এক ব্যক্তির হাতে থাকলেই যে স্বৈরাচর হবে তা নয়। এটি নির্ভর করে ব্যক্তি টু ব্যক্তি, শুধু আইন চেঞ্জ করলেই সবকিছু সঠিক হয়ে যাবে না।
৩১ দফা, নাকি জুলাই সনদ, অগ্রাধিকার কী হবে
বিবিসি বাংলা: এই সংস্কারের বিষয়গুলোতে যেখানে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নিয়ে একটা জুলাই সনদ প্রণয়নের কথা। সেটাও বাস্তবায়নের উপায়গুলো নিয়ে বা বাস্তবায়নের পথ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে একটা বিতর্ক আছে। অনেক দল বলছে যে, নির্বাচনের আগেই আইনি ভিত্তি দেওয়া বা বাস্তবায়ন করা। আর বিএনপি বলছে, নির্বাচিত সংসদ সেটা করবে। এই জায়গাটা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী, বিএনপির চিন্তাটা এখন কী?
তারেক রহমান: দেখুন, এখানে আবার আমাকে বলতে হচ্ছে, আমরা কিন্তু কোনো হাইড এন্ড সিক করছি না। যদি আমাদের সেরকম অসৎ উদ্দেশ্য থাকত মনের ভিতরে, বলতাম আরেকটা যে ঠিক আছে, ওকে, অসুবিধা নাই। তার পরে ইনশআল্লাহ আমরা সরকার গঠনে সক্ষম হলে আমরা হয়তো করতাম না। তো আমরা যেটা মনে করছি, সেটাই বলছি।
এখন বিষয় হচ্ছে দেখুন, এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ইম্পর্টেন্ট একটি বিষয়। দেখুন, আমরা যদি ইভেন রিসেন্ট যে ঘটনা, নেপালেও যদি দেখি, আপনি দেখেন, ওরা কিন্তু এত কিছুর মধ্যে যাচ্ছে না। ওরা বলছে যে, গুরুত্বপূর্ণ যা বিষয় আছে, সংস্কার বলেন বা বিভিন্ন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যা বিষয় আছে—নির্বাচিত প্রতিনিধি যাঁরা আসবেন, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি যাঁরা আসবেন, তাঁরা সেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তার পরেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবকিছু বিবেচনা করে রাজনৈতিক দলগুলো বসেছে, অন্তর্বর্তী সরকার আহ্বান করেছে। এখানে যতটুকু হয়েছে, আমরা বলেছি, এখন যতটুকু হয়েছে, যেগুলো শুধু আইন দিয়ে করলে হয়ে যায়, সেগুলো হয়ে যাক। যেগুলোর সাংবিধানিক এনডোর্সমেন্ট লাগবে, সেগুলো আমরা মনে করি যে, নির্বাচিত সংসদ হওয়ার পরে সেখানে গ্রহণ করাটাই ভালো হবে।
কারণ, আপনি যদি নির্বাচিত সংসদের কথা বলেন, অথচ তাকে বাদ দিয়ে যদি আপনি আউট অব দ্য বক্স কিছু করেন এবং এটা যদি রেওয়াজ হয়ে যায়, তাহলে এটা আমরা মনে করি যে, এটা সাংবিধানিকভাবে হোক, আইনগতভাবে হোক বা যে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করেন না কেন, ভবিষ্যতের জন্য এটা একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
সে জন্য আমরা মনে করি, যেটা দেশের জন্য সামগ্রিকভাবে ক্ষতির একটি কারণ হবে। সে জন্যই আমরা এটার সাথে একমত না।
বিবিসি বাংলা: এখন বিএনপির যেহেতু ৩১ দফা আছে, যদিও যেসব বিষয় আলোচনায় এসেছে, অনেক বিষয়ে মিল আছে। তো বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে বা সরকার গঠন করে, তখন ৩১ দফা নাকি জুলাই সনদ—কোনটা অগ্রাধিকার পাবে?
তারেক রহমান: আমরা যেগুলোতে একমত হয়েছি, প্রথমে আমরা সেগুলোর ওপরেই জোর দিব। সেটা আপনি যে নামেই বলেন না কেন, স্বাভাবিকভাবে আমরা ঐকমত্য কমিশনে যেগুলোতে সকলে মিলে একমত হয়েছি, আমরা প্রথমে সেগুলোতে ইনশাআল্লাহ সরকার গঠনের সুযোগ পেলে প্রথমে সেগুলোতেই অবশ্যই জোর দিব।
আর, তারপরে আপনি যেটা ৩১ দফার কথা বললেন, অবশ্যই ৩১ দফা আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট জনগণের প্রতি। আমরা তো আমাদের ৩১ দফার মধ্যে যেগুলোর এটার সাথে মিলে গিয়েছে, সেগুলো তো আমরা করবই। এর বাইরে যেগুলো থাকবে ৩১ দফায় আছে, সেগুলোও বাস্তবায়ন করব।
কারণ ওটা তো আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট। এটাও যেমন পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট, ওটাও আমাদের পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট। এটা আমরা রাজনৈতিক দলগুলো মিলে একত্রিত হয়ে বলেছি। ওটাও আমরা অনেকগুলো রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েই কিন্তু ৩১ দফা দিয়েছি।
‘বিড়ালটি আমার মেয়ের’
বিবিসি বাংলা: রাজনীতি থেকে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। আপনাকে সম্প্রতি প্রাণী অধিকার রক্ষা নিয়ে বেশ সোচ্চার দেখা গেছে। এ-সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে আপনি যোগ দিয়েছেন। রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের বাইরে আপনার পোষা বিড়ালের সঙ্গে আপনার নিয়মিত ছবি দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তো এটা আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কীভাবে?
তারেক রহমান: প্রথমত এখানে একটু ক্লিয়ার করে নেই, বিড়ালটি আমার মেয়ের। ও এখন অবশ্য সবারই হয়ে গিয়েছে। আমরা সবাই ওকে আদর করি।
বিষয়টি হচ্ছে, এরকম শুধু বিড়াল নয়, আমি এবং আমার ভাই যখন ছোট ছিলাম, আমাদের একটি ছোট কুকুরও ছিল। ইভেন, তখন আমাদের বাসায় আম্মা হাঁস-মুরগি পালতেন, ছাগলও ছিল আমাদের বাসায়। উনি ছাগলও কয়েকটি পালতেন।
তো স্বাভাবিকভাবেই আপনি যেই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলেন, পোষা কুকুর-বিড়ালই বলেন, বাই দ্য ওয়ে কবুতরও ছিল আমাদের বাসায়। শুধু কবুতর না, আমাদের বাসায় একটি বিরাট বড় খাঁচা ছিল। সেই খাঁচার মধ্যে কিন্তু পাখি ছিল, বিভিন্ন রকমের এবং আবার আরেকটি খাঁচা ছিল, যেটার মধ্যে একটা ময়না ছিল।
ময়নাটা আমরা বরিশাল থেকে এনেছিলাম। ও আবার বরিশালি ভাষায় কথাও বলত। টুকটুক করে মাঝে মাঝে কিছু কিছু কথাও বলত। কাজেই বিষয়টি হঠাৎ করেই না। এই পশুপাখির প্রতি যে বিষয়টি, এটির সাথে আমি কমবেশি ছোটবেলা থেকে জড়িত আছি। হয়তো এটি এখন প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্নভাবে। বাট, এটির সাথে আমি বা আমার পরিবার, আমরা অনেক আগে থেকেই আছি।
কুকুর-বিড়াল ছিল, গরু-ছাগল ছিল, হাঁস-মুরগি ছিল, পাখি ছিল, ময়না ছিল, কবুতর ছিল। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা চিন্তা করি, আমাদের আল্লাহ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তৈরি করেছেন। আমাদের দায়িত্ব কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টি যা কিছু আছে প্রকৃতির, তার প্রতি কিন্তু যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এটি একটি বিষয়।
আর আমরা যদি মানবিক দৃষ্টিকোণ অথবা আমরা যদি নেচার থেকেও বিষয়টি দেখি, দেখুন, ওরা না থাকলে কিন্তু আমাদের জন্য বেঁচে থাকা কষ্টকর। প্রকৃতি যদি না থাকে, প্রকৃতির ব্যালেন্স যদি না থাকে।
এই আলোচনা শুরু হওয়ার আগে কিন্তু আপনি আমরা তিনজন কিন্তু ওয়েদার নিয়ে কথা বলছিলাম, এই ইংল্যান্ডের বা ইউকের ওয়েদার নিয়ে আমরা আলাপ করছিলাম এবং আমি বলছিলাম যে, আমার এই ১৭ বছর অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ওয়েদার মনে হয় একটু একটু এখানেও চেঞ্জ হয়েছে। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে পত্রপত্রিকায় দেখেছি পলিউশন ঢাকা শহরে। নরমালি আমরা জানি যে, একটি দেশের টোটাল অংশের মধ্যে এটলিস্ট ২৫ শতাংশ গ্রীন দরকার, বনায়ন দরকার। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আমি যতটুকু জেনেছি, এটি ১২ পার্সেন্টের মতো। হুইচ ইস ভেরি ডেঞ্জারাস।
তো এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি—কীভাবে আমরা বাড়াব। তো যেমন এগুলো আছে, ঠিক একই সাথে এই যে আপনি পশুপাখির কথা বললেন, এ বিষয়গুলো আছে নেচার। নেচারকে যদি আমরা মিনিমাম ঠিক রাখতে না পারি, সেখানে মানুষ হিসেবে কিন্তু আমাদের বসবাস করা খুব কঠিন হয়ে যাবে। কাজেই আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এ বিষয়গুলো বোধহয় করা প্রয়োজন।
সামাজিক মাধ্যমে মিম, কার্টুন কীভাবে দেখেন
বিবিসি বাংলা: রাজনীতিতে যেমন আপনাকে নিয়ে অনেক আলোচনা আছে, স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক মাধ্যমেও আপনাকে নিয়ে অনেক আলোচনা আছে এবং আপনি যে পোস্টগুলো করেন, সেটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। আপনাকে নিয়ে অনেক মিমও তৈরি হয়, অনেক কার্টুন হয়। যেমন—একটা মিমের কথা যদি আমি বলি, অনেকে শেয়ার করেছিল যে, আপনি আপনার সাথে আমরা জুমে কথা বলছি, আপনি জুমে বক্তব্য দেন। এটা নিয়ে একটা মিম তৈরি হয়েছে যে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, তো এ ধরনের মিমগুলো আপনি কীভাবে দেখেন?
তারেক রহমান: আমি এনজয় করি বেশ, বেশ আমি এনজয় করি।
বিবিসি বাংলা: আপনি দেখেন এগুলো? আপনার চোখে পড়ে?
তারেক রহমান: হ্যাঁ, চোখে পড়বে না কেন, অবশ্যই চোখে পড়ে। তবে এখানে একটি কথা আছে, যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়টি এল, আমার মনে হয় এ বিষয়ে একটু এড করা উচিত।
দেখুন, সোশ্যাল মিডিয়া এমন একটি বিষয়, আমি নিজেও আছি সোশ্যাল মিডিয়ায় কমবেশি। বহু বহু মানুষ আছেন, লক্ষকোটি মানুষ আছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এটি দিয়ে যেমন খুব দ্রুত একজনের সাথে আরেকজনের যোগাযোগ করা যায়।
আমরা মাঝে মাঝে বলি যে, দেখেন, অনেক সময় অনেক আলোচনায় আসে, সেমিনার-বক্তব্যে আসে যে, ডিনামাইটটা যখন আবিষ্কৃত হয়, ডিনামাইটটা আবিষ্কৃত হয়েছিল আপনার পাহাড় ভেঙে কীভাবে মানুষের চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট তৈরি করা যায়; হয়তো কীভাবে চাষের জমি করা যায়। এরকম লক্ষ্য সামনে রেখেই, উদ্দেশ্য সামনে রেখেই কমবেশি ডিনামাইটের ব্যবহারটা শুরু হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখেছি, এটি মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই যে, অবশ্যই প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে। যেহেতু আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। মানুষের বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাস করি। প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে তার মতামত প্রকাশ করার।
তবে আমরা যদি সকলে এতটুকু সচেতন হই যে, আমি আমার মত প্রকাশ করলাম, কিন্তু এই মত প্রকাশের ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি না—এ বিষয়টিকে যদি আমরা বিবেচনায় রাখি, একটি মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হলো কি না, ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি না—এসব বিষয় বোধহয় আমাদের বিবেচনায় রাখা উচিত; এটি এক নম্বর।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ার বহুল ব্যবহারের ফলে ডিসইনফরমেশন বা মিসইনফরমেশন বিষয়টিও চলে এসেছে সামনে। এ কথাও চলে এসেছে। একটি জিনিস আমি দেখলাম বা শুনলাম, সাথে সাথেই আমি সেটিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তা না করে আমার মনে হয়, ফ্যাক্ট চেক বলে যেই কথাটি আছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, এটা সব জায়গায় আছে—এ ব্যাপারেও যদি আমরা একটু অ্যালার্ট থাকি সবাই, এ ব্যাপারে যদি একটু সচেতন থাকি যে ঠিক আছে, এটি একটু যাচাইবাছাই করে নিই।
যদি সত্য হয়, অবশ্যই আমার সেখানে মতামত থাকবে। কিন্তু যদি মিথ্যা হয় বিষয়টি, কেন আমি এখানে মতামত দিব? একটি মিথ্যার সাথে আমি কেন নিজেকে সংশ্লিষ্ট করব? একটি খারাপ কিছুর সাথে কেন আমি নিজেকে সংশ্লিষ্ট করব? এটি আমি আমার মতামতটা প্রকাশ করলাম।
মানুষের আস্থার প্রশ্নে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: আমরা প্রায় শেষ দিকে চলে এসেছি। আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই যে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন যেটা হয়েছে গত বছরের ৫ আগস্ট। তারপর থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হবে—এই প্রশ্নে মানুষকে কীভাবে আস্থায় নেবেন?
তারেক রহমান: এই প্রশ্নের উত্তরে যদি একটু এভাবে বলি, স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দল হিসেবে তো আমাদের একটি পরিকল্পনা আছে। আপনাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে আমি কিছু কিছু বলেছি।
ব্যাপারটা হচ্ছে এরকম যে, দেখুন এই মুহূর্তে মাঠে আমরা যেই রাজনৈতিক দলগুলো আছি, আমরা ধরে নিতে পারি, সেই রাজনৈতিক দলগুলো ইনশআল্লাহ আগামীতে দেশ পরিচালনা করতে পারে। তার মধ্যে বিএনপিরই কিন্তু দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে।
আপনাকে যদি বলি, ধরেন এখন লন্ডন আসবেন। তো আপনি একটা প্লেনে উঠলেন। যে প্লেন চালাবে, সে যদি আপনাকে বলে যে ভাই কিছু মনে করেন না, আমার ঠিক লাইসেন্সটা হয়নি এখনো, তবে আমার মনে হয় আমি চেষ্টা করলে আপনাকে নিয়ে যেতে পারব লন্ডন পর্যন্ত উড়িয়ে। আপনি কি তার সাথে উঠবেন প্লেনে? নিশ্চয়ই আপনি উঠবেন না।
আপনি একজন অভিজ্ঞ ড্রাইভারের সাথে উঠতে পারেন। কিন্তু অভিজ্ঞ ড্রাইভারও গাড়ি হয়তো ঠিকই চালাচ্ছে সেফলি, কিন্তু রাস্তায় তো গর্ত খানাখন্দ থাকবেই, একটু জার্কিং হতেই পারে। জোরে অনেক সময় ব্রেক হতেই পারে, ঝাঁকুনি লাগতেই পারে, কিন্তু অভিজ্ঞ ড্রাইভার আপনাকে মোটামুটি ঠিকভাবে নিয়ে যাবে। নিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ সে চেষ্টা করবে। কারণ তার সেই অভিজ্ঞতা আছে।
কাজেই আমরা যদি দেখি যে, ভালো কাজ বা কমিটমেন্ট আপনি যেটা বলেন, বিএনপি করবে কি না। আমরা তো করেছি। হতে পারে আমাদের দ্বারা কিছু ভুল-ত্রুটি হয়েছে।
আপনি একটু আগে একটা কথা বলেছিলেন, মানুষ তো অতীত থেকেই শিখে। ইয়েস, আমরাও দেখেছি, আমরাও অতীত থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি যে ঠিক আছে এই কাজটি এভাবে করলে হয়তো ভুল হয়, এটি আমরা ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ করব না। বাট আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা ভালো-মন্দ যাচাই করতে পারব।
একই সাথে আমাদের কমিটমেন্ট আছে, যে কমিটমেন্ট দিয়ে আমরা ডেলিভারি করতে পারব এবং আমরা ডেলিভারি করতে চাই।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান
বিবিসি বাংলা: শেষ প্রশ্নটি করি তাহলে আপনাকে এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই। বিগত সরকারের আমলে তাদের একটা বিষয় বড় সমালোচনা ছিল যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ। আপনারা যদি ক্ষমতায় আসেন, সে ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদ বা সংবাদমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়নের বিষয়গুলো যে আর হবে না, সেই নিশ্চয়তা কি আপনি দিতে পারেন?
তারেক রহমান: জ্ব, ইয়েস পারি। একদম দিতে পারি। আপনি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পত্রপত্রিকা খুলুন। আমি কারও নাম উল্লেখ করব না, কোনো পত্রিকার কথা উল্লেখ করব না। শুধু খুলে দেখুন কীভাবে অনেক খবর ছাপা হয়েছিল, যার সত্যতা কিন্তু ছিল না, অপপ্রচার ছিল। কিন্তু অপপ্রচারটা সংবাদ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আপনি কি শুনেছেন, আপনি কি আমাকে প্রমাণ দিতে পারবেন, বলতে পারবেন যে বিএনপির সময়, আমি কিন্তু বলতে পারব অনেক অনেক সাংবাদিকের নাম, যাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন স্বৈরাচারের সময় এবং পরবর্তীতে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ইভেন, এখনো অনেকে প্রবাসজীবনে আছেন, এরকম বহু সাংবাদিক।
আমি বলতে পারব, স্বৈরাচারের সময় বহু সাংবাদিককে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন করে বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ধমক দেওয়া হতো। বিএনপির সময় এগুলো করা হয়নি, কারণ তখন সংবাদপত্রে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে তৎকালীন বিএনপি সরকার সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে, যদি ওই রকম হতো, তাহলে কিন্তু ওরকম খবর প্রকাশিত হতো না।
অর্থাৎ, বিএনপির সময় যদি অত্যাচার-নির্যাতন থাকত, তাহলে খবরগুলো প্রকাশিত হতো না স্বাভাবিকভাবে, যা হয়নি বিগত সরকারের সময় স্বৈরাচার সরকারের সময়। কাজেই আপনাকে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, বিএনপির অতীত সরকারের সময় যেরকম সাংবাদিকদের গুম করা হয়নি। সাংবাদিকদের নির্যাতন করা হয়নি। সাংবাদিকদের দেশ ছেড়ে যেতে হয়নি, বাধ্য হতে হয়নি। ইনশআল্লাহ ভবিষ্যতেও হবে না।
বিবিসি বাংলা: তাহলে কি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে—এ ধরনের যে আইনগুলো রয়েছে, সেগুলো আপনারা বাতিল করবেন, এটা কি ধরে নেওয়া যায়?
তারেক রহমান: অবশ্যই, আমরা সকলে মিলে বসব, আলোচনা করব। আপনাদের মতো সাংবাদিকসহ যাঁরা আছেন, তাঁদের সাথে আলোচনা করব। আলোচনা করে সেগুলো এরকম কালো আইন যা যা আছে, আমরা আস্তে আস্তে ঠিক করব।
তবে এখানে বোধহয় একটি বিষয় আবার আমাকে উল্লেখ করতে হয়, যেটি আমি সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে বলেছি। দেখুন, এটি তো সবাইকে মিলে করতে হবে। অপপ্রচারকে তো অবশ্যই সংবাদ হিসেবে তো প্রচার করা ঠিক নয়, তাই না?
আমাদের কাছে আপনাদের যেরকম চাওয়া থাকবে, ভবিষ্যৎ সরকারের কাছে, যারাই আসুক সরকারে, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমাদেরও অনুরোধ থাকবে আপনাদের প্রতি যে অপপ্রচার সংবাদ হিসেবে যেন প্রচারিত না হয়—এ বিষয়টি একটু সকলকে সচেতন বা খেয়াল রাখতে হবে।
বিবিসি বাংলা: তারেক রহমান, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলার জন্য।
তারেক রহমান: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমার কথাগুলো দেশের মানুষের সামনে আমি তুলে ধরতে পেরেছি। সেই সুযোগটুকু আপনারা করে দিয়েছেন, তার জন্য আপনাদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ।
বিবিসি বাংলা: এখন বাংলাদেশের সরকার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
তারেক রহমান: বিষয়টি তো রাজনৈতিক। এটি তো কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়। আমরা প্রথম থেকে যে কথাটি বলছি, আমরা চাই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সফল হোক। অর্থাৎ, অনেক কিছুর মতো বিভিন্ন বিষয় আছে। যেমন—আমরা যদি মূল দুটো বিষয় বলি যে, কিছু সংস্কারের বিষয় আছে, একই সাথে প্রত্যাশিত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, স্বাধীন নির্বাচনের একটি বিষয় আছে।
মূলত কিছু সংস্কারসহ যে সংস্কারগুলো না করলেই নয়, এরকম সংস্কারসহ একটি স্বাভাবিক সুষ্ঠু, স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাই হচ্ছে বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য। আমরা প্রত্যাশা করি, ওনারা উনাদের ওপরে যেটা মূল দায়িত্ব, সেটি ওনারা সঠিকভাবে সম্পাদন করবেন। এটাই তো তাঁদের কাছে আমাদের চাওয়া রাজনৈতিক দল হিসেবে।
আমরা আশা রাখি, প্রত্যাশা করি যে, ওনারা কাজটি সুন্দরভাবে করবেন। স্বাভাবিকভাবে এই কাজের সৌন্দর্য বা কতটুকু ভালো, কতটুকু ভালো বা মন্দভাবে করতে পারছেন, তার ওপরেই মনে হয় সম্পর্কের উষ্ণতা বা শীতলতা যেটাই বলেন, সেটা নির্ভর করবে।
বিবিসি বাংলা: আপনি কয়েক মাস আগে একটি মন্তব্য করেছিলেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আপনার এই মন্তব্য নিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, এ বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী? তিনি তখন বলেছিলেন, সন্দেহটা ওনার মনে। অর্থাৎ, আপনার মনে সন্দেহ আছে কি না, সেটা তিনি জানতে চান। আপনার মনে কি সেই সন্দেহ আছে?
তারেক রহমান: দেখুন, আমি যখন কথাটি বলেছিলাম, এই মুহূর্তে আমার যতটুকু মনে পড়ে, সেই সময় পর্যন্ত ওনারা কিন্তু নির্বাচনের ব্যাপারে সঠিক কোনো টাইম ফ্রেম বা কোনো কিছু বলেননি।
রোডম্যাপ বলতে যা বোঝায়, আমরা নরমালি যা বুঝে থাকি, এরকম কিছু বলেননি। এবং সে কারণেই শুধু আমার মনের মধ্যেই নয়, আমরা যদি সেই সময় বিভিন্ন মিডিয়া দেখি, বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব দেখি, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা করেন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে, প্রায় সবার মনের মধ্যেই সন্দেহ ছিল।
আমরা যখন দেখলাম যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ডক্টর ইউনূস, উনি মোটামুটিভাবে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করলেন। এবং পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার উনি ওনার যে সিদ্ধান্ত, সেটির ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তারপর থেকেই খুব স্বাভাবিকভাবেই এই সন্দেহ বহু মানুষের মন থেকে ধীরে ধীরে চলে যেতে ধরেছে।
আমি মনে করি, ওনারা যা বলেছেন, ওনারা যতক্ষণ পর্যন্ত দৃঢ় থাকবেন, ওনাদের বক্তব্যে, ওনাদের কাজে যত বেশি দৃঢ় থাকবেন, ততই সন্দেহ চলে যাবে আস্তে আস্তে।
বিবিসি বাংলা: সেই সন্দেহ মনে কিছুটা দূরীভূত হয়েছিল লন্ডনে যখন তিনি আপনার সঙ্গে বৈঠক করলেন। তার পরেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা এসেছিল। তো সেই বৈঠকে নির্বাচনের কথা তো হয়েছিল, যেহেতু সেটি পরে এসেছে। এর বাইরে কি আপনাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়েছে? আর কোনো বিষয়ে কোনো চিন্তাভাবনা বা সমঝোতা কিছু হয়েছে?
তারেক রহমান: এর বাইরে স্বাভাবিকভাবেই উনি একজন অত্যন্ত স্বনামধন্য মানুষ। অত্যন্ত বিজ্ঞ মানুষ উনি। এর বাইরে তো অবশ্যই স্বাভাবিকভাবে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হয়েছে। এর বাইরেও উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন যে, জনগণ যদি আপনাদের সুযোগ দেয়, তাহলে আপনারা কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য—এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
আমার কিছু চিন্তাভাবনা দেশের মানুষকে নিয়ে, দেশের জনগণকে নিয়ে, দেশকে নিয়ে আমরা যদি সুযোগ পাই, জনগণ আমাদের যদি সেই সুযোগ দেন, তাহলে আমরা কী কী বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করব, সে বিষয়গুলো নিয়ে কিছু কিছু আলোচনা হয়েছে।
বিবিসি বাংলা: নির্বাচনের বিষয়টি তো আপনি বললেন, এর বাইরে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে গত এক বছরে যে ভূমিকা রেখেছে অন্তর্বর্তী সরকার, সেটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
তারেক রহমান: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানে ইন্টেরিম, মানে এটা তো ক্ষণস্থায়ী বিষয়। তো খুব স্বাভাবিকভাবেই একটি দেশ পরিচালনা তো একটি বিশাল বিষয়। আমরা হয়তো ভূখণ্ডের ভিত্তিতে যদি বিবেচনা করি, হয়তো বাংলাদেশকে অনেকে বলবে ছোট দেশ। কিন্তু আমরা যদি জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিবেচনা করি, বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক ভূখণ্ডের চেয়ে বড় দেশ।
ইউকের (যুক্তরাজ্য) জনসংখ্যা ৭ কোটির মতো, বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্লাস-মাইনাস ২০ কোটির মতো এখন। কাজেই ইউকের তিন গুণ বড়। এরকম একটি দেশ পরিচালনা করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই জনগণের ম্যান্ডেটসহ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকার প্রয়োজন। বিভিন্ন বিষয় থাকে, ইস্যুজ থাকে, বিভিন্ন বিষয় আছে।
তো এখন নির্বাচনের বাইরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পারফরমেন্স আপনি যেটা বললেন, আমরা সবকিছু বিবেচনা করলে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, হয়তো ওনারা চেষ্টা করেছেন অনেক বিষয়ে। সব ক্ষেত্রে সবাই তো আর সফল হতে পারে না, স্বাভাবিকভাবে ওনাদের লিমিটেশনস কিছু আছে। সেই লিমিটেশনসের মধ্যে ওনারা হয়তো চেষ্টা করেছেন, যতটুকু পেরেছেন হয়তো চেষ্টা করছেন।
এক এগারোর সরকার নিয়ে মূল্যায়ন কী?
বিবিসি বাংলা: আমি একটু পিছনে তাকাতে চাই।
তারেক রহমান: ভাই, আমরা তো সামনে যেতে চাই। আপনি পেছনে কেন যাচ্ছেন? দেশকে সামনে নিতে হবে।
বিবিসি বাংলা: মানে, পেছন থেকেই তো শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে হয়। তো পেছনের একটা বিষয়, সেটা হচ্ছে, এক-এগারোর সরকার বা সেনাসমর্থিত সরকারের সেই সময়টা নিয়ে রাজনীতিতে অনেক আলোচনা আছে। সে সময়টাকে ঘিরে আপনার মূল্যায়ন কী?
তারেক রহমান: এক বাক্যে বা সংক্ষেপে যদি বলতে হয়, এক-এগারোর সরকার তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি সরকার ছিল।
আমরা দেখেছি, সেই সরকার আসলে কীভাবে দেশের যতটুকু যেমনই হোক বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যতটুকুই রাজনীতি গড়ে উঠেছিল, গণতান্ত্রিক ভিত্তি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল ভুল-ত্রুটি সবকিছুর ভিতর দিয়েই। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, কীভাবে তারা সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, বিরাজনীতিকরণ করতে চেয়েছিল। দেশকে একটি অন্ধকার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দেখেছি যে, খুব সম্ভবত তাদেরই ভিন্ন আরেকটি রূপ; অন্যভাবে দেখেছি আমরা ’ইন দ্য নেম অব ডেমোক্রেসি’।
বিএনপির রাজনীতিতে পরিবর্তন হয়েছে কতটা
বিবিসি বাংলা: ২০০৪ সালে আমি আপনার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ঢাকায়। সে সময় আপনি বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করবেন। তো বিএনপির রাজনীতিতে আসলে কতটা পরিবর্তন হয়েছে; ভবিষ্যৎ বিএনপিই বা কেমন হবে?
তারেক রহমান: আমাদের রাজনীতির মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণ, দেশ এবং দেশের সার্বভৌমত্ব। আমরা দুটো বিষয় নিয়ে বাংলাদেশে খুবই গর্ব করি, অহংকার করি। একটি হচ্ছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প, আরেকটি হচ্ছে প্রবাসীরা দিন-রাত পরিশ্রম করে যে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান—এ দুটোই কিন্তু বিএনপি শুরু করেছিল।
আমরা দেখেছি, বিএনপির সময়ে শুরু হয়েছিল প্রবাসীদের বিদেশ যাওয়া, একই সাথে গার্মেন্ট শিল্পের প্রসার। এর বাইরেও যদি আমরা দেখি, ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষটা হয়েছিল, পরবর্তীতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন, আমরা দেখেছি কীভাবে ধীরে ধীরে দুর্ভিক্ষপীড়িত একটি দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসপূর্ণ করে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণ না, অল্প পরিমাণ করে হলেও আমরা কিন্তু সেই সময় বিদেশে খাদ্য রপ্তানি, চাল রপ্তানি করেছিলাম।
আর রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা দেখি, যেখানে একসময় সকল দলকে নিষিদ্ধ করে একটি দল বাকশাল করা হয়েছিল। আমরা দেখেছি যে, বিএনপির কাঁধে যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে, তখন কীভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চালু আবার করা হয়েছিল।
কাজেই আপনি বললেন, অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ইয়েস, আমরা অতীতে এই ভালো কাজগুলো করেছি। ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ এ বিষয়গুলো কনসিডারেশন (বিবেচনায়) রেখেই সামনে এগিয়ে যাব। আমাদের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে ভবিষ্যৎ বিএনপির গণতন্ত্রের যে বুনিয়াদ, একটি শক্তিশালী বুনিয়াদ তৈরি করা। জবাবদিহি তৈরি করা।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা অভিযোগ সব সময় থাকে। যখন যারা চেয়ারে বসে, জবাবদিহিতার প্রশ্নটা তখন থাকে না। মানে, এড়িয়ে যায়—এ ধরনের একটা অভিযোগ সব সময় ছিল। সব রাজনৈতিক দল বা যারাই সরকারে এসেছে।
তারেক রহমান: দেখুন, অভিযোগ থাকতেই পারে। আমি আগেই তো বলেছি, একটি বিষয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম অভিযোগ থাকতে পারে। এখন অভিযোগ নিয়ে তো আর বলা যাবে না। কিন্তু অভিযোগটা কনসিডারেশনে (বিবেচনায়) অবশ্যই রাখব। আপনি যেহেতু আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, আমি আপনাকে এটাই বলেছি। আপনি জানতে চেয়েছেন ভবিষ্যৎ কেমন হবে।
আমি আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে যা দেখেছি, বুঝেছি, জেনেছি, আমি আপনার সামনে সেটিই তুলে ধরলাম। অভিযোগ এ দেশেও আছে, কিন্তু আপনি যা জানতে চাইছেন, এটি তো আমি একমাত্র সুযোগ যদি পাই, আমি ইনশআল্লাহ সুযোগ পেলে পরে তখন আস্তে আস্তে জিনিসটি প্রমাণ করা সম্ভব হবে।
হ্যাঁ, এটাও বাস্তবতা। প্রাগমেটিক কথা যেটা, বাস্তব কথা যেটা, আমি সুযোগ পেলে যে সাথে সাথেই বিষয়টি হবে তা না। কারণ, আমি সুযোগ পেলে আপনাকেও বুঝতে হবে। আপনিও কিন্তু দেশ গঠনের একটা পার্ট। কাজেই আপনার মতো এরকম লক্ষকোটি মানুষকে বিষয়টি বুঝতে হবে। এতটুকু বলতে পারি যে, ইয়েস, উই আর কমিটেড। উই উইল ট্রাই আওয়ার বেস্ট টু ডু পারফরম বেস্ট ডু দ্যাট।
বিবিসি বাংলা: জবাবদিহির কথা বলছিলেন। এ প্রসঙ্গে বলি, গত ১৫ বছর আপনি নির্বাসনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ায়, এটা একটা ভিন্ন পরিস্থিতি। নেতৃত্ব নিয়ে আপনার চিন্তাধারায় কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে? আপনি কী অনুভব করেন, অনুধাবন করেন?
তারেক রহমান: গত ১৭ বছর প্রবাসজীবনে আছি এবং অনেকগুলো বছর আমি বাংলাদেশের সাথে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা টাইম ডিফারেন্স, ডিস্টেন্স ডিফারেন্স তো আছেই। রিচিং ডিফারেন্স তো একটা ডিফিকাল্টিস তো আছেই। এটি একটি বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই আমি আমার পরিবার অর্থাৎ, আমার স্ত্রী এবং আমার সন্তানকে এখানে ধন্যবাদ দিতে চাই। কারণ তাদের সহযোগিতা না থাকলে হয়তো এই ডিফিকাল্ট কাজটি করা আমার জন্য আরও ডিফিকাল্ট হতো। ওনাদের সহযোগিতা ছিল, সে জন্য আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
একই সাথে আমি আবারও ধন্যবাদ দিতে চাই আমার হাজারো-লক্ষ নেতাকর্মীকে। যাঁরা এই ডিফিকাল্টিজের মধ্যে থেকেও আমাকে সহযোগিতা করেছেন দলকে সুসংগঠিত রাখতে, দলকে রাজপথে নিয়ে যেতে শত অত্যাচার, বাধাবিঘ্নের মাঝেও জনগণের কথা তুলে ধরতে, জনগণের দাবির ব্যাপারে সোচ্চার থাকতে। আপনি জিজ্ঞেস করেছেন মনে হয় যে, এখানে (যুক্তরাজ্যে) থেকে কী কী দেখেছি, শিখেছি বা জেনেছি। আমি মনে করি, এই দেশ থেকে ভালো যা কিছু দেখেছি বা শিখেছি। দেশের নাগরিক হিসেবে এবং যেহেতু আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী, হয়তো আমার একটি সুযোগ আছে দেশের জন্য ভালো কিছু করার।
যদি আমি ইনশাআল্লাহ সেই সুযোগ পাই, তাহলে যতটুকু সম্ভব দেশের মানুষের জন্য বা দেশের জন্য কিছু করার, এভাবে বিষয়টিকে আমি বিবেচনা করি।
কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির মূলনীতি কী হবে?
বিবিসি বাংলা: কূটনীতির প্রসঙ্গে আসি। বিএনপি যদি সরকার গঠন করে, তাহলে কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির মূলনীতি কী হবে?
তারেক রহমান: গুড কোশ্চেন। বিএনপির মূলনীতি একটাই—সবার আগে বাংলাদেশ। কূটনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির নীতি সবার আগে বাংলাদেশ। আমার জনগণ, আমার দেশ, আমার সার্বভৌমত্ব। এটিকে অক্ষুণ্ন রেখে, এর স্বার্থ বিবেচনা করে, এই স্বার্থকে অটুট রেখে বাকি সবকিছু।
বিবিসি বাংলা: এটাকে বৈশ্বিক রাজনীতির একটা প্রভাব বলা যায়? কারণ আপনি যদি বিভিন্ন দেশে দেখেন, এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পও আমেরিকা ফার্স্ট একটা স্লোগান দিয়ে এসেছিলেন।
তারেক রহমান: না, ওদেরটা ওরা বলেছে, আমি ভাই বাংলাদেশি। আমার কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ বড়, আমার কাছে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ বড়। কাজেই কে কী বলল...সবার আগে বাংলাদেশ, সিম্পল, কমপ্লিকেট (জটিল) করার কিছু নাই, এটা সিম্পল ব্যাপার।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে অবস্থান কী?
বিবিসি বাংলা: বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে যে সম্পর্ক ছিল, সেটা নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। তো ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে আপনাদের নীতি কী হবে?
তারেক রহমান: আমার মনে হয়, আপনি একটু আগে যে প্রশ্নগুলো করেছেন, সেখানে বোধহয় আমি ক্লিয়ার করেছি পুরো ব্যাপারটা। সবার আগে বাংলাদেশ। এখানে তো আপনি পার্টিকুলার (সুনির্দিষ্ট) একটি দেশের কথা বলেছেন।
এখানে ওই দেশ বা অন্য দেশ তো বিষয় না। বিষয় তো হচ্ছে, ভাই, বাংলাদেশ আমার কাছে আমার স্বার্থ, আমি আগে আমার দেশের মানুষের স্বার্থ দেখব, আমার দেশের স্বার্থ দেখব। ওটাকে আমি রেখে আপহোল্ড করে আমি যা যা করতে পারব, আমি তা-ই করব।
বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশের স্বার্থ আপনারা সবার আগে নেবেন, সেটা আপনি পরিষ্কার করেছেন। ভারতের কথা বিশেষভাবে আসছে, যেহেতু সেটি বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ এবং বাংলাদেশের তিন পাশেই এই দেশের সীমান্ত রয়েছে। এবং এটি নিয়ে আপনিও জানেন যে, বিভিন্ন সময়ে কথা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও কথা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সময় তো সম্পর্ক নিয়ে বললামই, সেটা নিয়ে কথা হয়েছে। তাদের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বা কেমন থাকা প্রয়োজন—এ নিয়ে আপনার চিন্তা কী?
তারেক রহমান: অবশ্যই আমি আমার পানির হিস্যা চাই। অবশ্যই আমি দেখতে চাই না যে, আরেক ফেলানী ঝুলে আছে। অবশ্যই আমরা এটা মেনে নিব না।
বিবিসি বাংলা: বাংলাদেশের স্বার্থের প্রসঙ্গে আপনি বলছেন যে, পানির হিস্যা চাওয়া এবং সীমান্ত হত্যার বিষয়টি নিয়ে আপনারা সোচ্চার থাকবেন।
তারেক রহমান: না না, আমি উদাহরণ দিয়ে বললাম। দুটো উদাহরণ দিয়ে বোঝালাম আপনাকে যে আমাদের স্ট্যান্ডটা কী হবে। আমরা আমাদের পানির হিস্যা চাই। অর্থাৎ আমার দেশের হিস্যা, মানুষের হিস্যা আমি চাই, হিসাব আমি চাই।
আমার যেটা ন্যায্য, সেটা আমি চাই। অবশ্যই ফেলানী হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আমি বোঝাতে চেয়েছি যে, আমার মানুষের ওপরে আঘাত আসলে অবশ্যই সেই আঘাতকে এভাবে আমি মেনে নেব না।
বিবিসি বাংলা: একটা বিষয় যদি বলি, ৫ অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবং আপনিও জানেন যে, শেখ হাসিনা দিল্লিতে গেছেন এবং সেখানে আছেন। ভারতের সাথে একটা সম্পর্কের শীতলতা দেখা গেছে গত এক বছর ধরে। যেমন ধরুন, সেটি যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে, ব্যবসার ক্ষেত্রে নানা রকম, সেই ক্ষেত্রে কি কোনো পরিবর্তন আপনারা সরকারে এলে হবে বা পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন—এমন কোনো চিন্তা কি আপনাদের আছে?
তারেক রহমান: এখন তারা যদি স্বৈরাচারকে সেখানে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়, সেখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। এটা বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাদের সাথে শীতল থাকবে। সো, আমাকে আমার দেশের মানুষের সাথে থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর সংসদ ও দলীয় নেতৃত্বের প্রশ্নে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: সংস্কারের প্রশ্নে আসি। এখন খুব আলোচিত ইস্যু। সংস্কারের কিছু বিষয়ে দেখা যাচ্ছে যে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের কিছুটা মতপার্থক্য বা মতবিরোধ হচ্ছে। যেমন—এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা বা দলের প্রধান থাকতে পারবেন না, এরকম একটা প্রস্তাব এসেছে, যেখানে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। যদি এক ব্যক্তি তিন পদে একই সাথে থাকেন, সেটা স্বৈরতান্ত্রিক একটা ব্যবস্থা তৈরির সুযোগ দেয় কি না?
তারেক রহমান: সকলের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এই যে বাংলাদেশে রাষ্ট্র মেরামতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না, থাকবেন না—এরকম আরও যে বিষয়গুলো আছে, এগুলো বাংলাদেশে যখন স্বৈরাচার ছিল তাদের মুখের ওপরে, তাদের চোখের দিকে চোখ রেখে আমরা বিএনপিই বলেছিলাম।
এখন হয়তো অনেকে সংস্কারের কথা বলছেন। সেদিন কিন্তু সংস্কারের ’স’-ও তারা বলেননি। তার পরেও সকলের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে আমি বলতে চাই যে, বিএনপি ’নোট অব ডিসেন্ট’ দিলে সেটি সমস্যা, অর্থাৎ বিএনপিকে অ্যাগ্রি (সম্মত) করতে হবে সবার সাথে, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু বিএনপি যদি কোনোটার সাথে একমত না হয়, তাহলে বেঠিক। এটি তো গণতন্ত্র হলো না।
মানে, আমাকে অন্যের সাথে একমত হতে হবে, তাহলে গণতন্ত্র। আমি যদি অন্যের সাথে দ্বিমত করি, তাহলে গণতন্ত্র না। এটি কেমন গণতন্ত্র? কারণ গণতন্ত্রের মানেই তো হচ্ছে, বিভিন্ন মতামত থাকবে। আমরা অনেক ব্যাপারেই একমত হব হয়তো। সকল ব্যাপারে একমত হবো না, কিছু ব্যাপারে হয়তো দ্বিমত থাকতেই পারে। এটাই তো গণতন্ত্র, এটাই তো এসেন্স অব গণতন্ত্র।
আমরা তো কোনো হাইড অ্যান্ড সিক করছি না। আমি যেটা মনে করছি যে ভাই, আমি মনে করছি যেটা আমার দৃষ্টিতে ঠিক না, আমি বলছি ঠিক না।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু দুই বছর আগে ২০২৩ সালে আপনারা ৩১ দফা দিয়েছেন। সেই ৩১ দফাতেই আপনারা সংস্কারের যেসব বিষয় এনেছেন, সেখানে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলেছেন। তাহলে এ বিষয়গুলোতে আপত্তি কেন?
তারেক রহমান: না, আমরা যেটাতে বলেছিলাম, আমরা সেখানে এখনো আছি। যতটুকু ভারসাম্য হওয়া উচিত, যে যে বিষয়ে যতটুকু বিবেচনা করা উচিত, আমরা সে বিষয়ের মধ্যে এখনো কমবেশি আছি। আমাদের অবস্থান থেকে তো আমরা অবস্থান পরিবর্তন করিনি।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু মূল যে বিষয়গুলো, যেমন যেটা বড় বিরোধ হিসেবে আসছে, বড় মতপার্থক্য হিসেবে আসছে যে, এক ব্যক্তির তিন পদে একসাথে থাকা, সেখানেই তো আপত্তিটা থাকছে বিএনপির।
তারেক রহমান: না, আমরা তো তখনো বলিনি যে এক ব্যক্তি তিন পদে থাকতে পারবে না। এটা অন্যরা কেউ বলেছে যে, এক ব্যক্তি তিন পদে থাকতে পারবে না। আমরা মনে করি না যে, এটাতে স্বৈরাচারী হওয়ার কোনো কারণ আছে।
আমরা তো দেখেছি, স্বৈরাচারের সময়ও এবং তার আগে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তাদের টু থার্ড মেজরিটি ছিল। টু থার্ড মেজরিটি ২০০৮ সালে তারা নিয়েছিল। তারা ওটাকে চেঞ্জ করে ফেলেছে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাখেনি।
২০০১ সালে তো বিএনপিরও টু থার্ড মেজরিটি ছিল, বিএনপি তো চেঞ্জ করেনি। যেহেতু জনগণ মনে করে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে; বিএনপি টু থার্ড মেজরিটি থাকার পরেও তো চেঞ্জ করেনি।
কাজেই এক ব্যক্তির হাতে থাকলেই যে স্বৈরাচর হবে তা নয়। এটি নির্ভর করে ব্যক্তি টু ব্যক্তি, শুধু আইন চেঞ্জ করলেই সবকিছু সঠিক হয়ে যাবে না।
৩১ দফা, নাকি জুলাই সনদ, অগ্রাধিকার কী হবে
বিবিসি বাংলা: এই সংস্কারের বিষয়গুলোতে যেখানে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নিয়ে একটা জুলাই সনদ প্রণয়নের কথা। সেটাও বাস্তবায়নের উপায়গুলো নিয়ে বা বাস্তবায়নের পথ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে একটা বিতর্ক আছে। অনেক দল বলছে যে, নির্বাচনের আগেই আইনি ভিত্তি দেওয়া বা বাস্তবায়ন করা। আর বিএনপি বলছে, নির্বাচিত সংসদ সেটা করবে। এই জায়গাটা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী, বিএনপির চিন্তাটা এখন কী?
তারেক রহমান: দেখুন, এখানে আবার আমাকে বলতে হচ্ছে, আমরা কিন্তু কোনো হাইড এন্ড সিক করছি না। যদি আমাদের সেরকম অসৎ উদ্দেশ্য থাকত মনের ভিতরে, বলতাম আরেকটা যে ঠিক আছে, ওকে, অসুবিধা নাই। তার পরে ইনশআল্লাহ আমরা সরকার গঠনে সক্ষম হলে আমরা হয়তো করতাম না। তো আমরা যেটা মনে করছি, সেটাই বলছি।
এখন বিষয় হচ্ছে দেখুন, এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ইম্পর্টেন্ট একটি বিষয়। দেখুন, আমরা যদি ইভেন রিসেন্ট যে ঘটনা, নেপালেও যদি দেখি, আপনি দেখেন, ওরা কিন্তু এত কিছুর মধ্যে যাচ্ছে না। ওরা বলছে যে, গুরুত্বপূর্ণ যা বিষয় আছে, সংস্কার বলেন বা বিভিন্ন বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যা বিষয় আছে—নির্বাচিত প্রতিনিধি যাঁরা আসবেন, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি যাঁরা আসবেন, তাঁরা সেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।
তার পরেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবকিছু বিবেচনা করে রাজনৈতিক দলগুলো বসেছে, অন্তর্বর্তী সরকার আহ্বান করেছে। এখানে যতটুকু হয়েছে, আমরা বলেছি, এখন যতটুকু হয়েছে, যেগুলো শুধু আইন দিয়ে করলে হয়ে যায়, সেগুলো হয়ে যাক। যেগুলোর সাংবিধানিক এনডোর্সমেন্ট লাগবে, সেগুলো আমরা মনে করি যে, নির্বাচিত সংসদ হওয়ার পরে সেখানে গ্রহণ করাটাই ভালো হবে।
কারণ, আপনি যদি নির্বাচিত সংসদের কথা বলেন, অথচ তাকে বাদ দিয়ে যদি আপনি আউট অব দ্য বক্স কিছু করেন এবং এটা যদি রেওয়াজ হয়ে যায়, তাহলে এটা আমরা মনে করি যে, এটা সাংবিধানিকভাবে হোক, আইনগতভাবে হোক বা যে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করেন না কেন, ভবিষ্যতের জন্য এটা একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
সে জন্য আমরা মনে করি, যেটা দেশের জন্য সামগ্রিকভাবে ক্ষতির একটি কারণ হবে। সে জন্যই আমরা এটার সাথে একমত না।
বিবিসি বাংলা: এখন বিএনপির যেহেতু ৩১ দফা আছে, যদিও যেসব বিষয় আলোচনায় এসেছে, অনেক বিষয়ে মিল আছে। তো বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে বা সরকার গঠন করে, তখন ৩১ দফা নাকি জুলাই সনদ—কোনটা অগ্রাধিকার পাবে?
তারেক রহমান: আমরা যেগুলোতে একমত হয়েছি, প্রথমে আমরা সেগুলোর ওপরেই জোর দিব। সেটা আপনি যে নামেই বলেন না কেন, স্বাভাবিকভাবে আমরা ঐকমত্য কমিশনে যেগুলোতে সকলে মিলে একমত হয়েছি, আমরা প্রথমে সেগুলোতে ইনশাআল্লাহ সরকার গঠনের সুযোগ পেলে প্রথমে সেগুলোতেই অবশ্যই জোর দিব।
আর, তারপরে আপনি যেটা ৩১ দফার কথা বললেন, অবশ্যই ৩১ দফা আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট জনগণের প্রতি। আমরা তো আমাদের ৩১ দফার মধ্যে যেগুলোর এটার সাথে মিলে গিয়েছে, সেগুলো তো আমরা করবই। এর বাইরে যেগুলো থাকবে ৩১ দফায় আছে, সেগুলোও বাস্তবায়ন করব।
কারণ ওটা তো আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট। এটাও যেমন পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট, ওটাও আমাদের পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট। এটা আমরা রাজনৈতিক দলগুলো মিলে একত্রিত হয়ে বলেছি। ওটাও আমরা অনেকগুলো রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েই কিন্তু ৩১ দফা দিয়েছি।
‘বিড়ালটি আমার মেয়ের’
বিবিসি বাংলা: রাজনীতি থেকে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। আপনাকে সম্প্রতি প্রাণী অধিকার রক্ষা নিয়ে বেশ সোচ্চার দেখা গেছে। এ-সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে আপনি যোগ দিয়েছেন। রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের বাইরে আপনার পোষা বিড়ালের সঙ্গে আপনার নিয়মিত ছবি দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তো এটা আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কীভাবে?
তারেক রহমান: প্রথমত এখানে একটু ক্লিয়ার করে নেই, বিড়ালটি আমার মেয়ের। ও এখন অবশ্য সবারই হয়ে গিয়েছে। আমরা সবাই ওকে আদর করি।
বিষয়টি হচ্ছে, এরকম শুধু বিড়াল নয়, আমি এবং আমার ভাই যখন ছোট ছিলাম, আমাদের একটি ছোট কুকুরও ছিল। ইভেন, তখন আমাদের বাসায় আম্মা হাঁস-মুরগি পালতেন, ছাগলও ছিল আমাদের বাসায়। উনি ছাগলও কয়েকটি পালতেন।
তো স্বাভাবিকভাবেই আপনি যেই দৃষ্টিকোণ থেকেই বলেন, পোষা কুকুর-বিড়ালই বলেন, বাই দ্য ওয়ে কবুতরও ছিল আমাদের বাসায়। শুধু কবুতর না, আমাদের বাসায় একটি বিরাট বড় খাঁচা ছিল। সেই খাঁচার মধ্যে কিন্তু পাখি ছিল, বিভিন্ন রকমের এবং আবার আরেকটি খাঁচা ছিল, যেটার মধ্যে একটা ময়না ছিল।
ময়নাটা আমরা বরিশাল থেকে এনেছিলাম। ও আবার বরিশালি ভাষায় কথাও বলত। টুকটুক করে মাঝে মাঝে কিছু কিছু কথাও বলত। কাজেই বিষয়টি হঠাৎ করেই না। এই পশুপাখির প্রতি যে বিষয়টি, এটির সাথে আমি কমবেশি ছোটবেলা থেকে জড়িত আছি। হয়তো এটি এখন প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্নভাবে। বাট, এটির সাথে আমি বা আমার পরিবার, আমরা অনেক আগে থেকেই আছি।
কুকুর-বিড়াল ছিল, গরু-ছাগল ছিল, হাঁস-মুরগি ছিল, পাখি ছিল, ময়না ছিল, কবুতর ছিল। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা চিন্তা করি, আমাদের আল্লাহ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তৈরি করেছেন। আমাদের দায়িত্ব কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টি যা কিছু আছে প্রকৃতির, তার প্রতি কিন্তু যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এটি একটি বিষয়।
আর আমরা যদি মানবিক দৃষ্টিকোণ অথবা আমরা যদি নেচার থেকেও বিষয়টি দেখি, দেখুন, ওরা না থাকলে কিন্তু আমাদের জন্য বেঁচে থাকা কষ্টকর। প্রকৃতি যদি না থাকে, প্রকৃতির ব্যালেন্স যদি না থাকে।
এই আলোচনা শুরু হওয়ার আগে কিন্তু আপনি আমরা তিনজন কিন্তু ওয়েদার নিয়ে কথা বলছিলাম, এই ইংল্যান্ডের বা ইউকের ওয়েদার নিয়ে আমরা আলাপ করছিলাম এবং আমি বলছিলাম যে, আমার এই ১৭ বছর অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ওয়েদার মনে হয় একটু একটু এখানেও চেঞ্জ হয়েছে। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে পত্রপত্রিকায় দেখেছি পলিউশন ঢাকা শহরে। নরমালি আমরা জানি যে, একটি দেশের টোটাল অংশের মধ্যে এটলিস্ট ২৫ শতাংশ গ্রীন দরকার, বনায়ন দরকার। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আমি যতটুকু জেনেছি, এটি ১২ পার্সেন্টের মতো। হুইচ ইস ভেরি ডেঞ্জারাস।
তো এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি—কীভাবে আমরা বাড়াব। তো যেমন এগুলো আছে, ঠিক একই সাথে এই যে আপনি পশুপাখির কথা বললেন, এ বিষয়গুলো আছে নেচার। নেচারকে যদি আমরা মিনিমাম ঠিক রাখতে না পারি, সেখানে মানুষ হিসেবে কিন্তু আমাদের বসবাস করা খুব কঠিন হয়ে যাবে। কাজেই আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এ বিষয়গুলো বোধহয় করা প্রয়োজন।
সামাজিক মাধ্যমে মিম, কার্টুন কীভাবে দেখেন
বিবিসি বাংলা: রাজনীতিতে যেমন আপনাকে নিয়ে অনেক আলোচনা আছে, স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক মাধ্যমেও আপনাকে নিয়ে অনেক আলোচনা আছে এবং আপনি যে পোস্টগুলো করেন, সেটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। আপনাকে নিয়ে অনেক মিমও তৈরি হয়, অনেক কার্টুন হয়। যেমন—একটা মিমের কথা যদি আমি বলি, অনেকে শেয়ার করেছিল যে, আপনি আপনার সাথে আমরা জুমে কথা বলছি, আপনি জুমে বক্তব্য দেন। এটা নিয়ে একটা মিম তৈরি হয়েছে যে, ওয়ার্ক ফ্রম হোম, তো এ ধরনের মিমগুলো আপনি কীভাবে দেখেন?
তারেক রহমান: আমি এনজয় করি বেশ, বেশ আমি এনজয় করি।
বিবিসি বাংলা: আপনি দেখেন এগুলো? আপনার চোখে পড়ে?
তারেক রহমান: হ্যাঁ, চোখে পড়বে না কেন, অবশ্যই চোখে পড়ে। তবে এখানে একটি কথা আছে, যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়টি এল, আমার মনে হয় এ বিষয়ে একটু এড করা উচিত।
দেখুন, সোশ্যাল মিডিয়া এমন একটি বিষয়, আমি নিজেও আছি সোশ্যাল মিডিয়ায় কমবেশি। বহু বহু মানুষ আছেন, লক্ষকোটি মানুষ আছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এটি দিয়ে যেমন খুব দ্রুত একজনের সাথে আরেকজনের যোগাযোগ করা যায়।
আমরা মাঝে মাঝে বলি যে, দেখেন, অনেক সময় অনেক আলোচনায় আসে, সেমিনার-বক্তব্যে আসে যে, ডিনামাইটটা যখন আবিষ্কৃত হয়, ডিনামাইটটা আবিষ্কৃত হয়েছিল আপনার পাহাড় ভেঙে কীভাবে মানুষের চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট তৈরি করা যায়; হয়তো কীভাবে চাষের জমি করা যায়। এরকম লক্ষ্য সামনে রেখেই, উদ্দেশ্য সামনে রেখেই কমবেশি ডিনামাইটের ব্যবহারটা শুরু হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখেছি, এটি মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই যে, অবশ্যই প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে। যেহেতু আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। মানুষের বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাস করি। প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে তার মতামত প্রকাশ করার।
তবে আমরা যদি সকলে এতটুকু সচেতন হই যে, আমি আমার মত প্রকাশ করলাম, কিন্তু এই মত প্রকাশের ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি না—এ বিষয়টিকে যদি আমরা বিবেচনায় রাখি, একটি মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হলো কি না, ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি না—এসব বিষয় বোধহয় আমাদের বিবেচনায় রাখা উচিত; এটি এক নম্বর।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়ার বহুল ব্যবহারের ফলে ডিসইনফরমেশন বা মিসইনফরমেশন বিষয়টিও চলে এসেছে সামনে। এ কথাও চলে এসেছে। একটি জিনিস আমি দেখলাম বা শুনলাম, সাথে সাথেই আমি সেটিতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তা না করে আমার মনে হয়, ফ্যাক্ট চেক বলে যেই কথাটি আছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, এটা সব জায়গায় আছে—এ ব্যাপারেও যদি আমরা একটু অ্যালার্ট থাকি সবাই, এ ব্যাপারে যদি একটু সচেতন থাকি যে ঠিক আছে, এটি একটু যাচাইবাছাই করে নিই।
যদি সত্য হয়, অবশ্যই আমার সেখানে মতামত থাকবে। কিন্তু যদি মিথ্যা হয় বিষয়টি, কেন আমি এখানে মতামত দিব? একটি মিথ্যার সাথে আমি কেন নিজেকে সংশ্লিষ্ট করব? একটি খারাপ কিছুর সাথে কেন আমি নিজেকে সংশ্লিষ্ট করব? এটি আমি আমার মতামতটা প্রকাশ করলাম।
মানুষের আস্থার প্রশ্নে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: আমরা প্রায় শেষ দিকে চলে এসেছি। আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই যে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন যেটা হয়েছে গত বছরের ৫ আগস্ট। তারপর থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হবে—এই প্রশ্নে মানুষকে কীভাবে আস্থায় নেবেন?
তারেক রহমান: এই প্রশ্নের উত্তরে যদি একটু এভাবে বলি, স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দল হিসেবে তো আমাদের একটি পরিকল্পনা আছে। আপনাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে আমি কিছু কিছু বলেছি।
ব্যাপারটা হচ্ছে এরকম যে, দেখুন এই মুহূর্তে মাঠে আমরা যেই রাজনৈতিক দলগুলো আছি, আমরা ধরে নিতে পারি, সেই রাজনৈতিক দলগুলো ইনশআল্লাহ আগামীতে দেশ পরিচালনা করতে পারে। তার মধ্যে বিএনপিরই কিন্তু দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে।
আপনাকে যদি বলি, ধরেন এখন লন্ডন আসবেন। তো আপনি একটা প্লেনে উঠলেন। যে প্লেন চালাবে, সে যদি আপনাকে বলে যে ভাই কিছু মনে করেন না, আমার ঠিক লাইসেন্সটা হয়নি এখনো, তবে আমার মনে হয় আমি চেষ্টা করলে আপনাকে নিয়ে যেতে পারব লন্ডন পর্যন্ত উড়িয়ে। আপনি কি তার সাথে উঠবেন প্লেনে? নিশ্চয়ই আপনি উঠবেন না।
আপনি একজন অভিজ্ঞ ড্রাইভারের সাথে উঠতে পারেন। কিন্তু অভিজ্ঞ ড্রাইভারও গাড়ি হয়তো ঠিকই চালাচ্ছে সেফলি, কিন্তু রাস্তায় তো গর্ত খানাখন্দ থাকবেই, একটু জার্কিং হতেই পারে। জোরে অনেক সময় ব্রেক হতেই পারে, ঝাঁকুনি লাগতেই পারে, কিন্তু অভিজ্ঞ ড্রাইভার আপনাকে মোটামুটি ঠিকভাবে নিয়ে যাবে। নিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ সে চেষ্টা করবে। কারণ তার সেই অভিজ্ঞতা আছে।
কাজেই আমরা যদি দেখি যে, ভালো কাজ বা কমিটমেন্ট আপনি যেটা বলেন, বিএনপি করবে কি না। আমরা তো করেছি। হতে পারে আমাদের দ্বারা কিছু ভুল-ত্রুটি হয়েছে।
আপনি একটু আগে একটা কথা বলেছিলেন, মানুষ তো অতীত থেকেই শিখে। ইয়েস, আমরাও দেখেছি, আমরাও অতীত থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি যে ঠিক আছে এই কাজটি এভাবে করলে হয়তো ভুল হয়, এটি আমরা ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ করব না। বাট আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা ভালো-মন্দ যাচাই করতে পারব।
একই সাথে আমাদের কমিটমেন্ট আছে, যে কমিটমেন্ট দিয়ে আমরা ডেলিভারি করতে পারব এবং আমরা ডেলিভারি করতে চাই।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান
বিবিসি বাংলা: শেষ প্রশ্নটি করি তাহলে আপনাকে এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েই। বিগত সরকারের আমলে তাদের একটা বিষয় বড় সমালোচনা ছিল যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ। আপনারা যদি ক্ষমতায় আসেন, সে ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদ বা সংবাদমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়নের বিষয়গুলো যে আর হবে না, সেই নিশ্চয়তা কি আপনি দিতে পারেন?
তারেক রহমান: জ্ব, ইয়েস পারি। একদম দিতে পারি। আপনি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পত্রপত্রিকা খুলুন। আমি কারও নাম উল্লেখ করব না, কোনো পত্রিকার কথা উল্লেখ করব না। শুধু খুলে দেখুন কীভাবে অনেক খবর ছাপা হয়েছিল, যার সত্যতা কিন্তু ছিল না, অপপ্রচার ছিল। কিন্তু অপপ্রচারটা সংবাদ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আপনি কি শুনেছেন, আপনি কি আমাকে প্রমাণ দিতে পারবেন, বলতে পারবেন যে বিএনপির সময়, আমি কিন্তু বলতে পারব অনেক অনেক সাংবাদিকের নাম, যাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন স্বৈরাচারের সময় এবং পরবর্তীতে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ইভেন, এখনো অনেকে প্রবাসজীবনে আছেন, এরকম বহু সাংবাদিক।
আমি বলতে পারব, স্বৈরাচারের সময় বহু সাংবাদিককে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন করে বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ধমক দেওয়া হতো। বিএনপির সময় এগুলো করা হয়নি, কারণ তখন সংবাদপত্রে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে তৎকালীন বিএনপি সরকার সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে, যদি ওই রকম হতো, তাহলে কিন্তু ওরকম খবর প্রকাশিত হতো না।
অর্থাৎ, বিএনপির সময় যদি অত্যাচার-নির্যাতন থাকত, তাহলে খবরগুলো প্রকাশিত হতো না স্বাভাবিকভাবে, যা হয়নি বিগত সরকারের সময় স্বৈরাচার সরকারের সময়। কাজেই আপনাকে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, বিএনপির অতীত সরকারের সময় যেরকম সাংবাদিকদের গুম করা হয়নি। সাংবাদিকদের নির্যাতন করা হয়নি। সাংবাদিকদের দেশ ছেড়ে যেতে হয়নি, বাধ্য হতে হয়নি। ইনশআল্লাহ ভবিষ্যতেও হবে না।
বিবিসি বাংলা: তাহলে কি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে—এ ধরনের যে আইনগুলো রয়েছে, সেগুলো আপনারা বাতিল করবেন, এটা কি ধরে নেওয়া যায়?
তারেক রহমান: অবশ্যই, আমরা সকলে মিলে বসব, আলোচনা করব। আপনাদের মতো সাংবাদিকসহ যাঁরা আছেন, তাঁদের সাথে আলোচনা করব। আলোচনা করে সেগুলো এরকম কালো আইন যা যা আছে, আমরা আস্তে আস্তে ঠিক করব।
তবে এখানে বোধহয় একটি বিষয় আবার আমাকে উল্লেখ করতে হয়, যেটি আমি সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে বলেছি। দেখুন, এটি তো সবাইকে মিলে করতে হবে। অপপ্রচারকে তো অবশ্যই সংবাদ হিসেবে তো প্রচার করা ঠিক নয়, তাই না?
আমাদের কাছে আপনাদের যেরকম চাওয়া থাকবে, ভবিষ্যৎ সরকারের কাছে, যারাই আসুক সরকারে, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমাদেরও অনুরোধ থাকবে আপনাদের প্রতি যে অপপ্রচার সংবাদ হিসেবে যেন প্রচারিত না হয়—এ বিষয়টি একটু সকলকে সচেতন বা খেয়াল রাখতে হবে।
বিবিসি বাংলা: তারেক রহমান, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলার জন্য।
তারেক রহমান: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমার কথাগুলো দেশের মানুষের সামনে আমি তুলে ধরতে পেরেছি। সেই সুযোগটুকু আপনারা করে দিয়েছেন, তার জন্য আপনাদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ।

উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দ
১১ মে ২০২৩
ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকে এই কার্যক্রমে যুক্ত। আমরা ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মুদারাবা স্কুল স্টুডেন্ট সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ চালু করেছি, যেখানে অভিভাবকেরা সন্তানদের পক্ষ থেকে হিসাব পরিচালনা করেন। মূল লক্ষ্য হলো শিশু-কিশোরদের সুদমুক্ত অর্থনীতিতে যুক্ত করা এবং ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল...
৪ দিন আগে
ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি (ইবিএল) নিয়মিতভাবে স্কুলে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং বিশেষ অফারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচেতন করছে এবং তাদের হিসাব খোলায় উৎসাহ দিচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং জ্ঞান ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব বোঝাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করি।
৪ দিন আগে
দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে আগামী নির্বাচনে দলের কৌশল, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও তাদের নেতা-কর্মীদের বিচার...
২০ দিন আগে
দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে আগামী নির্বাচনে দলের কৌশল, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও তাদের নেতা-কর্মীদের বিচার, বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিসহ সমসাময়িক নানা বিষয়ে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরেছেন তারেক রহমান।
আজকের পত্রিকা ডেস্ক

বিবিসি বাংলা: তারেক রহমান আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার সাথে যোগ দেবার জন্য।
তারেক রহমান: আপনাদেরকেও অনেক ধন্যবাদ, আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
বিবিসি বাংলা: আপনি কেমন আছেন? আপনার সময় কেমন যাচ্ছে?
তারেক রহমান: আলহামদুলিল্লাহ, আমি শারীরিকভাবে ভালো আছি। সময় তো স্বাভাবিকভাবে ব্যস্তই যাচ্ছে। ফিজিক্যালি হয়তো আমি এই দেশে আছি, বাট মন-মানসিকতা সবকিছু মিলিয়ে তো আমি গত ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশেই রয়ে গিয়েছি।
বিবিসি বাংলা: আমরা এমন একটা সময় আপনার সাথে কথা বলছি, যখন বাংলাদেশ ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল বলা হবে না। ২০২৪ সালে একটি ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনের অবসান হয়েছে। আর কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ একটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আপনি আপনার অনেক দলীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন, কথা বলেছেন, নিয়মিতই কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু গণমাধ্যমের সাথে আপনি এই দীর্ঘ সময় কথা বলেননি। এত দিন ধরে আপনি কথা বলেননি কেন?
তারেক রহমান: ব্যাপারটা বোধ হয় এ রকম না, ব্যাপারটা বোধয় একটু ভিন্ন। আসলে আমি কথা ঠিকই বলেছি। আমি দীর্ঘ ১৭ বছর এখানে আছি এই দেশে, প্রবাস জীবনে, তবে আমার ওপরে যখন দলের দায়িত্ব এসে পড়েছে; তারপর থেকে আমি গ্রামেগঞ্জে আমার নেতা-কর্মীসহ তাদের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে সাধারণ মানুষ যখন যেভাবে অংশগ্রহণ করেছে, আমি সকলের সাথে কথা বলেছি।
আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বিগত স্বৈরাচার সরকারের সময় কোর্ট থেকে রীতিমতন একটা আদেশ দিয়ে আমার কথা বলার অধিকারকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমি যদি গণমাধ্যমে কিছু বলতে চাইতাম, হয়তো গণমাধ্যমের ইচ্ছা ছিল ছাপানোর, গণমাধ্যম সেটি ছাপাতে পারত না।
আমি একবার প্রেসক্লাবে কথা বলেছিলাম। তখন পরের দিন দেখলাম যে প্রেসক্লাবে একটি তখনকার যেই প্রেসক্লাবের যারা সদস্য ছিলেন বা কমিটি ছিল, তারা একটি মিটিং ডেকে একটি সভা করে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা তখন আমাকে আইনের দৃষ্টিতে ফেরারি বলা হয়েছিল যে, সে রকম কোনো ব্যক্তিকে তারা প্রেসক্লাবে কথা বলতে দিবে না। এভাবে তারা চেষ্টা করেছিল আমার কথা বন্ধ করে রাখতে।
আমি কথা বলেছি, সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন পন্থায় আমি পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি, আমি ইনশা আল্লাহ পৌঁছেছি মানুষের কাছে। কাজেই গণমাধ্যমে যে কথা বলিনি তা না। আমি কথা বলেছি হয়তো আপনারা তখন কথা নিতে পারেননি অথবা শুনতে পারেননি। ইচ্ছা থাকলেও ছাপাতে পারেননি হয়তো প্রচার করতে পারেননি। কিন্তু আমি বলেছি আমি থেমে থাকিনি।
দেশে ফেরার প্রশ্নে যা বললেন?
বিবিসি বাংলা: আমি অবশ্য সাক্ষাৎকারের কথা বলছিলাম যে প্রশ্নোত্তরের বিষয়টি মানে বিশেষ করে গত এক বছরে। বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেছে এবং অনেকের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আপনি দেশে এসে সশরীরে দলের নেতৃত্ব দেবেন। গত এক বছরে যে প্রশ্নটা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে এবং এখনো আসছে যে আপনি এখনো দেশে ফেরেননি কেন। কেন আপনি এখনো দেশে ফেরেননি?
তারেক রহমান: কিছু সংগত কারণে হয়তো ফেরাটা হয়ে ওঠেনি এখনো। তবে সময় তো চলে এসেছে মনে হয়। ইনশা আল্লাহ দ্রুতই ফিরে আসব।
বিবিসি বাংলা: সেটা কবে, আমরা কি জানতে পারি?
তারেক রহমান: দ্রুতই মনে হয়। দ্রুতই ইনশা আল্লাহ।
বিবিসি বাংলা: নির্বাচনের আগে কি তাহলে আপনি দেশে আসবেন, এমন সম্ভাবনা বলা যায়?
তারেক রহমান: রাজনীতি যখন করি, আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে স্বাভাবিক, নির্বাচনের সাথে রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক কর্মীর একটি ওতপ্রত সম্পর্ক। কাজেই যেখানে একটি প্রত্যাশিত, জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনের সময় কেমন করে দূরে থাকব? আমি তো আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে, ইচ্ছা থাকবে, আগ্রহ থাকবে সেই প্রত্যাশিত যে প্রত্যাশিত নির্বাচন জনগণ চাইছে। সেই প্রত্যাশিত নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হবে, জনগণের সাথে জনগণের মাঝেই থাকব ইনশা আল্লাহ।
বিবিসি বাংলা: একটা বিষয়, যেটা আপনার দল থেকে, মাঝে দলের নেতাদের কেউ কেউ কখনো কখনো বলেছেন যে একটা নিরাপত্তার শঙ্কার কথা বলেছেন। আপনি না আসার পেছনে, আপনি কি কোনো ধরনের শঙ্কা বোধ করেছেন এর মধ্যে?
তারেক রহমান: বিভিন্ন রকম শঙ্কার কথা তো আমরা অনেক সময় বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে তো শুনেছি। সরকারেরও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকেও তো অনেক সময় অনেক শঙ্কার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে, বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে।
’কোনো ব্যক্তি নয়, মাস্টারমাইন্ড গণতন্ত্রকামী জনগণ’
বিবিসি বাংলা: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গে আসি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আপনার ভূমিকা নিয়ে অনেক আলোচনা আছে। এটি মোটামুটি সব পক্ষই স্বীকার করেও যে সেই সময়ে আপনার একটা সক্রিয় ভূমিকা ছিল। আবার আপনার দলের কোনো কোনো নেতা বা সমর্থক তারা এই অভ্যুত্থানে আপনাকে ’একমাত্র মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আপনি কি নিজেকে এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দেখেন?
তারেক রহমান: না। আমি অবশ্যই এই জুলাই আন্দোলনে আমাকে আমি কখনোই মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দেখি না। এই যে ৫ই অগাস্ট যেই আন্দোলন, জুলাই আন্দোলন বলে যেটি বিখ্যাত বা যেটি সকলের কাছে গৃহীত, এই আন্দোলনটি সফল হয়েছে জুলাই মাসে। কিন্তু এই আন্দোলনটি প্রেক্ষাপট শুরু হয়েছে কিন্তু বহু বছর আগে থেকে।
এই আন্দোলনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা, সেটি বিএনপি হোক বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলো হোক, যারা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছে। বিভিন্নভাবে তাদের নেতা-কর্মীরা নির্যাতিত হয়েছে।
আমি মনে করি, জুলাই-আগস্ট মাসে এসে জনগণ সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের সাথে অংশগ্রহণ করেছে। শুধু কী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাই সেদিন ছিল মাঠে? অবশ্যই নয়।
আমরা দেখেছি, সেদিন মাদ্রাসার ছাত্ররা তাঁরা ছিলেন এই আন্দোলনের মাঠে। আমরা দেখেছি গৃহিণীরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমে এসেছেন সন্তানের পেছনে। আমরা দেখেছি, কৃষক, শ্রমিক, সিএনজিচালক, ছোট দোকান কর্মচারী বা দোকানমালিক থেকে আরম্ভ করে গার্মেন্টস কর্মী—তাঁরা নেমে এসেছিলেন। আমরা দেখেছিলাম, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নেমে এসেছিলেন এই আন্দোলনে।
এমন অনেক সাংবাদিক, যাঁরা স্বৈরাচারের অত্যাচারে নির্যাতিত হয়ে দেশ থেকে বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন এই আন্দোলনে। কাজেই কারও ভূমিকাকে আমরা ছোট করে দেখতে চাই, না খাটো করে দেখতে চাই না।
আমি বিশ্বাস করি, দৃঢ়ভাবে সমাজের দলমত-নির্বিশেষে শ্রেণিবিন্যাস নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের অবদান আছে।
এই আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলন, যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাঁরাই এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড। কোনো দল, কোনো ব্যক্তি নয়, এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।
বিবিসি বাংলা: যখন আন্দোলনটা চলছিল, তখন আন্দোলনে যে ছাত্রনেতৃত্ব ছিল, তাদের সাথে আপনার কতটা যোগাযোগ ছিল? আপনার দলের সাথে তো নিশ্চয়ই যোগাযোগ ছিল, অন্যদের সাথে আপনাদের আপনার কতটা যোগাযোগ ছিল?
তারেক রহমান: স্বাভাবিকভাবে আমি যেহেতু বাইরে থেকে কাজ করছি, আমাকে যোগাযোগটা অনলাইনের মাধ্যমে রাখতে হয়েছে এবং সেই দিনগুলোতে আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে টেলিফোন সিস্টেম বা অনলাইন সিস্টেমের কী অবস্থা করেছিল স্বৈরাচার।
আপনি যোগাযোগের যেটি কথা বলেছেন, এই যোগাযোগটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিভিন্নভাবে আমাদেরকে করতে হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে করতে হয়েছে। যোগাযোগটা যে খুব স্মুথ সব সময় থেকেছে, তা নয়। প্রত্যেকে সহযোগিতা করেছি আমরা।
বিবিসি বাংলা: ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান, সেটির পরে এটার কৃতিত্ব কার সেটা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ দাবি করেছে, তাতে কি আপনার মনে হয় যে এর ফলে বিভিন্ন পক্ষের যে সংকীর্ণ স্বার্থ পূরণের চেষ্টা, সেটাই একটু বেশি প্রকট হয়েছে এবং এখানে বিএনপির আসলে কোনো দায় আছে কি না?
তারেক রহমান: দেখুন ব্যাপারটা আমরা যদি একটু অন্যভাবে দেখি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এটি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।
এই আন্দোলন, মানুষের এই আত্মত্যাগ সাধারণত কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে বা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শিশু হত্যা হয় না, শিশু শহীদ হয় না, শিশু মৃত্যুবরণ করে না। বাট আমরা দেখেছি এই আন্দোলনে স্বৈরাচারের এই আন্দোলনে যতটুকু আমার মনে আছে, প্রায় ৬৩ জন শিশু শহীদ হয়েছে, মারা গিয়েছে।
আমি আগেই বলেছি, আপনার আগের প্রশ্নের উত্তরে বলেছি যে এই আন্দোলনের ক্রেডিট দলমত-নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণের, কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নয়।
অনেকে হয়তো অনেক কিছু বলে থাকতে পারেন, ডিমান্ড করতে পারেন, সেটি তাঁদের অবস্থান।
আমি বা আমার দলের অবস্থান হচ্ছে, আন্দোলন হয়ে গিয়েছে, আন্দোলনের জনগণ সফলতা লাভ করেছেন। আন্দোলনে স্বাভাবিকভাবেই দুটো পক্ষ আছে। একটি পক্ষ হচ্ছে মানুষ শহীদ হয়েছে। ২০০০-এর মতো মানুষকে হত্যা করা হয়েছে আন্দোলনে। আবার আরেকটি পক্ষ হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজারের মতন মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অন্ধ হয়ে গিয়েছেন।
আমার মনে হয়, আমাদের উচিত হবে, এখন আমাদের সকলের উচিত হবে রাষ্ট্রসহ সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলোর যার যতটুকু সম্ভব, সেই পরিবারগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। যতটুকু সহযোগিতা তাদেরকে করা যায়, যতটুকু সম্ভব তাদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের এই আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানানো।
নির্বাচন এককভাবে নাকি দলগতভাবে
বিবিসি বাংলা: অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই দেখা গেছে যে বিএনপির পক্ষ থেকে দ্রুত নির্বাচন দাবি করা হয়েছে। সরকার গড়িমসি করছে এ ধরনের অভিযোগও বিএনপির নেতারা করে আসছেন। তো এখন দেখা যাচ্ছে যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং নির্বাচন কমিশন তারা ফেব্রুয়ারিতে একটা নির্বাচনের সময় দিয়েছেন। তো ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে—আপনাদের আস্থা কতটা আছে তাতে?
তারেক রহমান: বিএনপি প্রথম থেকেই বলে আসছিল যে যত দ্রুত নির্বাচনটি হবে, তত দ্রুত দেশের মধ্যে একটি স্থিতিশীলতা আসবে। দেখুন বাংলাদেশের মানুষ গত ১৭ বছর যাবৎ তাদের রাজনৈতিক অধিকার যেমন তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তাদেরকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিল।
যার ফলশ্রুতিতে আমরা সমাজে অনেকগুলো পর্যায়ক্রমিকভাবে স্পিলওভার ইফেক্ট বলতে যা বোঝায় অনেকগুলো খারাপ লক্ষণ দেখেছি। বেকার সমস্যা বেড়েছে, দরিদ্রতা বেড়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসাব্যবস্থা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কৃষিব্যবস্থা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়েছে।
আমরা সে জন্যই বলেছিলাম যে যত দ্রুত নির্বাচন হবে, যত দ্রুত দেশের মালিক যারা অর্থাৎ জনগণ তাদের কাছে যখন সেই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তারা যখন সিদ্ধান্ত নেবে, অর্থাৎ দেশের মালিক যখন সিদ্ধান্ত নিবে দেশ কারা কীভাবে পরিচালিত করবে, তত দ্রুত দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
কারণ, প্রকৃতভাবে নির্বাচিত একটি সরকার অবশ্যই জনগণের যে চাওয়া অর্থাৎ, জনগণ যেভাবে চায় সেই বিষয়গুলোকে তারা অ্যাড্রেস করবে। ইয়েস, একটি নির্বাচন হলেই যে সব রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যাবে তা না। সমস্যাগুলোকে যখন আপনি অ্যাড্রেস করবেন খুব স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে সমস্যা কমতে শুরু করবে।
আমরা আনন্দিত যে দেরিতে হলেও সরকার জিনিসটি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আমরা ডিসেম্বরের ভিতরে চেয়েছিলাম। উনারা ফেব্রুয়ারির ভিতরে এখন নির্বাচনটি করতে চাইছেন। আমরা আস্থা রাখতে চাই যে সরকার সে ব্যাপারে সব রকম উদ্যোগ পর্যায়ক্রমিকভাবে গ্রহণ করবেন।
বিবিসি বাংলা: এখন যেহেতু আপনারা বলছেন যে আপনারা আস্থা রাখতে চান, সেখানে নির্বাচন নিয়ে আপনার পরিকল্পনাটা কি? এককভাবে বিএনপি নির্বাচন করবে মানে দলগতভাবে নাকি জোটবদ্ধভাবে আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে নির্বাচন করবে?
তারেক রহমান: খুব ট্রিকি কোশ্চেন একটু। দেখুন আমরা প্রায় ৬৪টি রাজনৈতিক দল বিগত স্বৈরাচারের সময় যার যার অবস্থান থেকে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে।
আমরা চেষ্টা করেছিলাম কমবেশি একসাথে কাজ করার জন্য। এমনকি আমরা যে ৩১ দফা দিয়েছি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের, এটি প্রথমে ২০১৬ সালে আমরা দিয়েছিলাম শুধু বিএনপির পক্ষ থেকে। পরবর্তীতে ভিশন টুয়েন্টি ছিল। যেটা পরবর্তীতে কিছুটা আরেকটু ডেভেলপ করে আমরা ২৭ দফা দিয়েছিলাম।
পরবর্তীতে আমরা আমাদের সাথে যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে তাদের সাথে পরামর্শ করে সকলের মতামত নিয়ে আমরা ৩১ দফা দিয়েছি। কারণটি হচ্ছে যে দলগুলোকে আমরা পেয়েছি, আমাদের সাথে রাজপথের আন্দোলনে, আমরা চাই সকলকে সাথে নিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে। সকলের মতামতকে সাথে নিয়ে আমরা রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে চাই।
বিবিসি বাংলা: সেখানে তাহলে মানে যারা আন্দোলন করেছে তারাই নাকি? মানে মিত্র কারা হবে আসলে কারা সাথে থাকবে আপনাদের নির্বাচনকে সামনে রেখে?
তারেক রহমান: ওই যে বললাম, কমবেশি সকলকে নিয়ে আমরা রাষ্ট্র গঠন করতে চাই।
বিএনপির মনোনয়নে এবার ভিন্ন কী হবে
বিবিসি বাংলা: কিন্তু দেখা গেছে, জামায়াতে ইসলামী তারা কিছু দলকে নিয়ে বিএনপিবিরোধী একটি জোট করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেটিকে আপনারা কি উদ্বেগ হিসেবে দেখেন? মানে আপনারা কীভাবে দেখেন সেটা?
তারেক রহমান: দেখুন, কোনো দল বা সমষ্টিগতভাবে কোনো দল যদি বাংলাদেশের যে আইন আছে, বৈধ আইন আছে। বাংলাদেশের যে সংবিধান এখনো যেটি আছে, এই সবকিছুর ভেতরে থেকে অর্থাৎ মানুষের সমর্থন-গ্রহণযোগ্যতা সবকিছুর ভেতরে থেকে যারা রাজনীতি করবে, তারা করতেই পারে। এটাতে তো কোনো সমস্যা বা উদ্বেগের কোনো কারণ আমি দেখি না।
বিবিসি বাংলা: সেখানে যদি তারা একটি আলাদা জোট করে, সেটি কি আপনাদের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে?
তারেক রহমান: না, কেন? ইলেকশন হলে তো ইলেকশনে প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতেই পারে। এতে উদ্বেগের কী আছে? বিএনপি তো আগেও নির্বাচন করেছে। বিভিন্ন সময় বিএনপি নির্বাচন করেছে। কম্পিটিশন করেই বিএনপি নির্বাচন করেছে। প্রতিযোগিতা করেছে। উদ্বেগের কিছু নেই।
বিবিসি বাংলা: মনোনয়নের প্রশ্নে যদি আসি, সেখানে আপনাদের কৌশলটা কী হবে? এর আগে বিভিন্ন সময় নির্বাচনগুলোতে পেশিশক্তির প্রভাব, টাকার প্রভাব, পারিবারিক বিষয় বিবেচনা এই বিষয়গুলো বিভিন্ন সময় অভিযোগ আছে। এবার ভিন্ন কি হবে আসলে?
তারেক রহমান: আপনি যেই বিষয়গুলো বললেন, আমরা কখনোই এইসব বিবেচনায় নিয়ে কখনোই আমার দল নমিনেশনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়নি।
আমাদের নমিনেশনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত সব সময় কমবেশি, যা ছিল বা ভবিষ্যতে আমরা যেটিকে মূল্যায়ন করব—সেটি হচ্ছে অবশ্যই কোনো একটি পার্টিকুলার এলাকা থেকে আমরা আমাদের দলের এমন একজন ব্যক্তিকেই নমিনেশন দিতে চাইব, যে ওই এলাকার সমস্যা সম্পর্কে সচেতন আছে, যার সাথে ওই এলাকার মানুষের সম্পৃক্ততা আছে, উঠাবসা আছে, যে ওই এলাকার মানুষের সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম।
যে ওই এলাকার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ, তরুণ, নারী, মুরব্বিসহ ছাত্রছাত্রী সবার সাথে যার একটা কমিউনিকেশন আছে। এই ধরনের মানুষকেই আমরা প্রায়োরিটি দিব, খুবই স্বাভাবিক। অর্থাৎ যার প্রতি জনসমর্থন আছে। যে জনসমর্থনকে তার সাথে রাখতে পারে। জনগণের যার প্রতি সমর্থন আছে সে রকম মানুষকে দেখেই আমরা নমিনেশন দেব।
বিবিসি বাংলা: সেখানে তৃণমূলের মতামত কতটা প্রাধান্য পাবে? অভিযোগ আছে যে তৃণমূলের মতামত প্রাধান্য কম পায়?
তারেক রহমান: না, ব্যাপারটা এ রকম না। দেখুন গণতন্ত্রে স্বাভাবিক যেখানেই গণতন্ত্র আছে, সেখানে মতামত থাকতেই পারে। বিভিন্ন রকম মতামত অভিযোগ। হয়তো এক জায়গায় ৫০ জন আছে। ৫০ জনের মধ্যে ৩০ জন একটি কথা বলছে, ১৫ জন একটি কথা বলছে। বাকিরা আরেকটি কথা বলছে। তাহলে আপনি কি বলবেন যে মতামত নে্য়ও হচ্ছে না? না।
স্বাভাবিকভাবেই যেখানে আমরা মেজরিটির যেটা মতামত পাবো, এলাকার মানুষের কম বেশি। আমরা তো আমাদের মতন করে খোঁজ করছি। সেটি তৃণমূলই হোক বা সেটি সাধারণ মানুষের হোক।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য—আমরা কিন্তু দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করছি না। আমরা নির্বাচন করছি এমন একজন ব্যক্তিকে, যেই শুধু দলেরই সমর্থন নয় বরং দলমত-নির্বিশেষে ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষের সমর্থন যার প্রতি আছে।
আমরা এ রকম একজন মানুষকে বের করে আনতে চাইছি। এ রকম একজন মানুষকে আমাদের দলের মনোনয়ন দিতে চাইছি। শুধু দল দিয়ে তো নির্বাচন হবে না। নির্বাচনে তো সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ থাকে। বিভিন্ন মানুষের অংশগ্রহণ থাকে।
কাজেই যার সমর্থন আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব, চেষ্টা করছি যার প্রতি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থন আছে। শুধুমাত্র দলীয় সমর্থন নয়, এরকম মানুষ।
প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী কি না?
বিবিসি বাংলা: নির্বাচন প্রসঙ্গে আপনার কাছে জানতে চাই যে আগামী নির্বাচনে আপনার ভূমিকা কী হবে, আপনি কি সরাসরি নির্বাচন করছেন? আপনাকে কি আমরা প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী হিসেবে দেখতে পাব নির্বাচনে?
তারেক রহমান: আমার মনে হয়, আপনি প্রথম দিকে বোধহয় একটা প্রশ্ন করেছেন, আমি ওখানে বলেছিলাম স্বাভাবিক আমি একজন রাজনৈতিক দলের সদস্য। একজন রাজনৈতিক কর্মী আমি। নির্বাচনের সাথে তো রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক কর্মীর ওতপ্রোত সম্পর্ক।
কাজেই নির্বাচন যেখানে একটি মানে জনগণের সম্পৃক্ত, এ রকম একটি নির্বাচন হবে, সেখানে তো অবশ্যই আমি নিজেকে দূরে থাকতে পারব না। আমাকে আসতেই হবে। স্বাভাবিকভাবেই মাঠেই ইনশা আল্লাহ থাকব আমি। আপনি আপনার প্রশ্নের পরের যে অংশটি ছিল, দেখুন আমি মনে করি এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণের। এটি তো আমার সিদ্ধান্ত না। এটি সিদ্ধান্ত নিবে বাংলাদেশের জনগণ।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু আপনি নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা সেই সিদ্ধান্ত তো আপনাকে নিতে হবে।
তারেক রহমান: না না সেটি তো নিব, কেন নিব না? অবশ্যই নিব।
বিবিসি বাংলা: আপনি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তাহলে?
তারেক রহমান: জ্বি, ইনশা আল্লাহ।
বিবিসি বাংলা: অর্থাৎ বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে বা নির্বাচনে অংশ নেয় সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী হিসেবে আমরা তারেক রহমানকে দেখতে পাব সেটা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি?
তারেক রহমান: এটির সিদ্ধান্ত তো বাংলাদেশের জনগণের।
বিবিসি বাংলা: বিএনপির পক্ষ থেকে?
তারেক রহমান: সে ক্ষেত্রে তো এটি দল সিদ্ধান্ত নেবে। দল কিভাবে করবে এটি তো দলের সিদ্ধান্ত।
নির্বাচনে খালেদা জিয়ার ভূমিকা কি হবে?
বিবিসি বাংলা: সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং আপনাদের দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তিনি কি এ নির্বাচনে কোনো ভূমিকায় থাকবেন? তাকে কি আমরা নির্বাচনে কোনো ভূমিকায় দেখতে পাবো?
তারেক রহমান: আপনি এমন একজন মানুষের কথা বলেছেন, যেই মানুষটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, যতবার গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করা হয়েছে, প্রতিবার উনি অবদান রেখেছেন। সেই গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত বা পুনরুদ্ধার করার জন্য।
এবারও আপনাদের সকলের চোখের সামনেই ঘটেছে যে কীভাবে স্বৈরাচারের সময় তার উপরে অত্যাচারের খড়গহস্ত নেমে আসে। কিন্তু উনি আপোষ করেননি। এরকম একজন ব্যক্তি আজ অসুস্থ। কেন কীভাবে উনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেন, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তাকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হলো।
আমরা দেখেছিলাম একজন সুস্থ মানুষ গিয়েছেন। কিন্তু যখন বেরিয়ে এসেছেন একজন অসুস্থ মানুষ বেরিয়ে এসেছেন। তাকে চিকিৎসার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। এ সবগুলোই ঘটনা দেশবাসী জানেন। তারপরেও যে মানুষটির এত বড় অবদান রয়েছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার।
আমি সেই দলের একজন কর্মী হিসেবে বিশ্বাস করি বা বিশ্বাস করতে চাই গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যেই প্রত্যাশিত, জনপ্রত্যাশিত যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, উনার শারীরিক সক্ষমতা যদি এলাও করে উনাকে নিশ্চয়ই উনি কিছু না কিছু ভূমিকা রাখবেন।
বিবিসি বাংলা: সেটা কি নির্বাচনে অংশগ্রহণ হতে পারে?
তারেক রহমান: এটি আমি এখনো বলতে পারছি না। আমি মাত্রই বললাম যে উনার শারীরিক বা ফিজিক্যাল এবিলিটির উপরে বিষয়টি কিছুটা হলেও নির্ভর করছে।
বিবিসি বাংলা: এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন চলে আসে বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে। আপনার বাবা সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আপনার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তিনি চার দশক বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন আপনি কার্যত দলের নেতৃত্বে রয়েছেন আপনি। বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে পরিবারের প্রভাব কতটা থাকবে?
তারেক রহমান: দেখুন বিষয়টিকে আমি একটু তাহলে অন্যভাবে উপস্থাপন করি। সব রকম সকলের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমি বলতে চাইছি। দেখুন, একজন চিকিৎসকের সন্তান যখন চিকিৎসক হয় তখন সে ভালোও করে সে খারাপও করে। একজন লয়ারের সন্তানও দেখা যায় যে অনেক সময় বাবা-মায়ের মতন ভালো লয়ার (আইনজীবি) হয় অথবা হয় না।
রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে অনেকের সন্তান পলিটিক্সে এসেছে। সবাই কি ভালো করেছে? সবাই ভালো করেনি। কেউ কেউ করেছে কেউ কেউ করতে পারেনি ভালো।
আপনি যদি আমাকে ইঙ্গিত করে থাকেন, তাহলে এভাবে আমি বলব যে, দেখুন আমরা দেখেছি বাংলাদেশের মতন দেশে রাজনীতি যারা করেন বিগত ১৭ বছরে দেখেছি। তার আগেও আমরা দেখেছি রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে হ্যারাসমেন্টের শিকার হন। মিথ্যে মামলার শিকার হন। আমাদের বহু নেতা-কর্মী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জেল জুলুম খেটেছে। ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যেই কয়টা উদাহরণ দিলাম আমি মাত্র।
আপনি কি বলতে পারবেন, এর কোনোটার মধ্যে দিয়ে আমি যাইনি? এর প্রতিটার ভেতর দিয়ে আমি গিয়েছি। প্রত্যেকটা স্তর পার করে এসেছি আমি। আমি শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছি। যেই নির্যাতনের চিহ্ন এখনো কখনো কখনো আমাকে সহ্য করতে হয়। জেল জুলুম খেটেছি আমি। বিভিন্নভাবে মিথ্যা অপপ্রচারের শিকার হয়েছি আমি। সবকিছুর ভিতর দিয়েই আমি পেরিয়ে এসেছি।
কাজেই এইজন্য এই কথাগুলো আমি বললাম যে রাজনীতি পরিবারকরণ হয় না। এটি সমর্থনের ভিত্তিতে হয়। কাজেই যে অর্গানাইজ করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে দলকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে সে এগিয়ে যেতে পারবে। কেউ যদি এগিয়ে যেতে না পারে, তাহলে সে এগিয়ে যেতে পারবে না। সময় পরিস্থিতি সবকিছু প্রমাণ করে দিবে।
বিবিসি বাংলা: আপনার স্ত্রী বা কন্যা বা আপনার পরিবারে যারা আছেন তারা রাজনীতিতে আসবেন কিনা এটা নিয়ে কিন্তু ব্যাপক আলোচনা আছে। আলোচনা হয় কিন্তু রাজনীতিতে। তো এ ধরনের কি কোনো সম্ভাবনা আছে বা তারা আগ্রহী কি না রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে?
তারেক রহমান: আমি ওই যে বললাম সময় পরিস্থিতি বলে দিবে ওটা।
বিএনপির অগ্রাধিকার
বিবিসি বাংলা: একটু আবার নির্বাচনের দিকে যাই। বিএনপি সর্বশেষ সরকারে ছিল ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। এরপর প্রায় ১৯ বছর পরে বিএনপির সামনে আবার একটা সরকার গঠনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেই তখনকার যে বিএনপি আর এখনকার যে বিএনপি এই দুটোর পার্থক্যটা আপনি কোথায় কী বলবেন?
তারেক রহমান: এই ১৯ বছরে আমরা বাংলাদেশ বলি বা পুরো বিশ্ব বলি অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়েছে সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে। দুটো বড় বড় জিনিসের বোধহয় পরিবর্তন হয়েছে।
একটি হচ্ছে কোভিডের ভিতর দিয়ে পুরা বিশ্ব গিয়েছে। এই কোভিড বিভিন্নভাবে আমাদের অনেক কিছু চিন্তা ভাবনা মনোজগত চেঞ্জ করেছে। ঠিক একইভাবে যদি আরেকটি বিষয় আমরা দেখি এই যে আপনার সাথে আমি কথা বলছি অনলাইনে, এই যে আইটি বা সোশ্যাল মিডিয়া এই পুরো বিষয়টা কিন্তু মানুষের মনোজগতকে ভিন্নভাবে ভিন্ন রকম করেছে।
অনেক্ষক্ষেত্রে মনোজগতে একটা প্রভাব বিস্তার করেছে। খুব স্বাভাবিকভাবে আপনি যেই সময়ের কথা বলেছেন সেই সময় এই বিষয়গুলো হয়তো সেভাবে ছিল না। তো স্বাভাবিকভাবেই এই সবকিছু বিবেচনা করে সামনের দিনগুলোতে আমাদেরকে এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব রেখে বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে।
আমরা সেভাবে চিন্তাভাবনা করে আমাদের প্ল্যান প্রোগ্রাম বিষয়গুলোকে আমরা সাজাচ্ছি। সেই সময় থেকে ১৯ বছর আগে আমাদের যেসব প্ল্যান প্রোগ্রাম ছিল, তার থেকে কিছুটা পরিবর্তন হবে।
কিন্তু ওই যে বেসিক যে জিনিসটা সেটা হচ্ছে মানুষের বেটারমেন্ট। মানুষের ভালো কিছু করার জন্য মানুষ যাতে আজকে যেমন আছে আগামীকাল যাতে একটু বেটার থাকতে পারে কি, কীভাবে সেটা করা যেতে পারে, কে কোনো শ্রেণি কীভাবে একটু বেটার থাকতে পারে, সেটিই থাকবে আমাদের সবচেয়ে প্রায়োরিটি ইস্যু।
দুর্নীতি প্রশ্নে বিএনপি ভোটারদের আশ্বস্ত করবে কীভাবে
বিবিসি বাংলা: বিগত যখন বিএনপি সরকারে ছিল তখন অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ছিল, তার মধ্যে একটা বড় বিষয় ছিল দুর্নীতির অভিযোগ। সরকারে যারা ছিলেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে বা সেই সময় যেভাবে দুর্নীতি হচ্ছিল বিভিন্ন জায়গায়। আপনার নিশ্চয় মনে আছে যে দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে তখন অনেক সমালোচনা হয়েছিল। এ ধরনের পরিস্থিতি যে আর হবে না এ বিষয়ে আপনি ভোটারদেরকে কিভাবে আশ্বস্ত করবেন?
তারেক রহমান: দেখুন আপনি যে কথাটি বললেন দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। ৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ছিল সেই সময়। আমরা ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবরে সরকার নির্বাচনের পর ১০ই অক্টোবর সরকার গঠন করি, সম্ভবত।
এর বোধহয় কিছুদিন পরে একটি সূচক বের হলো টিআইবির। মানে দুই তিন মাস পরে বোধহয় একটি সূচক বের হলো।
নিশ্চয়ই মাত্র নির্বাচিত একটি সরকারের পক্ষে তো ভালোমন্দ কোনো কিছুই তিন মাসে করা সম্ভব নয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই যে সূচকটি হয়েছিল সেটি তার আগে আমাদের আগে যে সরকারটি ছিল তারা যে পাঁচ বছর যা করেছে তার উপর ভিত্তি করেই সেই সূচকটি তারা তৈরি করেছে।
আপনি যদি ২০০১ থেকে ২০০৬ অর্থাৎ বিএনপি সরকার গঠন করার পরে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে যখন ক্ষমতা হ্যান্ডওভার করে দিল, আপনি যদি সেই সংস্থা টিএইবি নামক সেই সংস্থাটার রিপোর্টই যদি আপনি দেখেন তাহলে দেখবেন পর্যায়ক্রমিকভাবে, এটি কিন্তু আমার কথা না, এটি তাদের পরিসংখ্যানের কথা-পর্যায়ক্রমিকভাবে কিন্তু নেমে এসেছে।
হ্যাঁ আমি এডমিট করছি পুরাপুরি হয়তো আমরা করতে পারিনি। বাস্তবতা তো বুঝতে হবে। এটি একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কাজেই এটি মানুষকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে বুঝিয়ে আস্তে আস্তে করতে হবে। জিনিসটি সময় লাগবে।
আমি এখন যত কথাই বলি না কেন বাস্তবতা হচ্ছে এই বিষয়টি যেহেতু সময় লাগবে আমাদেরকে কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে।
সেজন্যই আমি ভোটারদেরকে এতটুকু বলতে পারব, আমরা যদি সুযোগ পাই, জনগণ যদি আমাদেরকে সেই সুযোগ দেন, তাহলে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আমরা যাতে একটি এমন অবস্থা তৈরি করতে পারি যেখানে কিছুটা হলেও আমরা বহিঃবিশ্বে বিশ্বের অন্য দেশের সামনে কিছুটা হলেও যাতে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারি।
চাঁদাবাজি, দখলের মত নানা অভিযোগ নিয়ে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: পাঁচই আগস্টের পরে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে চাঁদাবাজি বা দখলের মত নানা অভিযোগ এসেছে। আপনাদের দল থেকে অনেককে বহিষ্কার করা হয়েছে এটা ঠিক, আবার একই সাথে এটাও ঠিক যে এই অভিযোগগুলো কিন্তু বারবার আসছে। তো এটা থামানো যাচ্ছে না কেন?
তারেক রহমান: আপনার প্রতি সম্মান রেখে আপনার সাথে এগ্রিও যেমন করবো, আবার এখানে অন্য একটি বিষয় আমি তুলে ধরতে চাইবো।
এর মধ্যে নিশ্চয়ই আপনারা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখেছেন যে প্রায় ৭০০০ এর মতন আমাদের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে আমরা কিছু সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। কিন্তু এই ৭০০০ এ সবাই কিন্তু আপনি যে অভিযোগ করলেন এই অভিযোগের সাথে জড়িত নয়। এর মধ্যে এমন অনেক বিষয় আছে যারা অন্য সাংগঠনিক বিষয়ের সাথে জড়িত। এটি গেল একটি বিষয়।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে আমাদের কাছে এরকম যখন অনেক অভিযোগ এসেছে। আমরা অভিযোগগুলো তদন্ত করেছি। তদন্ত করার পরে আমরা বেশ কিছু বিষয় পেয়েছি।
যেমন আমি দুই-একটি উদাহরণ দিয়ে আপনাকে বলি। যেমন-ধরেন দুই ভাই। কোনো একটি এলাকায় দুই ভাই আছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে পারিবারিক সম্পত্তি সহায় সম্পত্তি নিয়ে একটি সমস্যা আছে। এক ভাই বিগত যে স্বৈরাচার পলাতক স্বৈরাচার তাদের কারো সাথে এক ভাইয়ের খুব ভালো সম্পর্ক।
তার ফলে সে সেই স্বৈরাচারের যে দোসর যার সাথে এই এক ভাইয়ের সম্পর্ক, সে তার ইনফ্লুয়েন্সটি ব্যবহার করে অন্য ভাইয়ের সম্পত্তিও জোর করে দখল করে রেখেছে। এখন পাঁচ তারিখের পরে যে ভাই স্বৈরাচারের দোসরকে ব্যবহার করেছিল সেই দোসরও তো পালিয়ে গিয়েছে। তো স্বাভাবিকভাবেই সেই ভাই এখন আর শেল্টার পাচ্ছে না।
তো অন্য যার সম্পত্তি জোর করে রেখে দিয়েছিল অন্য ভাইটি। সেই অন্য ভাইটি স্বাভাবিকভাবে তার হক আদায় করতে গিয়েছে বা হক বুঝে নিতে গিয়েছে। এখন এক্সিডেন্টলি বা ইনসিডেন্টলি যে ভাই এতদিনভাবে বঞ্চিত ছিল সম্পত্তি থেকে সেই ভাই বিএনপি করে। বিএনপির কোনো একজন কর্মী বা স্ট্রং সমর্থক বা নেতা যেটাই হোক। চাপিয়ে দিল অভিযোগ তুলে দিল অন্যজন যে বিএনপি দখল করতে গিয়েছে। এ রকম ঘটনা আমরা প্রচুর পেয়েছি।
আবার আরেকটি আমি উদাহরণ দেই যা সত্য, যা বাস্তব। স্বৈরাচারের সময় সারা বাংলাদেশে আমাদের প্রায় ৫০ লাখের বেশি নেতা-কর্মীর নামে বিভিন্ন রকম গায়েবি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছিল।
আমাদের বহু নেতা-কর্মী তাদের ঘর বাড়িতে থাকতে পারতো না। তাদেরকে বিভিন্নভাবে পালিয়ে থাকতে হতো। বিভিন্নভাবে সরে থাকতে হতো। এই সুযোগে স্বৈরাচার তাদের ব্যবসা বাণিজ্য দোকান-পাট ঘর বাড়ি জমি জমা পুকুর দখল করে নিয়েছিল। পাঁচ তারিখে যখন স্বৈরাচার পলাতক হয়ে গিয়েছে, পালিয়ে গিয়েছে-তখন স্বৈরাচারের যারা দখল করেছে তারাও সাথে সাথে পালিয়ে গিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই আমাদের নেতা-কর্মীরা তাদের নিজেদের যেগুলি বৈধ সম্পত্তি, পৈতৃক সম্পত্তি সেগুলো আবার ফিরে পেতে গিয়েছে। তখন আবার কিছু সংখ্যক লোক প্রচার করেছে যে বিএনপির লোকজন দখল করতে গিয়েছে এরকম ঘটনা প্রচুর ঘটেছে।
আপনি যেই কথাটি বললেন সেরকমও কিছু ঘটেছে। সে কারণেই আমরা আমাদের অবস্থান থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। তবে এখানে আমার একটি প্রশ্ন আছে, যে প্রশ্নটি আমরা পাবলিকলিও করেছি। দেখুন আমরা একটি রাজনৈতিক দল। কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমরা অস্বীকার করছি না। ঘটেছে যেমন, আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি তাদের বিরুদ্ধে।
যতটুকু আমরা জেনেছি, যতটুকু আমরা তদন্তের পরে পেয়েছি, যখন সত্যতা পেয়েছি, আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু পুলিশিং করা তো আমাদের কাজ না। রাজনৈতিক দলের কাজ অবশ্যই পুলিশিং করা না।
আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কখনো বলিনি সরকারকে-যে অমুককে ধরতে পারবে না, তমুককে ধরতে পারবে না, এই করতে পারবে না ওই কথা। আমরা কিন্তু কখনো বলিনি। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে যাদের কাজ পুলিশিং করা তারা কেন তাদের কাজটি করছে না। তারা কেন তাদের কাজে ব্যর্থ এটি আমাদের প্রশ্ন।
বিবিসি বাংলা: তার মানে এখানে সরকারের একটা ব্যর্থতা আছে?
তারেক রহমান: অবশ্যই। আমি তো আগেই বলছি পুলিশিং তো রাজনৈতিক দলের কাজ না পুলিশিং করার দায়িত্ব সরকারের।
বিবিসি বাংলা: অর্থাৎ আমরা ধরে নিতে পারি যে, আপনারা যদি সরকার গঠন করেন সে ক্ষেত্রে আপনার দলের নেতা-কর্মী বা আপনার দলের নামে কোনো চাঁদাবাজি বা দখল এ ধরনের কিছু কেউ সেটা করতে পারবে না, কারণ তখন যেহেতু আপনারা সরকারে থাকবেন?
তারেক রহমান: ইয়েস, পুলিশ পুলিশের কাজ করবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আইনশৃঙ্খলার কাজ করবে। বিএনপি ইনশা আল্লাহ সরকার গঠন করলে আমার দলের কোন নেতা-কর্মী তখনো যদি এ রকম কোনো অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত হয় আমরা দলের অবস্থান থেকে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিব।
দল তার পক্ষে থাকবে না, দলের অবস্থান এবং দেশের আইন অনুযায়ী। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব যাদের, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তারা তাদের কাজ করবে, সিম্পল। এখানে দুইয়ে দুইয়ে চারের মতন ব্যাপার।
’ডাকসুর প্রভাব পড়বে না জাতীয় রাজনীতিতে’
বিবিসি বাংলা: একটু ডাকসু নির্বাচন প্রশ্নে আসি। সাম্প্রতিক সময়ে ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ব্যাপক আলোচনা চলছে রাজনীতিতে এখনো। এর ফলাফলে দেখা গেছে যে বিএনপি সমর্থক ছাত্রদলের চেয়ে বেশ বড় ব্যবধানে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল জয়ী হয়েছে। আপনি কীভাবে দেখেন এই ফলাফলটাকে আসলে?
তারেক রহমান: আমি মনে করি গণতান্ত্রিক যাত্রার একটি ভালো উদ্যোগ এটি। ভালো সূচনা। এটি গেল এক নম্বর।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে যারা জয়ী হয়েছেন বা এরকম আরো ভবিষ্যতে যারা জয়ী হবেন, তাদের প্রতি শুভেচ্ছা এবং যারা ভবিষ্যতে জয়ী হবেন তাদের প্রতি অগ্রিম শুভেচ্ছা রইলো।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে দেখুন একটা অগ্রযাত্রা শুরু হলো, কিন্তু আমরা চাইছিলাম না যে কোনো বিতর্কের মধ্যে এগুলা পড়ুক। আমরা আশা করব যে পরবর্তীতে যেগুলো হবে সেগুলো বিতর্কবিহীন হবে নির্বাচনগুলো।
বিবিসি বাংলা: এই নির্বাচনের ফলাফল, মানে ডাকসুর নির্বাচনের ফলাফল এটা কি জাতীয় রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে? আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আপনার কি মনে হয়? আপনি কি মনে করেন সেটা?
তারেক রহমান: আমি যেটা দেখলাম বিভিন্ন মিডিয়াতে কিছু ব্যক্তি, যেমন-মান্না ভাই, ওনাকে উনি তো বোধহয় দুবার ভিপি ছিলেন। আমার থেকে অনেক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাজনীতিবিদ।
আমরা যদি উনার বক্তব্য শুনে থাকি বা ধরে থাকি তাহলে তো আমি মনে করি না কোনো কারণ আছে। ছাত্র রাজনীতি ছাত্র রাজনীতির জায়গায়, জাতীয় রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির জায়গায়।
জামায়াতের সম্ভাব্য জোট নিয়ে উদ্বেগ নেই
বিবিসি বাংলা: এখন যে সক্রিয় দলগুলো আছে তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর প্রশ্নে যদি একটু আসি, যে জামায়াতে ইসলামীকে ঘিরে বিএনপির নেতাদের অনেক সমালোচনা করতে দেখা যাচ্ছে। গত সাম্প্রতিক সময়ে, তো জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে আপনার মনোভাবটা কি আসলে?
তারেক রহমান: বিষয়টা হচ্ছে যে দেখুন বাংলাদেশের স্বীকৃত যে নিয়ম, আইন-কানুন আছে, এগুলোর ভিতরে থেকে যদি কেউ রাজনীতি করে অবশ্যই করতে পারে।
বিএনপি সবসময় বহুদলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। কাজেই বিষয়টি আমরা এভাবেই দেখতে চাই।
দেশের যে আইন কানুন আছে তার ভিতরে থেকে যারা রাজনীতি করবে, অবশ্যই সবার রাজনীতি করার অধিকার আছে। এবং আমরা তো চাই সবাই রাজনীতি করুক। বহুদলীয় রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি।
বিবিসি বাংলা: জামায়াতে ইসলামী তো বিএনপির সাথে একসময় মিত্র ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের বিরোধী ভূমিকা নিয়ে কিন্তু বিএনপি নেতারা এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, সামনে আনছেন। কিন্তু বিএনপি আবার তাদের সাথে সরকারও গঠন করেছিল একটা সময়?
তারেক রহমান: ২০২৪ সালে স্বৈরাচার যেই হত্যাগুলো করেছে দেশ স্বাধীনের পরে যখন তারা সরকার গঠন করেছিল ক্ষমতায় ছিল তখনও যে সকল লুট তারা করেছে, খুন-গুম তারা করেছে।
বিগত ১৭ বছর গুম খুন যারা করেছে, এর জবাব যে রকম তাদেরকেই দিতে হবে, ঠিক একইভাবে ’৭১ সালে কোনো রাজনৈতিক দল যদি তাদের কোনো বিতর্কিত ভূমিকা থেকে থাকে, তাহলে তাদের জবাব তারাই দিবেন। ওটা তো আর আমি দিতে পারবো না। আমারটা আমি দিতে পারবো। অন্যেরটা তো আমি দিতে পারবো না।
যা বললেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রসঙ্গে
বিবিসি বাংলা: আপনি জুলাইয়ের সময়ের কথা বলছিলেন। সে সময়ের হত্যাকাণ্ডের কথা বলছিলেন। সেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ব্যাপারে আপনার আপনাদের বা বিএনপির অবস্থানটা কী আসলে?
তারেক রহমান: দেখুন, আমি ১৭ বছর যাবত প্রবাস জীবনে আছি। ওয়ান ইলেভেন, তথাকথিত ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় যেই শারীরিক নির্যাতন আমার উপরে হয়েছিল তারপরে চিকিৎসার জন্য আমি এই দেশে আসি।
আমি যখন এখানে আসি, আমার ভাইকে আমি রেখে এসেছিলাম ছোট ভাইকে। আমি যখন এই দেশে আসি আমার সুস্থ মাকে আমি রেখে এসেছিলাম। একটি ঘর রেখে এসেছিলাম। যেই ঘরে আমি এবং আমার ছোট ভাই বড় হয়েছি। যেই ঘরে আমার বাবার স্মৃতি ছিল। যেই ঘরে আমাদের দুই ভাইয়ের সন্তানরা জন্মগ্রহণ করেছিল। যেই ঘরে আমার মায়ের বহু স্মৃতি ছিল।
সেই স্মৃতিগুলোকে ভেঙে চুড়ে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে ভাইকে আমি রেখে এসেছিলাম সেই ভাই এখন আর নেই। যেই সুস্থ মাকে রেখে এসেছিলাম সেই সুস্থ মা এখন সুস্থ নেই। শুধু অসুস্থই নন, উনার উপরে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনও করা হয়েছে।
আমি আমার পরিবারের যেই কাহিনী আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। এটিকে আপনারা কাহিনী বলুন, বা সংগ্রাম বলুন যেটাই বলুন না কেন, এটি শুধু আমার কাহিনী না, বা আমার পরিবারের কাহিনী না। এরকম কাহিনী বাংলাদেশের শত না, হাজার হাজার পরিবারের।
যে পরিবারের বাবা, যে পরিবারের ভাই, যে পরিবারের স্বামী তার ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, হ্যান্ডকাফ পারা অবস্থায় হাসপাতালের বারান্দায় মারা গিয়েছে, তা না হলে হ্যান্ডকাফ পারা অবস্থায় জেলের ভিতরে মারা গিয়েছে, সহায় সম্পত্তি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে-এই সকল অন্যায়, এই সকল হত্যা, এই সকল নির্যাতনের জন্য যারা দায়ী, যারা এসবের হুকুম দিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিচার হতে হবে।
এটি প্রতিশোধের কোনো বিষয় নয়। এটি ন্যায়ের কথা। এটি আইনের কথা। অন্যায় হলে তার বিচার হতে হয়। কার সম্পর্কে কী মনোভাব সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বিবিসি বাংলা: এখানে একটা বিষয় আলোচনায় এসেছে যে যারা অপরাধী তাদের বিচার হবে। কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারা-না পারার প্রশ্নে বিএনপিরও অনেক নেতা অনেক সময় বলেছেন যেকোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে তারা নন। তো এখন নির্বাচনও সামনে আসছে। ফলে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে কি পারবে না সে ধরনের একটা প্রশ্নও আসছে। তো সেটা সেই জায়গাটাতে বিএনপির অবস্থানটা কী হতে পারে?
তারেক রহমান: দল হিসেবে তারা যদি অন্যায় করে থাকে তাহলে দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। দেশের আইন সিদ্ধান্ত নেবে।
বিবিসি বাংলা: তার মানে এটা আদালতের বিষয় বলে মনে করছেন?
তারেক রহমান: দল হিসেবে যদি অন্যায় হয়ে থাকে তাহলে তাই হবে। সোজা কথায় অন্যায়কারীর বিচার হতে হবে। তো সেটি ব্যক্তি হোক, সেটি দলই হোক। যারা জুলুম করেছে তাদের তো বিচার হতে হবে। সেটি ব্যক্তিও হতে পারে। সেটি দলও হতে পারে।
বিবিসি বাংলা: আপনি ব্যক্তিগতভাবে কী মনে করেন? আওয়ামী লীগের কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে থাকা উচিত নাকি, না?
তারেক রহমান: আমার মনে হয় আপনার কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তরে আমি মনে হয় বলেছিলাম যে আমরা রাজনীতি করি জনগণের জন্য।
আমরা বিশ্বাস করি এবং বিভিন্ন সময় বলিও আমরা বিএনপি যারা করি আমাদের রাজনৈতিক সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং বিশ্বাস করতে চাই-যে দলের ব্যক্তিরা বা যে দল মানুষ হত্যা করে, মানুষ গুম করে, মানুষ খুন করে, দেশের মানুষের অর্থসম্পদ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে-জনগণ তাদেরকে সমর্থন করতে পারে বলে আমি মনে করি না।
জনগণ যদি সমর্থন না করে কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক সংগঠনকে তাদের টিকে থাকার তো কোনো কারণ আমি দেখি না। যেহেতু জনগণের শক্তিতে আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের সিদ্ধান্তে আমরা বিশ্বাস করি। জনগণের সিদ্ধান্তের উপরে আমরা আস্থা রাখতে চাই। এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় বিচারক আমি মনে করি জনগণ।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে বিবিসি বাংলার সাক্ষাৎকারের এটি প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্বটি প্রকাশ হবে মঙ্গলবার ৭ই অক্টোবর বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইট, ফেসবুক পাতা ও ইউটিউব চ্যানেলে।
বিবিসি বাংলা: তারেক রহমান আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার সাথে যোগ দেবার জন্য।
তারেক রহমান: আপনাদেরকেও অনেক ধন্যবাদ, আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
বিবিসি বাংলা: আপনি কেমন আছেন? আপনার সময় কেমন যাচ্ছে?
তারেক রহমান: আলহামদুলিল্লাহ, আমি শারীরিকভাবে ভালো আছি। সময় তো স্বাভাবিকভাবে ব্যস্তই যাচ্ছে। ফিজিক্যালি হয়তো আমি এই দেশে আছি, বাট মন-মানসিকতা সবকিছু মিলিয়ে তো আমি গত ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশেই রয়ে গিয়েছি।
বিবিসি বাংলা: আমরা এমন একটা সময় আপনার সাথে কথা বলছি, যখন বাংলাদেশ ইতিহাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল বলা হবে না। ২০২৪ সালে একটি ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনের অবসান হয়েছে। আর কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ একটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আপনি আপনার অনেক দলীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন, কথা বলেছেন, নিয়মিতই কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু গণমাধ্যমের সাথে আপনি এই দীর্ঘ সময় কথা বলেননি। এত দিন ধরে আপনি কথা বলেননি কেন?
তারেক রহমান: ব্যাপারটা বোধ হয় এ রকম না, ব্যাপারটা বোধয় একটু ভিন্ন। আসলে আমি কথা ঠিকই বলেছি। আমি দীর্ঘ ১৭ বছর এখানে আছি এই দেশে, প্রবাস জীবনে, তবে আমার ওপরে যখন দলের দায়িত্ব এসে পড়েছে; তারপর থেকে আমি গ্রামেগঞ্জে আমার নেতা-কর্মীসহ তাদের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে সাধারণ মানুষ যখন যেভাবে অংশগ্রহণ করেছে, আমি সকলের সাথে কথা বলেছি।
আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বিগত স্বৈরাচার সরকারের সময় কোর্ট থেকে রীতিমতন একটা আদেশ দিয়ে আমার কথা বলার অধিকারকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আমি যদি গণমাধ্যমে কিছু বলতে চাইতাম, হয়তো গণমাধ্যমের ইচ্ছা ছিল ছাপানোর, গণমাধ্যম সেটি ছাপাতে পারত না।
আমি একবার প্রেসক্লাবে কথা বলেছিলাম। তখন পরের দিন দেখলাম যে প্রেসক্লাবে একটি তখনকার যেই প্রেসক্লাবের যারা সদস্য ছিলেন বা কমিটি ছিল, তারা একটি মিটিং ডেকে একটি সভা করে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা তখন আমাকে আইনের দৃষ্টিতে ফেরারি বলা হয়েছিল যে, সে রকম কোনো ব্যক্তিকে তারা প্রেসক্লাবে কথা বলতে দিবে না। এভাবে তারা চেষ্টা করেছিল আমার কথা বন্ধ করে রাখতে।
আমি কথা বলেছি, সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন পন্থায় আমি পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি, আমি ইনশা আল্লাহ পৌঁছেছি মানুষের কাছে। কাজেই গণমাধ্যমে যে কথা বলিনি তা না। আমি কথা বলেছি হয়তো আপনারা তখন কথা নিতে পারেননি অথবা শুনতে পারেননি। ইচ্ছা থাকলেও ছাপাতে পারেননি হয়তো প্রচার করতে পারেননি। কিন্তু আমি বলেছি আমি থেমে থাকিনি।
দেশে ফেরার প্রশ্নে যা বললেন?
বিবিসি বাংলা: আমি অবশ্য সাক্ষাৎকারের কথা বলছিলাম যে প্রশ্নোত্তরের বিষয়টি মানে বিশেষ করে গত এক বছরে। বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেছে এবং অনেকের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আপনি দেশে এসে সশরীরে দলের নেতৃত্ব দেবেন। গত এক বছরে যে প্রশ্নটা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে এবং এখনো আসছে যে আপনি এখনো দেশে ফেরেননি কেন। কেন আপনি এখনো দেশে ফেরেননি?
তারেক রহমান: কিছু সংগত কারণে হয়তো ফেরাটা হয়ে ওঠেনি এখনো। তবে সময় তো চলে এসেছে মনে হয়। ইনশা আল্লাহ দ্রুতই ফিরে আসব।
বিবিসি বাংলা: সেটা কবে, আমরা কি জানতে পারি?
তারেক রহমান: দ্রুতই মনে হয়। দ্রুতই ইনশা আল্লাহ।
বিবিসি বাংলা: নির্বাচনের আগে কি তাহলে আপনি দেশে আসবেন, এমন সম্ভাবনা বলা যায়?
তারেক রহমান: রাজনীতি যখন করি, আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে স্বাভাবিক, নির্বাচনের সাথে রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক কর্মীর একটি ওতপ্রত সম্পর্ক। কাজেই যেখানে একটি প্রত্যাশিত, জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনের সময় কেমন করে দূরে থাকব? আমি তো আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে, ইচ্ছা থাকবে, আগ্রহ থাকবে সেই প্রত্যাশিত যে প্রত্যাশিত নির্বাচন জনগণ চাইছে। সেই প্রত্যাশিত নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হবে, জনগণের সাথে জনগণের মাঝেই থাকব ইনশা আল্লাহ।
বিবিসি বাংলা: একটা বিষয়, যেটা আপনার দল থেকে, মাঝে দলের নেতাদের কেউ কেউ কখনো কখনো বলেছেন যে একটা নিরাপত্তার শঙ্কার কথা বলেছেন। আপনি না আসার পেছনে, আপনি কি কোনো ধরনের শঙ্কা বোধ করেছেন এর মধ্যে?
তারেক রহমান: বিভিন্ন রকম শঙ্কার কথা তো আমরা অনেক সময় বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে তো শুনেছি। সরকারেরও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকেও তো অনেক সময় অনেক শঙ্কার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে, বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে।
’কোনো ব্যক্তি নয়, মাস্টারমাইন্ড গণতন্ত্রকামী জনগণ’
বিবিসি বাংলা: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গে আসি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আপনার ভূমিকা নিয়ে অনেক আলোচনা আছে। এটি মোটামুটি সব পক্ষই স্বীকার করেও যে সেই সময়ে আপনার একটা সক্রিয় ভূমিকা ছিল। আবার আপনার দলের কোনো কোনো নেতা বা সমর্থক তারা এই অভ্যুত্থানে আপনাকে ’একমাত্র মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। আপনি কি নিজেকে এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দেখেন?
তারেক রহমান: না। আমি অবশ্যই এই জুলাই আন্দোলনে আমাকে আমি কখনোই মাস্টারমাইন্ড হিসেবে দেখি না। এই যে ৫ই অগাস্ট যেই আন্দোলন, জুলাই আন্দোলন বলে যেটি বিখ্যাত বা যেটি সকলের কাছে গৃহীত, এই আন্দোলনটি সফল হয়েছে জুলাই মাসে। কিন্তু এই আন্দোলনটি প্রেক্ষাপট শুরু হয়েছে কিন্তু বহু বছর আগে থেকে।
এই আন্দোলনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীরা, সেটি বিএনপি হোক বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলো হোক, যারা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছে। বিভিন্নভাবে তাদের নেতা-কর্মীরা নির্যাতিত হয়েছে।
আমি মনে করি, জুলাই-আগস্ট মাসে এসে জনগণ সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের সাথে অংশগ্রহণ করেছে। শুধু কী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাই সেদিন ছিল মাঠে? অবশ্যই নয়।
আমরা দেখেছি, সেদিন মাদ্রাসার ছাত্ররা তাঁরা ছিলেন এই আন্দোলনের মাঠে। আমরা দেখেছি গৃহিণীরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমে এসেছেন সন্তানের পেছনে। আমরা দেখেছি, কৃষক, শ্রমিক, সিএনজিচালক, ছোট দোকান কর্মচারী বা দোকানমালিক থেকে আরম্ভ করে গার্মেন্টস কর্মী—তাঁরা নেমে এসেছিলেন। আমরা দেখেছিলাম, সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নেমে এসেছিলেন এই আন্দোলনে।
এমন অনেক সাংবাদিক, যাঁরা স্বৈরাচারের অত্যাচারে নির্যাতিত হয়ে দেশ থেকে বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন এই আন্দোলনে। কাজেই কারও ভূমিকাকে আমরা ছোট করে দেখতে চাই, না খাটো করে দেখতে চাই না।
আমি বিশ্বাস করি, দৃঢ়ভাবে সমাজের দলমত-নির্বিশেষে শ্রেণিবিন্যাস নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের অবদান আছে।
এই আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের জনগণের আন্দোলন, যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তাঁরাই এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড। কোনো দল, কোনো ব্যক্তি নয়, এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।
বিবিসি বাংলা: যখন আন্দোলনটা চলছিল, তখন আন্দোলনে যে ছাত্রনেতৃত্ব ছিল, তাদের সাথে আপনার কতটা যোগাযোগ ছিল? আপনার দলের সাথে তো নিশ্চয়ই যোগাযোগ ছিল, অন্যদের সাথে আপনাদের আপনার কতটা যোগাযোগ ছিল?
তারেক রহমান: স্বাভাবিকভাবে আমি যেহেতু বাইরে থেকে কাজ করছি, আমাকে যোগাযোগটা অনলাইনের মাধ্যমে রাখতে হয়েছে এবং সেই দিনগুলোতে আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে টেলিফোন সিস্টেম বা অনলাইন সিস্টেমের কী অবস্থা করেছিল স্বৈরাচার।
আপনি যোগাযোগের যেটি কথা বলেছেন, এই যোগাযোগটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিভিন্নভাবে আমাদেরকে করতে হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে করতে হয়েছে। যোগাযোগটা যে খুব স্মুথ সব সময় থেকেছে, তা নয়। প্রত্যেকে সহযোগিতা করেছি আমরা।
বিবিসি বাংলা: ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান, সেটির পরে এটার কৃতিত্ব কার সেটা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ দাবি করেছে, তাতে কি আপনার মনে হয় যে এর ফলে বিভিন্ন পক্ষের যে সংকীর্ণ স্বার্থ পূরণের চেষ্টা, সেটাই একটু বেশি প্রকট হয়েছে এবং এখানে বিএনপির আসলে কোনো দায় আছে কি না?
তারেক রহমান: দেখুন ব্যাপারটা আমরা যদি একটু অন্যভাবে দেখি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এটি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।
এই আন্দোলন, মানুষের এই আত্মত্যাগ সাধারণত কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে বা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শিশু হত্যা হয় না, শিশু শহীদ হয় না, শিশু মৃত্যুবরণ করে না। বাট আমরা দেখেছি এই আন্দোলনে স্বৈরাচারের এই আন্দোলনে যতটুকু আমার মনে আছে, প্রায় ৬৩ জন শিশু শহীদ হয়েছে, মারা গিয়েছে।
আমি আগেই বলেছি, আপনার আগের প্রশ্নের উত্তরে বলেছি যে এই আন্দোলনের ক্রেডিট দলমত-নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণের, কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নয়।
অনেকে হয়তো অনেক কিছু বলে থাকতে পারেন, ডিমান্ড করতে পারেন, সেটি তাঁদের অবস্থান।
আমি বা আমার দলের অবস্থান হচ্ছে, আন্দোলন হয়ে গিয়েছে, আন্দোলনের জনগণ সফলতা লাভ করেছেন। আন্দোলনে স্বাভাবিকভাবেই দুটো পক্ষ আছে। একটি পক্ষ হচ্ছে মানুষ শহীদ হয়েছে। ২০০০-এর মতো মানুষকে হত্যা করা হয়েছে আন্দোলনে। আবার আরেকটি পক্ষ হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজারের মতন মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অন্ধ হয়ে গিয়েছেন।
আমার মনে হয়, আমাদের উচিত হবে, এখন আমাদের সকলের উচিত হবে রাষ্ট্রসহ সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলোর যার যতটুকু সম্ভব, সেই পরিবারগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। যতটুকু সহযোগিতা তাদেরকে করা যায়, যতটুকু সম্ভব তাদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের এই আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানানো।
নির্বাচন এককভাবে নাকি দলগতভাবে
বিবিসি বাংলা: অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই দেখা গেছে যে বিএনপির পক্ষ থেকে দ্রুত নির্বাচন দাবি করা হয়েছে। সরকার গড়িমসি করছে এ ধরনের অভিযোগও বিএনপির নেতারা করে আসছেন। তো এখন দেখা যাচ্ছে যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং নির্বাচন কমিশন তারা ফেব্রুয়ারিতে একটা নির্বাচনের সময় দিয়েছেন। তো ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে—আপনাদের আস্থা কতটা আছে তাতে?
তারেক রহমান: বিএনপি প্রথম থেকেই বলে আসছিল যে যত দ্রুত নির্বাচনটি হবে, তত দ্রুত দেশের মধ্যে একটি স্থিতিশীলতা আসবে। দেখুন বাংলাদেশের মানুষ গত ১৭ বছর যাবৎ তাদের রাজনৈতিক অধিকার যেমন তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তাদেরকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিল।
যার ফলশ্রুতিতে আমরা সমাজে অনেকগুলো পর্যায়ক্রমিকভাবে স্পিলওভার ইফেক্ট বলতে যা বোঝায় অনেকগুলো খারাপ লক্ষণ দেখেছি। বেকার সমস্যা বেড়েছে, দরিদ্রতা বেড়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসাব্যবস্থা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কৃষিব্যবস্থা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়েছে।
আমরা সে জন্যই বলেছিলাম যে যত দ্রুত নির্বাচন হবে, যত দ্রুত দেশের মালিক যারা অর্থাৎ জনগণ তাদের কাছে যখন সেই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তারা যখন সিদ্ধান্ত নেবে, অর্থাৎ দেশের মালিক যখন সিদ্ধান্ত নিবে দেশ কারা কীভাবে পরিচালিত করবে, তত দ্রুত দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
কারণ, প্রকৃতভাবে নির্বাচিত একটি সরকার অবশ্যই জনগণের যে চাওয়া অর্থাৎ, জনগণ যেভাবে চায় সেই বিষয়গুলোকে তারা অ্যাড্রেস করবে। ইয়েস, একটি নির্বাচন হলেই যে সব রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যাবে তা না। সমস্যাগুলোকে যখন আপনি অ্যাড্রেস করবেন খুব স্বাভাবিকভাবেই ধীরে ধীরে সমস্যা কমতে শুরু করবে।
আমরা আনন্দিত যে দেরিতে হলেও সরকার জিনিসটি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আমরা ডিসেম্বরের ভিতরে চেয়েছিলাম। উনারা ফেব্রুয়ারির ভিতরে এখন নির্বাচনটি করতে চাইছেন। আমরা আস্থা রাখতে চাই যে সরকার সে ব্যাপারে সব রকম উদ্যোগ পর্যায়ক্রমিকভাবে গ্রহণ করবেন।
বিবিসি বাংলা: এখন যেহেতু আপনারা বলছেন যে আপনারা আস্থা রাখতে চান, সেখানে নির্বাচন নিয়ে আপনার পরিকল্পনাটা কি? এককভাবে বিএনপি নির্বাচন করবে মানে দলগতভাবে নাকি জোটবদ্ধভাবে আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে নির্বাচন করবে?
তারেক রহমান: খুব ট্রিকি কোশ্চেন একটু। দেখুন আমরা প্রায় ৬৪টি রাজনৈতিক দল বিগত স্বৈরাচারের সময় যার যার অবস্থান থেকে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে।
আমরা চেষ্টা করেছিলাম কমবেশি একসাথে কাজ করার জন্য। এমনকি আমরা যে ৩১ দফা দিয়েছি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের, এটি প্রথমে ২০১৬ সালে আমরা দিয়েছিলাম শুধু বিএনপির পক্ষ থেকে। পরবর্তীতে ভিশন টুয়েন্টি ছিল। যেটা পরবর্তীতে কিছুটা আরেকটু ডেভেলপ করে আমরা ২৭ দফা দিয়েছিলাম।
পরবর্তীতে আমরা আমাদের সাথে যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে তাদের সাথে পরামর্শ করে সকলের মতামত নিয়ে আমরা ৩১ দফা দিয়েছি। কারণটি হচ্ছে যে দলগুলোকে আমরা পেয়েছি, আমাদের সাথে রাজপথের আন্দোলনে, আমরা চাই সকলকে সাথে নিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে। সকলের মতামতকে সাথে নিয়ে আমরা রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে চাই।
বিবিসি বাংলা: সেখানে তাহলে মানে যারা আন্দোলন করেছে তারাই নাকি? মানে মিত্র কারা হবে আসলে কারা সাথে থাকবে আপনাদের নির্বাচনকে সামনে রেখে?
তারেক রহমান: ওই যে বললাম, কমবেশি সকলকে নিয়ে আমরা রাষ্ট্র গঠন করতে চাই।
বিএনপির মনোনয়নে এবার ভিন্ন কী হবে
বিবিসি বাংলা: কিন্তু দেখা গেছে, জামায়াতে ইসলামী তারা কিছু দলকে নিয়ে বিএনপিবিরোধী একটি জোট করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেটিকে আপনারা কি উদ্বেগ হিসেবে দেখেন? মানে আপনারা কীভাবে দেখেন সেটা?
তারেক রহমান: দেখুন, কোনো দল বা সমষ্টিগতভাবে কোনো দল যদি বাংলাদেশের যে আইন আছে, বৈধ আইন আছে। বাংলাদেশের যে সংবিধান এখনো যেটি আছে, এই সবকিছুর ভেতরে থেকে অর্থাৎ মানুষের সমর্থন-গ্রহণযোগ্যতা সবকিছুর ভেতরে থেকে যারা রাজনীতি করবে, তারা করতেই পারে। এটাতে তো কোনো সমস্যা বা উদ্বেগের কোনো কারণ আমি দেখি না।
বিবিসি বাংলা: সেখানে যদি তারা একটি আলাদা জোট করে, সেটি কি আপনাদের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে?
তারেক রহমান: না, কেন? ইলেকশন হলে তো ইলেকশনে প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতেই পারে। এতে উদ্বেগের কী আছে? বিএনপি তো আগেও নির্বাচন করেছে। বিভিন্ন সময় বিএনপি নির্বাচন করেছে। কম্পিটিশন করেই বিএনপি নির্বাচন করেছে। প্রতিযোগিতা করেছে। উদ্বেগের কিছু নেই।
বিবিসি বাংলা: মনোনয়নের প্রশ্নে যদি আসি, সেখানে আপনাদের কৌশলটা কী হবে? এর আগে বিভিন্ন সময় নির্বাচনগুলোতে পেশিশক্তির প্রভাব, টাকার প্রভাব, পারিবারিক বিষয় বিবেচনা এই বিষয়গুলো বিভিন্ন সময় অভিযোগ আছে। এবার ভিন্ন কি হবে আসলে?
তারেক রহমান: আপনি যেই বিষয়গুলো বললেন, আমরা কখনোই এইসব বিবেচনায় নিয়ে কখনোই আমার দল নমিনেশনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়নি।
আমাদের নমিনেশনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত সব সময় কমবেশি, যা ছিল বা ভবিষ্যতে আমরা যেটিকে মূল্যায়ন করব—সেটি হচ্ছে অবশ্যই কোনো একটি পার্টিকুলার এলাকা থেকে আমরা আমাদের দলের এমন একজন ব্যক্তিকেই নমিনেশন দিতে চাইব, যে ওই এলাকার সমস্যা সম্পর্কে সচেতন আছে, যার সাথে ওই এলাকার মানুষের সম্পৃক্ততা আছে, উঠাবসা আছে, যে ওই এলাকার মানুষের সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম।
যে ওই এলাকার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ, তরুণ, নারী, মুরব্বিসহ ছাত্রছাত্রী সবার সাথে যার একটা কমিউনিকেশন আছে। এই ধরনের মানুষকেই আমরা প্রায়োরিটি দিব, খুবই স্বাভাবিক। অর্থাৎ যার প্রতি জনসমর্থন আছে। যে জনসমর্থনকে তার সাথে রাখতে পারে। জনগণের যার প্রতি সমর্থন আছে সে রকম মানুষকে দেখেই আমরা নমিনেশন দেব।
বিবিসি বাংলা: সেখানে তৃণমূলের মতামত কতটা প্রাধান্য পাবে? অভিযোগ আছে যে তৃণমূলের মতামত প্রাধান্য কম পায়?
তারেক রহমান: না, ব্যাপারটা এ রকম না। দেখুন গণতন্ত্রে স্বাভাবিক যেখানেই গণতন্ত্র আছে, সেখানে মতামত থাকতেই পারে। বিভিন্ন রকম মতামত অভিযোগ। হয়তো এক জায়গায় ৫০ জন আছে। ৫০ জনের মধ্যে ৩০ জন একটি কথা বলছে, ১৫ জন একটি কথা বলছে। বাকিরা আরেকটি কথা বলছে। তাহলে আপনি কি বলবেন যে মতামত নে্য়ও হচ্ছে না? না।
স্বাভাবিকভাবেই যেখানে আমরা মেজরিটির যেটা মতামত পাবো, এলাকার মানুষের কম বেশি। আমরা তো আমাদের মতন করে খোঁজ করছি। সেটি তৃণমূলই হোক বা সেটি সাধারণ মানুষের হোক।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য—আমরা কিন্তু দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করছি না। আমরা নির্বাচন করছি এমন একজন ব্যক্তিকে, যেই শুধু দলেরই সমর্থন নয় বরং দলমত-নির্বিশেষে ওই এলাকার অধিকাংশ মানুষের সমর্থন যার প্রতি আছে।
আমরা এ রকম একজন মানুষকে বের করে আনতে চাইছি। এ রকম একজন মানুষকে আমাদের দলের মনোনয়ন দিতে চাইছি। শুধু দল দিয়ে তো নির্বাচন হবে না। নির্বাচনে তো সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ থাকে। বিভিন্ন মানুষের অংশগ্রহণ থাকে।
কাজেই যার সমর্থন আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব, চেষ্টা করছি যার প্রতি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থন আছে। শুধুমাত্র দলীয় সমর্থন নয়, এরকম মানুষ।
প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী কি না?
বিবিসি বাংলা: নির্বাচন প্রসঙ্গে আপনার কাছে জানতে চাই যে আগামী নির্বাচনে আপনার ভূমিকা কী হবে, আপনি কি সরাসরি নির্বাচন করছেন? আপনাকে কি আমরা প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী হিসেবে দেখতে পাব নির্বাচনে?
তারেক রহমান: আমার মনে হয়, আপনি প্রথম দিকে বোধহয় একটা প্রশ্ন করেছেন, আমি ওখানে বলেছিলাম স্বাভাবিক আমি একজন রাজনৈতিক দলের সদস্য। একজন রাজনৈতিক কর্মী আমি। নির্বাচনের সাথে তো রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক কর্মীর ওতপ্রোত সম্পর্ক।
কাজেই নির্বাচন যেখানে একটি মানে জনগণের সম্পৃক্ত, এ রকম একটি নির্বাচন হবে, সেখানে তো অবশ্যই আমি নিজেকে দূরে থাকতে পারব না। আমাকে আসতেই হবে। স্বাভাবিকভাবেই মাঠেই ইনশা আল্লাহ থাকব আমি। আপনি আপনার প্রশ্নের পরের যে অংশটি ছিল, দেখুন আমি মনে করি এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণের। এটি তো আমার সিদ্ধান্ত না। এটি সিদ্ধান্ত নিবে বাংলাদেশের জনগণ।
বিবিসি বাংলা: কিন্তু আপনি নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা সেই সিদ্ধান্ত তো আপনাকে নিতে হবে।
তারেক রহমান: না না সেটি তো নিব, কেন নিব না? অবশ্যই নিব।
বিবিসি বাংলা: আপনি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তাহলে?
তারেক রহমান: জ্বি, ইনশা আল্লাহ।
বিবিসি বাংলা: অর্থাৎ বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে বা নির্বাচনে অংশ নেয় সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী হিসেবে আমরা তারেক রহমানকে দেখতে পাব সেটা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি?
তারেক রহমান: এটির সিদ্ধান্ত তো বাংলাদেশের জনগণের।
বিবিসি বাংলা: বিএনপির পক্ষ থেকে?
তারেক রহমান: সে ক্ষেত্রে তো এটি দল সিদ্ধান্ত নেবে। দল কিভাবে করবে এটি তো দলের সিদ্ধান্ত।
নির্বাচনে খালেদা জিয়ার ভূমিকা কি হবে?
বিবিসি বাংলা: সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং আপনাদের দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তিনি কি এ নির্বাচনে কোনো ভূমিকায় থাকবেন? তাকে কি আমরা নির্বাচনে কোনো ভূমিকায় দেখতে পাবো?
তারেক রহমান: আপনি এমন একজন মানুষের কথা বলেছেন, যেই মানুষটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, যতবার গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করা হয়েছে, প্রতিবার উনি অবদান রেখেছেন। সেই গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত বা পুনরুদ্ধার করার জন্য।
এবারও আপনাদের সকলের চোখের সামনেই ঘটেছে যে কীভাবে স্বৈরাচারের সময় তার উপরে অত্যাচারের খড়গহস্ত নেমে আসে। কিন্তু উনি আপোষ করেননি। এরকম একজন ব্যক্তি আজ অসুস্থ। কেন কীভাবে উনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেন, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তাকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হলো।
আমরা দেখেছিলাম একজন সুস্থ মানুষ গিয়েছেন। কিন্তু যখন বেরিয়ে এসেছেন একজন অসুস্থ মানুষ বেরিয়ে এসেছেন। তাকে চিকিৎসার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। এ সবগুলোই ঘটনা দেশবাসী জানেন। তারপরেও যে মানুষটির এত বড় অবদান রয়েছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার।
আমি সেই দলের একজন কর্মী হিসেবে বিশ্বাস করি বা বিশ্বাস করতে চাই গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যেই প্রত্যাশিত, জনপ্রত্যাশিত যে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, উনার শারীরিক সক্ষমতা যদি এলাও করে উনাকে নিশ্চয়ই উনি কিছু না কিছু ভূমিকা রাখবেন।
বিবিসি বাংলা: সেটা কি নির্বাচনে অংশগ্রহণ হতে পারে?
তারেক রহমান: এটি আমি এখনো বলতে পারছি না। আমি মাত্রই বললাম যে উনার শারীরিক বা ফিজিক্যাল এবিলিটির উপরে বিষয়টি কিছুটা হলেও নির্ভর করছে।
বিবিসি বাংলা: এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন চলে আসে বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে। আপনার বাবা সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আপনার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তিনি চার দশক বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন আপনি কার্যত দলের নেতৃত্বে রয়েছেন আপনি। বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে পরিবারের প্রভাব কতটা থাকবে?
তারেক রহমান: দেখুন বিষয়টিকে আমি একটু তাহলে অন্যভাবে উপস্থাপন করি। সব রকম সকলের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমি বলতে চাইছি। দেখুন, একজন চিকিৎসকের সন্তান যখন চিকিৎসক হয় তখন সে ভালোও করে সে খারাপও করে। একজন লয়ারের সন্তানও দেখা যায় যে অনেক সময় বাবা-মায়ের মতন ভালো লয়ার (আইনজীবি) হয় অথবা হয় না।
রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে অনেকের সন্তান পলিটিক্সে এসেছে। সবাই কি ভালো করেছে? সবাই ভালো করেনি। কেউ কেউ করেছে কেউ কেউ করতে পারেনি ভালো।
আপনি যদি আমাকে ইঙ্গিত করে থাকেন, তাহলে এভাবে আমি বলব যে, দেখুন আমরা দেখেছি বাংলাদেশের মতন দেশে রাজনীতি যারা করেন বিগত ১৭ বছরে দেখেছি। তার আগেও আমরা দেখেছি রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে হ্যারাসমেন্টের শিকার হন। মিথ্যে মামলার শিকার হন। আমাদের বহু নেতা-কর্মী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জেল জুলুম খেটেছে। ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যেই কয়টা উদাহরণ দিলাম আমি মাত্র।
আপনি কি বলতে পারবেন, এর কোনোটার মধ্যে দিয়ে আমি যাইনি? এর প্রতিটার ভেতর দিয়ে আমি গিয়েছি। প্রত্যেকটা স্তর পার করে এসেছি আমি। আমি শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছি। যেই নির্যাতনের চিহ্ন এখনো কখনো কখনো আমাকে সহ্য করতে হয়। জেল জুলুম খেটেছি আমি। বিভিন্নভাবে মিথ্যা অপপ্রচারের শিকার হয়েছি আমি। সবকিছুর ভিতর দিয়েই আমি পেরিয়ে এসেছি।
কাজেই এইজন্য এই কথাগুলো আমি বললাম যে রাজনীতি পরিবারকরণ হয় না। এটি সমর্থনের ভিত্তিতে হয়। কাজেই যে অর্গানাইজ করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে দলকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে সে এগিয়ে যেতে পারবে। কেউ যদি এগিয়ে যেতে না পারে, তাহলে সে এগিয়ে যেতে পারবে না। সময় পরিস্থিতি সবকিছু প্রমাণ করে দিবে।
বিবিসি বাংলা: আপনার স্ত্রী বা কন্যা বা আপনার পরিবারে যারা আছেন তারা রাজনীতিতে আসবেন কিনা এটা নিয়ে কিন্তু ব্যাপক আলোচনা আছে। আলোচনা হয় কিন্তু রাজনীতিতে। তো এ ধরনের কি কোনো সম্ভাবনা আছে বা তারা আগ্রহী কি না রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে?
তারেক রহমান: আমি ওই যে বললাম সময় পরিস্থিতি বলে দিবে ওটা।
বিএনপির অগ্রাধিকার
বিবিসি বাংলা: একটু আবার নির্বাচনের দিকে যাই। বিএনপি সর্বশেষ সরকারে ছিল ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। এরপর প্রায় ১৯ বছর পরে বিএনপির সামনে আবার একটা সরকার গঠনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেই তখনকার যে বিএনপি আর এখনকার যে বিএনপি এই দুটোর পার্থক্যটা আপনি কোথায় কী বলবেন?
তারেক রহমান: এই ১৯ বছরে আমরা বাংলাদেশ বলি বা পুরো বিশ্ব বলি অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়েছে সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে। দুটো বড় বড় জিনিসের বোধহয় পরিবর্তন হয়েছে।
একটি হচ্ছে কোভিডের ভিতর দিয়ে পুরা বিশ্ব গিয়েছে। এই কোভিড বিভিন্নভাবে আমাদের অনেক কিছু চিন্তা ভাবনা মনোজগত চেঞ্জ করেছে। ঠিক একইভাবে যদি আরেকটি বিষয় আমরা দেখি এই যে আপনার সাথে আমি কথা বলছি অনলাইনে, এই যে আইটি বা সোশ্যাল মিডিয়া এই পুরো বিষয়টা কিন্তু মানুষের মনোজগতকে ভিন্নভাবে ভিন্ন রকম করেছে।
অনেক্ষক্ষেত্রে মনোজগতে একটা প্রভাব বিস্তার করেছে। খুব স্বাভাবিকভাবে আপনি যেই সময়ের কথা বলেছেন সেই সময় এই বিষয়গুলো হয়তো সেভাবে ছিল না। তো স্বাভাবিকভাবেই এই সবকিছু বিবেচনা করে সামনের দিনগুলোতে আমাদেরকে এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব রেখে বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে।
আমরা সেভাবে চিন্তাভাবনা করে আমাদের প্ল্যান প্রোগ্রাম বিষয়গুলোকে আমরা সাজাচ্ছি। সেই সময় থেকে ১৯ বছর আগে আমাদের যেসব প্ল্যান প্রোগ্রাম ছিল, তার থেকে কিছুটা পরিবর্তন হবে।
কিন্তু ওই যে বেসিক যে জিনিসটা সেটা হচ্ছে মানুষের বেটারমেন্ট। মানুষের ভালো কিছু করার জন্য মানুষ যাতে আজকে যেমন আছে আগামীকাল যাতে একটু বেটার থাকতে পারে কি, কীভাবে সেটা করা যেতে পারে, কে কোনো শ্রেণি কীভাবে একটু বেটার থাকতে পারে, সেটিই থাকবে আমাদের সবচেয়ে প্রায়োরিটি ইস্যু।
দুর্নীতি প্রশ্নে বিএনপি ভোটারদের আশ্বস্ত করবে কীভাবে
বিবিসি বাংলা: বিগত যখন বিএনপি সরকারে ছিল তখন অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ছিল, তার মধ্যে একটা বড় বিষয় ছিল দুর্নীতির অভিযোগ। সরকারে যারা ছিলেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে বা সেই সময় যেভাবে দুর্নীতি হচ্ছিল বিভিন্ন জায়গায়। আপনার নিশ্চয় মনে আছে যে দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে তখন অনেক সমালোচনা হয়েছিল। এ ধরনের পরিস্থিতি যে আর হবে না এ বিষয়ে আপনি ভোটারদেরকে কিভাবে আশ্বস্ত করবেন?
তারেক রহমান: দেখুন আপনি যে কথাটি বললেন দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। ৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ছিল সেই সময়। আমরা ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবরে সরকার নির্বাচনের পর ১০ই অক্টোবর সরকার গঠন করি, সম্ভবত।
এর বোধহয় কিছুদিন পরে একটি সূচক বের হলো টিআইবির। মানে দুই তিন মাস পরে বোধহয় একটি সূচক বের হলো।
নিশ্চয়ই মাত্র নির্বাচিত একটি সরকারের পক্ষে তো ভালোমন্দ কোনো কিছুই তিন মাসে করা সম্ভব নয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই যে সূচকটি হয়েছিল সেটি তার আগে আমাদের আগে যে সরকারটি ছিল তারা যে পাঁচ বছর যা করেছে তার উপর ভিত্তি করেই সেই সূচকটি তারা তৈরি করেছে।
আপনি যদি ২০০১ থেকে ২০০৬ অর্থাৎ বিএনপি সরকার গঠন করার পরে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে যখন ক্ষমতা হ্যান্ডওভার করে দিল, আপনি যদি সেই সংস্থা টিএইবি নামক সেই সংস্থাটার রিপোর্টই যদি আপনি দেখেন তাহলে দেখবেন পর্যায়ক্রমিকভাবে, এটি কিন্তু আমার কথা না, এটি তাদের পরিসংখ্যানের কথা-পর্যায়ক্রমিকভাবে কিন্তু নেমে এসেছে।
হ্যাঁ আমি এডমিট করছি পুরাপুরি হয়তো আমরা করতে পারিনি। বাস্তবতা তো বুঝতে হবে। এটি একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কাজেই এটি মানুষকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে বুঝিয়ে আস্তে আস্তে করতে হবে। জিনিসটি সময় লাগবে।
আমি এখন যত কথাই বলি না কেন বাস্তবতা হচ্ছে এই বিষয়টি যেহেতু সময় লাগবে আমাদেরকে কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে।
সেজন্যই আমি ভোটারদেরকে এতটুকু বলতে পারব, আমরা যদি সুযোগ পাই, জনগণ যদি আমাদেরকে সেই সুযোগ দেন, তাহলে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আমরা যাতে একটি এমন অবস্থা তৈরি করতে পারি যেখানে কিছুটা হলেও আমরা বহিঃবিশ্বে বিশ্বের অন্য দেশের সামনে কিছুটা হলেও যাতে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারি।
চাঁদাবাজি, দখলের মত নানা অভিযোগ নিয়ে যা বললেন
বিবিসি বাংলা: পাঁচই আগস্টের পরে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে চাঁদাবাজি বা দখলের মত নানা অভিযোগ এসেছে। আপনাদের দল থেকে অনেককে বহিষ্কার করা হয়েছে এটা ঠিক, আবার একই সাথে এটাও ঠিক যে এই অভিযোগগুলো কিন্তু বারবার আসছে। তো এটা থামানো যাচ্ছে না কেন?
তারেক রহমান: আপনার প্রতি সম্মান রেখে আপনার সাথে এগ্রিও যেমন করবো, আবার এখানে অন্য একটি বিষয় আমি তুলে ধরতে চাইবো।
এর মধ্যে নিশ্চয়ই আপনারা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখেছেন যে প্রায় ৭০০০ এর মতন আমাদের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে আমরা কিছু সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। কিন্তু এই ৭০০০ এ সবাই কিন্তু আপনি যে অভিযোগ করলেন এই অভিযোগের সাথে জড়িত নয়। এর মধ্যে এমন অনেক বিষয় আছে যারা অন্য সাংগঠনিক বিষয়ের সাথে জড়িত। এটি গেল একটি বিষয়।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে আমাদের কাছে এরকম যখন অনেক অভিযোগ এসেছে। আমরা অভিযোগগুলো তদন্ত করেছি। তদন্ত করার পরে আমরা বেশ কিছু বিষয় পেয়েছি।
যেমন আমি দুই-একটি উদাহরণ দিয়ে আপনাকে বলি। যেমন-ধরেন দুই ভাই। কোনো একটি এলাকায় দুই ভাই আছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে পারিবারিক সম্পত্তি সহায় সম্পত্তি নিয়ে একটি সমস্যা আছে। এক ভাই বিগত যে স্বৈরাচার পলাতক স্বৈরাচার তাদের কারো সাথে এক ভাইয়ের খুব ভালো সম্পর্ক।
তার ফলে সে সেই স্বৈরাচারের যে দোসর যার সাথে এই এক ভাইয়ের সম্পর্ক, সে তার ইনফ্লুয়েন্সটি ব্যবহার করে অন্য ভাইয়ের সম্পত্তিও জোর করে দখল করে রেখেছে। এখন পাঁচ তারিখের পরে যে ভাই স্বৈরাচারের দোসরকে ব্যবহার করেছিল সেই দোসরও তো পালিয়ে গিয়েছে। তো স্বাভাবিকভাবেই সেই ভাই এখন আর শেল্টার পাচ্ছে না।
তো অন্য যার সম্পত্তি জোর করে রেখে দিয়েছিল অন্য ভাইটি। সেই অন্য ভাইটি স্বাভাবিকভাবে তার হক আদায় করতে গিয়েছে বা হক বুঝে নিতে গিয়েছে। এখন এক্সিডেন্টলি বা ইনসিডেন্টলি যে ভাই এতদিনভাবে বঞ্চিত ছিল সম্পত্তি থেকে সেই ভাই বিএনপি করে। বিএনপির কোনো একজন কর্মী বা স্ট্রং সমর্থক বা নেতা যেটাই হোক। চাপিয়ে দিল অভিযোগ তুলে দিল অন্যজন যে বিএনপি দখল করতে গিয়েছে। এ রকম ঘটনা আমরা প্রচুর পেয়েছি।
আবার আরেকটি আমি উদাহরণ দেই যা সত্য, যা বাস্তব। স্বৈরাচারের সময় সারা বাংলাদেশে আমাদের প্রায় ৫০ লাখের বেশি নেতা-কর্মীর নামে বিভিন্ন রকম গায়েবি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছিল।
আমাদের বহু নেতা-কর্মী তাদের ঘর বাড়িতে থাকতে পারতো না। তাদেরকে বিভিন্নভাবে পালিয়ে থাকতে হতো। বিভিন্নভাবে সরে থাকতে হতো। এই সুযোগে স্বৈরাচার তাদের ব্যবসা বাণিজ্য দোকান-পাট ঘর বাড়ি জমি জমা পুকুর দখল করে নিয়েছিল। পাঁচ তারিখে যখন স্বৈরাচার পলাতক হয়ে গিয়েছে, পালিয়ে গিয়েছে-তখন স্বৈরাচারের যারা দখল করেছে তারাও সাথে সাথে পালিয়ে গিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই আমাদের নেতা-কর্মীরা তাদের নিজেদের যেগুলি বৈধ সম্পত্তি, পৈতৃক সম্পত্তি সেগুলো আবার ফিরে পেতে গিয়েছে। তখন আবার কিছু সংখ্যক লোক প্রচার করেছে যে বিএনপির লোকজন দখল করতে গিয়েছে এরকম ঘটনা প্রচুর ঘটেছে।
আপনি যেই কথাটি বললেন সেরকমও কিছু ঘটেছে। সে কারণেই আমরা আমাদের অবস্থান থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। তবে এখানে আমার একটি প্রশ্ন আছে, যে প্রশ্নটি আমরা পাবলিকলিও করেছি। দেখুন আমরা একটি রাজনৈতিক দল। কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমরা অস্বীকার করছি না। ঘটেছে যেমন, আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি তাদের বিরুদ্ধে।
যতটুকু আমরা জেনেছি, যতটুকু আমরা তদন্তের পরে পেয়েছি, যখন সত্যতা পেয়েছি, আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু পুলিশিং করা তো আমাদের কাজ না। রাজনৈতিক দলের কাজ অবশ্যই পুলিশিং করা না।
আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কখনো বলিনি সরকারকে-যে অমুককে ধরতে পারবে না, তমুককে ধরতে পারবে না, এই করতে পারবে না ওই কথা। আমরা কিন্তু কখনো বলিনি। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে যাদের কাজ পুলিশিং করা তারা কেন তাদের কাজটি করছে না। তারা কেন তাদের কাজে ব্যর্থ এটি আমাদের প্রশ্ন।
বিবিসি বাংলা: তার মানে এখানে সরকারের একটা ব্যর্থতা আছে?
তারেক রহমান: অবশ্যই। আমি তো আগেই বলছি পুলিশিং তো রাজনৈতিক দলের কাজ না পুলিশিং করার দায়িত্ব সরকারের।
বিবিসি বাংলা: অর্থাৎ আমরা ধরে নিতে পারি যে, আপনারা যদি সরকার গঠন করেন সে ক্ষেত্রে আপনার দলের নেতা-কর্মী বা আপনার দলের নামে কোনো চাঁদাবাজি বা দখল এ ধরনের কিছু কেউ সেটা করতে পারবে না, কারণ তখন যেহেতু আপনারা সরকারে থাকবেন?
তারেক রহমান: ইয়েস, পুলিশ পুলিশের কাজ করবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আইনশৃঙ্খলার কাজ করবে। বিএনপি ইনশা আল্লাহ সরকার গঠন করলে আমার দলের কোন নেতা-কর্মী তখনো যদি এ রকম কোনো অনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত হয় আমরা দলের অবস্থান থেকে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিব।
দল তার পক্ষে থাকবে না, দলের অবস্থান এবং দেশের আইন অনুযায়ী। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব যাদের, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তারা তাদের কাজ করবে, সিম্পল। এখানে দুইয়ে দুইয়ে চারের মতন ব্যাপার।
’ডাকসুর প্রভাব পড়বে না জাতীয় রাজনীতিতে’
বিবিসি বাংলা: একটু ডাকসু নির্বাচন প্রশ্নে আসি। সাম্প্রতিক সময়ে ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ব্যাপক আলোচনা চলছে রাজনীতিতে এখনো। এর ফলাফলে দেখা গেছে যে বিএনপি সমর্থক ছাত্রদলের চেয়ে বেশ বড় ব্যবধানে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল জয়ী হয়েছে। আপনি কীভাবে দেখেন এই ফলাফলটাকে আসলে?
তারেক রহমান: আমি মনে করি গণতান্ত্রিক যাত্রার একটি ভালো উদ্যোগ এটি। ভালো সূচনা। এটি গেল এক নম্বর।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে যারা জয়ী হয়েছেন বা এরকম আরো ভবিষ্যতে যারা জয়ী হবেন, তাদের প্রতি শুভেচ্ছা এবং যারা ভবিষ্যতে জয়ী হবেন তাদের প্রতি অগ্রিম শুভেচ্ছা রইলো।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে দেখুন একটা অগ্রযাত্রা শুরু হলো, কিন্তু আমরা চাইছিলাম না যে কোনো বিতর্কের মধ্যে এগুলা পড়ুক। আমরা আশা করব যে পরবর্তীতে যেগুলো হবে সেগুলো বিতর্কবিহীন হবে নির্বাচনগুলো।
বিবিসি বাংলা: এই নির্বাচনের ফলাফল, মানে ডাকসুর নির্বাচনের ফলাফল এটা কি জাতীয় রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে? আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আপনার কি মনে হয়? আপনি কি মনে করেন সেটা?
তারেক রহমান: আমি যেটা দেখলাম বিভিন্ন মিডিয়াতে কিছু ব্যক্তি, যেমন-মান্না ভাই, ওনাকে উনি তো বোধহয় দুবার ভিপি ছিলেন। আমার থেকে অনেক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাজনীতিবিদ।
আমরা যদি উনার বক্তব্য শুনে থাকি বা ধরে থাকি তাহলে তো আমি মনে করি না কোনো কারণ আছে। ছাত্র রাজনীতি ছাত্র রাজনীতির জায়গায়, জাতীয় রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির জায়গায়।
জামায়াতের সম্ভাব্য জোট নিয়ে উদ্বেগ নেই
বিবিসি বাংলা: এখন যে সক্রিয় দলগুলো আছে তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর প্রশ্নে যদি একটু আসি, যে জামায়াতে ইসলামীকে ঘিরে বিএনপির নেতাদের অনেক সমালোচনা করতে দেখা যাচ্ছে। গত সাম্প্রতিক সময়ে, তো জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে আপনার মনোভাবটা কি আসলে?
তারেক রহমান: বিষয়টা হচ্ছে যে দেখুন বাংলাদেশের স্বীকৃত যে নিয়ম, আইন-কানুন আছে, এগুলোর ভিতরে থেকে যদি কেউ রাজনীতি করে অবশ্যই করতে পারে।
বিএনপি সবসময় বহুদলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। কাজেই বিষয়টি আমরা এভাবেই দেখতে চাই।
দেশের যে আইন কানুন আছে তার ভিতরে থেকে যারা রাজনীতি করবে, অবশ্যই সবার রাজনীতি করার অধিকার আছে। এবং আমরা তো চাই সবাই রাজনীতি করুক। বহুদলীয় রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি।
বিবিসি বাংলা: জামায়াতে ইসলামী তো বিএনপির সাথে একসময় মিত্র ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের বিরোধী ভূমিকা নিয়ে কিন্তু বিএনপি নেতারা এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, সামনে আনছেন। কিন্তু বিএনপি আবার তাদের সাথে সরকারও গঠন করেছিল একটা সময়?
তারেক রহমান: ২০২৪ সালে স্বৈরাচার যেই হত্যাগুলো করেছে দেশ স্বাধীনের পরে যখন তারা সরকার গঠন করেছিল ক্ষমতায় ছিল তখনও যে সকল লুট তারা করেছে, খুন-গুম তারা করেছে।
বিগত ১৭ বছর গুম খুন যারা করেছে, এর জবাব যে রকম তাদেরকেই দিতে হবে, ঠিক একইভাবে ’৭১ সালে কোনো রাজনৈতিক দল যদি তাদের কোনো বিতর্কিত ভূমিকা থেকে থাকে, তাহলে তাদের জবাব তারাই দিবেন। ওটা তো আর আমি দিতে পারবো না। আমারটা আমি দিতে পারবো। অন্যেরটা তো আমি দিতে পারবো না।
যা বললেন আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রসঙ্গে
বিবিসি বাংলা: আপনি জুলাইয়ের সময়ের কথা বলছিলেন। সে সময়ের হত্যাকাণ্ডের কথা বলছিলেন। সেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ব্যাপারে আপনার আপনাদের বা বিএনপির অবস্থানটা কী আসলে?
তারেক রহমান: দেখুন, আমি ১৭ বছর যাবত প্রবাস জীবনে আছি। ওয়ান ইলেভেন, তথাকথিত ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় যেই শারীরিক নির্যাতন আমার উপরে হয়েছিল তারপরে চিকিৎসার জন্য আমি এই দেশে আসি।
আমি যখন এখানে আসি, আমার ভাইকে আমি রেখে এসেছিলাম ছোট ভাইকে। আমি যখন এই দেশে আসি আমার সুস্থ মাকে আমি রেখে এসেছিলাম। একটি ঘর রেখে এসেছিলাম। যেই ঘরে আমি এবং আমার ছোট ভাই বড় হয়েছি। যেই ঘরে আমার বাবার স্মৃতি ছিল। যেই ঘরে আমাদের দুই ভাইয়ের সন্তানরা জন্মগ্রহণ করেছিল। যেই ঘরে আমার মায়ের বহু স্মৃতি ছিল।
সেই স্মৃতিগুলোকে ভেঙে চুড়ে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে ভাইকে আমি রেখে এসেছিলাম সেই ভাই এখন আর নেই। যেই সুস্থ মাকে রেখে এসেছিলাম সেই সুস্থ মা এখন সুস্থ নেই। শুধু অসুস্থই নন, উনার উপরে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনও করা হয়েছে।
আমি আমার পরিবারের যেই কাহিনী আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। এটিকে আপনারা কাহিনী বলুন, বা সংগ্রাম বলুন যেটাই বলুন না কেন, এটি শুধু আমার কাহিনী না, বা আমার পরিবারের কাহিনী না। এরকম কাহিনী বাংলাদেশের শত না, হাজার হাজার পরিবারের।
যে পরিবারের বাবা, যে পরিবারের ভাই, যে পরিবারের স্বামী তার ঘরবাড়ি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, হ্যান্ডকাফ পারা অবস্থায় হাসপাতালের বারান্দায় মারা গিয়েছে, তা না হলে হ্যান্ডকাফ পারা অবস্থায় জেলের ভিতরে মারা গিয়েছে, সহায় সম্পত্তি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে-এই সকল অন্যায়, এই সকল হত্যা, এই সকল নির্যাতনের জন্য যারা দায়ী, যারা এসবের হুকুম দিয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিচার হতে হবে।
এটি প্রতিশোধের কোনো বিষয় নয়। এটি ন্যায়ের কথা। এটি আইনের কথা। অন্যায় হলে তার বিচার হতে হয়। কার সম্পর্কে কী মনোভাব সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বিবিসি বাংলা: এখানে একটা বিষয় আলোচনায় এসেছে যে যারা অপরাধী তাদের বিচার হবে। কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারা-না পারার প্রশ্নে বিএনপিরও অনেক নেতা অনেক সময় বলেছেন যেকোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে তারা নন। তো এখন নির্বাচনও সামনে আসছে। ফলে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে কি পারবে না সে ধরনের একটা প্রশ্নও আসছে। তো সেটা সেই জায়গাটাতে বিএনপির অবস্থানটা কী হতে পারে?
তারেক রহমান: দল হিসেবে তারা যদি অন্যায় করে থাকে তাহলে দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। দেশের আইন সিদ্ধান্ত নেবে।
বিবিসি বাংলা: তার মানে এটা আদালতের বিষয় বলে মনে করছেন?
তারেক রহমান: দল হিসেবে যদি অন্যায় হয়ে থাকে তাহলে তাই হবে। সোজা কথায় অন্যায়কারীর বিচার হতে হবে। তো সেটি ব্যক্তি হোক, সেটি দলই হোক। যারা জুলুম করেছে তাদের তো বিচার হতে হবে। সেটি ব্যক্তিও হতে পারে। সেটি দলও হতে পারে।
বিবিসি বাংলা: আপনি ব্যক্তিগতভাবে কী মনে করেন? আওয়ামী লীগের কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে থাকা উচিত নাকি, না?
তারেক রহমান: আমার মনে হয় আপনার কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তরে আমি মনে হয় বলেছিলাম যে আমরা রাজনীতি করি জনগণের জন্য।
আমরা বিশ্বাস করি এবং বিভিন্ন সময় বলিও আমরা বিএনপি যারা করি আমাদের রাজনৈতিক সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং বিশ্বাস করতে চাই-যে দলের ব্যক্তিরা বা যে দল মানুষ হত্যা করে, মানুষ গুম করে, মানুষ খুন করে, দেশের মানুষের অর্থসম্পদ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে-জনগণ তাদেরকে সমর্থন করতে পারে বলে আমি মনে করি না।
জনগণ যদি সমর্থন না করে কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক সংগঠনকে তাদের টিকে থাকার তো কোনো কারণ আমি দেখি না। যেহেতু জনগণের শক্তিতে আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের সিদ্ধান্তে আমরা বিশ্বাস করি। জনগণের সিদ্ধান্তের উপরে আমরা আস্থা রাখতে চাই। এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় বিচারক আমি মনে করি জনগণ।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে বিবিসি বাংলার সাক্ষাৎকারের এটি প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্বটি প্রকাশ হবে মঙ্গলবার ৭ই অক্টোবর বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইট, ফেসবুক পাতা ও ইউটিউব চ্যানেলে।

উত্তরাধিকার, এখনও সময় আছে, দেশ—তিনটি লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ২০০৪ সালের কোনো এক দুপুরবেলা কলকাতার টালিগঞ্জে বসে এ কথা বলেছিলেন দুই বাংলায় জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার। প্রায় চার হাজার শব্দের সাক্ষাৎকারে অকপটে অনেক কথাই তিনি বলেছেন। সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের পক্ষে সেই সময় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন তাপস কুমার দ
১১ মে ২০২৩
ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকে এই কার্যক্রমে যুক্ত। আমরা ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মুদারাবা স্কুল স্টুডেন্ট সেভিংস অ্যাকাউন্ট’ চালু করেছি, যেখানে অভিভাবকেরা সন্তানদের পক্ষ থেকে হিসাব পরিচালনা করেন। মূল লক্ষ্য হলো শিশু-কিশোরদের সুদমুক্ত অর্থনীতিতে যুক্ত করা এবং ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল...
৪ দিন আগে
ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসি (ইবিএল) নিয়মিতভাবে স্কুলে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং বিশেষ অফারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচেতন করছে এবং তাদের হিসাব খোলায় উৎসাহ দিচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং জ্ঞান ও সঞ্চয়ের গুরুত্ব বোঝাতে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করি।
৪ দিন আগে
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রায় দুই দশক পর প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে বিবিসি বাংলার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি।
১৯ দিন আগে