Ajker Patrika

ট্রাম্প-মাস্ক দ্বন্দ্বে বিপাকে নাসা, ৪০টি অভিযান বন্ধের আশঙ্কা

অনলাইন ডেস্ক
চাঁদ ও মঙ্গলে অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে নিজেদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উদ্যোগগুলোকে নতুন করে সাজাচ্ছে নাসা। ছবি: হ্যানকুক হেলথ
চাঁদ ও মঙ্গলে অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে নিজেদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উদ্যোগগুলোকে নতুন করে সাজাচ্ছে নাসা। ছবি: হ্যানকুক হেলথ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইলন মাস্কের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বাজেট কাটছাঁটের আশঙ্কা আরও বেড়েছে। হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী বিজ্ঞানভিত্তিক প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দ প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এতে নাসার ৪০টি চলমান মহাকাশ মিশন বা অভিযান বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।

যেসব প্রকল্পে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছিল, সেসব প্রকল্প সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়েছে। এমনকি প্লুটো গ্রহের বিখ্যাত হৃদয় আকৃতির ছবি তুলেছিল যে মহাকাশযান, তা-ও এই বাজেট কাটছাঁট কারণে মাঝপথে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

নাসা তাদের বাজেট প্রস্তাবে জানিয়েছে, তারা চাঁদ ও মঙ্গলে অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে নিজেদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উদ্যোগগুলোকে নতুন করে সাজাচ্ছে।

স্পেসএক্স ও নাসার ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে ধোঁয়াশা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, ইলন মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্সের সঙ্গে করা সব ফেডারেল চুক্তি বাতিল করা হতে পারে। অথচ নাসা বর্তমানে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে (আইএসএস) রসদ ও নভোচারী পাঠাতে স্পেসএক্সের ফ্যালকন-৯ রকেটের ওপর নির্ভর করে। ভবিষ্যতে চাঁদ ও মঙ্গলে নভোচারী পাঠানোর জন্য স্পেসএক্সের স্টারশিপ রকেট ব্যবহারের পরিকল্পনাও রয়েছে।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’-এ মাস্ক হুমকি দেন, স্পেসএক্স ধীরে ধীরে তাদের ‘ড্রাগন’ মহাকাশযান কার্যক্রম বন্ধ করে দেবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ অভিযানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই অনিশ্চয়তা সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের ওপেন ইউনিভার্সিটির মহাকাশ বিজ্ঞানী ড. সাইমিয়ন বারবার বলেন, ‘আমরা গত সপ্তাহে যেসব তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত, মতবিরোধ এবং নীতির পরিবর্তন দেখেছি, তা আমাদের মহাকাশযাত্রার ভিত্তিকে নড়িয়ে দিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মহাকাশ গবেষণা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের ওপর নির্ভর করে।’

বিবিসির মতে যেসব মিশন ঝুঁকিতে রয়েছে—

  • মার্স স্যাম্পল রিটার্ন (এমএসআর)
  • ল্যান্ডস্যাট নেক্সট
  • ইনভিশন
  • ভ্যারিটাস
  • দ্য ভিঞ্চি
  • মার্স ওডিসি
  • মাভেন (MAVEN)
  • জুনো

এসব প্রকল্প অনেকখানি এগিয়েছে। তবে এগুলোর উন্নয়ন ও উৎক্ষেপণ খরচ ইতিমধ্যে বহন করা হয়েছে। এখন কেবল তাদের পরিচালন ব্যয় প্রয়োজন।

বিবিসির মতে যেসব মিশন ঝুঁকিতে রয়েছে। ছবি: বিবিসি
বিবিসির মতে যেসব মিশন ঝুঁকিতে রয়েছে। ছবি: বিবিসি

মঙ্গল ও চাঁদে মানুষ পাঠানোই অগ্রাধিকার

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অধীনে নাসা মূলত দুটি লক্ষ্যে কাজ করছে—চীনের আগেই চাঁদে মার্কিন নভোচারী পাঠানো এবং মঙ্গলে মার্কিন পতাকা স্থাপন। এ লক্ষ্যে মঙ্গল অভিযানের জন্য অতিরিক্ত ১০ কোটি ডলার বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

ক্র্যানফিল্ড ইউনিভার্সিটির মহাকাশ বিশ্লেষক ড. অ্যাডাম বেকার বিবিসিকে বলেন, ‘এই বাজেট প্রস্তাব পাস হলে নাসার কার্যক্রমে এক মৌলিক পরিবর্তন আসবে।’

নতুন রকেট বনাম পুরোনো ব্যয়বহুল প্রকল্প

নাসার চাঁদে মানুষ পাঠানোর মূল রকেট—স্পেস লঞ্চ সিস্টেম (এসএলএস)। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনেক বিলম্ব হচ্ছে এবং অতিরিক্ত ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। প্রতিটি উৎক্ষেপণের জন্য ব্যয় হয় ৪ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। বিপরীতে স্পেসএক্সের স্টারশিপ বা ব্লু অরিজিনের নিউ গ্লেন রকেটের উৎক্ষেপণ খরচ আনুমানিক ১০ কোটি ডলার, কারণ এগুলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য।

হোয়াইট হাউসের প্রস্তাবে এসএলএস ধীরে ধীরে বন্ধ করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে স্টারশিপ এখনো তিনটি পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণে ব্যর্থ হয়েছে এবং নিউ গ্লেন এখনো চাঁদের উদ্দেশে পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ শুরু করেনি।

ড. বারবার বলেন, ‘আমরা এক বিপজ্জনক বিকল্পের দিকে এগোচ্ছি। যদি মাস্ক বা বেজোস ভবিষ্যতে আর আগ্রহ না দেখায় কিংবা তাদের কোম্পানি অতিরিক্ত অর্থ দাবি করে, তাহলে কংগ্রেস বাধ্য হবে তা দিতে।’

আন্তর্জাতিক অংশীদারত্বেও ধাক্কা

এই বাজেট কাটছাঁটের প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ইএসএ)। যেমন—মঙ্গলে পাঠানো রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন রোভার এবং নাসার পারসিভিয়ারেন্স রোভারের সংগ্রহ করা পাথর পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার মিশন।

মহাকাশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সুরি স্যাটেলাইট টেকনলজির প্রধান প্রফেসর স্যার মার্টিন সুইটিং বলেন, ‘এটি দুঃখজনক হলেও ইউরোপের জন্য একটি সুযোগ হতে পারে নিজেদের মহাকাশ কার্যক্রমে স্বনির্ভরতা বাড়ানোর।’

তবে স্বল্প মেয়াদে ইউরোপের জন্য ফলাফল নেতিবাচক। আইএসএস ও চাঁদের চারপাশে নির্মাণাধীন লুনার গেটওয়ে প্রকল্পে নাসার অবদান কমে গেলে ইউরোপের অংশগ্রহণও ঝুঁকিতে পড়বে।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও জলবায়ু গবেষণার জন্য ঝুঁকি

নাসার বেশ কয়েকটি আর্থ অবজারভেশন (পৃথিবী পর্যবেক্ষণ) প্রোগ্রামও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই ধরনের প্রকল্প পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাব পর্যবেক্ষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ড. বেকার বলেন, ‘এগুলো আমাদের আগাম সতর্কবার্তার ব্যবস্থা। জলবায়ুর প্রভাব পূর্বাভাস দেওয়া ও তা মোকাবিলার ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’

রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা

এখনো কংগ্রেস এই বাজেট প্রস্তাব অনুমোদন করেনি। তবে দ্য প্ল্যানেটারি সোসাইটির স্পেস নীতি প্রধান কেসি ড্রেয়ার জানান, অনেক রিপাবলিকান সদস্য ব্যক্তিগতভাবে এই বাজেটের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

তবে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে চূড়ান্ত বাজেট পাস না হলে হোয়াইট হাউসের এই কম বাজেটই অস্থায়ীভাবে কার্যকর হয়ে যেতে পারে। একবার কোনো মহাকাশ মিশন বন্ধ হয়ে গেলে তা আবার চালু করা প্রায় অসম্ভব বলেই জানান ড্রেয়ার।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত