Ajker Patrika

ইসরায়েলি হামলার পর ইরানজুড়ে আতঙ্ক, শোক আর প্রতিশোধের আগুন

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৪ জুন ২০২৫, ০১: ২৭
হামলার প্রতিবাদে ইরানের রাজধানী তেহরানে বিক্ষুব্ধ মানুষ। ছবি: সংগৃহীত
হামলার প্রতিবাদে ইরানের রাজধানী তেহরানে বিক্ষুব্ধ মানুষ। ছবি: সংগৃহীত

তেহরানের পশ্চিমাঞ্চলের মার্জদারান পাড়ায় বসবাসকারী ৬২ বছর বয়সী রোয়া শুক্রবার ভোররাতে বিস্ফোরণের শব্দে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘এটা ছিল ভয়াবহ। মনে হচ্ছিল, হৃৎপিণ্ডটা যেন বুকে লাফাচ্ছে।’

রোয়া জানান, প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, বিস্ফোরণ দূরের কোনো এলাকায় ঘটেছে। কিন্তু পরে জানতে পারেন, তাঁর বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক রাস্তা দূরের একটি বাড়িও হামলার শিকার হয়েছে।

ইরান-ইরাক যুদ্ধপরবর্তী সময়ে এই প্রথম তেহরান শহরের ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় সরাসরি এ ধরনের ভয়াবহ বিমান হামলা চালানো হলো। শুক্রবার ভোররাত থেকে শুরু হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অন্তত পাঁচ দফায় এই হামলা চালায় ইসরায়েল। তেহরানের বিভিন্ন এলাকায় বিমান হামলায় বহু আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এই হামলায় ইরানের ছয় শীর্ষস্থানীয় পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। যাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন দেশটির পরমাণু শক্তি সংস্থার সাবেক প্রধান। একই সঙ্গে দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মোহাম্মদ বাঘেরি, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি এবং আইআরজিসির মহাকাশ ইউনিটের প্রধান আলী আকবর হাজিকাদেহ নিহত হয়েছেন।

নিহতদের মধ্যে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির উপদেষ্টা ও সাবেক নিরাপত্তাপ্রধান আলী শামখানিও রয়েছেন। আহত ও নিহতদের মধ্যে অনেকের পরিবারের সদস্যও আছেন। খামেনি ও অন্য শীর্ষ নেতারা এই হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে এই উত্তেজনার জন্য দায়ী করেছেন।

ইশফাহান শহরের কাছাকাছি নাতানজে অবস্থিত ইরানের প্রধান পারমাণবিক স্থাপনাতেও হামলা চালানো হয়। দেশব্যাপী আরও বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে।

হামলার পরপরই ইরানের বহু এলাকায় পেট্রলপাম্পে দীর্ঘ লাইন পড়ে। তবে কর্তৃপক্ষ জানায়, জ্বালানির কোনো ঘাটতি হয়নি এবং তেল স্থাপনাগুলো অক্ষত রয়েছে। তবে হামলার পর ইরানের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সাময়িকভাবে ইন্টারনেট সীমিত করে এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দেশের সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কনসার্ট স্থগিত ঘোষণা করে।

ইসরায়েল আবারও নতুন করে হামলার হুমকি দেওয়ায় অনেক বাসিন্দা তেহরান ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। এই শহরের আবাসিক এলাকায় ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে নিহতদের মধ্যে শিশুদেরও খুঁজে পাওয়া গেছে।

এক সাংবাদিক ফাতেমেহ কালান্তারি লিখেছেন, ‘সে (নিহত এক শিশুকন্যা) কোনো সামরিক ব্যক্তি ছিল না, পারমাণবিক বিজ্ঞানীও না। সে শুধু একজন সাইক্লিং ভালোবাসা মেয়ে ছিল—আমার বন্ধু নাজমেহ।’

হামলার প্রতিবাদে তেহরানসহ ইরানের অন্যান্য শহরেও বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। ইরানের ফার্স নিউজ এজেন্সি একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, কুম শহরের পবিত্র জামকারান মসজিদের চূড়ায় লাল রঙের একটি পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ফার্স বলেছে, পবিত্র জামকারান মসজিদের ওপর প্রতিশোধের লাল পতাকা উড়ছে।

শিয়া মুসলমানদের জন্য লাল পতাকা এক বিশেষ প্রতীক। সাধারণত ইসলামি মাস মহররমে, বিশেষ করে কারবালার যুদ্ধ ও ইমাম হোসেন (আ.)-এর শাহাদাত স্মরণে এই পতাকা উত্তোলন করা হয়। তবে মহররম মাস ছাড়া এই পতাকা উত্তোলন অত্যন্ত বিরল ঘটনা। পতাকাটি প্রতিশোধ ও শোকের এক শক্তিশালী বার্তা বহন করে।

এই পতাকায় লেখা রয়েছে, ‘ইয়া লা-সারাত আল-হোসেইন’। এর অর্থ হলো, হে হোসাইনের প্রতিশোধ গ্রহণকারীরা।

ইসলামের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (আ.) শিয়া ইসলামের অন্যতম পবিত্র চরিত্র। তাঁকে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে মানা হয়। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান ইরাকের কারবালায় উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদের সেনাদের হাতে তিনি শহীদ হন।

এই যুদ্ধ ও ইমাম হোসেনের শাহাদাত শিয়া ইসলামের ভিত্তিভূমি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এটি সুন্নি ও শিয়া ইসলামের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাজনরেখা তৈরি করে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই পতাকা উত্তোলন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের শক্ত বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এক্সে প্রকাশিত ইরানের তাসনিম সংবাদ সংস্থার একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, কুম শহরের জামকারান মসজিদে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীরা ইরানের পতাকা হাতে নিয়ে ইসরায়েলবিরোধী স্লোগান দিচ্ছেন। তেহরান থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত কুম শহর ইরানের অন্যতম পবিত্র নগরী।

হামলাটি ঘটেছে ঈদে গাদির-এর প্রাক্কালে। এটি মূলত শিয়া মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এই হামলার জবাবে ইরান ঘোষণা দিয়েছে, তারা একটি নতুন পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র গড়বে এবং ফোরদো সাইটে আরও উন্নত সেন্ট্রিফিউজ স্থাপন করবে।

তেহরানে আজ ভয়, ক্ষোভ এবং প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা একত্রে গর্জে উঠেছে। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তাকে গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত