Ajker Patrika

গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা-গণহত্যার ৬০০ দিন

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২৮ মে ২০২৫, ১৮: ০৫
ত্রাণের আশায় একটি গাড়ির দিকে ছুটছে ফিলিস্তিনিরা। ছবি: আনাদোলু
ত্রাণের আশায় একটি গাড়ির দিকে ছুটছে ফিলিস্তিনিরা। ছবি: আনাদোলু

গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর ৬০০ দিন পার হয়েছে। অবিরাম বোমা হামলা, পরিকল্পিত অনাহার, ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ও অবর্ণনীয় শোকের ৬০০ দিন। এই দীর্ঘ সময়ে ইসরায়েলি গণহত্যার বিপরীতে তথাকথিত সভ্য পশ্চিমা বিশ্ব কেবল নীরব দর্শক হয়ে থাকেনি, তারা প্রতিটি দিনকে ‘সম্ভব’ করে তুলেছে।

প্রায় ১৬ হাজার শিশুসহ ৫৫ হাজার ফিলিস্তিনির নিহত হওয়ার পরও ইসরায়েলকে যখন কোনো জবাবদিহির মুখে পড়তে হয় না, তখন তাকে কী বলা যায়? যখন অনাহারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়? যখন পানি, জ্বালানি, ওষুধ ও মানবিক সাহায্য পরিকল্পিতভাবে আটকে দেওয়া হয়—তখন সেটাকে আপনি কী বলবেন? আপনি একে গণহত্যা বলবেন।

এটা কেবল আমার কথা নয়। এটি শীর্ষস্থানীয় গণহত্যা গবেষক, প্রধান মানবাধিকার সংস্থা ও ক্রমবর্ধমানসংখ্যক জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের ব্যবহৃত শব্দ। জাতিসংঘের অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রান্সেসকা আলবানিজ ঘোষণা করেছেন, গাজায় গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে বলে ‘বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ’ রয়েছে।

জাতিসংঘের ২০ বিশেষজ্ঞের এক দল যৌথ বিবৃতিতে ‘প্রকাশ্য গণহত্যা’ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন এবং জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থাও এই সিদ্ধান্তে সমর্থন জানিয়েছে। এমনকি আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল টম ফ্লেচারের মতো জ্যেষ্ঠ জাতিসংঘ মানবিক কর্মকর্তারাও গাজায় যা ঘটছে, তা বর্ণনা করতে প্রকাশ্যে এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

এটি কেবল আইনি কৌশলগত বিষয় নয়, এটি একটি নৈতিক বিপদ সংকেত। ফিলিস্তিনিরা প্রায় দুই বছর ধরে যা চিৎকার করে বলে আসছেন, তার সঙ্গে মানবাধিকার সংস্থাগুলো ধীরে ধীরে তাল মেলালেও গাজায় বোমা পড়ছেই, শিশুরা মারা যাচ্ছে এবং পশ্চিমা সরকারগুলো তাদের অস্ত্র দিয়ে, ইসরায়েলের সুরক্ষার অজুহাত দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডকে চালিয়ে যেতে সহায়তা করছে।

আমি কেবল একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে এটি লিখছি না। কেবল একমাত্র পরিজন হারানো ব্যক্তি হিসেবে আমি এটি লিখছি না। আমি এমন একজন হিসেবে লিখছি, যে কিনা প্রয়োজনের সময়ে বিশ্বকে ব্যর্থ হতে দেখছে। গাজায় আমার পরিবার এখনো বাস্তুচ্যুত, এখনো অনাহারে, এখনো শোকাহত এবং এখনো অনিরাপদ।

আমি লন্ডন থেকে লিখছি, এখানে আমি মিছিল করছি, চিৎকার করছি, মিনতি করছি এবং কাঁদছি। আর এই সময়ে যুক্তরাজ্য সরকার বিতর্ক করছে যে, ইসরায়েলের কার্যকলাপ ‘অসামঞ্জস্য’ কি না বা এটি আন্তর্জাতিক আইন ‘লঙ্ঘন করছে’ কি না। কোনো এক রোববার সকালে এক রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ উপপ্রধানমন্ত্রী অ্যাঞ্জেলা রেইনার বলেছিলেন, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে কি না তা নির্ধারণ করা ‘তাদের অবস্থান নয়।’ অথচ ৮০০-এর বেশি ব্রিটিশ আইনজীবী ও বিচারক প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে একটি খোলাচিঠি সই করে ইসরায়েলের ‘আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘনের’ বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তাঁদের কাছে যেন নৈতিকতা ঐচ্ছিক কোনো বিষয়। যেন যুক্তরাজ্যের আসল অবস্থান হত্যা বন্ধ করা নয়, বরং এই হত্যা সম্ভব করার জন্য অস্ত্র বিক্রি চালিয়ে যাওয়া। তারপর একই অনুষ্ঠানে বিরোধীদলীয় নেতা কেমি ব্যাডেনক জাতীয় টেলিভিশনে দাঁড়িয়ে কিয়ার স্টারমারকে ‘সন্ত্রাসীদের পক্ষে উল্লাস’ করার অভিযোগ করেন। কেন? কারণ তিনি স্বীকার করেছেন, ইসরায়েল যুদ্ধাপরাধ করে থাকতে পারে।

ছয় শ দিনের হত্যাযজ্ঞ এবং এখনো, ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের একমাত্র প্রশ্ন হলো—কিন্তু হামাসের কী হবে? যেন এটি শিশুদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারাকে ন্যায্যতা দেয়। যেন এটি বেসামরিক নাগরিকদের ব্যাপক হত্যা ও একটি পুরো জনগোষ্ঠীর ধীর, ইচ্ছাকৃত অনাহারকে ক্ষমা করে। আমাকে পরিষ্কার করে বলতে দিন—যদি এটি গণহত্যা না হয়, তবে কী?

এই ৬০০ দিনে ইসরায়েল হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, গির্জা, বেকারি ও শরণার্থীশিবিরগুলোতে বোমা হামলা চালিয়েছে। তারা পুরো পরিবারকে হত্যা করেছে, নাগরিক রেজিস্ট্রি থেকে তাদের নাম-পদবি মুছে দিয়েছে। তারা সাংবাদিক, জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্র, সাহায্যকর্মী ও অ্যাম্বুলেন্সকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। তারা মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়েছে। তারা তাঁবুগুলোকে কফিনে পরিণত করেছে।

এসবের মধ্যেও পশ্চিমা নেতারা কেবল ফাঁকা বুলি, অস্পষ্ট ‘উদ্বেগ’ এবং অর্থহীন ‘সতর্কতা’র কথা বলে দায় সারছেন। যেন ইসরায়েলের আরও সতর্কতার প্রয়োজন। যেন প্রতিদিনের এই হত্যাযজ্ঞ যথেষ্ট সতর্কতা নয়।

আমার ছয় বছর বয়সী ভাগনি জুরি যখন মারা যায়, তখন সে তার বিছানায় ঘুমাচ্ছিল। আমাদের বাড়িসহ গাজার কোনো জায়গাই নিরাপদ নয় ইসরায়েলি বোমার আঘাত থেকে। আমাদের বাড়ি বোমা মেরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার পাঁচ বছর বয়সী আরেক ভাগনি আহত হয়েছিল। তার বাবা আহত হয়েছিলেন।

তার দাদাও আহত হয়েছিলেন। জুরির ছোট্ট দেহ আত্মীয়রা ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে বের করে এবং একটি গণকবরে সমাহিত করে তড়িঘড়ি। সেদিন এত বেশি মরদেহ ছিল যে সঠিকভাবে দাফন-কাফনও ছিল না। আপনি কীভাবে এর পক্ষে সাফাই দেবেন?

শিশুদের অনাহারে রাখা, রাফায় বোমা হামলা, হাসপাতালগুলোর আশপাশে আবিষ্কৃত গণকবর, সেখানে পাওয়া মরদেহগুলোতে নির্যাতন ও মৃত্যুদণ্ডের চিহ্ন ছিল—আপনি কীভাবে এগুলোকে ন্যায্যতা দেবেন? আপনি পারবেন না, কোনোভাবেই পারবেন না, যদি না আপনি বিশ্বাস করেন যে, ‘ফিলিস্তিনিদের জীবন মূল্যহীন।’

এটিই প্রতিটি অস্পষ্ট নিন্দা, প্রতিটি কাপুরুষোচিত ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশের পেছনের অলিখিত যুক্তি। কারণ, গত সপ্তাহে ওয়াশিংটন ডিসিতে যখন দুই ইসরায়েলি নিহত হয়, তখন তা আন্তর্জাতিক শিরোনাম হয়। কিন্তু যখন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শিশু জবাই হয়, তখন বিশ্ব গণহত্যার সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক করে এবং হত্যাকারী রাষ্ট্রকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখে।

এটি সমান দুটি পক্ষের মধ্যকার যুদ্ধ নয়, এটি কখনোই ছিল না। এটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী যাকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলো সমর্থন করছে, তাদের বিপরীতে পড়া শরণার্থী ও লাখো শিশুর এক অসম লড়াই। যেখানে পরের পক্ষের করার কিছুই নেই এবং বিশ্ব কেবল এটি ঘটতেই দেয়নি, তারা এটি ঘটাতে সাহায্য করেছে।

শুধু কিছু না করে নয়, বরং ভুল পথে অনেক কিছু করে তারা এটি করছে। তারা ভিন্নমত দমন করে, সাংবাদিকদের বরখাস্ত করে, প্রতিবাদ নিষিদ্ধ করে, সংহতিকে অপরাধমূলক কাজ হিসেবে গণ্য করে ইসরায়েলকে এই যুদ্ধ চালিয়ে নিতে সহায়তা করছে। যুক্তরাজ্যে আমি দেখেছি মানুষ কেবল ‘ফিলিস্তিন’ শব্দটি বলার জন্য চাকরি হারিয়েছে।

আমি ব্রিটিশ মিডিয়াকে ‘গণহত্যা’ বলতে অস্বীকার করতে দেখেছি। এমনকি যখন ইসরায়েলি মুখপাত্ররা মঞ্চে এসে ফিলিস্তিনি শিশুদের অস্তিত্বই অস্বীকার করেছেন, তখনো।

ছয় শ দিন। এটি কখনোই এত দীর্ঘস্থায়ী হওয়া উচিত ছিল না। প্রতিটি দিন এই নির্মমতা-বর্বরতা-গণহত্যা অব্যাহত থাকা কেবল একটি ট্র্যাজেডি নয়, এটি একটি পছন্দ। ইতিহাস মনে রাখবে, এই গণহত্যা গোপনে ঘটেনি। এটি সরাসরি ঘটেছে। হাই রেজল্যুশনে। প্রতিটি পর্দায়। প্রতিটি ভাষায়।

আমরা আপনাদের বলেছিলাম, এখনো বলছি—কী ঘটছে! এখন একমাত্র প্রশ্ন হলো—আর কত দিন লাগবে বিশ্বকে অবশেষে বলতে যে, যথেষ্ট হয়েছে?

তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি গ্লোবালে লন্ডনপ্রবাসী ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আহমেদ নাজারের লেখা থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চট্টগ্রামে নারীকে লাথি মেরে ফেলে দেওয়া ‘শিবিরের লোক’ আকাশ চৌধুরীকে ধরছে না পুলিশ

প্রফেসর আনোয়ারা আ.লীগের লোক হলে এত অপমান নিয়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হত না: ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময়

আলিপুরদুয়ার থেকে মোদির ‘মিশন বেঙ্গল’, নজর বাংলাদেশে

বৈষম্যবিরোধীদের মিছিল থেকে জি এম কাদেরের বাড়ি ভাঙচুর, মোটরসাইকেলে আগুন

পরিচালক পদ বাতিল, বিসিবি সভাপতির পদ থেকে ফারুককে অপসারণ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত