Ajker Patrika

সিরিয়ার গণতান্ত্রিক রূপান্তরে জাতীয় সংলাপ শুরু, পরিবর্তন আনতে ব্যাপক উদ্যোগ

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০: ৫৮
সিরিয়া দুদিনব্যাপী জাতীয় সংলাপে উপস্থিতি দেশটির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সদস্যরা। ছবি: এএফপি
সিরিয়া দুদিনব্যাপী জাতীয় সংলাপে উপস্থিতি দেশটির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সদস্যরা। ছবি: এএফপি

সিরিয়ার ডি-ফ্যাক্টো শাসক ও প্রেসিডেন্ট আহমদ আল-শারার উদ্যোগে শুরু হয়েছে জাতীয় সংলাপ। সেখানে তিনি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার শুরুতে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নতুন করে গড়তে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছেন।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার আহমদ আল-শারা দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন ন্যায়বিচার সংস্থা গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ সময় তিনি দেশটিতে দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর রাজনৈতিক রূপান্তরকে পথ দেখানোর লক্ষ্য নিয়ে শুরু হওয়া জাতীয় সংলাপে অংশগ্রহণকারীদের স্বাগত জানান।

সিরিয়ার এই নেতা আরও ঘোষণা করেছেন, সারা দেশে অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ কেবল রাষ্ট্রের হাতেই থাকবে, অন্য কারও হাতে নয়। সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, বহু সশস্ত্র গোষ্ঠী দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে।

রাজধানী দামেস্কে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনকে আল-শারা ও তাঁর নেতৃত্বাধীন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবর্তন এবং রাষ্ট্র পুনর্গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে তুলে ধরেছে। তবে, অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, প্রক্রিয়াটি খুব তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

উদ্বোধনী ভাষণে আল-শারা বলেন, ‘আমি সব সিরিয়ানের প্রতি আহ্বান জানাই, আসুন আমরা একসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াই, ক্ষত সারাই এবং কয়েক দশকের স্বৈরশাসনের যন্ত্রণা মুছে ফেলি।’ এ সময় তিনি অন্তর্বর্তীকালীন ন্যায়বিচার কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন।

তিনি আরও বলেন, ‘গত দুই মাসে আমরা সিরিয়ার জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য কাজ করেছি। অস্ত্রগুলো এক জায়গায় আনা এবং সেগুলোর ওপর রাষ্ট্রের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কোনো বিলাসিতা নয় বরং এটি দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা।’

আল-শারা এর আগেও একাধিকবার বলেছেন, আসাদবিরোধী লড়াইয়ে অংশ নেওয়া কুর্দি নেতৃত্বাধীন বাহিনীগুলোকেও জাতীয় সেনাবাহিনীতে একীভূত করা উচিত।

এই সম্মেলন নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনিশ্চয়তা ছিল। তবে রোববার আকস্মিকভাবে এর আয়োজনের ঘোষণা অনেক পর্যবেক্ষককে বিস্মিত করেছে। কারণ, তাঁরা ধারণা করেছিলেন, এই সম্মেলনের প্রস্তুতি নিতেই অন্তত এক-দুই মাস সময় লাগবে। বিভিন্ন অঞ্চলের নেতাদের কাছে যখন আমন্ত্রণ পাঠানো হয়, তখনো আয়োজক কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। বিষয়টি নিয়ে অবশ্য কিছুটা বিভ্রান্তি ও সমালোচনা তৈরি হয়।

সিরিয়ার প্রবাসী রাজনীতিবিদ জর্জ সাবরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে জানান, তিনি ২৩ ফেব্রুয়ারি দামেস্কে সম্মেলনে অংশ নিতে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, তবে তিনি বর্তমানে ফ্রান্সে নির্বাসনে থাকায় সময়মতো সিরিয়ায় পৌঁছাতে পারেননি।

স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্যমতে, প্রায় ৬০০ প্রতিনিধি এই আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। অংশগ্রহণকারীরা অন্তর্বর্তীকালীন ন্যায়বিচার, নতুন সংবিধানের কাঠামো, প্রতিষ্ঠান সংস্কার ও পুনর্গঠন, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, নাগরিক সমাজের ভূমিকা এবং দেশের অর্থনীতি নিয়ে কাজ করবেন।

যদিও এই সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলো বাধ্যতামূলক নয়, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। মূলত, বাশার আল-আসাদের শাসনামলে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তারা সম্মেলনের ফলাফলের দিকে নজর রাখছে।

আল-জাজিরার সাংবাদিক রেসুল সারদার দামেস্ক থেকে জানান, অনেক সিরিয়ান এই সম্মেলন থেকে বড় কোনো সিদ্ধান্তের প্রত্যাশা করছেন না। তবে অনেকেই এটিকে জাতির জন্য ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘কারণ, তাঁদের মতে, ২০০৭ সালে গৃহযুদ্ধ শুরুর পর প্রথমবারের মতো সিরিয়ার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও মতাদর্শের মানুষ একত্রিত হয়ে তাঁদের দেশ পুনর্গঠনের উপায় ও ভবিষ্যৎ নিয়ে জাতীয় সংলাপে অংশ নিচ্ছেন।’

এদিকে, এই সম্মেলন আয়োজনে স্বল্প প্রস্তুতি এবং মাত্র এক দিনের কর্মসূচির কারণে কিছু মহলে সংশয় দেখা দিয়েছে। সিরিয়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়—কুর্দি, খ্রিষ্টান, দ্রুজ ও আসাদের আলভী সম্প্রদায়ের অনেকে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং নতুন শাসকদের অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনের প্রতিশ্রুতিতেও পুরোপুরি আশ্বস্ত নন।

সিরিয়ার স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি প্রশাসনের বিভিন্ন দল অভিযোগ করেছে, সম্মেলনে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর ‘প্রতীকী’ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। ৩৫টি রাজনৈতিক দলের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যেসব সম্মেলনে শুধু প্রতীকী প্রতিনিধিত্ব থাকে, সেগুলো অর্থহীন, মূল্যহীন এবং দেশের চলমান সংকটের বাস্তবসম্মত সমাধানে কোনো ভূমিকা রাখবে না।’

গৃহযুদ্ধের সময় বাস্তুচ্যুত সরকারি কর্মী দালিয়া দালাতি বলেন, তিনি ‘কোনো ফলাফল’ আশা করছেন না। তাঁর মতে, আসাদের পতনের তিন মাস পরও দেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি নাজুক।

সম্মেলনে আমন্ত্রিত অর্থোডক্স খ্রিষ্টান আর্চবিশপ এলিয়া তুহমে, বলেন, ‘এই সম্মেলন নাগরিকদের মতামত প্রতিফলিত করার একটি কার্যকরী উদ্যোগ কিনা তা বলা এখনো খুব চটজলদি হয়ে যাবে।’ তবে হামা থেকে আগত বিচারক ইমান শাহুদ এই সম্মেলনকে ‘সত্যিকারের বিজয়ের দিন’ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘আপনি আপনার সামনে দেখতে পাচ্ছেন, সিরিয়ার সব সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে উপস্থিত রয়েছেন—নারী-পুরুষ নির্বিশেষে।’

সিরিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর সিটিজেনস ডিগনিটির পরিচালক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক লাবিব নাহাস বলেন, জাতীয় সংলাপ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে দ্রুত সম্পন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হবে।

তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংলাপ আরও দীর্ঘ এবং আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অপেক্ষা করছে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কী ধরনের হবে, যা আগামী মাসের শুরুতেই ঘোষণা করতে হবে। এই সময়সীমার কারণে সিরিয়ানদের পর্যাপ্ত সুযোগ ও সময় দেওয়া হয়নি।’

লাবিব নাহাস আরও বলেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি ‘একটি নিখুঁত সরকার গঠনের’ শর্তের সঙ্গে যুক্ত করা খুবই অন্যায়। তিনি বলেন, ‘এই দেশ ছয় দশকের স্বৈরশাসন এবং ১৪ বছরের বিধ্বংসী যুদ্ধ পার করে এসেছে। প্রথম চেষ্টাতেই নিখুঁত সরকার গঠনের ব্যর্থতার জন্য পুরো দেশকে শাস্তি দেওয়া খুবই অন্যায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি সত্যিই সিরিয়াকে আবার স্থিতিশীল ও নিরাপদ হিসেবে দেখতে চায়, তবে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা অপরিহার্য।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত