Ajker Patrika

ভারতে জেন-জিদের হাত ধরে ধর্ম ও জ্যোতিষশাস্ত্রের বাজার এখন ৭ লাখ কোটি টাকা!

এনডিটিভি
আপডেট : ০৭ জুলাই ২০২৫, ২৩: ৩৬
ভারতের জনপ্রিয় আধ্যাত্মিক গুরু ও ধর্মীয় বক্তা অনিরুদ্ধাচার্য মহারাজ ওরফে পুকি বাবা। ছবি: ইনস্টাগ্রাম
ভারতের জনপ্রিয় আধ্যাত্মিক গুরু ও ধর্মীয় বক্তা অনিরুদ্ধাচার্য মহারাজ ওরফে পুকি বাবা। ছবি: ইনস্টাগ্রাম

সম্প্রতি এক নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে ভারতে। তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে জেন-জিরা ধর্ম ও জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি আবারও আগ্রহী হয়ে উঠছে। একসময় যা কুসংস্কার বলে বিবেচিত হতো, তা এখন তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি ভারতে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক অর্থনীতিকে বিশাল আকার দিচ্ছে। এই বাজার বর্তমানে প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকার সমান।

গুরুগাঁওভিত্তিক সংখ্যাতত্ত্ব জ্যোতিষ সংস্থা নুম্রো ভানির জ্যোতিষী সিদ্ধার্থ এস কুমার এই পরিবর্তনের সরাসরি সাক্ষী। তিনি প্রতি মাসে ১০০ জনেরও বেশি ক্লায়েন্টকে পরামর্শ দেন, যাঁদের বেশির ভাগের বয়স ২৪ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। তবে তাঁর সবচেয়ে কম বয়সী ক্লায়েন্ট মাত্র আট বছর বয়সী! তিনি জানান, এই জেন-জিদের মধ্যে থেকে অনেক কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী সম্পর্ক বা আত্মপরিচয়-সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে আসছেন।

সিদ্ধার্থ এস কুমার একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। ২৫ বছর বয়সী এক যুবক এসেছিলেন তাঁর কাছে। যুবক তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি কেন এখানে? আমার জীবনের উদ্দেশ্য কী?’ সিদ্ধার্থ বলেন, ওই ছেলে যখন দেখলেন তাঁর জন্মছকে ভ্রমণ, শিক্ষা ও দর্শনের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে, তখন তিনি আর চোখের জল আটকাতে পারেননি। তিনি ১৪ বছর বয়সী একটি মেয়ের কথাও বলেন। ওই মেয়ের অল্প দিনের মধ্যে খুবই ঘনিষ্ঠ একটি সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল। সে সিদ্ধার্থের কাছে জানতে চেয়েছিল, ‘কেন সে মানুষের প্রতি এত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে?’

সম্পর্ক, কর্মজীবন বা জীবন নিয়ে বিভ্রান্তিতে থাকা মানুষের এমন গল্পগুলো একটি ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকে তুলে ধরে—তরুণ ভারতীয়রা তাঁদের ভেতরের বিশৃঙ্খলা ও মানসিক বাধাগুলো বুঝতে আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকছেন। প্রায়শই এটিকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার একটি উপায় হিসেবে ব্যবহার করছেন। আর প্রযুক্তি, এআই ও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এসব বিষয়ে পরামর্শ পাওয়াও সহজ হচ্ছে দিন দিন।

নুম্রো ভানির ২০২৪ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৫১ শতাংশ তরুণ ভারতীয় প্রতিদিন জ্যোতিষ শাস্ত্রীয় অন্তর্দৃষ্টি খোঁজেন। প্রায় ৮৮ শতাংশ সপ্তাহে অন্তত একবার রাশিফল পড়ে এবং ৭৫ শতাংশ তাদের হৃদয়সংক্রান্ত ব্যাপারে জ্যোতিষশাস্ত্রের ওপর নির্ভর করে।

তবে ট্র্যাডিশনাল জ্যোতিষশাস্ত্রের বাইরে এখন ডিজিটাল জ্যোতিষশাস্ত্রের জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। অ্যাস্ট্রো টক ও অ্যাস্ট্রো ভেদের মতো এআই প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যক্তিগত রাশিফল ও ম্যাচ-মেকিংয়ের মতো পরিষেবা দিচ্ছে। অনলাইন জ্যোতিষশাস্ত্রের বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে বার্ষিক ১৪ শতাংশ হারে ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৬ হাজার ২০০ কোটি রুপি) ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারি এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করেছে—২০২১ সালেই অনলাইনে এসব বিষয়ে পরামর্শের হার ২০-২৫ শতাংশ বেড়েছে।

এমনকি ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতেও জেন-জিদের ব্যাপক অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি সমাপ্ত কুম্ভমেলায় ৪০ কোটিরও বেশি মানুষ অংশ নিয়েছিলেন এবং তাঁদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল তরুণ ভারতীয়। এর মাধ্যমে ভারতের আধ্যাত্মিক অর্থনীতিও বিকশিত হচ্ছে। এটি এখন কেবল মন্দির পরিদর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এতে ভার্চুয়াল পূজা, অনলাইন তীর্থযাত্রা এবং জ্যোতিষশাস্ত্রীয় পরামর্শের মতো ডিজিটাল পরিষেবাও অন্তর্ভুক্ত। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বাজারের মূল্য ২০২৩ সালে ৫৮ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা) ছিল এবং এটি বার্ষিক প্রায় ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে।

সম্প্রতি সমাপ্ত কুম্ভ মেলায় ৪০ কোটিরও বেশি মানুষ অংশ নিয়েছিল, তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল তরুণ ভারতীয়রা।
সম্প্রতি সমাপ্ত কুম্ভ মেলায় ৪০ কোটিরও বেশি মানুষ অংশ নিয়েছিল, তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল তরুণ ভারতীয়রা।

ধর্ম ও জ্যোতিষশাস্ত্র কেন আবার জনপ্রিয় হচ্ছে?

মিলেনিয়ালরা ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা থেকে দূরে ছিলেন। তাঁরা কর্মজীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে, দীর্ঘ সময় কাজ করতে ও নীরবে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবিলা করতে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু জেনারেশন জেড বা জেন-জিরা উল্টো পথে হাঁটছেন—পুজোর ধূপকাঠি, রত্নপাথর, কৃতজ্ঞতার তালিকা, জ্যোতিষীয় রুটিন—সবই আজ তাঁদের পরিচয়ের অংশ এবং তাঁরা এটি গর্বের সঙ্গে করছেন।

এআইচালিত জ্যোতিষশাস্ত্রীয় অ্যাপ অ্যাস্ট্রো শিওর এআইয়ের প্রধান নির্বাহী ও সহপ্রতিষ্ঠাতা ভানিয়া মিশ্র বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই—এটি কেবল ফিরে আসছে না, এটি সম্ভবত পরবর্তী ফোমো (FOMO-Fear Of Missing Out)। মানুষ আর জিজ্ঞাসা করবে না, আপনি সপ্তাহান্তে বাইরে গিয়েছিলেন কি না। তারা জিজ্ঞাসা করবে, আপনি আপনার কর্মফল ঠিক করেছেন কি না।’

মিশ্রের মতে, মিলেনিয়ালরা একসময় উচ্চাকাঙ্ক্ষায় আধ্যাত্মিকতাকে চাপা দিয়েছিলেন। কিন্তু জেন-জি এই ইঁদুর দৌড় থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাঁরা নিজেদের পথ তৈরি করছেন। তাঁদের কাছে মানসিক শান্তির অগ্রাধিকার বেশি। মিলেনিয়াল ও তাঁদের বাবা-মা পারিবারিক আঘাত নিয়ে কখনো কথা বলেননি, কিন্তু জেন-জিরা এখন এসব বিষয় নিয়ে কথা বলছেন।

জেন-জিরা ধর্ম ও জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি আবারও আগ্রহী হয়ে উঠছে। ছবি: সংগৃহীত
জেন-জিরা ধর্ম ও জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি আবারও আগ্রহী হয়ে উঠছে। ছবি: সংগৃহীত

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইউভেট ডিসাও এতে একমত। তিনি বলেন, জেন-জিরা ধর্মের ক্ষমতা ও সমস্যা বোঝেন। তাঁরা এটিকে অন্ধভাবে গ্রহণ করেন না। তাঁরা তা-ই করেন, যা তাঁদের শান্তি দেয়। তাঁর মতে, এই প্রজন্ম আধুনিক বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই করে ভারতীয় ঐতিহ্যকে গ্রহণ করছেন।

জ্যোতিষী সিদ্ধার্থ বলেন, এই প্রজন্ম ধর্মকে নতুন করে সাজাচ্ছে—ট্র্যাডিশন মাইনাস ডগমা। তাঁরা প্রাচীন বিজ্ঞানের ডিজিটাল পুনরুত্থানের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এমনকি মিলেনিয়ালরাও এখন এই পথে ফিরতে শুরু করেছেন। এটি কেবল ভারতেই নয়, পশ্চিমা বিশ্বও বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্রে আসক্ত হচ্ছে।

ইনস্টাগ্রাম স্ক্রল করলে বোঝা যাবে, জ্যোতিষশাস্ত্র কতটা ট্রেন্ডি হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন জ্যোতিষ মিম, রাশিচক্রভিত্তিক রিল, সেলিব্রিটিদের রাশিফল—সবই ভাইরাল। প্রেমানন্দ গোবিন্দ শরণ (ইনস্টাগ্রামে তাঁর পৌনে ৩ কোটি ফলোয়ার) বা অনিরুদ্ধাচার্য মহারাজ ওরফে পুকি বাবার (ইনস্টাগ্রামে ৩৬ লাখ ফলোয়ার) মতো আধ্যাত্মিক গুরুরাও নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে তাঁদের কর্মকাণ্ড শেয়ার করে এই আলোচনার অংশ হচ্ছেন। তাঁরা জেন-জি ও অন্যান্য তরুণ প্রজন্মকে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি আরও আগ্রহী করে তুলছেন।

প্রেমানন্দ গোবিন্দ শরণ মহারাজের আশ্রমে বিরাট কোহলি ও আনুশকা শর্মা। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।
প্রেমানন্দ গোবিন্দ শরণ মহারাজের আশ্রমে বিরাট কোহলি ও আনুশকা শর্মা। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

ভানিয়া মিশ্র বলেন, ‘বিরাট কোহলি, আনুশকা শর্মা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক তারকা দুয়া লিপাও প্রকাশ্যে জ্যোতিষশাস্ত্রে তাঁদের বিশ্বাসের কথা বলছেন। বিষয়টি আধ্যাত্মিকতাকে আবার জনপ্রিয় করে তুলছে। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় যা আছে এবং আপনার তারকারা যা অনুসরণ করেন, তা অবশ্যই কুল, তাই না?’

সিদ্ধার্থ কুমার বলেন, আজকের তরুণেরা জ্যোতিষশাস্ত্র ও আধ্যাত্মিকতাকে তাঁদের সম্পর্ক, অর্থ, স্বাস্থ্য ও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে গাইড করার জন্য একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। অনেকের কাছে জ্যোতিষীরাই তাঁদের প্রধান উপদেষ্টা। একসময় যা কুসংস্কার হিসেবে দেখা হতো, তা এখন জেন-জিদের সেল্ফ-কেয়ার রুটিনের অংশ। কেউ নতুন কোনো প্রকল্প শুরু করছেন চন্দ্রচক্র অনুযায়ী, কেউ আবার ঘড়ি কিনছেন জ্যোতিষ দেখে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

অবিশ্বাস্য কম খরচে বাংলাদেশিদের গোল্ডেন ভিসা দেবে দুবাই, সুবিধা কী

উপজেলা পর্যায়ে আদালত সম্প্রসারণে একমত সব দল

ফিলিস্তিনপন্থী সংগঠন নিষিদ্ধের পক্ষে ভোট দিলেন টিউলিপ–রুশনারা

ফারজানা রুপা ও শাকিলকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে জাতিসংঘকে ব্যাখ্যা দিল সরকার

চেক জালিয়াতির মামলায় সাংবাদিকের ৫ মাসের কারাদণ্ড

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত