Ajker Patrika

দিল্লির উপকণ্ঠে ভুয়া দূতাবাস: বেরিয়ে আসছে প্রতারণার চাঞ্চল্যকর তথ্য

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২৭ জুলাই ২০২৫, ২৩: ১৬
উত্তর প্রদেশের স্পেশাল টাস্কফোর্সের হাতে আটক হর্ষবর্ধন জৈন। ছবি: সংগৃহীত
উত্তর প্রদেশের স্পেশাল টাস্কফোর্সের হাতে আটক হর্ষবর্ধন জৈন। ছবি: সংগৃহীত

দিল্লির উপকণ্ঠে গাজিয়াবাদে আট বছর ধরে একটি ভুয়া দূতাবাস চালাচ্ছিলেন হর্ষবর্ধন জৈন। তাঁর বিষয়ে তদন্ত শুরু হওয়ার পর বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রায় ৩০০ কোটি রুপির কেলেঙ্কারি, গত ১০ বছরে ১৬২টি বিদেশ ভ্রমণ ও একাধিক বিদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে তাঁর সম্ভাব্য যোগসূত্র মিলেছে। পুলিশের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।

গত সপ্তাহে গাজিয়াবাদের একটি ভাড়া করা দোতলা বাড়ি থেকে জৈন গ্রেপ্তার হন। ওই বাড়িকেই তিনি দূতাবাস বলে দাবি করেছিলেন। উত্তর প্রদেশ স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের (এসটিএফ) তদন্তে জানা গেছে, জৈন চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণার একটি চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং হাওয়ালা রুটের মাধ্যমে অর্থ পাচারেও যুক্ত ছিলেন।

গাজিয়াবাদের ওই বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ ভুয়া কূটনৈতিক নম্বরপ্লেটযুক্ত চারটি গাড়ি, জাল নথি ও একটি বিলাসবহুল ঘড়ির সংগ্রহ জব্দ করেছে। পুলিশ আগামীকাল সোমবার আদালতে জৈনকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানাবে। পুলিশ জানিয়েছে, জৈন প্রায় ৩০০ কোটি রুপির কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন।

গাজিয়াবাদের বিলাসবহুল দোতলা ভবনের বাইরে একটি নেমপ্লেটে লেখা ছিল, ‘গ্র্যান্ড ডাচি অব ওয়েস্টার্কটিকা’ ও ‘এইচ ই এইচভি জৈন অনারারি কনসাল’। এই প্রাঙ্গণে ভারত ও ওয়েস্টার্কটিকার পতাকা ছিল। এই দেশ অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের একটি মাইক্রোনেশন (ছোট দ্বীপ দেশ), বিশ্বের কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত কোনো দেশ নয়।

তদন্তকারীদের মতে, জৈন এই ভুয়া দূতাবাসকে নেটওয়ার্কিংয়ের জন্য ব্যবহার করতেন। এর মাধ্যমে বিদেশে চাকরির লোভ দেখিয়ে প্রতারিত করতেন। তদন্তে জানা গেছে, এই ভুয়া দূতাবাস ২০১৭ সাল থেকে চলছিল। জৈন লোকদেখানোর জন্য ‘দূতাবাসের’ বাইরে দাতব্য অনুষ্ঠান, এমনকি ভান্ডারার (সম্প্রদায় ভোজ) আয়োজন করতেন। তিনি ছয় মাস আগে ভবনটি ভাড়া নিয়েছিলেন। যদিও তিনি প্রায় আট বছর ধরে একটি ভুয়া দূতাবাস চালাচ্ছিলেন।

এক রহস্যময় ধর্মগুরুর যোগসূত্র পেয়েছে পুলিশ। ছবি: সংগৃহীত
এক রহস্যময় ধর্মগুরুর যোগসূত্র পেয়েছে পুলিশ। ছবি: সংগৃহীত

ভুয়া দূতাবাসে তল্লাশির সময় পুলিশ জৈনের বিতর্কিত ‘গডম্যান’ চন্দ্রস্বামী ও সৌদি অস্ত্র ব্যবসায়ী আদনান খাশোগির সঙ্গে ছবি খুঁজে পায়। স্বঘোষিত গডম্যান চন্দ্রস্বামী ৮০ ও ৯০-এর দশকে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে তাঁকে তিন প্রধানমন্ত্রী—পিভি নরসীমা রাও, চন্দ্র শেখর ও ভিপি সিংয়ের আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ১৯৯৬ সালে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হন। তাঁর আশ্রমে তল্লাশি চালিয়ে খাশোগির সঙ্গে তাঁর লেনদেনেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। চন্দ্রস্বামীর বিরুদ্ধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে হত্যার জন্য অর্থায়নের অভিযোগও ছিল।

ইউপি এসটিএফ জানতে পেরেছে, চন্দ্রস্বামীই জৈনকে খাশোগি ও প্রতারক আহসান আলী সাঈদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। অভিযোগ করা হয়েছে যে, সাঈদ জৈনের সঙ্গে ২৫টি শেল কোম্পানি খুলতে কাজ করেছিলেন। এ ধরনের কোম্পানি অর্থ পাচারের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। হায়দরাবাদে জন্মগ্রহণকারী সাঈদ পরে তুর্কি নাগরিকত্ব নেন।

সাঈদ সুইজারল্যান্ডে ‘ওয়েস্টার্ন অ্যাডভাইজরি গ্রুপ’ নামে একটি কোম্পানি চালাতেন। এই কোম্পানি বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করত এবং ব্রোকারেজের বিনিময়ে ঋণ পেতে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিত। অভিযোগ রয়েছে, এই কোম্পানি প্রায় ২৫ মিলিয়ন পাউন্ড—প্রায় ৩০০ কোটি রুপি—ব্রোকারেজ সংগ্রহ করে সুইস অঞ্চল থেকে পালিয়ে যায়। আহসান ২০২২ সালে লন্ডনে গ্রেপ্তার হন। পুলিশ এখন এই বিশাল কেলেঙ্কারিতে জৈনের জড়িত থাকার মাত্রা তদন্ত করছে। এর আগে পুলিশ জানতে পেরেছিল, জৈন ভুয়া দূতাবাস ও কূটনৈতিক ছদ্মবেশ ব্যবহার করে নেটওয়ার্কিং করতেন এবং মানুষকে চাকরির লোভ দেখাতেন।

জৈনের গ্রেপ্তারের পর ওয়েস্টার্কটিকা একটি বিবৃতিতে বলেছে, ‘২০১৬ সালে এইচ ভি জৈন ওয়েস্টার্কটিকাকে একটি বড় অনুদান দিয়েছিলেন। পরে আমাদের আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবকদের দলে যোগদানের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। এই স্বেচ্ছাসেবক দল নিজ নিজ দেশে আমাদের পরিবেশগত ও দাতব্য মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যান। তাঁর আনুষ্ঠানিক পদবি ছিল ‘ভারতের অনারারি কনসাল’। তাঁকে কখনই রাষ্ট্রদূতের পদ বা ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘প্রতারণা ও অন্যান্য অপরাধের জন্য তাঁর সাম্প্রতিক গ্রেপ্তারের সময়, জৈনের কাছে কূটনৈতিক নম্বরপ্লেট, পাসপোর্ট ও ওয়েস্টার্কটিকার সিলমোহরযুক্ত অন্যান্য জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। একজন অনারারি কনসাল হিসেবে এই জিনিসগুলো তৈরি করার কোনো অনুমোদন ছিল না। ওয়েস্টার্কটিকা নিজেই নম্বরপ্লেট বা পাসপোর্ট ব্যবহার করে না এবং আমরা কখনোই আমাদের প্রতিনিধিদের এটি করতে অনুমতি বা উৎসাহিত করিনি। তাঁর বাড়িকে ‘‘দূতাবাস’’ বলে অভিহিত করে জৈন আমাদের প্রতিনিধিদের জন্য ওয়েস্টার্কটিকার প্রোটোকল লঙ্ঘন করেছেন।’

ওয়েস্টার্কটিকা কী

মার্কিন নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তা ট্র্যাভিস ম্যাকহেনরি ২০০১ সালে ওয়েস্টার্কটিকা মাইক্রোনেশনটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজেকে এর গ্র্যান্ড ডিউক নিযুক্ত করেন। অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থিত ওয়েস্টার্কটিকার আয়তন ৬ লাখ ২০ হাজার বর্গমাইল। ম্যাকহেনরি অ্যান্টার্কটিক চুক্তি ব্যবস্থার একটি ফাঁক ব্যবহার করে নিজেকে সেখানকার শাসক নিযুক্ত করেন। যদিও চুক্তিটি দেশগুলোকে অ্যান্টার্কটিকার অংশ দাবি করতে বাধা দেয়। তবে এই চুক্তি ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিষয়ে কিছু বলে না।

ওয়েস্টার্কটিকা দাবি করে, তাদের ২ হাজার ৩৫৬ জন নাগরিক রয়েছে। তবে তাঁদের কেউই সেখানে বাস করেন না। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক গ্র্যান্ড ডাচি অব ওয়েস্টার্কটিকা একটি অলাভজনক সংস্থা হিসেবে কাজ করে। তারা জলবায়ু পরিবর্তন ও অ্যান্টার্কটিকা সম্পর্কে সচেতনতা প্রচার করে। তাদের নিজস্ব পতাকা, মুদ্রা ও টাইটেলও রয়েছে। তবে কোনো সরকার তাদের স্বীকৃতি দেয় না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত