Ajker Patrika

অনুরোধ করছি, আসবেন না—রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করা নেপালির আকুতি

আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২৩: ০১
অনুরোধ করছি, আসবেন না—রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করা নেপালির আকুতি

ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে লড়াই করছেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেপালি ভাড়াটে সেনা। নগদ অর্থ এবং রুশ পাসপোর্টের প্রতিশ্রুতি পেয়ে তাঁরা তাঁদের হিমালয়ের মাতৃভূমি ছেড়ে রণাঙ্গনে যোগ দিয়েছেন। তবে এই যুদ্ধে আহত হয়ে ইতিমধ্যে নেপালেও ফিরে এসেছেন বেশ কিছু সেনা। যুদ্ধের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে এই যুদ্ধে যোগ দিতে নেপালিদের নিরুৎসাহিত করছেন তাঁরা।

এ বিষয়ে বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন নেপালি নিজ দেশে এক বছরে যত টাকা আয় করেন, রাশিয়ার ভাড়াটে সেনা হিসেবে তাঁরা এক মাসেই এর দ্বিগুণ টাকা আয় করতে পারেন। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে নৃশংস পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের অনেকেই আহত ও নিহত হয়েছেন। 

যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে সূর্য শর্মা (ছদ্মনাম) নামে এক নেপালি বলেন, ‘আমি আমার বন্ধুদের আমার সামনেই মরতে দেখেছি। নেপালিরা সম্ভবত যুদ্ধ কতটা ভয়াবহ তা কল্পনাও করতে পারে না।’

২৪ বছর বয়সী সূর্য রাশিয়ান বাহিনীর সঙ্গে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি সম্মুখসমরে লড়াইয়ের জন্য পূর্ব ইউক্রেনে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যেই তাঁর ইউনিট ইউক্রেনের সেনাদের হামলার মুখে পড়ে। তিনি বলেন, ‘যখন বোমা এবং গুলির বৃষ্টি হচ্ছিল, আমি ভেবেছিলাম—আমার জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি মরতে যাচ্ছি।’ 

হিমালয়ের পাথুরে ভূখণ্ড এবং গরিব দেশ নেপাল দীর্ঘদিন ধরেই অন্য দেশের যুদ্ধে লড়ার জন্য ভাড়াটে সেনার উৎস। একসময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নেপালি সেনাদের বিপুল উপস্থিতি ছিল, যাঁরা গোর্খা সেনা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। 

তবে কোনো নেপালি বিদেশি বাহিনীর হয়ে যুদ্ধে লড়তে চাইলে নেপালে তা বৈধ বিবেচিত হয় তখনই, যদি ওই দেশটির সঙ্গে নেপাল সরকারের চুক্তি থাকে। নেপালের সঙ্গে এই ধরনের চুক্তি আছে শুধু যুক্তরাজ্য ও ভারতের। 

নেপালের সরকার দাবি করছে, দুই বছর আগে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দেশটির দুই শতাধিক নাগরিক অবৈধভাবে রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। তবে যুদ্ধফেরত সূর্য শর্মা দাবি করেছেন, রুশ বাহিনীর হয়ে লড়াই করা নেপালি ছাত্র, সাবেক সেনা এবং এমনকি সাবেক মাওবাদী যোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যাটি কম করে হলেও দুই হাজারের বেশি হবে। 

সূর্য বলেন, ‘আমরা যোগদানের প্রথম দিকে ছিলাম। কিন্তু এখন সেখানে অনেক নেপালি আছে, প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার।’ 

নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনের সম্মুখসমরে অন্তত ১২ জন নেপালি নিহত হয়েছেন এবং যুদ্ধবন্দী হয়েছেন আরও পাঁচ জন। তবে যুদ্ধফেরত ব্যক্তিরা দাবি করছেন, নিহত নেপালিদের প্রকৃতসংখ্যা কয়েক গুণ বেশি হবে। 

যোদ্ধাদের আকৃষ্ট করার জন্য, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নেপালিদের নাগরিকত্বের প্রস্তাব দিয়েছেন। আর তাঁদের সর্বোচ্চ ২ হাজার ২০০ ডলার পর্যন্ত মাসিক বেতন দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা আড়াই লাখ টাকার কাছাকাছি। 

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, নেপালের মাথাপিছু বার্ষিক গড় আয় ১ হাজার ৩০০ ডলার। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এই আয় সবচেয়ে কম। ফলে বিপুল বেতনের আশ্বাস পেয়ে অসংখ্য নেপালি যুদ্ধ করতে প্রলুব্ধ হচ্ছেন। গত বছরের জুনে টিকটকে এ ধরনের চিত্তাকর্ষক বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়েছিলেন নেপালের এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি। পরিচয় গোপন করে বার্তা সংস্থা এএফপির কাছে তিনি বলেন, ‘এটি একটি যুদ্ধ এবং আমরা একটি ঝুঁকি নিচ্ছি।’ 

৩৯ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি দুবাইয়ে পুলিশের হয়ে কাজ করার আগে নেপালের সেনাবাহিনীতে এক দশকেরও বেশি সময় ছিলেন। তিনি জানান, ইউক্রেনের যুদ্ধে আহত হয়ে নেপালে ফিরে আসার আগে ছয় মাসে তিনি প্রায় ১৫ হাজার ডলার সঞ্চয় করেছিলেন। এই অর্থ দিয়ে তিনি এখন একটি বাড়ি নির্মাণ করছেন। তিনি বলেন, ‘নেপালে যদি ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকত, তাহলে কেউ যুদ্ধে যেত না।’

এদিকে ২৪ বছর বয়সী সূর্য দাবি করেছেন, তিনি একজন নেপালি এজেন্টের দ্বারা প্রতারিত হয়ে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পা রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি স্টুডেন্ট ভিসায় রাশিয়ায় যেতে ঋণ করে অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু দেখা যায়, তাঁর ভিসায় কোনো কাজের অনুমতি ছিল না। একটি মাত্র কাজেরই সুযোগ ছিল তাঁর। আর তা হলো—যুদ্ধ করা। এ অবস্থায় কোনো সামরিক অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। কারণ, দেশ থেকে ঋণ পরিশোধের চাপই তাঁকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করেছিল। তিনি যে দলটির সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, সেই দলটিতে আরও ১৫ জন নেপালি ছিলেন। 

সূর্য বলেন, ‘আমরা গুলি চালানো শিখেছি, কীভাবে বাংকার তৈরি করতে হয় এবং কীভাবে ড্রোনকে লক্ষ্যবস্তু করতে হয় শিখেছি।’ 

ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে ভাষাকেও নেপালিদের জন্য একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন সূর্য। তিনি বলেন, ‘তারা যে নির্দেশনা দেয় তা আমরা বুঝতে পারি না এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এটি বিপজ্জনক হতে পারে।’ 

ইউক্রেনের সম্মুখসমরে লড়াই করার জন্য সূর্য যে ইউনিটের সঙ্গে যাচ্ছিলেন, তার বেশির ভাগ সদস্যই ছিল রুশ সেনা। আর নেপালি ছিল ছয়জন। ইউক্রেনের কুপিয়ানস্কে পৌঁছানোর আগেই তাঁদের ইউনিটটি গুপ্ত হামলার মুখে পড়ে। এই হামলায় তাঁদের ইউনিটের বেশ কয়েকজন সেনার মৃত্যু হয় এবং হাতে ও পায়ে গুলিবিদ্ধ হন সূর্য নিজেও। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সূর্য বলেন, ‘কখনো কখনো এটিকে একটি সিনেমার মতো মনে হয়।’

ইতিপূর্বে রাশিয়ার একটি হাসপাতালের বিছানা থেকে ফোনে এএফপির সঙ্গে কথা বলেছিলেন নেপালের আরেক যুদ্ধাহত সেনা। দেশবাসীকে প্রলোভনে না পড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। ২৭ বছর বয়সী ওই যুবক বলেছিলেন, ‘আপনি যত সতর্কই থাকুন না কেন, বোমা পড়লে কিংবা ড্রোন হামলার মুখে এটি কোনো কাজেই আসবে না।’ 

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমি অনুরোধ করছি, আপনারা আসবেন না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত