Ajker Patrika

হিমোফিলিয়া এক নীরব রক্তক্ষরণ ব্যাধি

ডা. অদিতি সরকার
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

হিমোফিলিয়া একটি বিরল অথচ গুরুতর ধরনের রক্তক্ষরণজনিত রোগ। এটি সাধারণত বংশগত কারণে হয়। তবে মাঝে মাঝে কোনো জিনগত পরিবর্তনের কারণেও কেউ জন্মসূত্রে হিমোফিলিয়া নিয়ে জন্মায়। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে রক্ত জমাট বাঁধানোর জন্য প্রয়োজনীয় একটি নির্দিষ্ট ক্লটিং ফ্যাক্টরের ঘাটতি থাকে। ফলে সামান্য আঘাতেও রক্তক্ষরণ দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে। এমনকি কখনো কখনো তা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।

হিমোফিলিয়ার প্রকারভেদ

হিমোফিলিয়া এ: এ ধরনের হিমোফিলিয়ায় ‘ফ্যাক্টর এইট’-এর ঘাটতি থাকে। এটি সবচেয়ে সাধারণ রূপ। ৮০-৮৫% রোগী এই রোগের ভুক্তভোগী।

হিমোফিলিয়া বি: একে ‘ক্রিসমাস ডিজিজ’ও বলা হয়। এতে ‘ফ্যাক্টর নাইন’-এর ঘাটতি দেখা যায়। উল্লেখযোগ্য বিষয়, হিমোফিলিয়া টেন-লিংকড রিসেসিভ রোগ হওয়ায় সাধারণত ছেলেরা এতে আক্রান্ত হয় এবং মেয়েরা বাহক হিসেবে থাকে।

লক্ষণ ও উপসর্গ

হিমোফিলিয়ার লক্ষণ নির্ভর করে রোগের তীব্রতার ওপর। সাধারণত এসব লক্ষণ তিনটি গ্রুপে ভাগ করা যায়।

তীব্র

» খুবই কম বা প্রায় অনুপস্থিত ক্লটিং ফ্যাক্টর (সাধারণ ১ শতাংশ)।

» অল্প আঘাতে এমনকি কোনো আঘাত ছাড়াও রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যেতে পারে।

» বিশেষ করে হাঁটু, কাঁধ, কনুইয়ের জয়েন্টে ঘন ঘন রক্ত জমা হওয়া, পেশিতে রক্তক্ষরণ হওয়া—একে হেমারথ্রোসিস বলা হয়। এর ফলে ব্যথা, ফোলা এবং চলাচলে অসুবিধা হয়।

» দাঁত উঠলে বা কাটা লাগলে দীর্ঘ সময় রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়া।

» প্রস্রাবে বা পায়খানায় রক্ত যাওয়া।

মাঝারি

» ১ থেকে ৫ শতাংশ ফ্যাক্টর উপস্থিত থাকে।

» মাঝারি আঘাতে রক্তপাত হয়, হেমারথ্রোসিস মাঝেমধ্যে হতে পারে।

হালকা

» ৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ফ্যাক্টর উপস্থিত থাকে।

» সাধারণত বড় সার্জারি কিংবা দাঁতের চিকিৎসা ছাড়া সাধারণত রক্তক্ষরণ হয় না।

» অনেক ক্ষেত্রে রোগটি দীর্ঘদিন অজানা থেকে যায়।

রোগনির্ণয়

হিমোফিলিয়া নির্ণয় করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট ল্যাবরেটরি পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

» অ্যাকটিভেটেড পারশিয়াল থ্রম্বোপ্লাস্টিন টাইম বা এপিটিটি: হিমোফিলিয়ায় এটি বাড়ে।

» প্রোথ্রোমবিন টাইম বা পিটি: সাধারণত স্বাভাবিক থাকে।

ব্লিডিং টাইম: স্বাভাবিক থাকে।

» ফ্যাক্টর অ্যাস: রোগনির্ণয়ের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। এতে দেখা হয় ফ্যাক্টর এইট অথবা নাইনের মাত্রা কত শতাংশ রয়েছে।

অনেক সময় এই রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকলেও মেয়েরা বাহক হিসেবে থাকায় তাদের মধ্যে রক্তক্ষরণ হয় না। কিন্তু তাদের গর্ভজাত সন্তানের মধ্যে রোগটি প্রকাশ পেতে পারে।

চিকিৎসা

হিমোফিলিয়া জীবনব্যাপী রোগ হলেও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে এর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। চিকিৎসার মূল দিক হলো:

» ফ্যাক্টর রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি

সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি এটি। এতে ঘাটতি পূরণ করতে প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টর এইট বা নাইন ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হয়।

এই থেরাপি দুইভাবে দেওয়া যায়—

» অন-ডিমান্ড থেরাপি: রক্তক্ষরণ হলে দেওয়া হয়।

» প্রফিল্যাকটিক থেরাপি: নিয়মিত দেওয়া হয়, যাতে রক্তক্ষরণ প্রতিরোধ করা যায়।

ডেসমোপ্রেসিন বা ডিডিএভিপি

» হিমোফিলিয়া এ রোগীদের হালকা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এটি ফ্যাক্টর এইট সাময়িকভাবে বাড়িয়ে দেয়।

অ্যান্টিফাইব্রিনোলাইটিকস

» মুখে খাওয়ার বা ইনজেকশনের মাধ্যমে ওষুধ দিয়ে রক্তপাত নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

জিন থেরাপি

» সাম্প্রতিক গবেষণায় জিন থেরাপি দিয়ে কিছু রোগীকে দীর্ঘ মেয়াদে উপশমে রাখা সম্ভব হয়েছে। যদিও এই চিকিৎসা এখনো অনেক দেশে ব্যয়বহুল এবং সীমিত।

করণীয় ও পরামর্শ

» আঘাত এড়াতে সতর্ক থাকতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ খেলা থেকে বিরত থাকা জরুরি।

» দাঁত ব্রাশ করার সময় নরম ব্রাশ ব্যবহার করা উচিত, যাতে মাড়িতে ক্ষত না হয়।

» যেহেতু এটি বংশগত রোগ। তাই আগে থেকে জেনেটিক কাউন্সেলিং নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

» সব সময় এমন একটি কার্ড বা ব্রেসলেট সঙ্গে রাখা উচিত, যেখানে লেখা থাকবে রোগীর হিমোফিলিয়া রয়েছে এবং জরুরি অবস্থায় কী করতে হবে।

» শিক্ষক, সহকর্মী ও বন্ধুদের রোগটি সম্পর্কে জানানো উচিত, যাতে জরুরি পরিস্থিতিতে সহায়তা পাওয়া যায়।

» দেশে ফ্যাক্টর থেরাপি সহজলভ্য করা এবং সরকারিভাবে রোগীদের ফ্রি চিকিৎসা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশে হিমোফিলিয়া ব্যবস্থাপনা

দেশে হিমোফিলিয়া রোগীদের জন্য কাজ করছে হিমোফিলিয়া সোসাইটি অব বাংলাদেশ (এইচএসবি)। তারা রোগীদের জন্য রক্ত, ফ্যাক্টর, পরামর্শ ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করে। তবে চিকিৎসা এখনো পর্যাপ্ত নয়।

হিমোফিলিয়া অভিশাপ নয়, এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী কিন্তু নিয়ন্ত্রণযোগ্য রক্তক্ষরণজনিত অবস্থা। সময়মতো রোগনির্ণয়, সঠিক চিকিৎসা এবং সামাজিক সচেতনতা এই রোগে আক্রান্তদের স্বাভাবিক ও সম্মানজনক জীবনযাপনে সহায়ক হতে পারে।

পরামর্শ দিয়েছেন: ডা. অদিতি সরকার, রেসিডেন্ট, বিএমইউ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত