Ajker Patrika

ভালো থাকার জন্য নাকি ভালো থেকে সন্তানের জন্ম দেবেন

অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
ভালো থাকার জন্য নাকি ভালো থেকে সন্তানের জন্ম দেবেন

আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো করার জন্য কি সন্তান পৃথিবীতে আনব, নাকি আগেই মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটিয়ে সন্তান জন্ম দেব? এটি খুব কঠিন প্রশ্ন। 

একজন মানুষ যখন আমি থেকে আমরা হন, তখন তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্যানভাসটা বড় হয়ে যায়। একটি প্রচলিত কথা—‘দাম্পত্য সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না বাচ্চা নিয়ে নাও, ঠিক হয়ে যাবে।’ 

প্রশ্নটা হলো, যেখানে আমরা দুজন মানুষই ভালো থাকতে পারছি না, সেখানে তৃতীয় একজনকে আনলে টানাপোড়েন আরও বাড়বে। কেন সেখানে তৃতীয় একজনকে আনব? 

এবার একটু ভেঙে ভেঙে দেখি। প্রথমে দেখি মায়ের ক্ষেত্রে কী হচ্ছে। 

প্রেগনেন্সি নিজেই একটি মনোদৈহিক, ক্ষেত্রবিশেষে মনোসামাজিক চাপ। হরমোন পরিবর্তনের কারণে মা ক্রমাগত নিজের শরীর বদলে যেতে দেখছেন। কখনো গর্ভকালীন কখনো-বা গর্ভ-পরবর্তী সময়ে কোনো কোনো নতুন মা বিষণ্নতার শিকার হন। যেটা অ্যান্টিপারটাম বা পোস্টপারটাম ডিপ্রেশন থেকে ক্ষেত্রবিশেষে সাইকোসিস পর্যন্ত হয়ে যায়। এখন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভালো না থাকলে এই বিষণ্নতা হলে মায়ের যত্ন হবে না। মায়ের অযত্ন মানে গর্ভস্থ শিশুরও অযত্ন। 

গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় মায়ের বিষণ্নতা এবং উদ্বেগজনিত রোগ থাকলে প্রিম্যাচিওর বেবি, অথবা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া থেকে শিশুর জন্মকালীন ওজন কম হতে পারে। সে জন্য শিশুকে আইসিইউতে রাখতে হতে পারে। এ কারণে শিশুটি পরবর্তীকালে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদ্‌রোগের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। শুধু তাই নয়, সন্তান প্রসবের পর মায়ের বিষণ্নতা রোগ হলে মা ও শিশু—উভয়ের জন্যই সেটা ক্ষতিকর। 

মা সন্তানকে ঠিকমতো বুকের দুধ খাওয়াতে না পারলে মা ও সন্তানের বন্ধন দৃঢ় হয় না। সঠিক পরিচর্যার অভাবে সন্তানটি ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, পুষ্টিহীনতায় ভুগতে পারে। কখনো এটা এত তীব্র হয়ে যায় যে, মা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কখনো সন্তানকে আঘাত করেন, মেরেও ফেলেন। কাজেই গর্ভাবস্থায় এবং প্রসব-পরবর্তী এক বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ মায়ের শরীর ও মনের জন্য। মেয়েরা এ অযত্নটা আমৃত্যু মনে রাখেন। 

নিউরোসায়েন্স বলে, যে শিশু বাবা-মার সুস্থ স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখে বড় হবে, সে ভবিষ্যৎ জীবনে মানসিক চাপে পড়লেও নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। বহু শিশুর ইদানীং কথা বলতে দেরি হচ্ছে। জেনেটিক কারণ বাদে এর পরিবেশগত একটা প্রভাব আছে। বাবা-মায়ের সুসম্পর্ক শিশুর মানসিক, দ্রুত কথা বলা এবং আবেগীয় বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। এ রকম পরিবেশে শিশু বড় হলে ইতিবাচক এবং আত্মবিশ্বাসী হবে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে মাতৃত্বজনিত বিষণ্নতা রোগের সঙ্গে মনোসামাজিক বিষয় সম্পৃক্ত। যেমন, অস্থিতিশীল দাম্পত্য সম্পর্ক, দাম্পত্য কলহ, মেয়ে সন্তান জন্ম দেওয়ার চাপ, পারিবারিক সহিংসতা, অর্থনৈতিক সংকট ইত্যাদি। করোনা-পরবর্তী সময়ে সবকিছু আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। 

স্বামী এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের বুঝতে হবে যে, শুধু নবাগত সন্তানই নয়, মায়েরও বিশেষ পরিচর্যা ও বিশ্রাম দরকার। নতুন মায়ের বাড়তি যত্নের খেয়াল রাখার দায়িত্ব সব থেকে বেশি বাবার। কিন্তু দেখা যায়, আমাদের সমাজে শিশু জন্মের পর কখনো কখনো মেয়েকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অনেক স্বামী শিশুর কান্নায় ঘুম হবে না ভেবে অন্য রুমে ঘুমান। স্ত্রীরও যে বিশ্রামের প্রয়োজন, সেটা কজন মনে রাখেন? বহু পরকীয়ার জন্ম হয় স্ত্রীর গর্ভাবস্থায়, অথবা স্ত্রী যখন সন্তানকে সময় দিচ্ছেন, সেই অবকাশে। একজন যখন নিজের শরীর ও মন মিশিয়ে সন্তানকে আগলে রাখছেন, তখন অন্যজন কী করছেন? এই আয়নাটি নিজের চোখের সামনে ধরা খুব দরকার। 

এখন নারীদের বড় একটি অংশ কর্মজীবী। ক্যারিয়ারের কিছুটা তো বিসর্জন দিতেই হয় সন্তানের জন্মের পর। বাবা-মার যদি বন্ধুত্বের জায়গাটা না থাকে, একজন পেশাজীবী মা অনেক রকম সাহায্য বাবার কাছ থেকে পাবেন না সন্তান হওয়ার পর। কাজেই সন্তান নেওয়ার আগে প্রতিটি মেয়েকে বলব, দুবার ভাবুন। 

শিশুর জন্ম হওয়াটা কি শুধু মার জন্যই মানসিক চাপের কাজ? 

মোটেও না। নতুন বাবার জন্যও এটি চাপের বিষয়। বাড়তি খরচের চাপ, মায়ের বাড়তি যত্ন—এগুলোর দায়ভার মোটামুটি পুরুষটির। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ক্ষতি করেছে পুরুষেরও। তার ওপরে সংসারের জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছে। এই সংসারের ঘানি আমৃত্যু টানবার চক্রব্যূহ থেকে পুরুষের পালানোর পথ নেই। 

যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে গেছে। বাবা-মা এবং শিশু নিয়ে তৈরি হচ্ছে একক বা নিউক্লিয়ার পরিবার। উপরন্তু নারী-পুরুষ উভয়কেই জীবনের তাগিদে উপার্জনে নামতে হচ্ছে। শিশু জন্মের পর পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্রের চাপে চাকরিজীবী মায়ের মতো একক পরিবারের বাবাও পড়ছেন। একইভাবে অসহিষ্ণুতা, ঘুম কম হওয়া, মনোযোগ কমে যাওয়া, বিষণ্নতায় নতুন মায়ের মতো নতুন বাবাটিও ভুগতে পারেন। 

গবেষণা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি সাতজন মায়ের মধ্যে একজন এবং প্রতি দশজন বাবার মধ্যে একজন শিশু জন্মের পর বিষণ্নতার শিকার হন। ফলে একক পরিবারে নতুন বাবা ও মা দুজনকেই পেশা এবং পরিবারের সঙ্গে সমন্বয় আনতে দীর্ঘ লড়াই করতে হয়। বাংলাদেশে এ ধরনের সচেতনতা বিরল। 

ফলে বাবা-মা যদি নিজেদের সমস্যার সমাধান না করেই মনে করেন সন্তান নিলে সমস্যার সমাধান হবে, তাহলে তাদের পুরোনো সমস্যা ধারাবাহিকভাবে চলতেই থাকবে এবং সন্তানটিও নতুন সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হবে। 

মনস্তাত্ত্বিকভাবে মায়ের গর্ভকালীন সময় থেকে শুরু করে প্রথম দুই বছর, শিশু যখন কথা বলতে জানে না, যেটাকে প্রিভারবাল স্টেজ বলে, তখন শিশুটি কিন্তু ঠিকই বুঝে যায় যে সে এই পরিবারে খুব আদরের সঙ্গে গৃহীত নয়। ফলে শিশুটি নিজেকে দায়ী করতে থাকে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মার গন্ডগোলের জন্য। এর ফল শুধু সুদূর প্রসারী। 

এই শিশুটি প্রাপ্তবয়স্ক হলেও এই মনস্তাত্ত্বিক ভোগান্তির শিকার হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হলে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর একটি প্রবণতা তার ব্যক্তিগত জীবনে দেখা যেতে পারে। কারণ সে দেখে এসেছে দাম্পত্যে ভালো না থাকা। অবচেতন ভাবে মানুষ যা দেখে তাই অনুকরণ করে। তাহলে কি এর থেকে মুক্তি নেই? অবশ্যই আছে। একমাত্র সচেতনতাই এ সমস্যা থেকে মুক্তির চাবি কাঠি। 

দাম্পত্যে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো মানে, সে দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে কষ্ট থাকবে না, দ্বন্দ্ব থাকবে না, তা নয়। এখানে তারা মানসিক দ্বন্দ্বগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে সেই ব্যাকরণটা জানেন। ফলে একটা ভালো মানসিক সম্পর্ক নিয়ে যখন কেউ বাবা-মা হওয়ার পরিকল্পনা করেন, তখন তারা জানেন যে ক্যারিয়ারে কতটুকু কোথায় বিসর্জন দিতে হবে এবং এতে কোন ধরনের সমস্যা আসতে পারে। পরস্পর আলোচনা ও সম্মতির ভিত্তিতে তারা সমস্যাগুলো মোকাবিলা করেন ব্যক্তিগত মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে। 

এখন কেউ একজন বলতেই পারেন, ‘আমাদের সময় তো বাচ্চা নিলেই সব ঠিক হয়ে যেত।’ বিশেষ করে শ্বশুর-শাশুড়ি শ্রেণির। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তখনকার মায়ের অর্থনৈতিক অক্ষমতা, সমাজের লোকে কী বলবে ইত্যাদি ভীতি, তাঁদের সম্পর্কে থেকে যেতে বাধ্য করত। এখন এই বিশ্বায়নের যুগে সেই পারিপার্শ্বিকের পরিবর্তন অনস্বীকার্য। 

নতুন একটা জীবনের উন্মেষ ঘটিয়ে সেই জীবনটিকেও বিষাক্ত ডালপালায় ঘিরে ফেলা মোটেও সমাধান নয়। নিজে মানসিকভাবে ভালো না থাকলে কীভাবে সন্তানের যত্ন নেবেন যেখানে শিশুর মনোদৈহিক বিকাশ চমৎকার হবে? 

প্লেনে উঠলে নির্দেশনা শোনা যায়, ‘অক্সিজেন মাস্কটা আগে নিজের মুখে নিন, তারপর শিশুকে দিন।’ 

কাজেই প্রথমে নিজেকে ভালো থাকা শিখতে হবে; নিজের সম্পর্ককে ভালো রাখার জায়গাটায় জোর দিতে হবে, তারপর সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে হবে। 

ভঙ্গুর সম্পর্কে সন্তানের জন্ম দেওয়া মা, বাবা ও সন্তান তিন পক্ষের জন্যই ভোগান্তির। 

লেখক: চিকিৎসক ও কাউন্সেলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার, ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার, ঢাকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত