Ajker Patrika

সততাকে কীভাবে মাপবেন

সানজিদা সামরিন
Thumbnail image

পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য দৈনিক ঠিক কয় ঘণ্টা পড়াশোনা করা প্রয়োজন? কেউ হয়তো বলবেন, ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৮ ঘণ্টা যদি কেউ না পড়ে, তাহলে কী করে হবে? আমি নিজে যখন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিই, তখন আশপাশের অনেককেই বলতে শুনেছি, ‘১৫-১৬ ঘণ্টার নিচে পড়াশোনা করে ভালো ফলাফল আশা করা যাবে না।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই ঘণ্টার হিসাব কি সবার জন্যই সমান? মানে কারও যদি একটা প্যারাগ্রাফ মুখস্থ করতে ২০ মিনিট লাগে, আর অন্য একজনের যদি লাগে ১ ঘণ্টা, তাহলে দুজনের জন্যই কি পড়াশোনার ওই নির্দিষ্ট ঘণ্টার হিসাব এক হবে? আসল বিষয় হলো, অভিভাবকদের এ প্রশ্ন তো করাই যাবে না! তাহলে এই প্রশ্ন কি করা যায় যে কয় ঘণ্টা টেবিলে বসে থাকা হচ্ছে, সেটার হিসাব রাখা জরুরি, নাকি পড়ালেখাটা ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, সেটা বেশি জরুরি?

আজকাল স্বনামধন্য স্কুলগুলোয় ক্লাস টু-থ্রিতে পড়ুয়া শিশুরা যত ধরনের প্রাইভেট কোচিং করে বা যতক্ষণ বইপত্র নিয়ে বসে থাকে, আমরা হয়তো ওই সময়ে, ওই বয়সে সেভাবে পড়াশোনা করিনি। তবে দুর্ভাগ্য অনেকের মতো আমারও ছিল বৈকি! ‘দ্রুত পড়া মুখস্থ’ হওয়ার মতো বালাই বোধ হয় ছাত্রজীবনে আর দ্বিতীয়টা নেই। একটা সময় পর যখন বুঝলাম, আসলে পড়া ভালোভাবে মুখস্থ, আত্মস্থ বা শেষ করার চেয়ে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত পড়ার টেবিলে বসে রইলাম কি না, সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ; তখন ঠিক করলাম পড়া শেষ করার পর বাকি সময়টুকু পূর্ণ করার জন্য গল্পের বই পড়ব। রাত ৯টা, সাড়ে ৯টার মধ্য়েই বেশির ভাগ দিন আমার সব পড়া হয়ে যেত। এরপর পড়ার বইয়ের নিচে একে একে জে কে রাউলিংয়ের হ্যারি পটার, বিভূতিভূষণের অপরাজিত, স্ট্যাকপোলের ব্লু লেগুন, শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজ পড়া হয়ে যেত। এতে আমার পরীক্ষার ফলাফল বা ব্যক্তিগতভাবে আমি ও আমার পরিবারের কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হইনি। তাহলে এত কথা বলছি কেন? কারণ ওই একটাই—সাড়ে ৯টায় পড়ার টেবিল থেকে উঠতে পারলাম না কেন? খুব আয়েশ করে বসার ঘরের সোফায় বসেও তো বইগুলো পড়তে পারতাম। নিজের উদাহরণ দিয়ে বলা কথাগুলো কি শুধুই আমার নিজের? আসলে অনেকেরই কথা এগুলো। পড়া তো ঠিকঠাকই তৈরি করছি, তাহলে প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি কেন?

ঘর থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে বা গোটা জগতেই যেন কাজের কাজটা ঠিকঠাক করলাম কি না, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কাজটা যে আমিই করছি, সময় লাগিয়ে, ঘণ্টা ধরে বসে বসে করছি, তা দৃষ্টির সম্মুখে আনা। যাতে মানুষ দেখে এবং যাতে প্রমাণ হয় যে ‘অমুক কাজটা করে বা করছে।’

শুধু ছাত্রজীবনের গল্প করলেই কি আর গল্প ফুরোয়? নিজেকে প্রমাণ করার দায় যেন ফুরোবারই নয়। প্রতিবেশী এক খালার বাড়িতে রাত ৮টায় মাঝে মাঝে অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে দেখতাম। অসম্ভব ভালো ছাত্রী তাঁর দুই মেয়ে। মেয়েদের সন্ধ্যায় পড়ানোর একফাঁকে হয়তো টিভি খুলেছেন পছন্দের সিরিয়াল দেখার জন্য। মেয়েরাও একটু বিরতি পায় যেন, সেই বিকেল থেকে চলছে পড়ার রেলগাড়ি। টিভি দেখার সময় যেই না খালুর গাড়ির শব্দ শুনতে পেতেন খালা, তখনই টিভি বন্ধ করে মেয়েদের বলতেন, ‘পড় পড় পড়। জোরে জোরে পড়।’

ওদিকে রান্নাঘরে কোনো কাজ না পেয়ে কাজের মেয়েটাও মেঝেতে ইচ্ছে করেই পানি ঢেলে মুছতে শুরু করত। কলবেল চাপার পর যখন দরজা খুলে গেল, তখন খালু খুশি হলেন এই দেখে যে মেয়েরা চিৎকার করে করে, ঝুলে ঝুলে পড়ছে, খালা কাঁথা সেলাই করছেন আর কাজের মেয়েটা রান্নাঘরে কাজ করছে। কেউ শুয়ে-বসে নেই, সবাই ব্যস্ত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সৎ হওয়াটা বোধ হয় খুব একটা জরুরি নয়; বরং প্রয়োজনে আজগুবি কাজ করতে হয়।

আজকাল ক্রিয়েটিভ জব, ক্রিয়েটিভ জব করে ছেলেমেয়েরা যেটাকে রসের হাঁড়ি ভাবছে, দুদিন পর সেটাই হয়ে উঠছে চাপের। কারণ গোটা বিশ্বেই করপোরেট কালচার আগ্রাসী ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু দিন শেষে অফিসে আসা ও যাওয়ার সময় নির্ধারিত হলেও আদৌ কি প্রতিটি কর্মীর দায়িত্ব ও কাজের হিসাবটা হচ্ছে? কে কতটুকু দায়িত্ব নিচ্ছেন বা কার কাঁধে কতটুকু দায়িত্ব তা নিয়ে ভাবার সময় কি কারও আছে? অফিসে ঠিক ৯টায় ঢুকে ৫টায় বেরিয়ে যাওয়া মানেই কি তিনি আদর্শ কর্মী বা সেই কর্মীই কর্মঠ? চেয়ার-টেবিলে বসে থাকাই কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সময়ের মধ্য়ে ঝটপট প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ফেলার চেয়ে? দায়িত্ব নেওয়ার চেয়ে? হয়তো তাই, কারণ টেবিলে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বসে থাকাটাই হয়তো বাহবা পাওয়ার যোগ্য়—কাজের কাজটা হওয়ার চেয়ে। হয়তো ভাবছেন, লেখাটা এখানেই শেষ। কিন্তু না, আরও দুই লাইন বলার আছে। ঝটপট কাজ শেষ বলে যাঁর কাঁধে আরও দুই-তিনটি কাজ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে; তখন কেউই ভাবছে না যে ৯টা-৫টার ঘড়ির কাঁটা মেনে চলা অনেকেই হয়তো গোটা দিন একটি কাজ নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন বা তিন-চার দিনে একটি কাজ শেষ করছেন, হয়তো করছেনই না। শুধু ঘড়ির কাঁটাকে সালাম ঠুকে আমরা কাজের কাজকে টপকে যেতে পারি। এই টপকে যাওয়ার নিয়ম সর্বত্রই আছে নিভৃতে...। কারণ ঘণ্টা মেপে চললে ‘সৎ’ না হলেও পার পাওয়া যায়।

সানজিদা সামরিন, সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত