Ajker Patrika

‘বাবা আমি মারা যাচ্ছি, আমাকে মাফ করে দিয়ো’

তাসনীম হাসান, সীতাকুণ্ড থেকে ফিরে
আপডেট : ০৬ জুন ২০২২, ০৯: ১৮
‘বাবা আমি মারা যাচ্ছি, আমাকে মাফ করে দিয়ো’

‘বিস্ফোরণের পর ছেলে ফোন দিয়ে আমাকে বলল, ‘‘বাবা, আমার একটা পা উড়ে গেছে। আমি মারা যাচ্ছি। আমাকে মাফ করে দিয়ো বাবা।” এরপরই ফোনের লাইন কেটে যায়। তারপর হাসপাতালে এসে দেখি আমার ছেলেটা স্ট্রেচারে শুয়ে আছে। চোখ দুটো বন্ধ।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে বসে শনিবার রাতে বিলাপ করছিলেন বাবা ফরিদুল ইসলাম। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বাড়ি এই স্কুলশিক্ষকের। তাঁর ছেলে মুবিনুল হক চট্টগ্রামের হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক শেষে বিএম কনটেইনার ডিপোতে চাকরি নিয়েছিলেন। চাকরির বয়স তিন মাস পেরিয়েছে মাত্র। এর মধ্যেই লাশ হয়ে ফিরতে হলো এই তরুণকে। নিজের মৃত্যুর বয়ানও যেন দিয়ে গেছেন বাবার কাছে। মৃত্যুর একটু আগেই যে বাবা ফরিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়েছিল এই তরুণের। ছেলের সঙ্গে শেষ মূহূর্তের সেই আলাপ এখন এই স্কুলশিক্ষকের বুকের ভেতর যেন কাঁটার মতো বিঁধছে।

আমার ছেলেটারে একটু খুঁইজা দেন

নিখোঁজ ছেলের পথ চেয়ে চেয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৃষ্টিটাই যেন ঝাপসা হয়ে গেছে আয়েশা বেগমের। চোখের সব জলও যেন ফুরিয়ে গেছে। হাতে ছেলের জন্মনিবন্ধনের সাদা একটা কাগজ। সেটি নিয়ে নির্বাক, স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আগুনের দিকে। কনটেইনারের ভেতরে আগুন একটু দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলে যেন ছ্যাঁৎ করে ওঠে আয়েশার বুক। চোখের জল মুছতে মুছতে অস্ফুটে বলে ওঠেন–উফ!

আলোকচিত্রী সাংবাদিকদের ক্যামেরা দেখতেই দৌড়ে আসেন আয়েশা। হাহাকার মেশানো কণ্ঠে তাঁদের কাছে বলে ওঠেন, ‘আমার ছেলেটারে কোথাও পাচ্ছি না। তারে একটু খুঁইজা দেন না। হাসপাতালে পাইনি। এখানেও পাচ্ছি না। আমার বুকের মানিকটা কোথায় হারাল?’ বলতে বলতে আয়েশার কথা ফের হারিয়ে যায় কান্নায়।

আয়েশা বেগমের নাড়িছেঁড়া ধন মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম চাকরি করতেন সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে। যে ডিপোতে শনিবার রাতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই। ছেলের খোঁজ না পেয়ে গতকাল রোববার সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ছুটে যান আয়েশা। সেখানে ছেলেকে না পেয়ে আবার দৌড়ে আসেন সীতাকুণ্ডের ঘটনাস্থলে।

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর চাম্বল এলাকায় আয়েশাদের বাড়ি। ছোট্ট শহীদুলকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল মায়ের। ডিপোর পাশের এম এ কাশেম রাজা উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ত শহীদুল। দিনভর স্কুলের ব্যস্ততা শেষে সন্ধ্যা হলেই হাজির হতো ডিপোতে। সেখানে সে অফিস সহকারীর কাজ করত। শনিবার কাজে যোগ দিতে যাওয়ার সময় মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয় শহীদুল। সেই বিদায় কি শেষ বিদায় হয়ে গেল—এই আশঙ্কায় বুক ফেটে যাচ্ছে মায়ের!

গতকাল বিকেলে আয়েশাকে ডিপোর পেছনের ঘেটে এলাকায় পাওয়া গেলেও আগের দিন মধ্য রাত থেকেই স্বজনের খোঁজে ডিপোর প্রবেশমুখের এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভিড় করেন অনেকেই। শনিবার দিবাগত রাত ১২টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় বিএম কনটেইনার ডিপোর প্রবেশমুখের দুই পাশের এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শুধুই মানুষ আর মানুষ। ডিপোর ভেতরে একেকটি অ্যাম্বুলেন্স বের হতেই সবাই ছুটে যাচ্ছে সেদিকে। পুলিশ লাঠিপেটা করে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মানুষকে দমানো যাচ্ছে না। সবার চেহারাতেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছাপ। তাঁদের বেশির ভাগই যে এসেছেন খোঁজ না পাওয়া স্বজন আর সহকর্মীর খোঁজে। পরে সেখান থেকে অনেকেই যান চমেকে। এ সময় কেউ স্বজনকে অক্ষত ফিরে পেয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন পরম মমতায়, আবার কেউ প্রিয় মানুষের মৃত্যুর সংবাদে চোখ ভাসিয়েছেন কান্নায়।

ডিপোতে কর্মরত মামার খোঁজে শনিবার রাত সাড়ে ১২টায় সীতাকুণ্ডে ছুটে গিয়েছিলেন কামরুল ইসলাম ও নুরুল আবসার। তিন ঘণ্টার খোঁজাখুঁজির পর অক্ষত অবস্থায় মামা হাফিজুল ইসলামকে ফিরে পেয়েছেন তাঁরা। হাফিজুল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ছোট্ট আগুন থেকে এত বড় ঘটনা ঘটে যাবে, একটুও ভাবিনি। এমন বিভীষিকার রাত কারও জীবনে না আসুক।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত