Ajker Patrika

ব্যাংক লুটে লাপাত্তা সওদাগরের জাহাজ

হুমায়ুন মাসুদ, চট্টগ্রাম
আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ০৮: ৫৫
ব্যাংক লুটে লাপাত্তা সওদাগরের জাহাজ

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী ছিলেন তিনি। ব্যবসা ছিল আমদানি-রপ্তানির। চট্টগ্রামে এমন ব্যবসায়ীদের ‘সওদাগরই’ বলা হয়। ব্যবসার জন্য একসময় ঋণ নেওয়া শুরু করেন। প্রথম দিকে ফেরত দিতেন। একপর্যায়ে বন্ধ করে দেন। ফাঁদে পড়ে ব্যাংকগুলো। একটি দুটি নয়, অন্তত ৮টি ব্যাংক। এসব ব্যাংক তাঁর কাছে পাবে সাড়ে ছয় শ কোটি টাকার বেশি। সেই টাকা নিয়ে তিনি সপরিবারে কানাডায় বসবাস করছেন বলে জানা গেছে।

চট্টগ্রামের এই ‘সওদাগরের’ নাম মোজাহের হোসেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ইয়াছির গ্রুপ। ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেওয়ায় আদালতে গেছে কয়েকটি ব্যাংক। সে মামলায় তাঁর জেল-জরিমানাও হয়েছে। কিন্তু তাতে টাকা উদ্ধার হচ্ছে না, তাই ব্যাংকগুলো আশায় আছে টাকা নিয়ে কবে বন্দরে ভিড়বে সেই সওদাগরের জাহাজ!

ব্যাংকের টাকা লুটের বড় বড় ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। সেই কেলেঙ্কারি আর ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও অপশাসনের খাতায় আরেকটি পালক যুক্ত করেছে চট্টগ্রামের এ ঘটনা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র এবং নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণের টাকা যদি ঋণগ্রহীতা বিদেশে পাচার করেন এবং তা প্রমাণিত হয়, তবে বিদেশ থেকেও সেই টাকা বা বিদেশে অবস্থিত অন্যান্য সম্পদ থেকে ঋণের টাকা উদ্ধারের ক্ষমতা সিআইডি, দুর্নীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) আছে।’

তবে ইয়াছির এন্টারপ্রাইজকে ঋণ দেওয়া ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) প্রেসিডেন্ট সেলিম আর এফ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের মেসার্স ইয়াছির এন্টারপ্রাইজকে দেওয়া বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ অনেক পুরোনো। এটা পুনরুদ্ধার হওয়ার তেমন একটা সম্ভাবনা নেই। তবে ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী বিষয়টি সুরাহা হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইয়াছির গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইয়াছির এন্টারপ্রাইজ, শাপলা ফ্লাওয়ার মিলস ও ইয়াছির পলিমার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে ইয়াছির এন্টারপ্রাইজ ভোগ্যপণ্য আমদানি করত। একপর্যায়ে ২০০৯ সাল থেকে বড় পরিসরে ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়া শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৩ সাল পর্যন্ত এসব ঋণ ধারাবাহিকভাবে পরিশোধ করলেও ২০১৪ সালের পর থেকে ঋণ পরিশোধ না করে আত্মগোপনে চলে যান ইয়াছির এন্টারপ্রাইজের মালিক মোজাহের হোসেন। এরপর থেকেই এসব ঋণ অনাদায়ি পড়ে আছে।

মামলা ও ব্যাংকগুলোর সূত্রে জানা গেছে, ইয়াছির গ্রুপের কাছে এবি ব্যাংকের হালিশহর শাখাসহ দুটি শাখার পাওনা ১৩৩ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা পাবে ১২৮ কোটি, সিটি ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার ১০৩ কোটি, প্রাইম ব্যাংকের জুবলী শাখা ১০০ কোটি, ব্যাংক এশিয়ার শেখ মুজিব রোড শাখা ৬৪ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২৯ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা ৩০ কোটি ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা ৩৬ কোটি টাকা পাবে। এ ছাড়া গ্রুপটির কাছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসির পাওনা দাঁড়িয়েছে ৩১ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের বাইরে ইয়াছির গ্রুপের কাছে যমুনা, ন্যাশনাল ও রূপালী ব্যাংকেরও পাওনা আছে বলে জানা গেছে। তবে কোন ব্যাংক কত টাকা পাবে, সে তথ্য পাওয়া যায়নি।

প্রাইম ব্যাংক থেকে নেওয়া একটি ঋণ মামলায় আদালত ২০১৬ সালে রায় দিয়েছেন। ইয়াছির এন্টারপ্রাইজের মালিকানাধীন শাপলা ফ্লাওয়ার মিলসের নামে মোজাহের হোসেন ওই ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি ১৫ লাখ ৪৭ হাজার ২৩০ টাকা ঋণ নেন। এই ঋণ পরিশোধ না করায় গত ১ নভেম্বর মোজাহের হোসেন ও তাঁর স্ত্রী জেবুন্নেছার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।

ইয়াছির এন্টারপ্রাইজের কাজে প্রিমিয়ার ব্যাংকের পাওনা ৩০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের এ ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও মোজাহের হোসেন কোনো অর্থ পরিশোধ না করায় ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ রাখা সম্পত্তি বিক্রির উদ্যোগ নেয়। একই বছরের নভেম্বর মাসে চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ পতেঙ্গা মৌজার ৪০ শতক জায়গা ২ কোটি টাকা বিক্রি করে। পাশাপাশি ওই ঘটনায় ২০১৫ সালে চেক জালিয়াতির একটি মামলা করে। অন্যদিকে ২০১৬ সালের অর্থঋণ আদালতে আরেকটি মামলা করে।

প্রিমিয়ার ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক ফখরুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা দুটি মামলা করেছিলাম। ২০১৯ সালে দুটি মামলারই রায় দিয়েছেন আদালত। একটি মামলায় আসামিদের ৬ মাসের জেল, অন্য মামলায় ১০ মাসের জেল দিয়েছেন। আদালতের মামলার পর তো আর তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আসামি দেশে না এলে ঋণের বাকি টাকা উদ্ধার করার কোনো উপায় নেই। এখন ওনার দেশে ফেরা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত