Ajker Patrika

আমাদেরও সাবধান হতে হবে

অজয় দাশগুপ্ত
আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২২, ১০: ৩৬
আমাদেরও সাবধান হতে হবে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন তাঁর সব ভাষণে সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছেন, সাবধান হতে বলছেন। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিজ্ঞ। তিনি খবর জানেন। তাঁর সঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের কথা মেলে না। কারণ, তাঁরা কাচের স্বর্গে বসে আছেন। এদিকে দুনিয়াজুড়ে চলছে সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি।

আমি যেখানে বাস করি, এই অস্ট্রেলিয়া ধনী দেশ নামে পরিচিত। তার নিরাপত্তা আর সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী অনেক শক্তপোক্ত।তারপরও তারা এখন পেছনের পায়ে ভর দিয়ে চলছে। ইতিমধ্যে মানুষের জন্য নানা প্যাকেজ সাহায্য চালু হয়ে গেছে। সুপার শপ বা চেইন শপগুলো তাদের ব্যবসায় লাভের পরিমাণ কমিয়ে বিশেষ ছাড় দিচ্ছে মানুষজনের জন্য। সবাই মিলে যে ব্যাপক প্রস্তুতি তার কথা মনে রেখেই বলছি।

অথচ এ দেশের মানুষের মৌলিক বা বেসিক জিনিসগুলোর অভাব নেই। তাদের বাড়িঘর-ফ্রিজে চাল, ডাল, ডিম, সবজি আছে। আছে মাছ-মাংস। দুধ-কলা কিছুই বাদ নেই। তবু দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার আয়োজন জারি রয়েছে। কারণ, মহামারি আর যুদ্ধের সংকটে তিনটি বছর পার করা এই পৃথিবীর আগামী বছরটাও যে অর্থনৈতিকভাবে ভালো যাবে না, সেই পূর্বাভাস বিশ্ব সংস্থাগুলো দিয়ে আসছে।খোদ বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বারবার দুর্ভিক্ষের শঙ্কার কথা বলে সতর্ক করে আসছেন দেশবাসীকে। সত্যি সত্যি যদি তেমন বিপদ আসন্ন হয়, তা সামাল দিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।

এই বিপদের মুখ অনেকগুলো। তার কয়েকটা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ দেখতে শুরু করেছে। টানা কয়েক বছর বাড়তে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার এখন নিম্নমুখী। বিশ্বের জ্বালানি বাজারের অস্থিরতা ফিরিয়ে এনেছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। শিগগিরই খাদ্যসংকট তৈরি হওয়ার স্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত এখনো সরকারের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির সার্বিক সংকটে মূল্যস্ফীতি বহু বছর পর এখন ৯ শতাংশের ওপরে থাকছে। তাতে নিম্ন আর মধ্যবিত্তের সংসার সামলাতে উঠছে নাভিশ্বাস। আর বিশ্ব খাদ্য সংস্থা খাদ্যসংকটের যে ঝুঁকির কথা বলছে, সেই তালিকায় বাংলাদেশের নামও আছে।

যাঁরা তাত্ত্বিক, তাঁরা এসব ভালো বলতে পারবেন। আমরা খোলা চোখে দেখছি অসুবিধা বা সংকট আসন্ন। এমন না যে বাংলাদেশ পথে বসবে। কিন্তু মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের নাভিশ্বাস এখন স্পষ্ট। ধনী বা উন্নত দেশ নামে পরিচিত দেশগুলোর সরকারেরা তাদের যাবতীয় মাধ্যম ও সম্বল নিয়ে তৈরি হচ্ছে। মানুষকে বাঁচানো আর নাগরিকের জীবন, সম্মান বজায় রাখার স্বার্থে তাদের উদ্যোগ এখন চোখে পড়ছে। আমাদের দেশেও যে সরকার চেষ্টা করছে না, তা নয়। কিন্তু রাজনীতি কিছুই মানে না। মানতে চায় না। অদ্ভুত এক রাজনীতি লালন করি আমরা। যখন সংকট ঘনীভূত হয়, তখন যা দরকার বা যা যা করা উচিত, তার কিছুই করে না রাজনৈতিক দলগুলো। তারা এখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংকট মোকাবিলার কথা ভাবলে মঙ্গল হতো। তার বদলে হিংসা আর আগ্রাসী মনোভাবে সরকার ও বিরোধী দলের সংঘাত মনে হচ্ছে আসন্ন; যা কারও জন্য ভালো হবে না।

সাধারণ মানুষের দিকে তাকান। তাদের মুখ বন্ধ কিন্তু অন্তর জ্বলছে। হাহাকারের নানা রূপ থাকে। এখনকার হাহাকার মোবাইল বা ডিজিটাল যুগের আড়ালে আছে বলে বোঝা যায় না। যখন তা বের হয়ে আসে, তখন তার চেহারা হয় ভয়ংকর। ফলে সাবধান হওয়ার বিকল্প নেই। সাধারণ বলতে যদি মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের কথা বলি, তাদের ঘরে নিত্যদিনের পণ্য চাল, ডাল, তেল বা ডিম নেই পর্যাপ্ত।

এগুলো আমাদের দেশের অতিসাধারণ পরিবারের সাধারণ খাবার। ডিম, মাংস, মাছের উৎপাদন নিয়ে যত পরিসংখ্যানই থাক, আসলে এগুলো এখন তাদের হাতের বাইরে। এই অধরা পণ্যগুলোই একসময় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। দেশের সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত বোঝে? তাদের মূল বিষয় জীবনধারণ। আজকের সমাজে একশ্রেণির মানুষ ইচ্ছেমতো খায়, ঘুরে বেড়ায়, অঢেল খরচ করে।ৎ

অজয় দাশগুপ্ত

এদের দেখে আসল পরিস্থিতি বোঝা যাবে না। আওয়ামী লীগের টানা তিন শাসনামলে সাধারণ মানুষের অবস্থা নিশ্চিতভাবেই ভালো হয়েছে। জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতে হবে, একটি বিশেষ শ্রেণি এর আগে কখনো এভাবে ফুলেফেঁপে বড় হতে পারেনি। এই কথিত বড় হওয়া কিন্তু কারও কল্যাণে আসেনি। এরা নিজেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। সবচেয়ে বড় কথা, এই ধনীদের জানা নেই কোথায় থামতে হয়।

আসন্ন সংকটের কথা মাথায় রেখে বলতে হয়, তারা কোনো সংকটে পাশে দাঁড়ায় না। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি সব সময় সোজা-সাপটা কথা বলেন। নানাভাবে তিনি তাদের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করলেও তাদের মন গলে না। মন না গলার মূল কারণ, আজকের বাংলাদেশে কারও জানা নেই এক জীবনে কত টাকার দরকার হয়। এই যে শত শত কোটি টাকা, কোথাও হাজার কোটির গল্প, এই টাকা দিয়ে তারা কী করবে? তারা নিজেরাও এর উত্তর জানে না। অবৈধ অর্থে বিত্তশালী হওয়ার নেশায় মত্ত তারা—সংকটের এটিও আরেকটি কারণ।

সংকট বা বিপদ বলে-কয়ে আসে না বলেই মানুষ তৈরি হতে পারে না। কিন্তু এবারের সংকট বলে-কয়ে হানা দিচ্ছে। কাজেই কারও সুযোগ নেই দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার; বরং মানুষ রুদ্ধশ্বাসে দেখছে তাদের জন্য কে কী করছে। বলা বাহুল্য এর ভেতরেই থাকবে তাদেরজবাব।

থাকবে মোকাবিলা। বাংলাদেশ কোনো বিপদে পড়ুক—এটা আমরা কেউ চাই না। চাই না বলেই সবাইকে কথা বলতে দেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। মানুষ যত বলবে, তত জানা যাবে কোথায় সংকট, কোথায় এর উৎস। তখনই প্রতিরোধ হবে সম্ভবপর। দুনিয়ার সঙ্গে তালমিলিয়ে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়ে সংকটকে উড়িয়ে দিক—এটাই সবার চাওয়া। রাজনীতি তা না পারলেও সমাজ বা দেশকে পারতেই হবে।

মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের মূল আয় স্তম্ভের একটি রেমিট্যান্স। ২ নভেম্বরের খবর বলছে, তা এখন রেকর্ড পরিমাণ নিম্নমুখী। চাপ বাড়ছে। বাড়ছে সংকট ও শঙ্কা। এমন সময়ে রাজনীতি কঠিন হলে দেশ ও সমাজের মঙ্গল হবে না। কিন্তু বিরোধীদেরও দেয়ালে পিঠ।এমন এক অবস্থা, যখন কেউ কারও কথা শোনে না। মানতে চায় না। ফলে সংকট সমাধান বা মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য নেই এবং হবে বলেও মনে হয় না। কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠতে পারে সবকিছু। সময় থাকতে সাবধান না হলে দুর্ভোগ বাড়বে।

লেখক: অজয় দাশগুপ্ত, অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত