Ajker Patrika

আন্ডা নিয়ে ঠান্ডা লড়াই

মহিউদ্দিন খান মোহন
আন্ডা নিয়ে ঠান্ডা লড়াই

আন্ডা, ডিম, বয়দা বা বয়জা—একই বস্তু। এর ইংরেজি নাম ‘এগ’। হাঁস-মুরগি, পাখি, মাছ এবং উভচর কিছু প্রাণী, যেমন সাপ, ব্যাঙ, কচ্ছপ বংশ বৃদ্ধিকল্পে আন্ডা বা ডিম দিয়ে থাকে। আন্ডা নিয়ে মজার একটি কথা আছে। পৃথিবীতে আন্ডা আগে এসেছে না মুরগি, তা এক অমীমাংসিত প্রশ্ন।

যদি বলা হয় আন্ডা আগে, তাহলে প্রশ্ন—কীভাবে তা এল? আর যদি বলা হয় মুরগি আগে, তখন সে মুরগি কীভাবে এল, সেই প্রশ্ন এসে যায়। তাই এটা নিয়ে কেউ আর বিতর্কে প্রবৃত্ত হয় না।

হাঁস-মুরগির ডিম মানুষের প্রয়োজনীয় একটি খাদ্যবস্তু। মানুষের দৈনন্দিন আমিষের চাহিদা মেটাতে ডিমের ভূমিকা বিরাট। অসুখ-বিসুখে স্বাস্থ্যহানি ঘটলে তা পুনরুদ্ধারে চিকিৎসকেরা রোগীদের সেদ্ধ বা আধা সেদ্ধ ডিম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ডিম খাওয়ার বেশ কয়েকটি পদ্ধতিও আছে। সকালে সেদ্ধ-আধা সেদ্ধ ছাড়াও পোচ করে খাওয়া খুবই স্বাস্থ্যসম্মত। আবার ডিমের ওমলেট খেতেও বেশ মজা। এই ওমলেট নিয়ে একটি গল্প বেশ প্রচলিত আমাদের দেশে। গ্রাম থেকে এক লোক ঢাকায় এসে নাশতা করতে গেছে রেস্তোরাঁয়। বেয়ারা এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খাবেন?’ লোকটি জানতে চাইল পরোটার সঙ্গে কী আছে। বেয়ারা বলল, ‘ভাজি, ডাল, গরুর মাংস আর ওমলেট।’ লোকটি কখনো ওমলেট খায়নি, দেখেওনি। সে ওমলেট অর্ডার দিল। কিছুক্ষণ পর বেয়ারা একটি প্লেটে দুটো পরোটা আর ওমলেট এনে দিল।

ওমলেট দেখে গ্রামের লোকটি বলল, ‘হালার বয়জা, ঢাহার শহরে আইয়া তুমি ওমলেট হইছ!’ এ ছাড়া ডিমের ঝোল রেঁধে ভাত খাওয়ার প্রচলন এপার বাংলা-ওপার বাংলায় বেশ প্রচলিত। আগের দিনে গ্রামের মানুষদের হাঁস-মুরগির ডিম খুব একটা কিনে খেতে হতো না। প্রতিটি পরিবারের গৃহিণীরা দু-চারটি মুরগি এবং হাঁস পুষতেন। ওগুলোর দেওয়া ডিমে পরিবারের চাহিদা মিটত।

আমরা যখন বালক, তখন গ্রামীণ জীবন ছিল খুবই সাদাসিধে। বাড়িতে মেহমান না এলে মুরগির মাংস রান্না হতো না। সেই মুরগি আবার ঘরের মুরগি, বাজারের নয়। সে সময় গ্রামের হাট-বাজারে আজকের মতো গরু-খাসি জবাই করে বিক্রি হতো না। ফলে মাছ, শাকসবজি দিয়েই চলত আহার। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, যেদিন মা ডিমের সালুন রান্না করতেন, আমরা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যেতাম। ডিমের তরকারি ছিল আমাদের কাছে পরম-কাঙ্ক্ষিত আইটেম। ডিম কিন্তু অনেক সময় হাস্যকৌতুকের উপমা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। যেমন পৃথিবীতে ‘ঘোড়ার ডিম’ নামে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব না থাকলেও আমরা কিন্তু কাউকে উপহাস করার জন্য এ কথাটি হরদম ব্যবহার করে থাকি। ডিম নিয়ে অনেকের মধ্যে কুসংস্কারও ছিল। সকালবেলা ডিম খেয়ে কোনো ‘শুভ কাজে যাত্রা নাস্তি’, এমন ধারণা অনেকেরই আগে ছিল।

স্কুলের পরীক্ষার সময় মায়েরা ডিম খেয়ে যেতে দিতেন না। তাতে নাকি পরীক্ষায় ডিম, মানে শূন্য পাওয়ার আশঙ্কা থাকে! এখন আর ওসব কুসংস্কার কেউ মানে না।
ডিম নিয়ে একটি বাস্তব ঘটনার কথা বলি। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এক ক্যাবিনেট মিটিংয়ে তৎকালীন মৎস্য ও পশুপালনমন্ত্রী সাদেক হোসেন খোকা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বললেন, ‘ম্যাডাম, গত অর্থবছরে সারা দেশে প্রায় পাঁচ শ আশি কোটি বিরানব্বই হাজার সাত শ পঞ্চাশটি ডিম উৎপন্ন হয়েছে (ফিগারটি হুবহু মনে নেই, তবে এমনই হবে)।’ অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান সাদেক হোসেন খোকার কথা শেষ হওয়ার আগেই বললেন, ‘কী কইলা খোকা, আরেকবার কও।’ খোকা সাহেব ফিগারটি আবার বললেন। সাইফুর রহমান প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘ম্যাডাম, আমার বাসায় ছয়গা মুরগি আছে। উহারা একেকটা আসিয়া ডিম পাড়িয়া কক কক করিয়া চলিয়া যায়। আমি সেই ডিমের হিসাব রাখিতে পারি না। আর খোকা, তুমি সারা বাংলাদেশের ডিম গুনিয়া ফালাইলা!’ ক্যাবিনেট সভায় হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছিল।

অবশ্য এটা স্বীকার করতেই হবে যে হাঁস-মুরগির ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিস্ময়কর অগ্রগতি লাভ করেছে। আগে গৃহস্থ বাড়ির গিন্নিরা হাঁস-মুরগি পুষতেন। এখন বাণিজ্যিকভাবে এর উৎপাদন হয়। সারা দেশে কতগুলো হাঁস-মুরগির খামার আছে, তা প্রাণিসম্পদমন্ত্রী হয়তো বলতে পারবেন। আমার মতো আম পাবলিকের পক্ষে তা একেবারেই সম্ভব নয়। তবে প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে যে পরিমাণের কথাই বলা হোক, তার সঠিকতা নিয়ে আমার সংশয় রয়েছে। কেননা, খামারে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ডিমের বাইরেও বাসাবাড়িতে যেসব হাঁস-মুরগি পালিত হয়, সেগুলো থেকে উৎপাদিত ডিম ওই হিসাবে হয়তো আসে না। যা হোক, ওই হিসাব নিয়ে বেহিসাবি কথা বলে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই।

মহিউদ্দিন খান মোহন

যে ডিম ছিল একসময় মহার্ঘ বস্তু, বাণিজ্যিক উৎপাদনের কারণে তা অনেকটাই সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। বালক বয়সে আমরা ডিমের হালি দেখেছি ছয় আনা-আট আনা। এই তো সেদিনের কথা। আশির দশকের গোড়ার দিকে এক হালি ডিমের দাম ছিল ছয় টাকা। তখন ঢাকার ফুটপাতে মুরগির একটি সেদ্ধ ডিম আড়াই টাকা এবং হাঁসের ডিম তিন টাকা দিয়ে কিনে খেতাম। এরপর ডিমের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দামও বাড়তে থাকে। সে সঙ্গে বাড়তে থাকে উৎপাদনও। ধীরে ধীরে দাম বাড়ায় তা মানুষের গায়ে খুব একটা লাগেনি। বাড়তে বাড়তে ডিমের হালি চার-পাঁচ বছর ধরে পঁচিশ-ত্রিশ টাকায় স্থির হয়েছিল।

 কিন্তু চলতি বছরের গোড়ার দিকে দাম বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে তা সপ্তাহ দুয়েক আগে ষাট টাকা হালিতে পৌঁছায়। হাঁসের ডিম সত্তর টাকায়। ডিমের দামের এই উল্লম্ফনে জনজীবনে সৃষ্টি হলো ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। কিন্তু কেউ এর কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এক লাফে ডিমের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, তা ভেবে আমাদের মতো মূর্খরা গলদঘর্ম হয়েছেন। মূল্যের হাইজাম্প ডিমকে তুলে আনল দোকানির খাঁচা থকে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে। টিভি টক শোতেও ঠাঁই করে নিল ডিম। সরব হলো সামাজিক-মাধ্যম।

দুষ্টলোকেরা কটাক্ষ করল, সম্ভবত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সৈনিকদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে অতিরিক্ত ডিম লাগছে। তাই ডিমের বাজারে আক্রা। তবে শেষ পর্যন্ত জানা গেল এসব কিছুই না। এর প্রধান কারণ সেই পুরোনো চরিত্র ‘সিন্ডিকেট’। মাঠে নামল অগতির গতি র‍্যাব। অভিযান চালানো হলো ডিমের আড়তে। জরিমানাও করা হলো। অমনি এক দিনেই ডিমের দাম হালিতে কমে গেল ১৫ টাকা। এখনো তা ৪০ টাকা হালিতে স্থির হয়ে আছে। এর নিচে নামবে কি না, কেউ বলতে পারছে না। কারণ, আমাদের দেশে কোনো কিছুর দাম একবার ওপরে উঠে গেলে সহজে আর নিচে নামে না। অনেকটা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলার মতো। একবার ক্ষমতার মসনদে বসতে পারলে, মানে ওপরে উঠতে পারলে আর নিচে নামতে চায় না। এমনকি একদিন তাদের নামতে হতে পারে, সেটাও ভুলে যায়।

আন্ডার এই আক্রার বাজারে যাঁরা ওই বস্তুটি কিনতে গেছেন, তাঁদের লিপ্ত হতে হয়েছিল এক ঠান্ডা লড়াইয়ে। সে লড়াই পকেটের সঙ্গে মনের। কোনো ক্ষেত্রে পকেট জিতেছে, কোনো ক্ষেত্রে মন। যাঁদের পকেট জিতেছে, তাঁরা ডিম কিনতে পেরেছেন, আর যাঁদের পকেট হেরেছে, তাঁরা এই ভেবে মনকে প্রবোধ দিয়েছেন, ‘ডিম না খেলে কী হয়? খেয়েছি তো জীবনে অনেক। খামোখা ব্লাড প্রেশার বাড়ানোর দরকার কী?’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত