Ajker Patrika

নজরদারি কতটুকু প্রয়োজন

সানজিদা সামরিন
আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮: ০১
Thumbnail image

ধরুন, আপনাকে ভাত খেতে দেওয়া হয়েছে। আপনি খাচ্ছেন। সুন্দর করে ইলিশ মাছের কাঁটা বেছে খাচ্ছেন। আতিথেয়তা যিনি করছেন, তিনি আপনার পাশের চেয়ারেই বসা। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, ‘কাঁটা বাছার জন্য বাঁ হাত ব্যবহারের দরকার নেই, এক হাতেই বাছতে হয়।’ আপনি একটু লজ্জা পেলেন, চেষ্টা করছেন এক হাতেই যেন কাঁটা বেছে খেতে পারেন।

কিছুক্ষণ পর পাশের জন বললেন, ‘এমনভাবে খেতে হয়, যাতে প্লেটের চারপাশ পরিচ্ছন্ন থাকে।’ আপনি দেখলেন, খেতে খেতে আপনার প্লেটের চারপাশে ডাল-ঝোল লেগেছে খানিকটা। আঙুল দিয়ে যতটা সম্ভব সরিয়ে আবার খাওয়া শুরু করলেন। এরপর কয়েক দফায় আবারও সতর্কবাণী, ‘ভাত মুখে দেওয়ার সময় টপ টপ করে ভাত যেন প্লেটে না পড়ে’, ‘ডালে চুমুক এমনভাবে দিতে হবে যেন শব্দ না হয়’, সবশেষে—‘পানি খাওয়ার সময় ঢকঢক শব্দ করবে না।’

এই হলো আপনার রাত্রিভোজের চিত্র। এখন যদি প্রশ্ন করি, খাবারটা কেমন ছিল বা রাত্রিভোজনের সময়টা কেমন ছিল? উত্তরটা কী হবে আপনার? উত্তর না দিলেও যা বুঝে নেওয়ার আছে তা হলো, খেতে যদি ১০ মিনিট লাগে তাহলে এই সময়ের মধ্য়ে প্রতিটা ধাপেই বিধিনিষেধ, নিয়মকানুন দেওয়া হয়েছে। এক হাতে কাঁটা বাছতে গিয়ে মাছের স্বাদ কেমন তা বুঝতে পারেননি, মনোযোগ ছিল হাতের আঙুলে।

মনোযোগ ছিল দাঁতে, গলায়, ঠোঁটে, প্লেটে; ডাল, পানি বা ঝোলে নয়। কারণ উদ্দেশ্য় ছিল সামনে ভাত বেড়ে দেওয়া ব্যক্তির মনমতো করে খাওয়া সম্পন্ন করা। নিজের ক্ষুধা মেটানো, তৃপ্তি করে খাওয়া নয়। ফলে এক চামচ বাড়তি ভাত লাগলেও আপনি নিতে পারেননি, ফের বিধিনিষেধের পাল্লায় পড়তে হয় এই কারণে। যত দূর বোঝা যায়, পিপাসা লাগলেও তাঁর সামনে আপনি পানি পান করবেন না ভবিষ্য়তে। যদি ফের ঢকঢক শব্দ হয়, যদি গ্লাসে চুমুক দেওয়ার পর ঠোঁটের ছাপ বসে যায়!

এতক্ষণ যে ঘটনার বর্ণনা দিলাম, এটা একটা সাধারণ উদাহরণ মাত্র। উদাহরণটা কে কীভাবে খেল সে বিষয়ে নয়; উদাহরণ নজরদারির। খেতে বসার সময় থেকে ওঠার আগ অবধি যদি কেউ আপনার দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন যে অস্বস্তিটা হয়, সেই অস্বস্তির কথা হচ্ছে।

এই নজরদারি সমাজ, সংসার, সন্তানের বেড়ে ওঠায় এবং কর্মক্ষেত্র—সবখানেই রয়েছে। বলা ভালো, প্রচণ্ড ভুলভাবে বিস্তার করছে, যা সম্পর্ক, কাজ বা জীবনের পথচলায় ‘বাধা’ বই আর কিছু নয়। আরেকটু অন্যভাবে বলা যায়। আশপাশে অনেক মা-বাবাকে দেখি, সন্তান বড় হয়ে গেছে, তবুও সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখেন। বিশ্ববিদ্য়ালয়পড়ুয়া ছেলে বা মেয়ের মা-বাবাও সারাক্ষণ তক্কে তক্কে আছেন—সন্তান কখন কার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে, ক্লাস শেষ হওয়ার পরপরই রিকশায় উঠে বাড়ি ফিরল নাকি দুই মিনিট চায়ের দোকানে দাঁড়াল? কী বই পড়ল, কী সিনেমা দেখল, আলমারির কোন ড্রয়ারে কী রাখল? সন্তানদের বন্ধুদের সঙ্গেও বেশ সূক্ষ্ম যোগাযোগ রাখছেন তাঁরা।

সারাক্ষণ একধরনের জবাবদিহির মধ্যে রাখতে হচ্ছে সন্তানকে। কিন্তু তাতে আসলে কী হচ্ছে? এভাবে নজরদারি করায় সন্তান সুপথে থাকবে, বিপদমুক্ত থাকবে, এককথায় সোজা থাকবে—ব্যাপারটা যেন অভিভাবকেরা এভাবেই ধরে নিয়েছেন। কিন্তু আসলে কী তাই?

ব্যক্তিগত অভিমত থেকে বলতে পারি, ‘এতে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব বাড়ছে। সহজ-স্বাভাবিক ব্যাপারও সন্তানেরা লুকিয়ে রাখছে তাঁদের থেকে। কারণ জানলেই কিনা কী বিপত্তিতে পড়তে হয়। হতে পারে অপ্রয়োজনীয় শাস্তিও!’ আবার গুড প্যারেন্টিং বলতে যা বোঝায় তা-ও যে কাছ থেকে দেখিনি তা নয়। কীভাবে সন্তানকে ছেড়ে দিয়েও আগলে রাখা যায়। যেখানে বন্ধুত্ব ও সম্মান পাশাপাশি থাকে। অন্যান্য সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একই কথা। সম্মানের দেয়াল থাকলেই সম্পর্কের মান অটুট থাকে, অন্যথায় কেবল দূরত্ব বাড়ে। যার ফাঁকফোকরে ঢুকে পড়ে নেগেটিভ এনার্জি। কর্মপরিবেশের ক্ষেত্রেও ওই একই কথা।

অতিরিক্ত নজরদারি কর্মীদের কাজের মানের ব্যাঘাত ঘটায়। তখন কাজের পরিবর্তে মনোযোগ বেশি থাকে নিজেকে ঝামেলামুক্ত রাখার ক্ষেত্রে। ব্যাপারটা অনেকটা পুলসিরাত পার হওয়ার মতো। চুলের মতো সরু এক সুতোর ওপর দিয়ে পথটা পার হওয়ার পালা যেন। ডানে বেহেশত আর বাঁয়ে পড়লেই দোজখের আগুন। কিন্তু পথটা কত সুন্দর বা সফলভাবে পার হওয়া গেল, সেটা যেন কিছুই না!

সবগুলোরই একটাই সমাধান বোধ হয়—সব সময় তক্কে তক্কে না থেকে বা ভুল ধরার জন্য ওত পেতে না থেকে সুন্দর ‘বোধ’ তৈরি করে দেওয়া। সুন্দর জীবন বিধান যাকে বলে, এটিকেট বা নৈতিকতা যাকে বলে। কারণ একজন পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে নজরদারিতে রেখে লাভ নেই বিশেষ; বরং দিন শেষে কোনো মানুষের কর্মটাই তো আসল। ক্ষেত্র অনুযায়ী সেটুকুই নিয়েই কথা হোক না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভুল ধরা বা ভুলের দণ্ড দেওয়া বা তাকে প্রায় নগ্ন করে ফেলা কি খুব জরুরি?

লেখক: সহসম্পাদক,আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত