Ajker Patrika

কোরবানির ঈদ: তাৎপর্য ও শিক্ষা

ড. এ এন এম মাসউদুর রহমান
আপডেট : ০৮ জুলাই ২০২২, ১০: ৫৪
কোরবানির ঈদ: তাৎপর্য ও শিক্ষা

ঈদুল আজহা মুসলিম মিল্লাতের দ্বিতীয় প্রধান উৎসব। ঈদ অর্থ খুশি আর আজহা অর্থ কোরবানি করা। তাই ঈদুল আজহা অর্থ কোরবানি করার খুশি। পরিভাষায়—বিশ্বমুসলিম পরম ত্যাগের নিদর্শনস্বরূপ জিলহজ মাসের ১০ তারিখে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে মহাসমারোহে পশু জবাই করার মাধ্যমে যে আনন্দ-উৎসব পালন করে, তা-ই ঈদুল আজহা। মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর সেখানকার লোকজন আরজ করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমরা ইসলাম-পূর্ব যুগে নববর্ষ উপলক্ষে ‘নওরোজ’ ও বসন্তের বরণ উপলক্ষে ‘মেহেরজান’ উৎসব করতাম। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর তা আর করতে পারি না। তখন মহানবী (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা আদায় করার মাধ্যমে আনন্দ-উৎসব পালনের জন্য মুসলমানদের নির্দেশ দেন। ঈদুল ফিতর রমজান শেষে শাওয়াল মাসের ১ তারিখে এবং ঈদুল আজহা জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পালিত হয়।

আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কোরবানি করা ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত। ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করার মতো যে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা পালনার্থে মুসলিমরা আজও কোরবানি করে থাকে। সুরা সাফফাতের ১০২-১০৯ নম্বর আয়াতে সেই কাহিনি বিবৃত হয়েছে। ইবরাহিম (আ.) বলেছিলেন, ‘হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমি তোমাকে জবাই করছি; অতএব, দেখো তোমার কী অভিমত।’ ইসমাইল (আ.) বলেছিলেন, ‘আব্বা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা-ই করুন। আমাকে ইনশা আল্লাহ আপনি অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ আল্লাহ বলেন, এরপর তারা উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করল এবং সে তাকে কাত করে শুইয়ে দিল। তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, ‘হে ইবরাহিম; তুমি তো স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছ। নিশ্চয় আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি এক মহান জবাইয়ের বিনিময়ে তাকে মুক্ত করলাম। আর তার জন্য আমি পরবর্তীদের মধ্যে সুখ্যাতি রেখে দিয়েছি। ইবরাহিমের প্রতি সালাম।’ তাই তো ১০ জিলহজ ফজরের নামাজের পর আল্লাহর কাছে ঈদুল আজহা ও কোরবানি করার চেয়ে প্রিয় কোনো ইবাদত নেই।

আদম (আ.)-এর যুগ থেকে শুরু করে সব নবী-রাসুলের যুগেই বিভিন্নভাবে কোরবানির বিধান ছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রতিটি জাতির জন্য আমি কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি; যাতে তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে, যেসব জন্তু তিনি রিজিক হিসেবে দিয়েছেন তার ওপর। তোমাদের ইলাহ্ তো এক ইলাহ্; অতএব তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণ করো; আর অনুগতদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা হজ: ৩৪)।

কোরবানি প্রতিবছর আসে এবং চলে যায়, কিন্তু এটি যে শিক্ষা ও আদর্শ রেখে যায় তা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোরবানির মূল শিক্ষাই হলো, হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আদর্শ ধারণ করা। কারণ তিনি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আবেগ, অনুভূতি, প্রেম-ভালোবাসা ও ঐকান্তিকতা নিয়ে কোরবানি করেছিলেন। কেবল গোশত ও রক্তের নাম কোরবানি নয়; বরং আল্লাহর পথে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার এক দৃপ্ত শপথের নাম কোরবানি। প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তি পশুর গলায় ছুরি চালায় না; বরং সে ছুরি চালায় মানব কুপ্রবৃত্তির গলায়; যা সম্পন্ন করলেই মানুষ প্রকৃত মানুষে পরিণত হয়। এটিই কোরবানির মূল নিয়ামক। এই অনুভূতি ব্যতীত কোরবানি করা কেবল গোশত খাওয়ার নামান্তর। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর কাছে কোরবানির পশুর গোশত, রক্ত কিছুই পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তোমাদের আল্লাহভীতি।’ (সুরা হাজ: ৩৭) যে কোরবানির মধ্যে লৌকিকতা আছে, সেই কোরবানির কোনো মূল্য নেই। কারণ আল্লাহভীরুদের কোরবানিই কেবল গ্রহণীয়। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ কেবল মুত্তাকিদের থেকে তা গ্রহণ করেন।’ (সুরা মায়িদা: ২৭)

কোরবানি পিতা-পুত্রের সম্পর্ক শিক্ষা দেয়। ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্রের মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক তা বর্তমান সমাজে অতি বিরল। তিনি পুত্রকে যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা জীবননাশকারী জেনেও পুত্র তাতে সম্মত হয়েছিলেন। পুত্র জানেন, পিতা তার অমঙ্গল চাইবেন না এবং পিতাও জানেন, পুত্র তাঁর কথায় সম্মত হবেন। এ কারণেই আল্লাহ কোরবানি করা প্রতিবছর আমাদের জন্য ওয়াজিব করেছেন। আমাদের উচিত, বাধ্যানুগত সন্তান তৈরি করা। যারা পরিবার, দেশ ও সমাজের কল্যাণের পাশাপাশি মুগ্ধ আচরণে সবাইকে আকৃষ্ট করবে।

কোরবানি ব্যক্তির অহংকার দূর করে। ব্যক্তি অনেক টাকায় পশু কিনে ভাবতে থাকে, আমার পশুই সেরা। তার মনে অহংকার সৃষ্টি হয়। কিন্তু কোরবানি করার মাধ্যমে এত দামি পশুও বিলীন হয়ে যায়। ফলে ব্যক্তির অহংকার দূর হয়। কোরবানি ব্যক্তির পশুত্ব দূর করে। জবাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে পশুর সব পাশবিক আচরণ যেমন নিমেষেই শেষ হয়ে যায়, তেমনি মানুষের মধ্যকার রাগ-ক্রোধ মৃত্যুর মাধ্যমে বিলীন হয়ে যায় এবং তার পশুত্বও শেষ হয়ে যায়।

কোরবানি মানুষকে সহমর্মী করে তোলে। কোরবানির গোশত কেবল কোরবানিদাতাই খাবে না; বরং তা তিনটি ভাগ করে এক ভাগ নিজের, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনের এবং আরেক ভাগ গরিব-মিসকিনের। যখন ব্যক্তি অন্যকে গোশত দেবে, তখন তার অন্তর অন্যের জন্য কোমল হয়ে ওঠে।

ঈদুল আজহার তাৎপর্য ও গুরুত্বের প্রতি লক্ষ করে কোরবানির শিক্ষাগুলো জীবনে বাস্তবায়ন করা আমাদের একান্ত কর্তব্য।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত