Ajker Patrika

শ্রেণিসংগ্রামেই শ্রেণি সমতা সম্ভব

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
শ্রেণিসংগ্রামেই শ্রেণি সমতা সম্ভব

এক শ পাঁচ বছর আগে রুশ দেশে একটা বিপ্লব ঘটেছিল, কিন্তু সেটা কেবল সেই দেশের ব্যাপার ছিল না, ব্যাপার ছিল সারা বিশ্বের। সেটি ছিল এমন একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লব, যা বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। এই বিপ্লব মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আগেও হয়েছে, দার্শনিক ও লেখকেরা স্বপ্ন দেখেছেন, ১৭৮৯ সালে ফরাসি দেশে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছিল। আওয়াজটা ছিল স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর। স্বাধীনতা এসেছিল কেবল ধনীদের জন্য, ফলে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

৮১ বছর পরে ওই ফরাসি দেশেরই রাজধানীতে, প্যারিসে আরেকটি বিপ্লব হয়, সেই বিপ্লবে সাম্য অর্জিত হয়েছিল। নেতৃত্ব ছিল মেহনতি মানুষদের। সেখানে গৃহযুদ্ধ হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে। সাম্যব্যবস্থা টিকে ছিল ৭২ দিন, তারপর টিকে থাকতে পারেনি। ৪৫ বছর পরে, ১৯১৭ সালে আগের সব প্রচেষ্টার অভিজ্ঞতা থেকে সারবস্তু এবং রুশ দেশের সমাজ ও অর্থনীতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত বিপ্লব ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকে ছিল ৭২ বছর।

সেখানে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলো। ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় এল সামাজিক মালিকানা এবং দেশটি বলতে পারল—আমাদের এখানে একটি মানুষও অভুক্ত নেই, কেউ নিরক্ষর নয়, বাস্তুহারা নয়, গণিকাবৃত্তির নাম-নিশানা নেই। তারপর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছে পূর্ব ইউরোপে, চীনে, কিউবা ও ভিয়েতনামে। বিশ্বের 
এক-তৃতীয়াংশ মানুষ শোষণ থেকে মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল সমাজতন্ত্রের মধ্য দিয়ে। উন্নতি ঘটেছিল অভূতপূর্ব।

প্রশ্ন ওঠে, সমাজতন্ত্র যদি এতই ভালো হবে তবে তার পতন হলো কেন? সমাজতন্ত্রের পতন হয়নি, সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের পতন হয়েছে। তারা পুঁজিবাদে ফেরত গেছে। কারণ, বাইরে থেকে বিশ্ব পুঁজিবাদ ছলে-বলে-কৌশলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে দিতে চেয়েছে। নিজেদের দেশে মেহনতি মানুষকে তারা কিছু কিছু ছাড় দিয়েছে, সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে। আর ওই রাষ্ট্রগুলোর ভেতরেও আমলাতান্ত্রিক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, যারা অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালিয়েছে। বাইরের আক্রমণ ও ভেতরের অন্তর্ঘাত, এই দুইয়ে মিলে রাষ্ট্রগুলোকে সমাজতন্ত্র থেকে সরিয়ে দিয়েছে।

সমাজতন্ত্র পরিত্যাগ করে ওই রাষ্ট্রগুলোর মানবিক চেহারা বদলে গেছে। বৈষম্য ও দুর্নীতি দেখা দিয়েছে। রাশিয়ায় নতুনভাবে জারতন্ত্র ফেরত এসেছে। সেখানে মেয়েরা বাধ্য হয়েছে দেহ বিক্রি করতে। চীন এখন মিয়ানমারের গণহত্যাকে পর্যন্ত সমর্থন দিচ্ছে। সমাজতন্ত্রের নয়, পতন ঘটবে পুঁজিবাদের। তার পতন ঘটবে ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক কারণে। মানুষের সভ্যতার বিবর্তন হয়েছে। সে আরও এগোবে। একসময় ছিল দাসব্যবস্থা, পরে এসেছে সামন্তব্যবস্থা, তারপর এল পুঁজিবাদীব্যবস্থা। পুঁজিবাদ ইতিহাসের শেষ কথা হতে পারে না, হবে না। তার পতন ঐতিহাসিকভাবেই অনিবার্য।

দাসব্যবস্থা, সামন্তব্যবস্থা ও পুঁজিবাদ—এই তিনের ভেতর মস্ত মস্ত পার্থক্য; কিন্তু ঐক্য আছে এক জায়গায়, সেটা হলো ব্যক্তিমালিকানা। এই তিন ব্যবস্থাই ব্যক্তিমালিকানাকেন্দ্রিক। ব্যক্তিমালিকানায় শতকরা ৫ জন সম্পদের মালিক হয়েছে ৯৫ জনকে শোষণ ও বঞ্চিত করে। অথচ সম্পদ সৃষ্টি করেছে ওই ৯৫ জনই। ব্যক্তিমালিকানার শেষ অবস্থা পুঁজিবাদ। ব্যক্তিমালিকানায় কুলাবে না। একদিকে দেখা দিয়েছে অভ্যন্তরীণ নানা রকমের দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ। অন্যদিকে প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে ৯৫ জনের বিক্ষোভ। ফলে পুঁজিবাদ এখন বেসামাল ও বেপরোয়া।

পুঁজিবাদ মুনাফানির্ভর; অনবরত সে মুনাফা খোঁজে। মুনাফা ছাড়া আর কিছু চেনে না। মুনাফার লালসায় সে মানুষ মারে, প্রকৃতিকে ধ্বংস করে। যুদ্ধ বাধায়, মারণাস্ত্র তৈরি করে, মাদকের কারখানা বসায়। নিজেকে রক্ষা করার জন্য সব চেষ্টা শেষ করে দিয়ে এখন সে চরম ফ্যাসিবাদী রূপ নিয়েছে। পুঁজিবাদ যে কতটা বর্বর, অমানবিক ও বেপরোয়া হতে পারে, তা দুটি বিশ্বযুদ্ধে দেখা গেছে। দেখা যাচ্ছে মিয়ানমারে; যেখানে দেশের সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘু একটি জনগোষ্ঠীকে গণহত্যার মধ্য দিয়ে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেবে বলে ঠিক করেছে এবং নিপীড়নের নিকৃষ্টতম যে হাতিয়ার দলবদ্ধ ধর্ষণ, সেটাকে প্রয়োগ করছে। এই বর্বরতা পুঁজিবাদের। নানা রূপে ও ছদ্মবেশে এর দৌরাত্ম্য এখন পৃথিবীময় চলছে।

বাংলাদেশেও এখন দলবদ্ধ ধর্ষণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারেরা ওই কাজ করত, তারা ছিল শত্রু, নেমেছিল গণহত্যায়। এখন বাঙালি পুরুষ অত্যাচার করছে বাঙালি নারীর ওপর। কেবল নারীর ওপর নয়, কন্যাশিশুর ওপরও। যে কাজ হানাদারেরাও করে, বাঙালি পুরুষেরা তা করছে। অবিশ্বাস্য, কিন্তু সত্য। ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াল? মুক্তির জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি, প্রাণ দিয়েছি। পরিণাম কি এই? এই পরিণাম ঘটত না, যদি দেশে একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটত। ঘটেনি। উনসত্তরে জন-অভ্যুত্থান ঘটেছিল, সেটি ছিল পুঁজিবাদবিরোধী। কিন্তু সেই অভ্যুত্থানের যে লক্ষ্য, সেটি অর্জিত হয়নি। রাষ্ট্র ও সমাজ রয়ে গেছে আগের মতোই। উন্নতি যা হয়েছে তা পুঁজিবাদী ধরনের। পুঁজিবাদী উন্নতির পরিণাম এ রকমই হওয়ার কথা। সমস্যাটা কেবল আইনের শাসনের অনুপস্থিতির নয়, কথিত নৈতিক অধঃপতনেও এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। এসব হচ্ছে রোগের লক্ষণ, রোগ নয়। রোগটা রয়েছে গভীরে, সে হচ্ছে পুঁজিবাদ।

সর্বত্র আজ দেখছি মৃত্যু। গুম হচ্ছে মানুষ, অপহৃত হচ্ছে। ঘটছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। সড়কগুলো পরিণত হয়েছে মৃত্যুকূপে। ঢাকা শহর পরিণত হয়েছে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শহরগুলোর একটিতে। উন্নতি হচ্ছে। যত উন্নতি, ততই বৃদ্ধি বৈষম্যের। শোনা যাচ্ছে আর্তনাদ। একটি দৃষ্টান্ত দিই। ১৯৪৩ সালে বাংলায় ভয়াবহ একটি দুর্ভিক্ষ ঘটে। তাকে পঞ্চাশের মন্বন্তর বলা হয়। ৩০ লাখ মানুষ তাতে প্রাণ হারায়। তখন অভাবের তাড়নায় আমাদের গ্রামে একজন মানুষ আত্মহত্যা করেন। বেকার ছিলেন। সহায়তা দেওয়ার মতো অবস্থা কারও ছিল না। আমগাছের ডালে নিজেকে ঝুলিয়ে দিয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। ঝুলন্ত মানুষটিকে অনেকেই দেখেছেন। আমার বয়স তখন সাত। আমিও দেখেছি। সে দৃশ্য অনেক সময় আমাকে ভয় দেখিয়েছে। ৭৩ বছর পরে ওই গ্রামেই আরেকটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এবার একজন নয়, এক পরিবারের তিনজন আত্মহত্যা করেছেন। বাবা, মা ও মেয়ে, তিনজন মিলে বিষ খেয়েছেন। কারণ ওই একই। অভাব। পিতা ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন, মাছের। সংসার চলত না। ক্ষুদ্রঋণ নিয়েছিলেন। শোধ করতে পারছিলেন না। পরিবারের তিনজন মিলে তাই আত্মহত্যা করলেন, মরে গিয়ে বাঁচতে চাইলেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীতাহলে? ৭০ বছর পার হলো, আমরা দুই-দুইবার স্বাধীন হলাম, উন্নতির দৃশ্য ও আওয়াজ চতুর্দিকে দেখছি এবং শুনছি, তার ভেতরে এই মৃত্যু কেন? মৃত্যুর কারণ পুঁজিবাদী উন্নতি। পৃথিবীতে একসময় ডাইনোসর নামে অতিকায় এক প্রাণী ছিল। হাজার হাজার বছর টিকেছে। তারপর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কারণ পরিবর্তিত পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে তারা নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারেনি। বুদ্ধি ছিল না, হাত ছিল না, হাতিয়ারের ব্যবহার জানত না। একইভাবে পুঁজিবাদও বিদায় হবে। তার বুদ্ধি আছে, হাত আছে, হাতিয়ার আছে, কিন্তু বিবেক নেই, উল্টোদিকে তার আছে অপরিমেয় লোভ ও লালসা। মানবসভ্যতার জন্য এবং তার নিজের জন্য যে মহাসংকট সে সৃষ্টি করেছে, সেটি থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না। পরিবর্তন আসবে। কোনো এক দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে। মুক্তিকামী মানুষের দায়িত্ব সেই অপরিহার্য ও অনিবার্য পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করা।

পরিবর্তনের পথপ্রদর্শক অক্টোবর বিপ্লবের প্রতীক কাস্তে-হাতুড়ি। কাস্তে-হাতুড়ি বোমা নয়, কামান নয়। কাউকে তারা ভয় দেখায় না, কিন্তু জানিয়ে দেয় এ কথা যে পৃথিবীর সব উন্নতির পেছনে আছে মানুষের শ্রম, রয়েছে ওই কাস্তে ও হাতুড়ি। অক্টোবর বিপ্লব বলেছে, শ্রমজীবীরা জয়ী হবেই হবে। মৃত্যু পরাজিত হবে জীবনের কাছে। অক্টোবর বিপ্লবে আপসের কোনো জায়গা ছিল না এবং ছিল সমাজবিপ্লবীদের ঐক্য ও তাঁদের জ্ঞানের প্রয়োগ। বিপ্লবের ক্ষেত্রে আপসের জায়গা নেই, সমাজবিপ্লবীদের ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই এবং জ্ঞানের সৃষ্টিশীল প্রয়োগ ছাড়া মুক্তি নেই।

সংস্কার আর বিপ্লব এক জিনিস নয়। বিপ্লব হচ্ছে আমূল পরিবর্তন। পরিবর্তন সমাজে, রাষ্ট্রে। অক্টোবর বিপ্লবের নায়ক লেনিন সে কথাটিই বলেছিলেন। বলেছিলেন, ক্ষমতা চলে যাবে সোভিয়েতের কাছে, অর্থাৎ পরিষদগুলোর কাছে। ১৯০৫-এর অভ্যুত্থানের পরে ওই পরিষদগুলো গঠিত হয়েছিল, তারা ছিল জারতন্ত্রবিরোধী। লেনিন বলেছিলেন, পুরোনো বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে অক্ষত রেখে বিপ্লব সম্পূর্ণ হবে না। সে রাষ্ট্রকে চূর্ণবিচূর্ণ করতে হবে।

আর এটা যেন না ভুলি যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চালিকা শক্তি হচ্ছে শ্রেণিসংগ্রাম। শ্রেণি বিভাজন ও শোষণ থাকলে শ্রেণিসংগ্রাম থাকবেই। শ্রেণিসংগ্রামের ভেতর দিয়েই শ্রেণিবৈষম্য দূর হবে, অর্জিত হবে সাম্য এবং প্রতিষ্ঠিত হবে সম্পদের সমবণ্টন। অক্টোবর বিপ্লবের ডাক এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠারই ডাক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত