Ajker Patrika

অ্যাসিডে বিপর্যস্ত পরিবেশ

মেহেরাব্বিন সানভী, চুয়াডাঙ্গা
আপডেট : ২৫ মে ২০২২, ১৭: ২৯
Thumbnail image

চুয়াডাঙ্গায় গয়না তৈরির শতাধিক দোকান থেকে নিঃসৃত অ্যাসিডের ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ। এ ছাড়া এসব দোকানে ৭ থেকে ৮ জন কারিগর গাদাগাদি করে অ্যাসিড নিয়ে কাজ করায় খোদ তাঁরাই রয়েছেন চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। অসচেতন কারখানার মালিকেরাও তোয়াক্কা করছেন না অ্যাসিড ব্যবহারের বিধি-নিষেধ।

অনিয়ন্ত্রিতভাবে অ্যাসিড ব্যবহারে দোকানগুলো থেকে দিন-রাত নির্গত হচ্ছে অ্যাসিডের বিষাক্ত ধোঁয়া। নাইট্রিক অ্যাসিড ও সালফিউরিক অ্যাসিড থেকে নিঃসৃত ধোঁয়া স্বল্প উচ্চতার পাইপ দিয়ে বের হয়ে মিশে যাচ্ছে বাতাসে, প্রবেশ করছে পথচারীসহ আশপাশের ভবন, ব্যাংক বিমা, অফিসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে।

চুয়াডাঙ্গা শহরের নিউ মার্কেট এলাকা থেকে হাসান চত্বর হয়ে ভি জে স্কুল পর্যন্ত চলাচলকারী প্রত্যেক পথচারীকেই অ্যাসিডের বিষাক্ত ধোঁয়া নিশ্বাসের সঙ্গে নিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে শ্বাসকষ্ট, হৃদ্‌রোগ, চর্ম ও চক্ষু রোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তাঁরা। অ্যাসিডের বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসে মিশে যাওয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আগের মতো এখন আর চোখে পড়ে না শত শত শালিকের ঝাঁক।

জেলার স্বর্ণপট্টি মূলত ভি জে স্কুলের সামনে থেকে নিউ মার্কেট এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এ এলাকার বিভিন্ন অলি-গলি, বাড়ির ছাদ, সিঁড়ির নিচে, টয়লেটের পাশে গাদাগাদি করে গড়ে উঠেছে শতাধিক গয়নার দোকান। এর মধ্যে মাত্র ৫ দোকানে অ্যাসিড ব্যবহারের লাইসেন্স আছে। জেলায় স্থানীয়ভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান অ্যাসিড বিক্রি করে না। তবে শহরসহ আশপাশের এলাকাতে ১৫ থেকে ২০টি ব্যাটারি বিক্রির দোকান রয়েছে। এসব দোকান মালিকেরা জানান, তাঁরা খোলা অবস্থায় অ্যাসিড বিক্রি করেন না। ব্যাটারিতে যেভাবে থাকে, তাঁরা সেভাবেই বিক্রি করেন। আর স্বর্ণের দোকান মালিকেরা জানান, তাঁদের অ্যাসিডের প্রয়োজন হলে যশোর থেকে দিয়ে যান। ফোন দিলেই পৌঁছে যায় অ্যাসিড। তাতে কতটুকু অ্যাসিড কে কিনল, আর কতটুকু কে ব্যবহার করল, এরও হিসেব নেই কারও কাছে।

এদিকে, এসব কারখানায় কারিগর ও সহকারী মিলে প্রায় ৮ শতাধিক কর্মী কাজ করছেন। এসব কর্মীদের বিষাক্ত অ্যাসিড নিয়ে কাজ করতে হয় প্রতিদিন। নাইট্রিক অ্যাসিড দিয়ে সোনা খাঁটি করার সময় যে ধোঁয়া বের হয়, তা বাতাসের সঙ্গে মিশে অম্লীয় বাষ্পে রূপ নেয়। পরে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডযুক্ত ওই বাতাস শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এতে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, হৃদরোগসহ নানা রকম রোগ সৃষ্টি হয়। জানা গেছে, সোনার গয়না তৈরিতে মূলত দুই ধরনের অ্যাসিড ব্যবহার করা হয়। একটি নাইট্রিক অ্যাসিড অপরটি সালফিউরিক অ্যাসিড। নাইট্রিক অ্যাসিড সোনাকে পুড়িয়ে খাদ বের করা হয়। আর তৈরি গয়নার সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা হয় সালফিউরিক অ্যাসিড।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কারিগর বলেন, ‘বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতার জন্য চিকিৎসকের কাছে গেলে বিষাক্ত অ্যাসিড নাড়াচাড়ার বিষয়ে বললে তখন চিকিৎসকরাও বিরক্ত হন।’

চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘স্বর্ণের কারিগররা যে অ্যাসিড ব্যবহার করেন, সেটাকে বলা হয় রাজ অম্ল। নাইট্রিক ও হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ১: ৩ এর মিশ্রণ। যা সোনা ও প্লাটিনামকে গলিয়ে দেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘যে অ্যাসিড স্বর্ণকে গলিয়ে দেয়, তার ধোঁয়া পরিবেশের চরম ক্ষতি করে, এর থেকে যে কালো ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়, তার থেকে গাড় পদার্থ নির্গত হয়। অ্যাসিড বৃষ্টি হয়। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরের ভেতর প্রবেশ করলে শ্বাসযন্ত্র ইনফেকশন হয়। শরীরের অভ্যন্তরে নরম যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো আছে, সেখানে আক্রমণ করে।’

চুয়াডাঙ্গা জেলা জুয়েলারি মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল হাসান জোয়ার্দ্দার টোকন জানান, বিষয়টি নিয়ে তাঁরাও চিন্তিত। তিনি বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গায় স্বর্ণের দোকানগুলোর পরিবেশগত বেশ কিছু সমস্যা আছে। আর এসব সমস্যার কারণে এই সেক্টরসহ আশপাশের পরিবেশেরও চরম ক্ষতি হচ্ছে।’

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান বলেন, ‘অ্যাসিডের ধোঁয়া মানবদেহের জন্য চরম ক্ষতিকর। স্বর্ণের দোকানে ব্যবহৃত অ্যাসিডের ধোঁয়া নির্গমনের জন্য যে পাইপ দেওয়ার কথা, সেগুলো আছে কি না। তা ছাড়াও সেখানে শিশুশ্রমসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। পরিদর্শন করে নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত