Ajker Patrika

হজের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত

ড. মো. আবদুল কাদির
আপডেট : ১৭ জুন ২০২২, ১২: ৩৮
হজের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত

হজ ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। হজের আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা, অভিপ্রায়, কোনো গন্তব্যের দিকে যাত্রা করা, কোনো কাজ বারবার করা ইত্যাদি। ইসলামের পরিভাষায়—তাওয়াফ, সায়ি, ওকুফে আরাফাতসহ আবশ্যকীয় বিধানাবলি পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নির্ধারিত সময়ে পবিত্র মক্কায় গমন করাকে হজ বলা হয়। ইসলামের মৌলিক বিধান নামাজ ও রোজা আদায়ের জন্য দৈহিক শক্তি ও সক্ষমতা প্রয়োজন। জাকাত আদায়ের জন্য প্রয়োজন আর্থিক সামর্থ্য। আর হজ এই দুই ধরনের ইবাদতের সম্মিলন। হজ আদায় আবশ্যক হওয়ার জন্য প্রয়োজন দৈহিক ও আর্থিক উভয় ধরনের সামর্থ্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং সামর্থ্যবান মানুষের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাবাঘরের হজ করা ফরজ।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)

অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ ও ওমরাহ আদায় করো।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৬)

হজের মৌসুমে পবিত্র মক্কানগরীতে যাওয়া-আসা এবং ওই সময়ে পরিবারের ব্যয়ভার বহনে সক্ষম হলে এবং দৈহিক সক্ষমতা থাকলে জীবনে একবার হজ করা ফরজ। ইসলামের অন্যান্য ফরজ বিধানের মতো এ ক্ষেত্রেও মুসলমান হওয়া, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া, সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া এবং স্বাধীন হওয়া হজ ফরজ হওয়ার পূর্বশর্ত। ইসলামের পবিত্রতম স্থান কাবাঘরকে কেন্দ্র করেই হজের বিধানাবলি প্রবর্তিত হয়। মানবজাতির কল্যাণ, বরকত ও ইবাদতের জন্য পৃথিবীতে সর্বপ্রথম এ ঘর নির্মাণ করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম পবিত্র মক্কা নগরীতে একটি ঘর তৈরি করা হয়েছিল, যা অতিশয় বরকতময় এবং জগৎবাসীর জন্য পথ প্রদর্শক।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৬)

ইসলামের ফরজ বিধানগুলোর মধ্যে হজের বিশেষ ফজিলত ও তাৎপর্য রয়েছে। একজন হাজি তাঁর দীর্ঘদিনের সঞ্চিত সম্পদ খরচ করে প্রাণপ্রিয় স্ত্রী-পুত্র, পরিবার-পরিজন, মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন সবাইকে ছেড়ে দূর আরব দেশে সফর করেন। গাড়ি-বাড়ি, কাজ-কারবার, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ পার্থিব সব ব্যস্ততা পেছনে ফেলে পাগলপারা হয়ে ছুটে যান পবিত্র মক্কা নগরীতে। আল্লাহর ঘর জিয়ারতের মাধ্যমে তিনি আল্লাহর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন। উদ্‌ভ্রান্তের মতো কাবা চত্বরে তাওয়াফ এবং সাফা-মারওয়ায় দৌড়াদৌড়ি করেন। জান্নাতি পাথর হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করে গুনাহের ক্ষমা করিয়ে নেন আল্লাহর কাছে। ছুটে যান আরাফাত, মিনা ও মুজদালিফার ময়দানে। পশু কোরবানির সঙ্গে কোরবানি দেন মনের পশুত্বকেও। আরাফাতের ময়দানের বিশ্ব সম্মেলনে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আগত সব গোত্র-বর্ণের মানুষের যোগদান বিশ্বভ্রাতৃত্বকে শক্তিশালী করে। ইহরামের শুভ্র-নির্মল পোশাকের মিছিলে ঘুচে যায় সব বৈষম্য-ব্যবধান। মুসলিম জাতি পরিণত হয় এক দেহ, এক আত্মায়। হাজিদের মুখে মুখে তালবিয়ার শিহরণজাগানিয়া গুঞ্জরন মক্কার অলিগলিতে আল্লাহ প্রেমের উদ্বেল তরঙ্গ বয়ে দেয়। পরম করুণাময়ের দরবারে হাজির হওয়ার আকুলতা নিয়ে সমস্বরে উচ্চারিত হয়—‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল-মুলক, লা শারিকালাকা’ অর্থাৎ, ‘হাজির হে আল্লাহ। আমি হাজির। আমি হাজির। আপনার কোনো অংশীদার নেই। আমি হাজির। সকল প্রশংসা ও নেয়ামত আপনার; এবং রাজত্বও। আপনার কোনো অংশীদার নেই।’

অশ্রুসিক্ত নয়নে লাখো-কোটি প্রেমিক বান্দার আকুল করা ধ্বনি আকাশ-বাতাস মুখর করে আল্লাহর আরশে পৌঁছে যায়। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের ডাকে সাড়া দেন এবং তাদের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেন। হাদিসে এসেছে, মহানবী (সা.) বলেন, ‘আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দিন এত সংখ্যক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, যা অন্য কোনো দিন দেন না। এই দিনে আল্লাহ তাআলা কাছে আসেন এবং আরাফাতের ময়দানে অবস্থানরত হাজিদের নিয়ে ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করে বলেন—ওরা কী চায়?’ (মুসলিম) অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি শরিয়তবিরোধী কাজ, যৌনতাবিষয়ক কথা ও কাজ থেকে বিরত থেকে হজ আদায় করে, সে তার মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়ার দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে।’ (বুখারি) আরেক হাদিসে এসেছে, ‘হজে মাবরুর তথা যথাযথভাবে পালিত হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া অন্য কিছু নয়।’ (বুখারি)

জাগতিক জীবন সুন্দর করার ক্ষেত্রে হজের ভূমিকা অনন্য। হজের মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি অর্জন করে। মানুষের মনের দুষ্টু প্রবৃত্তি অবদমিত হয়। বল্গাহীন জীবনে লাগাম টানে হজ। বিলাসিতার সব উপকরণ থেকে হাজিদের দূরে থাকার নির্দেশনা রয়েছে, যা তাঁদের জীবনকে নতুনভাবে সাজানোর সুযোগ এনে দেয়। বিদ্যাবুদ্ধি, ধনসম্পদ, যশ-খ্যাতি, গাড়ি-বাড়ি ইত্যাদি সমাজে যে হিংসার জন্ম দেয়, যে বিভেদের প্রাচীর তুলে দেয়, তা ভেঙে দিতে শক্ত ভূমিকা রাখে হজ। হজ পালনের সময় রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্রের কোনো পার্থক্য থাকে না। অনাবৃত মস্তকে সাদা কাফনের কাপড় জড়িয়ে চপল পায়ে অতিসাধারণ বেশে লাখো মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইবাদত করার এ দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব-অনন্য। সব ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়ে অন্যকে উষ্ণ আলিঙ্গন করার এ দৃশ্য পৃথিবীর বুকে বেহেশতি সুবাস ছড়িয়ে দেয়। ছড়িয়ে দেয় সহিষ্ণুতা, সম্প্রীতি ও কল্যাণকামিতার বার্তা।

হজ শেষে যখন হাজিরা আল্লাহপ্রেম, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েন, তখন তাঁরা সোনার মানুষ হয়ে যান। শত্রুতা ভুলে সমাজে ছড়িয়ে দেন ভালোবাসার পয়গাম। সব ধরনের অন্যায়-অপরাধ থেকে মুক্ত হয়ে শুদ্ধ-সুন্দর জীবনযাপনের প্রয়াস চালান। ইসলামের বিধিবিধান ও পূর্ণ অনুশাসনে নিজেকে মানিয়ে নেন এবং পৃথিবী থেকে একজন নেককার বান্দা হিসেবে বিদায় নেওয়ার শপথ নেন। হজের তাৎপর্য ও সার্থকতা এখানেই। সুতরাং যে হজ লোকদেখানো, ধার্মিকতার আড়ালে অপরাধে জড়ানোর চিন্তায় দুষ্ট, যে হজ হাজিকে অন্যায়-অনৈতিক কাজ থেকে বিরত রাখে না, তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই হজ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হতে হবে এবং হজের শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনে বাস্তবায়নের সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। তবেই মহান আল্লাহ আমাদের হজ কবুল করবেন এবং জান্নাতে মহা পুরস্কারে ভূষিত করবেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

১০০ বছর পর জানা গেল, ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রত্যঙ্গটি নারীর প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ

‘এই টাকা দিয়ে কী হয়, আমি এত চাপ নিচ্ছি, লাখ পাঁচেক দিতে বলো’, ওসির অডিও ফাঁস

কিশোরগঞ্জে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল, যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের এপিএস মোয়াজ্জেমকে অব্যাহতি

পারভেজ হত্যায় অংশ নেয় ছাত্র, অছাত্র ও কিশোর গ্যাং সদস্য

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত