Ajker Patrika

একজন কামাল লোহানী

জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
Thumbnail image

এখন আর তেমন মানুষ খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না, যাঁদের কাছে গেলে মনে হয়, তাঁরা ছায়া দিচ্ছেন মাথার ওপরে; যাঁরা যেকোনো বিষয়েই কথা বলার মতো গভীরতা রাখেন। কামাল লোহানী ছিলেন তেমনই একজন মানুষ।

তিনি ছিলেন সাংবাদিক, ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ছিলেন রাজনীতির মানুষ। সে যুগে এতগুলো পরিচয়কে একসঙ্গে বহন করা যেত। এবং প্রতিটি পরিচয়ই আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পারত মানুষটিকে। প্রতিটি পরিচয় নিয়েই তিনি পূর্ণাঙ্গ মানুষ।

গত শতাব্দীর পঞ্চাশ আর ষাটের দশকটি আমাদের রাজনীতি-সংস্কৃতির জন্য ঘটনাবহুল। এ সময় আত্মপরিচয়ের সন্ধানে যে সংগ্রাম চলেছিল, তারই এক বিশিষ্ট অংশীদার ছিলেন তিনি। বিশেষ করে রবীন্দ্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার হয়েছিলেন, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনে যাঁরা বলিষ্ঠ অবদান রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কামাল লোহানী অন্যতম। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান বিষয়ে বিশিষ্ট রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল হক ও কামাল লোহানীর দ্বৈরথ মিটিয়ে দিয়েছিলেন আমার বাবা সিরাজুদ্দীন হোসেন। কামাল লোহানীর লেখাতেই সেই সময়টি ফুটে উঠেছে।

কামাল লোহানী, মানে আমাদের লোহানী কাকাকে ঘরের বাইরে পাজামা-পাঞ্জাবি ছাড়া আর অন্য কোনো পোশাকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। দীর্ঘদেহী মানুষটাকে এই পোশাক মানাতো ভালো। এ যুগে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ রকম নিরহংকার, সরল জীবনযাপন করা মানুষ কি খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায়?

একটি ঘটনা বার বার বলার লোভ সামলাতে পারি না। লোহানী কাকার মেয়ে ঊর্মীদি একবার বলেছিলেন, বাবাকে তিনি একবারই কেবল শার্ট-প্যান্ট পরতে দেখেছেন। সেটা এক নাটকে অভিনয় করার সময়। ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর হয়ে থিয়েটারের আবদুল্লাহ আল-মামুনের রচনা ও পরিচালনায় একটি নাটক হয়েছিল সত্তরের দশকে। সে নাটকের স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী কামাল লোহানী যে চরিত্রে অভিনয় করছেন, সে চরিত্রকে পরতে হবে প্যান্ট-শার্ট। তাতে ঘাবড়ে গেলেন তিনি। কখনোই তো আর শার্ট-প্যান্ট পরেননি। এখন উপায়। সমস্যার কথা বলা হলো প্রায় একই দৈহিক গঠনের তবিবুল ইসলাম বাবুকে। বাড়ি থেকে নিজের শার্ট আর প্যান্ট এনে দিলেন বাবু। সেই একবারই বুঝি শার্ট-প্যান্ট পরা!

আমার বাবা সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথিক, শেখ মুজিবের মতোই। শেখ মুজিবুর রহমান আর সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কামাল লোহানী সে পথের পথিক ছিলেন না। রাজনৈতিক পরিচয়ে তিনি ছিলেন বামপন্থী। ষাটের দশকের মাঝামাঝি বাম ধারার রাজনীতি মস্কো-পিকিংয়ে ভাগাভাগি হয়ে গেলে তিনি চীনপন্থীদের দিকে থাকলেন। অথচ রাজনীতি ও সাংবাদিকতা করতে গিয়ে ভিন্ন মেরুর বঙ্গবন্ধু বা সিরাজুদ্দীন হোসেনের স্নেহবঞ্চিত হননি। মানুষে-মানুষে সম্পর্কটা তখনো ‘তুমি কোন দলে’—এই হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে ছিল। কামাল লোহানী তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের মধ্যে রেখেছিলেন দেশের প্রতি ভালোবাসা ও দেশের মানুষের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য। এ কারণেই চৈনিক বামদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলেও তিনি বলিষ্ঠভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এ কারণেই তিনি যুক্ত হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে।

আমি আলাদা করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কামাল লোহানীর অবদান নিয়ে বলতে চাই। সে সময় বার্তা বিভাগের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন কামাল লোহানী। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগের অনুষ্ঠান কেমন ছিল, সে কথা বলতে পারবে সে সময় যাঁরা এই বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতেন, তাঁরা। আমরা এখনো অবাক হয়ে ভাবি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জনমত তৈরি করতে কী কর্মনিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন কামাল লোহানী। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বুলেটিনটি ভেসে এসেছিল কামাল লোহানীর কণ্ঠ থেকে। এ যে কত বড় অর্জন, তা মুক্ত দেশের মানুষ কতটা মনে রেখেছে?

এখনকার যুগে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার মতো মানুষ প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে। কামাল লোহানীর সেই মেরুদণ্ড ছিল। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকাকালে তাঁর সঙ্গে করা অন্যায়ের কথা আমরা জানি, রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গী হিসেবে কোর্ট-প্যান্ট পরবেন না বলায় তাঁকে সফরসঙ্গী না করার ঘটনাও জানি। এ ঘটনাগুলো বহু আলোচনায় এসেছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, অন্যায় আচরণকে তিনি থোড়াই কেয়ার করে নিজের জীবন যাপন করে গেছেন।

এ যুগের সাংবাদিকদের মতো আর্থিক সচ্ছলতা তাঁর ছিল না। কারও কাছ থেকে হাত পেতে নেওয়ার প্রবণতা তো ছিলই না। যতটুকু রোজগার করেছেন, তা দিয়ে খুবই হিসাব করে দিনযাপন করে গেছেন তিনি। নিজেকে কখনোই কোনো অন্যায়ের কাছে সঁপে দিয়েছেন, এমন কোনো ঘটনা তাঁর জীবনে আছে বলে আমার জানা নেই।

ফোনে যখন কথা হতো, প্রথমেই মুগ্ধ হতাম তাঁর কণ্ঠস্বরে। সেই ভরাট কণ্ঠে স্নেহ ঝরে পড়ত। পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে জীবিতকালে তাঁর জন্মদিন নিয়ে যখন লেখার জন্য তাঁর বাড়িতে গেছি, তখনো দেখেছি, বহু মানুষ তাঁর কাছে এসে বসে আছে নানা কাজে আর তিনি একের পর এক সমস্যার সমাধান করে চলেছেন।

আমাদের সংস্কৃতিকে বাঁচাতে না পারলে রাজনীতিও যে বাঁচবে না, সে কথাই যেন কামাল লোহানীর মূলমন্ত্র ছিল। তিনি তাই সাংস্কৃতিক উত্তরণের কথা ভাবতেন। ছায়ানট, উদীচী, ক্রান্তির মতো সংগঠনকে আপন করে নিয়ে তাঁর পথচলা প্রাণিত করেছে আমাদের সংস্কৃতিকে। 
আফসোস, কামাল লোহানীর মতো মানুষদের সেই প্রচেষ্টাগুলো উত্তরসূরিদের কাছে খুব কমই পৌঁছেছে। তবু যাঁরা এখনো সেই রাজনীতি-সংস্কৃতির মধ্যে ছন্দ খুঁজে পান, তাঁরা লোহানী কাকাকে মনে রাখেন। বোঝেন, উত্তরণের কথা ভাবলে কামাল লোহানীকে ছাড়া এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত