Ajker Patrika

পরিবেশদূষণে ভারতের পর বাংলাদেশ

মৃত্যুঞ্জয় রায়
পরিবেশদূষণে ভারতের পর বাংলাদেশ

একবার ডেনমার্কের অলবোর্গ শহর থেকে বাসে চেপে যাচ্ছিলাম প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার দূরের প্যারিস শহরে। মাত্র ১৬ ঘণ্টার ভ্রমণ পথ। তিন-চার ঘণ্টা পরই খিদে পেল। ব্যাগ থেকে সঙ্গে থাকা কিছু খাবার বের করে খেতে শুরু করলাম।

একটা কমলালেবুও খেলাম। খাওয়ার পর বিপত্তি বাধল, এসি বাস, জানালা-দরজা তো সব আটকা। খাওয়ার পর উচ্ছিষ্টগুলো ফেলব কোথায়? এদিক-সেদিক তাকাচ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়ল, সিটের পাশে একটা জিপার লাগানো ব্যাগ ঝোলানো। কী সুন্দর তার চেহারা। এত সুন্দর ব্যাগ কি ময়লা রাখার জন্য? ইতস্তত করছিলাম। আসলে প্রতিটি সিটের পাশে হাতলের সঙ্গে বিশেষ কায়দায় ঝোলানো ব্যাগগুলো কেন রাখা হয়েছে? একবার ব্যাগের দিকে তাকাচ্ছি, আর একবার জানালার দিকে। উড়োজাহাজে এয়ার হোস্টেস থাকে, বাসে সে রকম কেউ নেই যে তাকে ডেকে কথাটা জেনে নেব। আমাদের দেশের মতো না দেখলাম কোনো হেলপার, না পেলাম কোনো কন্ডাক্টর।

ড্রাইভারই অল ইন ওয়ান। ড্রাইভার সাহেবের সিটের কাছেই আমার সিট। আমার ইতিউতি ভাব দেখে শেষে তিনিই আঙুল তুলে বোবাদের মতো ইঙ্গিত করে বুঝিয়ে দিলেন, ওগুলো ফেলার জন্যই তো ব্যাগগুলো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অতএব ফেলো ওখানে, ব্যাগের মুখ আটকাও। তাই করলাম।

আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। একটা ছোট বাসে করে একদিন ডেনমার্কের অরহুস শহরে যাচ্ছিলাম, সঙ্গে ছিল নানা দেশের কয়েকজন। একটা গ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি। সঙ্গীদের একজন হঠাৎ জানালা খুলে কী যেন একটা ফেলে দিল। ক্রাচ করে ব্রেক কষে ড্রাইভার সাহেব বাস থামিয়ে দিলেন। তাঁকে বললেন, ‘নামুন, প্লিজ, ওগুলো তুলে আনুন, আমার কাছে দিন। আমি ওগুলো একটা ব্যাগে রেখে দেব। পরে ডাস্টবিনে ফেলব।’

কত ঘটনার কথা বলব! অন্য আরেক দিন কোপেনহেগেন শহরে সেন্ট্রাল রেলস্টেশন থেকে বাসে যেতাম ওয়াইল্ডার প্লাডে ডেনিশ ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান রাইটসে। কয়েক দিন ধরে রোজই সকালে সেখানে যাই। বাস থেকে নেমে কিছুটা পথ হেঁটে সেখানে যেতে হয়।

কিন্তু একদিন সকালে একটা দৃশ্য দেখে সেই ছবি মনের ক্যামেরায় চিরস্থায়ী হয়ে গেল। একজন ডেনিশ ভদ্রলোক একটা সুন্দর কুকুর নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ কুকুরটা ফুটপাতের ওপরেই মলত্যাগ করে দিল। ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা টিস্যু বের করে ফুটপাত থেকে তা তুলে টিস্যুতে মুড়ে আবার তা জ্যাকেটের পকেটে রেখে দিলেন, কুকুর নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলেন।

আমারও কৌতূহল হলো, দেখি না তিনি ওটা কী করেন? কিছু দূর যাওয়ার পর একটা পোস্টের গায়ে ঝোলানো বর্জ্যদানি দেখে তার ভেতর পকেট থেকে সেই সম্পদ বের করে ফেলে দিলেন। ফুটপাতের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, ও দেশের ফুটপাতও আমাদের ঘরের মেঝের চেয়ে কম পরিষ্কার না।দেশের কথা মনে উঠতেই মনের মধ্যে ভেসে উঠল, এসব ক্ষেত্রে আমরা কী করি বা কী করতাম, সেই সব মলিন ছবি। সঙ্গে পাশের দেশেরও কিছু ছবি।

একবার ভারতের কলকাতা থেকে রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেনে করে যাচ্ছিলাম দিল্লি। সারা রাত ট্রেন চলার পর যখন ভোর হলো, তখন জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছুটে চলেছে ট্রেন। মাঠে মাঠে হাঁস-মুরগির মতো ময়ূর হেঁটে বেড়াচ্ছে। আর সেসব মাঠে গ্রামের লোকেরা খোলা জায়গাতেই মলত্যাগ করতে বসেছে। সুন্দরের সঙ্গে আহা কী অসুন্দর দৃশ্য! একসময় আমাদের দেশেও এরূপ ছবি দেখা যেত, এখন নেই। তবে এখন আছে অন্য রকম দৃশ্য।

কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল থেকে বাবুবাজার ঘাটের দিকে আসতে ঘাটের কাছাকাছি বাজারটার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া খালটা যেন এক বিরাট ভাগাড়। রাজ্যের ময়লা আর আবর্জনা ফেলে খালকে ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে, কোনো জলই তাতে নেই। খাবার খেয়ে তার ময়লাগুলো নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় বা বর্জ্যদানিতে না ফেলে যেখানে-সেখানে এখনো ফেলতে আমরা অভ্যস্ত।

সিটি করপোরেশন যতই ডাস্টবিন বানাক, ওগুলো আমরা চিনিই না। এমনকি কাশি এলেও তার কফ ও নাক ঝেড়ে দিচ্ছি রাস্তার ধুলায়।কোনো রোগীর কফ থাকলে তা রাস্তায় শুকিয়ে যে তার জীবাণু বাতাসে মিশে আমার শরীরেরও ঢুকতে পারে, সংক্রমণ করতে পারে, তা কখনো অমাদের মাথায় আসে না। চারদিকে কেবল ময়লা-আবর্জনা, নোংরা দুর্গন্ধময় পরিবেশ। নাকের সামনে লক্কড়ঝক্কড় বাসগুলো ঘন কালো ধোঁয়া ভস ভস করে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

সঙ্গে যোগ হচ্ছে প্রায় চার হাজার ইটভাটার ধোঁয়া। পথপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর পাতার ওপরে প্রতিদিন কয়েক টন ধুলা জমা হচ্ছে। গত সপ্তাহে বাবুবাজার সেতুর নিচ দিয়ে নৌকায় বুড়িগঙ্গা সেতু পার হওয়ার সময় বুড়িগঙ্গার যে কাজল কালো জল দেখলাম আর ঝাঁজাল গন্ধ পেলাম, তাতে বমি আসার জোগাড়। টঙ্গীর তুরাগ এবং গাজীপুরের বিলগুলোও এখন কলকারখানার বর্জ্য ও রঙে একই রূপ ধারণ করেছে। এতেই যেন আমরা বসবাস করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, সহ্য হয়ে গেছে সবকিছু। কিন্তু এরূপ দূষিত পরিবেশ যে আমাদের কতটা সর্বনাশ করে চলেছে, সে ধারণা কি আমাদের আছে?

ঢাকায় থাকলে আমার চোখ জ্বালাপোড়া করে, শ্বাসের কষ্ট অনুভব করি। গত সপ্তাহে তিন দিন মাদারীপুর থেকে এলাম। অথচ সেখানে এরূপ কোনো সমস্যাই হয়নি। কুমার নদের পাড়ে দাঁড়িয়ে বুক ভরে ভোরের শীতল বাতাস টেনে নিয়েছি। আমাদের শহরগুলোর বাতাস দূষিত, জল দূষিত, মাটি দূষিত, শব্দ দূষিত, এমনকি খাদ্যও দূষিত। এসবই সৃষ্টি করেছে পরিবেশসংকট। দিন দিন এই সংকট বাড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে, পরিবেশদূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। কয়েক বছর ধরেই ঢাকা বিশ্বের দূষিততম শহর হওয়ার লজ্জা অর্জন করে যাচ্ছে। প্রথম স্থানে রয়েছে ভারতের দিল্লি। ল্যানসেট বলছে, বিষাক্ত বাতাস ও বর্জ্যের কারণে এ দেশে প্রতিবছর ২ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। দূষণজনিত এই মৃত্যুর দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ।

এ তালিকায় প্রথম অবস্থানে আছে ভারত। যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট প্ল্যানেটরি হেলথ জার্নালে ‘পল্যুশন অ্যান্ড হেলথ: আ প্রোগ্রেস আপডেট’ শীর্ষক এক গবেষণা নিবন্ধে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৭ সালে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল, সে সময় থেকে এ পর্যন্ত কয়েক বছরে পরিবেশদূষণের কারণে অকালে ঝরে গেছে বিশ্বের প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষের প্রাণ। বিশ্বে বর্তমানে প্রতি ৬ জনের মধ্যে ১ জন প্রাণ হারাচ্ছে পরিবেশদূষণের কারণে।

এক বছরেই বিশ্বে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ মারা গেছে পরিবেশদূষণের ফলে। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে পরিবেশদূষণে মৃত্যু হয় ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ জনের। এর মধ্যে শুধু বায়ুদূষণের কারণেই মারা গেছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫১৫ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু ঘটেছে পানিদূষণে। পরিবেশদূষণে মৃত্যুতে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে ভারত। সে দেশে ২০১৯ সালে পরিবেশদূষণে মারা গেছে ২৩ লাখ ৫৭ হাজার ২৬৭ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে চীন, তৃতীয় নাইজেরিয়া, চতুর্থ পাকিস্তান, পঞ্চম ইন্দোনেশিয়া ও ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

শুধু পরিবেশদূষণের কারণে এই ক্ষতি মেনে নেওয়া যায় না। দূষণ আমরাই করছি, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। আর আমাদের প্রিয় পৃথিবীকে করে তুলছি বিপন্ন। আসুন, আমরা আমাদের কু-অভ্যাসগুলো বদলাই।

মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ৪ বিচারকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল যুক্তরাষ্ট্র

প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পর যা বলল ইইউ

আপনাদের সঙ্গে হাত মেলাব না, বিস্ফোরক তামিম

কাগজে-কলমে মেয়র হওয়ায় দায়িত্ব পালন করলাম: জাতীয় ঈদগাহ পরিদর্শন শেষে ইশরাক

এপ্রিলে নির্বাচন ঘোষণায় বিএনপি ও জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি: সালাহউদ্দিন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত