Ajker Patrika

বিজেপির অখণ্ড ভারত গঠনের স্বপ্ন পূরণ হবে কি

এ কে এম শামসুদ্দিন
আপডেট : ১০ জুন ২০২৩, ১১: ০৪
বিজেপির অখণ্ড ভারত গঠনের স্বপ্ন পূরণ হবে কি

গত ২৮ মে ভারতের নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই সঙ্গে তিনি মানচিত্রের একটি বিশাল আকৃতির ম্যুরাল উন্মোচন করেন। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারকে নিয়ে তথাকথিত ‘অখণ্ড ভারত’ মানচিত্রের ম্যুরাল সংসদ ভবনের অভ্যন্তরে স্থাপন করা হয়। সদ্য উন্মোচিত এই মানচিত্র নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক শুরু হয়েছে। মানচিত্র উন্মোচনের পর পাকিস্তান সরকার ও নেপালের রাজনৈতিক নেতারা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথমে নীরব থাকলেও পরে ৫ জুন এ বিষয়ে ভারতের আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা জানার জন্য নয়াদিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনকে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার কোনো কারণ নেই। তারপরও বাড়তি ব্যাখ্যার জন্য আমরা দিল্লির মিশনকে বলেছি, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলতে, তাদের আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা কী, তা জানার জন্য।’ এর জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ম্যুরালটিতে সম্রাট অশোকের রাজত্বের আওতাধীন এলাকা বোঝানো হয়েছে।

ভারতের এই ব্যাখ্যার পর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কী জবাব দেওয়া হয়, তা দেখার বিষয়।

তবে ভারতের চির বৈরী পাকিস্তান যথারীতি ক্ষোভ প্রকাশ করে কিছুটা কর্কশ ভাষায় প্রতিবাদ করেছে। পাকিস্তানের দাবি, ‘এই অখণ্ড ভারতের কথা হলো সম্প্রসারণবাদী মনোভাবের ফসল। এটা শুধু ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মানুষেরই নয়, ভারতেরও সংখ্যালঘুদের পরিচয় ও সংস্কৃতিকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসার চেষ্টা। তাই এখন যে অখণ্ড ভারতের কথা বলা হচ্ছে, তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। ভারতীয় রাজনীতিকেরা যেন এই নিয়ে কথা বলা বন্ধ করেন। তাঁরা যেন তাঁদের এই চেষ্টা থেকে দূরে থাকেন।’ এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে নেপালে। তাদের ভাষা ছিল আরও তীব্র ও ধারালো। লুম্বিনি ও কপিলাবস্তু নামের প্রসিদ্ধ দুটি অঞ্চল নেপালের অন্তর্ভুক্ত। এক জায়গায় গৌতম বুদ্ধের জন্ম, অন্য স্থানে শাক্য রাজত্বের রাজধানী ছিল; যেখানে বুদ্ধের বাল্যকাল কেটেছে। মানচিত্রে এই দুই অঞ্চলকেও ভারতের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখানেই নেপালের তীব্র ক্ষোভের কারণ। দেশটির দুজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী পি শর্মা অলি ও বাবুরাম ভট্টরাই ভারতের প্রতি রীতিমতো হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তাঁরা ভারতে সফররত নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহল প্রচণ্ডের প্রতি অনুরোধ করে বলেছেন, তিনি যেন বিষয়টি নিয়ে তাঁর প্রতিপক্ষ নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনা করে বলেন, এই ম্যুরাল তাঁদের সংসদ ভবন থেকে সরিয়ে নেন।

অখণ্ড ভারতের এই মানচিত্র নিয়ে বাংলাদেশের সরকার কিছু না বললেও রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ঢাকার এক পত্রিকাকে বলেছেন, ১৯৪৭ সাল-উত্তর আধুনিক মানচিত্রে অখণ্ড ভারত বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু অখণ্ড ভারতের মানচিত্র ভারতের সংসদে প্রদর্শন—এটা অনভিপ্রেত। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেছেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এটি সংশোধন করে সঠিক মানচিত্র প্রদর্শন করবে। ঢাকার বামপন্থী কয়েকটি দল ভারতে এ ধরনের মানচিত্র প্রদর্শনের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। দলটির নেতারা বলেছেন, ভারত সরকার হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আপত্তিকর এবং বিভ্রান্তিমূলক মানচিত্রের এই ম্যুরাল স্থাপন করেছে। তাঁরা অবিলম্বে এটি অপসারণের দাবি জানিয়েছেন। বাংলাদেশের বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি বলেছে, এটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য অপমানজনক। অন্য কোনো দেশের মানচিত্রে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করে দেখানোটা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। দেশের অনেক রাজনৈতিক দল এ বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ জানালেও আওয়ামী লীগের নেতারা ছিলেন হিসেবি। এ বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তিনজন জ্যেষ্ঠ নেতা ও দুজন মন্ত্রী কথা বলেছেন। তাঁরা কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে চাননি। ভারত ওই মানচিত্র দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছে, সেটা তাঁরা জানার চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন। তবে এত দিনে তথাকথিত ওই অখণ্ড ভারত মানচিত্রের উদ্দেশ্য কিংবা অর্থ তাঁরা উদ্ধার করতে পেরেছেন কি না, জানা যায়নি। সামনে নির্বাচন। এমনিতেই বেশ কিছুদিন ধরে তাঁরা নানামুখী চাপে পড়ে নাজুক অবস্থায় আছেন। এ সময় সংগত কারণেই ভারতের বিরাগভাজন হতে চাইবেন না। কাজেই তাঁরা যে প্রতিবাদ করবেন না, তা বলাই বাহুল্য।

অখণ্ড ভারতের ধারণাটি ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের মূল মতাদর্শগত চিন্তা থেকে উদ্ভব হয়েছে। আরএসএসের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক বা প্রধান এম এস গোলওয়ালকর এই অখণ্ড ভারত নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। আরএসএসের অন্যান্য তাত্ত্বিক নেতাও প্রচুর লিখেছেন। এ ছাড়া আরএসএসের অধীন ‘বিদ্যা ভারতী’ নামে কয়েক হাজার বিদ্যালয় আছে এবং এই বিদ্যালয়গুলো আরএসএসই পরিচালনা করে থাকে। এসব বিদ্যালয়ের বইয়ে লেখা আছে, বর্তমান ভারত সীমানাসংলগ্ন দেশগুলো একসময় ভারতের অঙ্গ ছিল। উত্তরে তিব্বত, নেপাল ও ভুটান। দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা। পূর্বে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ এবং পশ্চিমে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। আরএসএস এই অখণ্ড ভারতেরই স্বপ্ন দেখে, যেটি তাদের বিশ্বাসমতো ভগবান রামের সময় বিরাজ করছিল। এটিকেই আরএসএস ও বিজেপি ‘রাম রাজত্ব’ বলে। বিজেপি ও আরএসএসের অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন অবশ্য নতুন কিছু নয়। এ-সম্পর্কে ২০১৫ সালে আল জাজিরা টেলিভিশনকে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ফিরে আসুক অখণ্ড ভারতবর্ষ। বিজেপি চায় উপমহাদেশের তিন রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মিলেমিশে এক হয়ে যাক। যুক্তি হিসেবে বলেছিলেন, দুই জার্মানি এক হয়েছে, এক হয়ে গিয়েছে দ্বিধাবিভক্ত ভিয়েতনামও। কাজেই এই তিন রাষ্ট্র এক হতে অন্যায় কী কিংবা অলীক হবে কেন? গত বছর ভারতের স্বাধীনতার প্লাটিনাম জুবিলি উদ্‌যাপনের প্রাক্কালে আরএসএসপ্রধান মোহন ভাগবত অখণ্ড ভারত গঠনের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন। ১৩ আগস্ট নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী কেন্দ্র বারানসীতে অখণ্ড ভারতের খসড়া সংবিধানও প্রকাশ করা হয়। এই সংবিধানের খসড়া তৈরি করেছেন সে দেশের ৩০ জন ধর্মগুরু ও পণ্ডিত। এ বছর মাঘ মাসে অনুষ্ঠিতব্য মাঘী পূর্ণিমায় এই খসড়া সংবিধানের ৭৫০ পৃষ্ঠার মধ্যে ৩৫০ পৃষ্ঠা চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হবে বলে জানানো হয়েছে। মোহন ভাগবত অখণ্ড ভারত গঠনের দিনক্ষণও ঠিক করে দিয়েছেন। স্বাধীনতার শতবর্ষে, অর্থাৎ ২০৪৭ সালের মধ্যেই তাঁরা তাঁদের লক্ষ্যপূরণের দিন নির্ধারণ করেছেন।

আরএসএসের অনেক ইচ্ছাই বিজেপি কার্যে পরিণত করেছে, সে বিষয় নতুন করে বলার কিছু নেই। অখণ্ড ভারতের বিষয়ে বিজেপি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে দিয়েছে মোদির সংসদীয় দপ্তরের মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী। অখণ্ড ভারতের মানচিত্র উন্মোচনের পর তিনি মানচিত্র দিয়ে টুইট করেছেন এই বলে, ‘সংকল্পনা স্পষ্ট-অখণ্ড ভারত’। শুধু যোশীই নন, কর্ণাটক বিজেপির টুইটার হ্যান্ডেল থেকে একই মানচিত্রের ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘আমাদের গর্বিত মহান সভ্যতার জীবনীশক্তির প্রতীক’। বিজেপির অনেক নেতা এবং মন্ত্রী তাঁদের বক্তব্য ও আচার-আচরণের মাধ্যমে অখণ্ড ভারত গঠনের ইচ্ছার কথা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন। এসব বক্তব্য স্বাভাবিকভাবে এমন বার্তা বহন করে, যা বাংলাদেশসহ ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। এ বিষয় নিয়ে এখন পর্যন্ত ভারত সরকারের স্পষ্ট কোনো বক্তব্য আমরা পাইনি। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, অশোক বা মৌর্য সাম্রাজ্য সময়ের মানচিত্র ম্যুরাল আকারে স্থাপন করা হয়েছে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে তিব্বতের বিভিন্ন জনপদের প্রাচীন নাম ওই মানচিত্রে লেখা নেই কেন? অশোক সাম্রাজ্যের সময় তো তিব্বতের অনেক জনপদ অখণ্ড ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিব্বতের বিভিন্ন জনপদের প্রাচীন নাম লেখা হলে তা নিয়ে চীন আপত্তি তুলতে পারে ভেবেই কি সেই নামগুলো লেখা হয়নি?

বিজেপি বা আরএসএস অখণ্ড ভারত নিয়ে যতই উচ্চবাচ্য করুক না কেন, তাদের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়। অখণ্ড ভারতের ধুয়া তুলে তারা হয়তো রাজনৈতিক ফায়দা নিতে পারবে, কিন্তু তাদের পরিকল্পনা কোনো দিনও বাস্তবায়িত হবে না। মানচিত্রে দেখানো প্রতিটি দেশই তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম রক্ষায় সচেতন বলে আমার বিশ্বাস। ভারত চাইলেই কোনো ভূখণ্ডকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে না। বাংলাদেশের মানুষ এ বিষয়ে যে আরও বেশি সচেতন, এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। যে জাতি অস্ত্র হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারে; সেই জাতির একজনও বেঁচে থাকতে, স্বাধীনতার সূর্যকে কোনো দিন অস্তমিত হতে দেবে না।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত