জেসমিন ডেইরি ফার্মের গল্প

কাগজ-কলমে বন্দী কিংবা কথার তোড়ে উড়ে যাওয়া ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ শব্দ দুটি শুনলে কখনো কখনো হাসি পায় বটে। কিন্তু যখন চোখের সামনে দেখা যায় ছোট ছোট উদ্যোগ, দেখা যায় নারীরা সত্যি নিজেদের ক্ষমতায়নের চেষ্টা করে চলেছেন বিপুল পরিশ্রমে, তখন মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। ‘জেসমিন ডেইরি ফার্ম’ তেমনি এক নারীর শ্রম, ঘাম আর ভালোবাসায় গড়ে ওঠা অনবদ্য প্রতিষ্ঠান।

দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার শিবপুর বাজারসংলগ্ন জেসমিন বেগমের গরুর খামারটির প্রধান ফটকের ওপরে টানানো রয়েছে সাইনবোর্ড—জেসমিন ডেইরি ফার্ম। এটি কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের নামফলক নয়; বরং শিক্ষক হতে না পারার কষ্ট ও ক্ষত দূর করতে চাওয়া এক নারীর আত্মপরিচয়ের নিশানা। নারীদের উন্নয়নে সরকারের নানা সুযোগ কাজে লাগিয়ে জেসমিন বেগম ১১৫ শতাংশ জমিতে গড়ে তুলেছেন গরু, ছাগল, হাঁস ও মাছের খামার।

আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরি করা এ খামারটিতে গরু চুরি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে নেওয়া হয়েছে কড়া নজরদারির ব্যবস্থা। গরুর খাদ্য তৈরিতে ব্যবহারের জন্য আছে খড় কাটার মেশিন। আর পুরো খামারের দেখভাল করার জন্য আছেন ১০ জন যুবক।

২০০৫ সালে নিজের জমানো কিছু টাকা দিয়ে দুটি বাছুরসহ কেনা গাভি থেকে এখন ৭০টি গরুর মালিক জেসমিন বেগম। এ ছাড়া খামারে আছে ২০টি ছাগল, ২৩২টি ডিম পাড়া হাঁস, ফলদ ও সবজির বাগান এবং আছে বিশাল এক পুকুর। খামারের গরুর দুধ বিক্রি করে প্রতিদিন তাঁর আয় হয় ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। এ ছাড়া হাঁসের ডিম, ফল, সবজি ও মাছ বিক্রি করেও মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা আয় করেন জেসমিন বেগম।

দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার শিবপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী জেসমিন বেগম। আনোয়ার হোসেন পেশায় একজন শিক্ষক ও ধান ব্যবসায়ী। স্বামী হিসেবে জেসমিন বেগমকে তিনি সার্বিক সহযোগিতা করেন। স্কুলের কাজ শেষ করে দিনে ও রাতে সময় দেন স্ত্রীর খামারে।

কথা প্রসঙ্গে জেসমিন বলেন, ‘আমার খামারের ফ্রিজিয়ান গাভিগুলো প্রতিদিন প্রায় ১৫০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়। তবে এখন কিছু গাভি গর্ভবতী হওয়ায় খামারে দুধ উৎপাদনের পরিমাণ কমে গেছে।’ দুধ বিক্রি এই খামারে আয়ের বড় উৎস। জেসমিন ডেইরি ফার্ম থেকে গরুর দুধ, হাঁসের ডিম, ফল, সবজি এবং মাছ বিক্রি করে প্রতি মাসে সব খরচ বাদ দিয়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় হয় বলে জানান জেসমিন বেগম। তিনি জানান, বিনা সুদে অথবা স্বল্প সুদে সরকার যদি ঋণ দেয়, তাহলে খামারটির পরিসর আরও বড় করা হবে।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পরিমল কুমার সরকার বলেন, ‘নারীরা আজ সব দিক দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছেন। শুধু বাইরে কাজ বা চাকরি করতে হবে তা নয়, এভাবে নিজ উদ্যোগে অল্প পুঁজি নিয়ে খামার গড়ে তোলাটাও একটা কাজ।’

বিরামপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এ আর এম আল মামুন বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে বেকার যুব নারী-পুরুষদের উদ্যোক্তা হতে উৎসাহ জোগাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় খামারিদের জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে জেসমিন বেগমের জন্য সার্বিক সহযোগিতা থাকবে সব সময়।’

দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার শিবপুর গ্রামের জেসমিন বেগম একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। সরকারের অনেক উদ্যোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন তিনি। এই সফলতাকে ধরে রাখতে চান তিনি। খামারের অবকাঠামো এবং তাঁর কর্মতৎপরতা সে কথাই বলে। নারীর ক্ষমতায়নের গল্প শুধু কাগজ-কলমে বন্দী না থাকুক, সেটিই চান জেসমিন বেগম।