Ajker Patrika

এক কাপ ধার

মাহবুব আশরাফ
এক কাপ ধার

স্বাধীনতার পর মানুষজন একজোট হয়ে বাঁচার একটা সামাজিক রীতি ছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পরেও বেশ অনেক দিন এই রীতিটা রয়ে গিয়েছিল। হয়তো বিষয়টা আরও আগে থেকেই ছিল কিন্তু সেটা আমি দেখিনি বলে সেই কথা টানছি না। আমি বলছি প্রতিযোগিতাহীনভাবে একজোট হয়ে বেঁচে থাকার গল্প। প্রতিযোগিতাটা এমন কঠিনভাবে এড়িয়ে চলা হতো যে আমরা ছোটরা বুঝতেই পারতাম না কে বড় চাকুরে আর কে ছোট চাকুরে। আর বড়রাও পাত্তা দিত না কে সামাজিকভাবে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত।

সে সময়টাতে পাড়ার প্রত্যেকটি মানুষ এক অপরকে ভালো করেই চিনত। যোগাযোগও ছিল বেশ ভালো। পথেঘাটে বা খেলার মাঠে ছোটরা কোনো দুষ্টমি করলে মুরুব্বিরা হুংকার ছাড়ত, ‘এই তুমি “ওমুক” সাহেবের ছেলে না?’ ব্যস, হলো। সেই দুষ্টমির কথা ঠিকই পৌঁছে যেত মা-বাবার কাছে। তারপর যা হতো তা ধুনকরের কাজ।

যে সময়টার কথা বলছি সে সময়ে নারীদের কাজে যাওয়ার খুব একটা প্রচলন ছিল না। পুরো মহল্লায় দু-একজন নারী কাজে যেতেন, তা-ও সেটা নিতান্তই দায়ে পড়ে। কাজে না গেলে আয় নেই, আয় নেই তো ঠিকমতো খাওয়া নেই, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার জোগাড়। এমন সমস্যায় পড়েই দু-একজন নারী কাজে যেতেন।

যাদের ঘরে রোজগেরে পুরুষ আছেন, সেসব বাড়ির নারীরা কাজে যাওয়া তো দূরের কথা, বাজার বা দোকানেও যেতেন না। কাজের জন্য বাড়ির বাইরে যাক বা ঘরের কাজে বাড়িতেই বন্দী থাক, অবসরে সব বাড়ির নারীরা একজোট হয়ে যেতেন। কী নিয়ে যে তাঁদের এত আলাপ-আলোচনা হতো, তা আমার জানা নেই। 
সেই সময়টাতে বাবারা থলে হাতে সাতসকালে বাজার যেতেন নিত্যদিন। বাজার সেরে, নাশতা করে সেই যে অফিসে যেতেন, সারা দিন আর কোনো খোঁজ নেই। মায়েরা হেঁশেলেই ব্যস্ত। আন্ডাবাচ্চাদের মধ্যে যারা ডে-শিফটে পড়ে, তারা স্কুলে যাওয়ার আগপর্যন্ত আর মর্নিং শিফটের বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির সামনের 
রাস্তায় বা মাঠে নাঙ্গা পায়ে খেলায় মত্ত। এভাবে দিন গড়াতে গড়াতে মাস শেষের দিকে এলে, ছোটদের, অন্তত আমার ডাক পড়ত রান্নাঘর থেকে। বাড়ির আশপাশে না থাকলে এর-ওর মাধ্যমে ঠিকই খবর পৌঁছে যেত যে মা ডাকছে।

খেলা থামিয়ে দৌড়ে যেতাম মায়ের খোঁজে। রান্নাঘরে কেরসিনের স্টোভের পাশেই পাওয়া যেত মাকে। আমাকে দেখামাত্রই একটা চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘অমুক খালা’ বা ‘তমুক চাচি’র কাছ থেকে এককাপ রান্নার তেল বা লবণ, কখনোবা চিনি নিয়ে আসার জন্য। এই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যে বাসায় নেই, এবং সেটা অন্যের কাছ থেকে চেয়ে না আনলে যে রান্না হবে না, সেটা বুঝতাম। কিন্তু এই যে অন্যের বাড়ি থেকে কাপে করে তেলটা, নুনটা বা চিনিটা আনার ব্যাপারে কোনো সংকোচ কাজ করত না। না আমার, না মায়ের। তার কারণ, বাবা যখন টাকা হাতে পেয়ে এসব জিনিস বাজার থেকে কিনে আনবেন, তখন এই কাপেই সমান মাপে ধার শোধ করা হবে। যার কাছ থেকে ধার আনা হতো তিনি এতটাই দিতেন যে কাপ থেকে সেটা উপচে পড়ার জোগাড়। আমাকে বলতে হতো, ‘খালা, একটু কম দেন নাহলে বাসায় যেতে যেতে পড়ে যাবে।’

আমার মায়ের ফাটা দাগওয়ালা একটা কাপ ছিল। সেটাই ছিল তাঁর ধার করার মাপন যন্ত্র। দু-এক দিন পরেই যখন বাবা এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আনতেন বাজার থেকে, তখন ছিল ধার শোধের পালা। মা-ও কম যায় না, কাপ উপচে সেই ধারের জিনিস ফেরত পাঠাত। যেই খালা বা চাচিকে তাঁর জিনিস ফেরত দিতে গেছি, সে কাপের ভেতরের জিনিসের পরিমাণ দেখে আঁতকে উঠে বলতেন, ‘আমি কি তোর মাকে এতগুলো দিয়ে ছিলাম নাকি? এতগুলো এনেছিস কেন?’ তারপর কাপ থেকে তাঁর কৌটায় ঢেলে খানিকটা চিনি বা লবণ বা তেলসহ কাপটা ফেরত দিয়ে বলতেন, ‘তোর মাকে বলবি, যতটুকু নেয় ঠিক ততটুকুই যেন ফেরত পাঠায়।’ তেল বা লবণ হলে সেটুকুসহ মাকে কাপটা ফেরত দিতাম। আর যদি চিনি হতো তবে অবশিষ্ট চিনিটুকু মুখে চালান দিয়ে খালি কাপ পৌঁছাত মায়ের কাছে।

মায়ের সেই ফাটা কাপটা কবে যে হারালো কে জানে। কবে, কীভাবে যে এই অনাত্মীয়দের আত্মীয়তার জোট ভেঙে গেল, টেরও পেলাম না। এখন পাড়া তো দূরের কথা পাশের বাড়িতে কে থাকে, তা-ই ঠিকমতো জানি না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আমিনুল ইসলাম নন, শিক্ষা উপদেষ্টা হচ্ছেন অধ্যাপক আবরার

গণপিটুনিতে নিহত জামায়াত কর্মী নেজাম ও তাঁর বাহিনী গুলি ছোড়ে, মিলেছে বিদেশি পিস্তল: পুলিশ

বসুন্ধরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে ২ বিদেশি নাগরিককে মারধর

বিএনপির দুই পেশাজীবী সংগঠনের কমিটি বিলুপ্ত

ফরিদপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ: ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা, নিষিদ্ধের দাবি শিক্ষার্থীদের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত