Ajker Patrika

স্লোগানেই বিচ্ছিন্নতার আশঙ্কা

তরুণ চক্রবর্তী
আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১: ০৮
স্লোগানেই বিচ্ছিন্নতার আশঙ্কা

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভাঙার প্রক্রিয়া অবশ্যই দেশের পক্ষে বিপজ্জনক। কিন্তু সেই বিপজ্জনক খেলাটাই বিজেপির জ্ঞানভান্ডার রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের ঘোষিত কর্মসূচি। সেই কর্মসূচিই রূপায়ণে ব্যস্ততা চলছে। ভারতের শাসক দল বিজেপির স্লোগান, ‘এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত’ কিংবা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ আউর সবকা বিশওয়াস’-এর মধ্যেই রয়েছে বিচ্ছিন্নতার সুর। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আঘাত হানতেই হিন্দুত্ববাদী দলের প্রতিনিধি হিসেবে মোদি এ কাজটি সুচারুভাবে করছেন। ২৫ জানুয়ারি ভারতের জাতীয় নির্বাচন দিবসে আশঙ্কাটির বাস্তবতা প্রমাণিত হলো প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে। এক দেশ, এক নির্বাচনের কথা বলে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, বৈচিত্র্যময় ভারতকে এক সুতোয় বাঁধতে গিয়ে আঞ্চলিক রাজনীতির গুরুত্ব হ্রাসে তিনি সচেষ্ট। তাই ভারতীয় সংবিধানের মূলধারায় পরিবর্তন আনার যে মূল লক্ষ্য কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস এতকাল বলে এসেছে, সেই কাজ দ্রুততার সঙ্গে করছে বিজেপি। কংগ্রেস দুর্বল। এটাই বিজেপির পক্ষে বড় সুবিধা।ব্রিটিশ শাসনকাল থেকেই অবিভক্ত ভারতের গর্ব, ‘বিবিধের মাঝে মিলন’। সেই আত্মিক সুরের সঙ্গে সুর মিলিয়েই সাতচল্লিশের দেশভাগের পর বহু ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভাজনকে এক সুতোয় বাঁধতে সেই সময়ের রাষ্ট্রনায়কেরা ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করেন। ব্রিটিশ শাসন মুক্ত হলেও ব্রিটিশদের সংসদীয় রাজনীতিই হয়ে ওঠে ভারতীয় সংবিধানপ্রণেতাদের বিশাল দেশটির আইন তৈরির মূলমন্ত্র। বৈচিত্র্যময় দেশটির স্বাধীনতার বহু আগে কংগ্রেসের মতো রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশও প্রকৃত অর্থেই এমন বিচিত্র দেশের জন্য উপযুক্ত। কংগ্রেস নামটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে সবাইকে নিয়ে চলার এক উপযুক্ত মঞ্চের কথা। সমাজবাদী, কমিউনিস্ট বা মৌলবাদীদের মতো কোনো দর্শন বা গোঁড়ামি না থাকায় সবাইকে নিয়ে চলার ক্ষেত্রে স্বাধীনতার আগে থেকেই গোটা দেশেই নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে স্যার উমেশচন্দ্র ব্যানার্জির প্রতিষ্ঠিত দলটি। তবে নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে শতাব্দী প্রাচীন দলটি বিভিন্ন নেতৃত্বের হাতে কখনো চাঙা হয়েছে, কখনো দুর্বল। তবে বর্তমান সময়ের মতো এত দুর্বল কখনো হয়নি। আর সেই দুর্বলতাকেই পুঁজি করে বিজেপি তাদের ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছে।

এটা ঠিক, ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। পাকিস্তান ধর্মকেই মূলমন্ত্র করলেও কংগ্রেস প্রভাবিত স্বাধীন ভারত ধর্মনিরপেক্ষতাকেই তাদের পথচলার ভিত্তি করে। ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী নিজে ধর্মপ্রাণ হিন্দু হলেও অন্য ধর্মের প্রতি ছিলেন সমান শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে এই বিষয়ে তাঁর মিল পাওয়া যায়। তাই বঙ্গবন্ধুর আমলে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তি কখনো এমন টোল খায়নি। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শই গোটা দেশকে জুড়ে রেখেছে এক সুতোয়। তাই সাবেক জনসংঘ বা বর্তমান বিজেপির রাজনৈতিক দর্শন ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান’নীতি বা কংগ্রেসের ‘প্যান-ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির বিপরীতে আঞ্চলিক রাজনীতি প্রথম থেকে সক্রিয় থেকেও দেশকে সংঘবদ্ধ রাখতে বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি। তবে কোথাও কোথাও গণতান্ত্রিক আবার কোথাও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে আঞ্চলিক স্বার্থপূরণে সক্রিয় থেকেছেন বিভিন্ন রাজ্যের নেতারা। কিন্তু ক্ষতি হয়নি। এ ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কল্কে না পাওয়ার পাশাপাশি কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে নিজেদের বিরোধ এবং রাজনৈতিক লাভালাভের অঙ্কও অহিন্দিভাষীদের মধ্যে প্রভাব বিস্তারে কাজ করেছে। কমিউনিস্টরা চেষ্টা করেননি বা এখনো করছেন না, তা কিন্তু নয়। একসময় সংসদীয় রাজনীতিতে গোটা দেশেই তাঁদের অনেকটাই প্রভাব ছিল। কিন্তু বৈচিত্র্যময় এ দেশের ভোটের রাজনীতিতে তাঁরা এখন অনেকটাই নিষ্প্রভ। তবে মাও সে-তুংয়ের আদর্শে অনুপ্রাণিতরা দেশজুড়ে নিজেদের সশস্ত্র প্রভাব বিস্তারে অনেকটাই সক্ষম। কিন্তু কোনো কিছুই ভারতের সংহতিকে বিন্দুমাত্র বিপন্ন করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোই সামলে দিয়েছে যাবতীয় ঝড়ঝাপটা।

কিন্তু বিপুল শক্তি নিয়ে নরেন্দ্র মোদির উত্থান ভারতের মূল ভিত্তিকে কিছুটা হলেও টলিয়ে দিয়েছে। কাশ্মীর নিয়ে বর্তমান সরকারের মনোভাব কিংবা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন দেশের সংখ্যালঘুদের দেশপ্রেমে আঘাত হানতে বাধ্য। কোভিডকালে রামমন্দির বা সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প রূপায়ণে সরকারের ব্যস্ততার বিপরীতে রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচিত সরকারকে হয়রানি—মানুষ কিন্তু সরকারের অভিসন্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সেই সঙ্গে বিভাজনের রাজনীতি ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধী, এই দেয়াললিখনও পড়তে পারছেন না বিজেপির নেতারা। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যে পরম্পরা বিজেপির প্রথম প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়িও সগর্বে আগলে রেখেছিলেন, এখন সেটিও অনেকটাই লুণ্ঠিত। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা, নির্বাচন কমিশন, এমনকি দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতিও মানুষের আত্মবিশ্বাস সাত-আট বছরে অনেকটাই টোল খেয়েছে। তলানিতে এসে ঠেকে বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পর্ক। রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচিত মন্ত্রীরাও বর্তমান সরকারের আমলে জেল-যাত্রা থেকে রেহাই পাননি।

এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভাঙার প্রক্রিয়া অবশ্যই দেশের পক্ষে বিপজ্জনক। কিন্তু সেই বিপজ্জনক খেলাটাই বিজেপির জ্ঞানভান্ডার রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের ঘোষিত কর্মসূচি। সেই কর্মসূচিই রূপায়ণে ব্যস্ততা চলছে। ৩৭০ ধারা বিলোপ বা নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করে ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণও তারই অঙ্গ। আর এখানেই লুকিয়ে রয়েছে বিচ্ছিন্নতার বীজ।

তরুণ চক্রবর্তী, কলকাতা প্রতিনিধি, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে ধর্ষণ করলেন ছাত্রদল নেতা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত