Ajker Patrika

একুশের ফুল আ গা চৌ

মানবর্দ্ধন পাল
আপডেট : ২৪ মে ২০২২, ০৮: ৩৮
একুশের ফুল  আ গা চৌ

এই সংক্ষিপ্ত নামটিও লেখালেখিতে ব্যবহার করতেন তিনি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র এবং একুশের বরপুত্র আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী (১২ ডিসেম্বর ১৯৩৪-১৯ মে ২০২২)। ৮৮ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশের সুস্থ ও প্রগতিশীল সাংবাদিকতা জগতের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের অবসান হলো—নিভে গেল এক দেদীপ্যমান নক্ষত্র। তাঁর মৃত্যুর তারিখটি কাকতালীয় কি না, জানি না—একুশের বরপুত্র হিসেবে বোধ করি আরেক ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। ১৯৬১ সালের এই ১৯ মে তারিখেই ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরে বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ১১ জন শহীদ হয়েছিলেন। সেই রক্তাক্ত স্মৃতির সংযোগে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুর তারিখটিও যেন অক্ষয়-অম্লান হয়ে রইল।

তিনি কেবল এ দেশের সাংবাদিকতা জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন না, ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে কবি, গল্পকার , ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক। কিন্তু তাঁর সব প্রতিভার স্ফুলিঙ্গ ছাপিয়ে উঠেছিল সাংবাদিকতার অগ্নি। সেই আগুনের আলো ও উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল দেশময়। প্রায় ৭০ বছরের সাংবাদিকতার জীবন তাঁর—বিশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত। সেকালের বিখ্যাত আজাদ, ইত্তেফাক, সংবাদ থেকে শুরু করে একালের জনকণ্ঠ, কালের কণ্ঠ, সমকাল, ভোরের কাগজ ও নবধারার নবজাত দৈনিক আজকের পত্রিকাসহ আরও কিছু কাগজে তিনি কলাম লিখতেন।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সব্যসাচীর মতো দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে দুই হাতে লিখেছেন রাজনৈতিক কলাম। তবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার পত্রিকা ছাড়া মৌলবাদী বা স্বৈরশাসকের সমর্থক কোনো কাগজে তিনি কখনো লেখেননি। মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র—এই তিন শর্তে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কখনো আপস করেননি। ১৯৭৪ থেকে তিনি স্থায়ীভাবে লন্ডনে বসবাস করলেও দেশের মাটি-মানুষ ও রাজনীতি থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হননি। কেবল দেশের রাজনীতিই নয়; আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতির বিশ্লেষণেও তিনি ছিলেন চৌকস ও সূক্ষ্ম দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইতিহাসের জীবন্ত বিশ্বকোষ ছিলেন তিনি। সমকালীন বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপট ছিল তাঁর নখদর্পণে। দুধারি তলোয়ারের মতো তাঁর কলামে ঝলসে উঠত কাল-সমকালের রাজনৈতিক ঘটনাবলির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ। তাঁর বিশ্লেষণের সঙ্গে কেউ হয়তো ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন কিন্তু তাঁর ইতিহাসনিষ্ঠ যুক্তি ও বিশ্লেষণী দক্ষতা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। ইতিহাস ও সমসাময়িক ঘটনার উল্লেখ করে যুক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা যুক্তি দিতেও তিনি পারঙ্গম ছিলেন। গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম মানেই বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিচরণ। তাঁর লেখার নিমগ্ন পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, ফরাসি বিপ্লব থেকে রুশ বিপ্লব, প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাস এবং ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও ছিল তাঁর নিউরনের আয়নায়।

তিনি কেবল কলামিস্টই ছিলেন না, একাধিক নতুন পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা এবং সম্পাদকও ছিলেন। একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের অনুমোদনক্রমে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা ‘জয় বাংলা’ সম্পাদনা করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পথ সুদীর্ঘ বন্ধুর ও রক্তাক্ত, পিচ্ছিল এবং বহুবঙ্কিমও বটে। তবে রাজনীতি ও কূটনীতির জটিল জালে না জড়িয়ে এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনই বাঙালির চেতনায় স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস এবং প্রথম সোপান। সেই নিউক্লিয়াসকে লক্ষ্যবিন্দু করে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচনা করেছিলেন তাঁর একুশের প্রতিবাদী কবিতা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’। কালক্রমে এই প্রতিবাদী কবিতা আলতাফ মাহমুদের বিষাদ সুরে স্নাত হয়ে বাঙালির ভাষাপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার চেতনার শিল্পরূপের অন্যতম ধারক হয়ে উঠেছে। বাঙালির শোকে ও সংগ্রামে এই কাব্যগীতি হয়ে উঠেছে আমাদের জাতিসত্তার প্রাণভোমরা। তাই একুশের অনুষ্ঠান, প্রভাতফেরি, ভাষাবিষয়ক যেকোনো কার্যক্রমের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে আছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…’ গানটি। বিবিসির জরিপে এ গানটি জনপ্রিয়তার বিচারে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে।

বাংলা ভাষা যত দিন আছে, যত দিন আছে বাংলাদেশ এবং আছে বাঙালি জাতি—থাকবে চিরঞ্জীব হয়ে যত দিন আছে পৃথিবী, তত দিন একুশের অমর চেতনার সঙ্গে বেঁচে থাকবে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর একুশের গীতিকবিতাটিও। একই সঙ্গে বেঁচে থাকবেন এর রচয়িতাও। এই লেখার পর তিনি যদি আর একটি অক্ষরও না লিখতেন, তবু তাঁর উচ্চতার কোনো রকমফের হতো না। এই একটি লেখাই তাঁকে দান করেছে অমরত্বের মহিমা। তিনি মিশে আছেন একুশ ও একাত্তরের সঙ্গে, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক ও গ্রন্থকার

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জমকালো দোতলা বাড়িতে দূতাবাস, সামনে সারি সারি কূটনৈতিক গাড়ি—৭ বছর পর জানা গেল ভুয়া

বেনজীরের এক ফ্ল্যাটেই ১৯ ফ্রিজ, আরও বিপুল ব্যবহার সামগ্রী উঠছে নিলামে

অবশেষে রাজি ভারত, ‘জিতেছে বাংলাদেশ’

ই-মেইলে একযোগে ৫৪৭ ব্যাংক কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত, পুনর্বহালের দাবি

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাকে শুভেচ্ছা জানাতে বিমানবন্দরে পলাতক আসামি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত