Ajker Patrika

রাজনীতির চিত্রকল্প বদলে যাচ্ছে!

অরুণ কর্মকার
Thumbnail image

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতির চিত্রকল্পে বোধ হয় কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হয় আরও কিছু পরিবর্তন হতে চলেছে। এই বোধ যে কেবল রাজনীতির নিবিড় পর্যবেক্ষকদের তা নয়, সাধারণ মানুষেরও হচ্ছে। অবশ্য আমাদের দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতির একান্ত এবং নির্ভরযোগ্য পর্যবেক্ষক তাঁরাই, যাঁদের আমরা সাধারণ মানুষ বলে থাকি। তাই মাঝেমধ্যে তাঁদের সঙ্গে নিজের বোধ-বুদ্ধিগুলোর আদান-প্রদান করে নেওয়া বেশ কাজের হয়।

রাজধানীর পথপার্শ্বের চায়ের দোকানগুলো এই আদান-প্রদানের খুব একটা ভালো জায়গা। এর মধ্যে কারওয়ান বাজার এলাকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে পারি, যেটি বেশ সমৃদ্ধ বলেও মনে হয়। সেখানকার চায়ের দোকানগুলোতে মূলধারার কিছু সংবাদকর্মী, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসের কিছু তরুণ কর্মজীবী, কিছু শ্রমজীবী এবং পথচলতি নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের নৈমিত্তিক আনাগোনা হয়। সমাবেশ ঘটে। সমবেতদের পেশার যেমন বৈচিত্র্য, তেমনি আলোচনাও হয় বহুমাত্রিক এবং তথ্যবহুল। রাজনীতির চিত্রকল্প পরিবর্তনের কথা সেখানেই উঠেছিল।

এসব সমাবেশে শ্রমজীবী মানুষেরা সাধারণত আশপাশের কথাবার্তার মনোযোগী শ্রোতা হয়ে থাকেন। অধিকাংশ সময় নিজের প্রয়োজন শেষ হলে চুপচাপ চলে যান। কখনো কখনো কিছু মন্তব্য করেন। সেদিন তেমনই এক মন্তব্য করেছিলেন একজন সিএনজিচালিত অটোচালক। তাঁর বক্তব্য হলো, আন্দোলনরত বিরোধী দলের বক্তব্যের একটা প্রধান বিষয় শুরুতে ছিল আমেরিকা এবং অন্য বিদেশিরা কী বলছেন, কী চাইছেন, সেটা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা। তখন সরকার এবং সরকারি দল বলত, বিদেশিদের কথায় কিচ্ছু হবে না। নির্বাচন হবে দেশের সংবিধান অনুযায়ী, শেখ হাসিনার অধীনেই এবং সেই নির্বাচন সুষ্ঠুই হবে।

এরপর কিছুদিন যেতে না যেতেই বিরোধী দলগুলোর বক্তব্য পাল্টে যায়। এখন দলগুলোর নেতাদের বক্তব্য হলো, বিদেশিরা কী বলছে, কী ভাবছে, আমেরিকা-ভারত কী বলছে, তাতে কিছু যায়-আসে না। তাঁরা আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই তাঁরা নির্বাচনে যাবেন। অন্যথায় নির্বাচন প্রতিহত করা হবে। একইভাবে সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্যেও পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে তাঁদের বক্তব্যে কোনো পরিবর্তন না হলেও আমেরিকাসহ বিদেশিরা কী বলছে এবং কী বলছে না, তার ওপরই বেশি জোর দিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন তাঁরা। তাহলে কি ভেতরে-ভেতরে রাজনীতির প্রেক্ষাপট ও চিত্রকল্পে কিছু পরিবর্তন হয়েছে বা হচ্ছে? তা না হলে তো এভাবে বক্তব্য বদলে যেতে পারে না। খুব সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ বটে।

একজন অফিসকর্মীর মন্তব্য, পিটার হাস (যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত) তো নাকি কোথায় সাক্ষাৎকার দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুব প্রশংসা করেছেন। আরেকজনের মন্তব্য, আইএমএফের একজন কর্মকর্তাও তো নাকি বলেছেন যে শেখ হাসিনা ছাড়া এ দেশ চলবে না। তাহলে কি বিদেশিদের ভূমিকা এবং অবস্থানে কিছু পরিবর্তন হয়েছে? নাকি তা একই আছে। আগে তাঁদের ভূমিকার ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছিল কি? নাকি এখন ভূমিকা বদলে যাওয়ার যে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, সেটাই ভুল? বিদেশিরা কি তাঁদের আগের ভূমিকা ও অবস্থানেই আছেন? আসলে কী হচ্ছে রাজনীতির অভ্যন্তরে!

সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর বাইরে সরকারের অবস্থানে অবশ্য তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বিদেশিদের ভূমিকা সম্পর্কে সরকার আগেও যেমন সমালোচনামুখর ছিল, এখনো তেমনই আছে বলে মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো ১৬ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের এক আলোচনা সভায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভূরাজনীতির কূটকৌশলকে আক্রমণ করেই বক্তব্য দিয়েছেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অতিতৎপর বিদেশিদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তাদের লক্ষ্য নয়। তারা চায় ভারত মহাসাগর এবং এর অবিচ্ছেদ্য অংশ বঙ্গোপসাগরকে ব্যবহার করে তাদের প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণ চালাতে। তিনি সেটা চান না বলেই তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।

অনেকেই হয়তো স্মরণ করতে পারবেন, ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ হিসেবে শেখ হাসিনা একই প্রকৃতির একটি ষড়যন্ত্রের কথা বলেছিলেন। ওই নির্বাচনের আগে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী, মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখন তাঁকে গ্যাস রপ্তানির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা প্রকারান্তরে তাতে অসম্মতি জানান। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের ৫০ বছরের প্রয়োজনীয় গ্যাস মজুত নিশ্চিত করার আগে রপ্তানির বিষয়ে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। এই অসম্মতিই ২০০১ সালের নির্বাচনে তাঁর পরাজয়ের প্রধান কারণ ছিল বলে শেখ হাসিনা দাবি করে আসছেন। এর অর্থ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় গ্যাস রপ্তানির পক্ষের দেশি-বিদেশি লবি ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের ক্ষেত্র তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল।

এবারও গ্যাস খাতের একটি বিষয় ভালোভাবেই আলোচনায় ছিল। বিষয়টি গভীর সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সন মোবিলকে দেওয়া না-দেওয়াসংক্রান্ত। বিষয়টির মোটামুটি একটা নিষ্পত্তি হয়েছে বলেই জানা যায়। এক্সন মোবিলকে কাজ দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের মনোভাব ইতিবাচক। কিন্তু এবার এর চেয়েও বড় এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব বিস্তার রোধ করা। সে জন্য বঙ্গোপসাগর এলাকার দেশগুলোর একটা সহায়ক ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত। এ বিষয়টিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে ভারত।

বিষয়টির সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং চীন—তিনটিই বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র। উন্নয়ন-সহযোগীও বটে। তাই এই তিন দেশের একটিকে কোণঠাসা করার জন্য অন্য দুটি দেশের জোটকে সমর্থন দেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে একটি স্পর্শকাতর বিষয়। কিন্তু এ বিষয়টির এমন একটি নিষ্পত্তি বাংলাদেশকে করতে হবে, যাতে ওই তিনটি দেশই বাংলাদেশের বন্ধু ও উন্নয়ন-সহযোগী হিসেবে থাকে। এটিই এবারের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এটি নিয়েই টানাপোড়েন চলছে। চলতে থাকবে। সময়-সময় এই টানাপোড়েনের প্রতিফলন দৃশ্যমান হবে বিদেশিদের আচরণে এবং সরকার, সরকারি দল ও বিরোধী দলগুলোর বক্তব্যে। তার মধ্যেই থাকবে রাজনীতির চিত্রকল্প পরিবর্তনের আভাস।

আরেকটি পুরোনো বিষয় নতুন করে সামনে এসেছে—কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যু-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায়, পরিস্থিতিতে। বিষয়টি হলো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘাপটি মেরে থাকা ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির সম্ভাব্য উত্থান। এটি এখন আর কোনো বিদেশি শক্তিই চায় না। মৌলবাদী শক্তিকে মদদ দিয়ে নিজেদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের ভূরাজনীতি এখন অতীত। এই শক্তিকে দমন করে রাখার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার যে কৌশল অবলম্বন করেছে এবং দক্ষতা ও সাফল্য দেখিয়েছে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সব বিদেশি শক্তিরই প্রশংসা পেয়েছে। সমর্থন পেয়েছে। সাঈদীর মৃত্যুর পর ওই মৌলবাদী শক্তি যে মদমত্ততা দেখিয়েছে তা-ও আগামী নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতির সমীকরণ মেলাতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত