Ajker Patrika

ইমরান খানের জন্য ২০২২ কেন দুঃস্বপ্নের বছর

হামিদ মীর
আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২২, ০৯: ৪০
ইমরান খানের জন্য ২০২২ কেন দুঃস্বপ্নের বছর

ইমরান খান নিজেকে সব সময় পাকিস্তানের ত্রাতা হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছেন। তিনি প্রায়ই দাবি করে থাকেন যে, যদি কোনো দেশের নেতারা দুর্নীতিগ্রস্ত হন তাহলে সে দেশ অনেক ঋণ নিয়ে থাকে। ইমরান খান একদা বলেছিলেন, মৃত্যু হলেও ঋণের জন্য ভিক্ষা চাইবেন না। কথাটি এখনো পাকিস্তানের জনগণের স্মৃতিতে উজ্জ্বল।

তবে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নিজের কথায় অটল থাকতে পারেননি ইমরান খান। ক্ষমতা নেওয়ার পরবর্তী তিন বছরে তিনি ৪০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছেন। এর মাধ্যমে অতীতের ঋণ নেওয়ার সব রেকর্ড ভেঙে গেছে। এখন পাকিস্তানের সরকারবিরোধীরা নিজের কথাকে সম্মান জানিয়ে ইমরান খানকে সরে যাওয়ার দাবি জানাচ্ছে। পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো বলছে, ইমরান পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে সমর্পণ করেছেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান হিসেবে আইএমএফের একজন সাবেক কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোতে আইএমএফের অনুপ্রবেশ আরও বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এতে পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণ ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে। কিছু বিশেষজ্ঞ দাবি করেছেন, পাকিস্তান দেউলিয়া হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন হলো, ইমরান খান কি পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ধস ঠেকাতে পারবেন? নাকি ২০২৩ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের আগেই তাঁর দলের ক্ষমতা ছাড়তে হবে?

এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের সবচেয়ে ভাগ্যবান প্রধানমন্ত্রী হলেন ইমরান খান। কারণ, তাঁর পূর্বসূরিদের মতো তিনি কখনো শক্তিশালী সামরিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বাধার সম্মুখীন হননি। সেই সঙ্গে পাকিস্তানের বিরোধীদলগুলো দুর্বল ও বিভক্ত। আর এ কারণে কোনোরকম সমস্যা ছাড়াই তিন বছর পার করেছে ইমরান খানের সরকার। যদিও এখন তাঁর নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব হুমকির মুখে।

ইমরান খান কি পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ধস ঠেকাতে পারবেনসমস্যা মূলত শুরু হয় গত বছরের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় সামরিক আবাসিক এলাকাগুলোর স্থানীয় নির্বাচনে পরাজিত হতে থাকে ইমরান খানের দল। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে, তাঁর শাসন সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আর তুমুল জনপ্রিয় নয়।

এরপর গত বছরের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়ায় স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলে ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ২০১৩ সাল থেকেই ক্ষমতায় রয়েছে। কিন্তু এবারের নির্বাচনে প্রদেশটির সব গুরুত্বপূর্ণ শহরে হেরেছে দলটি, যা ইমরান খানকে শঙ্কার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পরাজয়ের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান না করে তিনি দলের জাতীয় কাঠামো ভেঙে দেন। দলের নতুন মনোনয়ন দলীয় কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এই কর্মীরা আবার আরও আগে থেকেই নেতাদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন।

ইমরান খান মনে করেন, খাইবার পাখতুনখাওয়ায় প্রার্থী বাছাই বাজে হওয়ায় তিনি হেরেছেন। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের কেউ কেউ এমনটি ভাবছেন না। এই পরাজয়ের জন্য পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতিকে দায়ী করছেন তাঁরা। এদিকে ২০২২ সালে পাকিস্তানের ইতিহাসে পেট্রলের দামে সবচেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে হাঁপিয়ে উঠেছেন পাকিস্তানের সাধারণ নাগরিকেরা। এর বিপরীতের ইমরান খানের দাবি, জীবনযাপনের ব্যয়ের দিক থেকে পাকিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি মুদ্রাস্ফীতি দেখছে পাকিস্তান। ডলারের বিনিময়ে পাকিস্তানের রুপির দামেরও রেকর্ড পতন হয়েছে।

ইমরান খানকে ২০১৮ সালে ভোট দেওয়া অনেকেই এখন তাঁর কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট। তিন বছরের শাসনামলে ইমরান খান চারবার অর্থমন্ত্রী ও ছয়বার অর্থসচিব বদলেছেন। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকটের জন্য সব সময়ই আগের সরকারকে দোষ দিয়ে আসছেন ইমরান। তবে তাঁর এই অজুহাত ক্রমে খেলো হয়ে যাচ্ছে। ইমরান খানের সরকার পাকিস্তানের দুর্নীতি বন্ধে কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।

ইমরান খানের পররাষ্ট্রনীতি আরেকটি বাজে পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কাবুলের ক্ষমতায় আসার পরই একসময়কার সশস্ত্র বিদ্রোহী আফগান তালেবানের প্রশংসা করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ইসলামাবাদে ওআইসির এক বিশেষ বৈঠকের আয়োজন করে তিনি তালেবানকে সহায়তা করারও চেষ্টা করেছেন। তবে ইসলামাবাদের কথা শোনা তো দূরের বিষয়, তালেবানরা উল্টো অত্যন্ত ঔদ্ধত্যের সঙ্গে পাকিস্তানকে অবজ্ঞা করে আসছে। আফগান সীমান্তে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বেষ্টনী দেওয়ায় নাক গলাচ্ছে তালেবান। শুধু তা-ই নয়, কিছু স্থানে পাকিস্তানের সেনাদের সঙ্গে তালেবান সদস্যদের গুলিবিনিময়ও হয়েছে। আফগানিস্তানের বর্তমান শাসকদের সঙ্গে পাকিস্তানি তালেবানের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি করার চেষ্টা করেছিল ইমরানের সরকার। তবে সেটিও ব্যর্থ হয়েছে। এখন পাকিস্তানের সেনা ও তালেবান সদস্যরা সীমান্তে মুখোমুখি অবস্থানে আছে এবং একে অপরকে হত্যা করছে।

সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ব্যাপার হলো, ইমরান খান আফগানিস্তানের তালেবানকে সমর্থন করছেন। কিন্তু পাকিস্তানের তালেবানপন্থী লোকজন তাঁকে সমর্থন করছেন না। খাইবার পাখতুনখাওয়ায় ইমরান খানের দল তালেবানপন্থী জমিয়াত উলেমা ইসলামের (জেইউআই-এফ) কাছে হেরেছে। জেইউআই-এফের প্রধান মাওলানা ফজল উর রেহমান পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপের ঘোর সমালোচক। তিনি গত সপ্তাহে আমাকে বলেছেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী খাইবার পাখতুনখাওয়ার নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে।

কিছু প্রতিবেদনে জানা গেছে, পাকিস্তানের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের নতুন প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আহমেদ আঞ্জুম আওয়াজ দিয়ে কাজ করতে চাইছেন না। বরং চুপিচুপি এগোতে চাইছেন তিনি। যদি এটি সত্য হয় তাহলে তা ইমরান খানের জন্য খারাপ খবর। যদি আইএসআই নিরপেক্ষই থাকতে থাকে, তবে ইমরান খানের পক্ষে পার্লামেন্টে আনা অনাস্থা ভোটে জয় পাওয়া কঠিন হবে। কারণ সেখানে তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠতা বেশ অল্প ব্যবধানের। (গত বছর পার্লামেন্টে দলীয় নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য ইমরান খান আইএসআইয়ের সহায়তা নিয়েছে বলে গুঞ্জন উঠেছিল।)

এদিকে ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিদেশি তহবিল নিয়ে ওঠা অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। এই মামলাটি ইমরান খানের জন্য একটি টাইম বোমার মতো হতে পারে, যা যেকোনো সময় তাঁর বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। দুর্ভাগ্যবশত চলতি বছর ইমরান খানের জন্য এটিই সম্ভাব্য শেষ বিপর্যয় হয়ে থাকছে না।

(এই নিবন্ধটি গত ১১ জানুয়ারি দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত হয়েছে)

ভাষান্তর: ইয়াসিন আরাফাত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শাহজালালে তৃতীয় টার্মিনাল চালুতে বাধা, রাজস্ব ভাগাভাগি নিয়ে টানাপোড়েন

ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে এবি ব্যাংক

বৈপ্লবিক পরিবর্তন করার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে

ব্যাংকের চাকরি যায় জাল সনদে, একই নথি দিয়ে বাগালেন স্কুল সভাপতির পদ

১ লাখ ৮২২ শিক্ষক নিয়োগ: যোগ্য প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা চলতি সপ্তাহে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত