Ajker Patrika

হাওরে পাহাড়ি ঢলে কৃষকের ঘরে কান্না

আজকের পত্রিকা ডেস্ক
আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২২, ০৮: ৪৩
Thumbnail image

‘ই বছর ধান ভালা অইছিল। কত স্বপ্ন দেখছিলাম ধান তুলিয়া ঈদ করমু। বাড়ির তুরা কাম করাইমু। আল্লাহ নিলা গিয়া সবতা। অখন স্বপ্ন পচিয়া গন্ধ বাইর অর। বাচ্চাকাচ্চা লইয়া কিলান চলমু মাতায় কাম করের না।’ পাহাড়ি ঢলে হাওরের ধান ডুবে যাওয়ায় এই আক্ষেপ সিলেট সদর উপজেলার পিঠাকড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল বারিকের।

শুধু সিলেট নয়, দেশের উত্তর-পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অনেকগুলো জেলার কৃষকের কপাল পুড়ছে হঠাৎ আসা পানিতে। উত্তর-পূর্বের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনো ও কিশোরগঞ্জের হাওরগুলোতে ধানে কেবল রং ধরেছিল। এর মধ্যেই ভারত থেকে পাহাড়ি ঢল এসে তলিয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা হাওর। ধান হারিয়ে দিশেহারা কৃষক।

উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তিস্তা ও যমুনায় বাড়ছে পানি। এতে নদীগুলোর বিস্তীর্ণ চরে চাষ করা পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, ভুট্টা, কাউন, তরমুজসহ অন্যান্য ফসল ডুবে যাচ্ছে। অথচ এই সময়টাতে তিস্তা-যমুনায় এভাবে পানি বাড়ার কথা নয়। পানি বাড়ছে উজানে ভারত থেকে আসা ঢলে। ভারতের আসাম, মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। সেই পানির ঢল ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দেশের কৃষকের স্বপ্ন।

দেশেও আগামী কয়েক দিন হালকা থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এতে নদ-নদীর পানি আরও বাড়বে, বাড়বে কৃষকের ঘরের কান্না। এরই মধ্যে গত রোববার বিকেল ও রাতে উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলায় ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। এতেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ফসলের।

৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে

হাওরাঞ্চলে এ পর্যন্ত ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য নগদ অর্থসহ কৃষিঋণ মওকুফসহ যা যা করা দরকার, তা করা হবে। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকেও সহায়তা করা হবে।

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের নিয়ন্ত্রণকক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ১ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ৬ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। হেক্টরপ্রতি ৩ টন ধান উৎপাদন হলে হাওরে আকস্মিক বন্যায় প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

সপ্তাহব্যাপী ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ বলছে, আগামী এক সপ্তাহ দেশের বেশির ভাগ স্থানে হালকা থেকে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। এই সময় বেশি বৃষ্টি হতে পারে দেশের হাওর এলাকাখ্যাত সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে। ওই দুই বিভাগের উজানে ভারতীয় অংশেও টানা ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর। ফলে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের হাওর এলাকায় আরেক দফা বন্যা হতে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেছে, সিলেট বিভাগের প্রায় সব জেলায় যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তা আগামী এক সপ্তাহ চলতে পারে। ফলে দেশের হাওর এলাকাগুলোতে বৃষ্টি ও সম্ভাব্য ঢলের প্রস্তুতি নিতে হবে।

হাওরে আবার বাড়ছে শঙ্কা

সুনামগঞ্জে ১ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ১২টি হাওরের ফসল তলিয়ে গেছে। প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে—এমনটা বলছে কৃষি বিভাগ। কিন্তু কৃষকদের দাবি, প্রায় ৮ হাজার হেক্টর বোরো ফসল বানের পানিতে ভেসে গেছে। তিন দিন ধরে পানি কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু এরই মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড আবারও পানি বৃদ্ধি ও বন্যার পূর্বাভাস দিয়েছে। এতে করে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করে কৃষকের কপালে।

আবার বৃষ্টি হতে পারে—আবহাওয়ার এই পূর্বাভাসে কৃষকেরাও দ্রুত ধান কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে অধিকাংশ জমির ধান এখনো না পাকায় চরম দুশ্চিন্তায় হাওরাঞ্চলের কৃষকেরা।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের কৃষক মো. আমীর আলী খরচার হাওরে ১১ কেয়ার জমিতে চাষাবাদ করেছেন। তাঁর জমির ধান পাকতে আরও ১০-১২ দিন সময় লাগবে। এর মধ্যে টিভি ও পত্রিকায় আবহাওয়ার পূর্বভাসের খবরে অনেকটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তিনি বলেন, ‘ধান পাকতে দেরি আছে। এখন চাইলেও ধান কাটা সম্ভব না।’

সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, ‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস আমাদের একটু দুশ্চিন্তায় ফেলে দিছে। কারণ এখনো স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছি না কি পরিমাণ বৃষ্টিপাত হবে। তবে আমরা চেষ্টা করছি বাঁধগুলো সংস্কার করার জন্য। কিন্তু বেশি বৃষ্টি হলে বাঁধগুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।’

এরই মধ্যে পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে সিলেট সদর উপজেলার বিভিন্ন হাওরের ধান। বিশেষ করে উপজেলার ৩ নম্বর খাদিমনগর ইউনিয়নের উফতা নয়া বিলের হাওরে ধানই বেশি তলিয়েছে। সদর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, পানিতে তলিয়েছে প্রায় ৮০ হেক্টর ধানের জমি।

উফতা নয়া বিলের হাওরে ধান কাটছিলেন আব্দুর বারিক। তিনি বলেন, ‘পচা ধান কাটতেছি। জমির এক কোনায় কিছু ধান বেঁচে গেছে। সেগুলোই এখন সম্বল।’

কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের সম্পূর্ণ ধান পাকতে আরও ১৫ দিনের বেশি সময় লাগবে। এর আগে আগাম বন্যার পূর্বাভাসে ফসল ঘরে তোলা নিয়ে শঙ্কায় কৃষকেরা। ইটনা উপজেলার কামারকোনা হাওরের কৃষক জাকির মিয়া বলেন, ‘প্রথম ঢলে নিচু জমি তলিয়ে সেসব জমির সব ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শুনতেছি আবারও পানি আসবে। এবার পানি এসে যদি বাঁধের ওপর দিয়ে মূল হাওরে ঢুকে যায়, তাহলে আমাদের সব শেষ হয়ে যাবে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ছাইফুল আলম বলেন, ‘আগাম বন্যা থেকে ফসল বাঁচাতে ধান ৮০ ভাগ পাকলেই কেটে ফেলার জন্য আমরা কৃষকদের উৎসাহ দিচ্ছি। আর কয়েক দিন সময় পেলে ধান কৃষকের গোলায় উঠবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত