Ajker Patrika

অস্তিত্বের সংকটে রেংমিৎচা

শাহ আলম, আলীকদম (বান্দরবান)
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৬: ১৬
Thumbnail image

পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘রেংমিৎচা’ ভাষা জানেন মুরুং জনগোষ্ঠীর মাত্র ৬ জন। তাঁরাও এ ভাষায় আর কথা বলেন না। এ ভাষায় কথা বলার লোকের অভাবে তাঁরা ম্রো ভাষায় কথা বলেন। ফলে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে রেংমিৎচা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আলীকদম উপজেলার রেংপুং হেডম্যানপাড়া ও ক্রাঞ্চিপাড়ায় ‘রেংমিৎচা’ ভাষা জানা মুরুং রয়েছেন মাত্র ৪ জন। পার্শ্ববর্তী নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ওয়াইবটপাড়া ও কাইনওয়াই পাড়ায় রয়েছেন আরও ২ জন। এ ছাড়া দেশের কোথাও পুরোপুরি এ ভাষা জানা লোক নেই।

২০১৩ সাল থেকে রেংমিৎচা ভাষা নিয়ে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করছেন ইয়াঙান ম্রো। তাঁর মতে, দেশে পুরোপুরি রেংমিৎচা ভাষা জানেন ৬ জন। আরও ১০-১২ জন ম্রো কিছুটা রেংমিৎচা জানেন। তবে তাঁরা কেউ এ ভাষায় এখন আর কথা বলেন না।

জানা গেছে, ষাটের দশকে রেংমিৎচা ভাষাভাষীদের প্রথম খুঁজে বের করেন জার্মান ভাষাবিদ লরেন্স জি লোফলার। এরপর ভাষাটি নিয়ে আর খুব একটা কাজ হয়নি। মার্কিন গবেষক ডেভিড এ পিটারসন ২০১৩ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে রেংমিৎচা ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁর সহযোগী ছিলেন স্থানীয় ম্রো যুবক ইয়াঙান ম্রো।

গবেষক পিটারসন ২০১৫ সালে আলীকদমের তৈনফা মৌজায় রেংমিৎচা ভাষাভাষী খুঁজে পান। সে সময় আলীকদমে রেংমিৎচাভাষী ১২ জনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ রেকর্ড করেন। ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি বান্দরবান প্রেসক্লাবে রেংমিৎচা ভাষা জানা কয়েকজন ম্রোকে সঙ্গে এর পুনরুদ্ধারের বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের ডকুমেন্টিং অ্যান্ডেনজার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ প্রোগ্রামের মাধ্যমে ডেভিড এ পিটারসন ওই অনুসন্ধান চালান। এ ভাষার বর্ণমালা, ধারণাপত্র তৈরি এবং সর্বক্ষেত্রেই ব্যবহার উপযোগী করতে তিনি গবেষণা অব্যাহত রাখার কথা বলেছিলেন।

রেংমিৎচাভাষী সত্তরোর্ধ্ব রেংপুং ম্রো আলীকদমের ২৯১ নম্বর তৈনফা মৌজার হেডম্যান। আজকের পত্রিকাকে তিনি জানান, রেংমিৎচা ভাষা জানলেও তিনি এই ভাষায় কথা বলেন না। কারণ, এ ভাষা জানা লোক এখন বেশি নেই। মাত্র ৫-৬ জন পুরোপুরি জানলেও সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। তাই কথা বলার মতো কেউ না থাকায় তিনি ম্রো ভাষায় কথা বলেন।

তিনি বলেন, তাঁর ছেলেমেয়ে, নাতি—সবাই ম্রো ভাষায় কথা বলেন। তাঁদের কেউ রেংমিৎচা ভাষা পুরোপুরি জানেন না। কেউ শিখতেও চান না। তবে তাঁর আশা, নতুন প্রজন্ম রেংমিৎচা ভাষাকে আগলে রাখবে, হারিয়ে যেতে দেবে না। তিনি মনে করেন, প্রাচীনকাল থেকেই রেংমিৎচাভাষী লোকজন ছিলেন, এখন কমে গেছে।

১৯৪০ সালে আলীকদমের তৈনখাল তীরবর্তী স্থানে মুরুং বসতি ছিল। সেই সময় ৬ থেকে ৭ হাজার মুরুং রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু কালের গর্ভে এই ভাষী লোকের সংখ্যা হারিয়ে যাচ্ছে।

রেংপুং হেডম্যান বলেন, তৈনফা মৌজার প্রথম হেডম্যান তাঁর নানা তাংলিং ম্রো, বাবা উকলিং ম্রো ও চাচা ইয়াং ইয়ুন ম্রো শতভাগ রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলতেন। তাঁরা মারা গেলে পরবর্তী প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা আর রেংমিৎচা ভাষা রপ্ত করেনি।

একসময় তৈনখাল এলাকার ক্রাংচিপাড়া, পায়া কার্বারিপাড়া ও টিংকুপাড়ায় রেংমিৎচাভাষী ছিলেন। বর্তমানে রেংপুং হেডম্যান ছাড়াও মাংপুং ম্রো, তিংওয়াই কার্বারি ও লাউলী ম্রো, রেংমিৎচা ভাষা ভালোভাবে বলতে পারেন। রেংপুং হেডম্যানের বড় মেয়ে কাইতুন ম্রো কিছুটা এ ভাষায় কথা বলতে পারেন।

বান্দরবানের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম মনু জানান, রেংমিৎচা স্বতন্ত্র কোনো ভাষা, নাকি ম্রো ভাষার একটি উপভাষা, তা নিয়ে বিশদভাবে কোনো গবেষণা হয়নি। একজন বিদেশি গবেষক আলীকদমের তৈনখাল এলাকা ঘুরে যে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, এটিই একমাত্র উদ্যোগ। এর বাইরে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাজ শুরু হয়েছে, এমন তথ্যও কেউ জানাতে পারেননি।

গবেষক ইয়াঙান ও রেংপুং হেডম্যানের মতে, রেংমিৎচা এবং ম্রো সম্পূর্ণ আলাদা ভাষা। তবে যাঁরা রেংমিৎচা ভাষায় কথা বলেন, তাঁরা ম্রো জনগোষ্ঠীর লোক। এরা বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। ম্রোদের কেউ কেউ খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলেও রেংমিৎচাভাষী কেউ ধর্মান্তর হননি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত