Ajker Patrika

নিরাপদ গন্তব্য: কত দূরে

মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
নিরাপদ গন্তব্য: কত দূরে

বছরের পর বছর ধরে গণমাধ্যমে শুধু নয়, মানুষের আলাপচারিতায় দুর্নীতির প্রসঙ্গে আলোচনা এক জনপ্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে এবং পতনও হয়েছে। পতন সর্বত্র হয়েছে, এ কথাও বলা যাবে না। সাম্প্রদায়িক শক্তিও যে মুখ থুবড়ে পড়েছে, তা-ও দৃশ্যমান হচ্ছে না। পশ্চিমা দেশগুলো বা প্রাচ্যের কিছু দেশে ধর্মীয় উন্মাদনা যে কমেছে, তা খুব সহজেই বলা যায়। সেখানকার গির্জাগুলো কমিউনিটি সেন্টারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মৌলবাদ এক নতুন সাংস্কৃতিক চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। বিপুল পরিমাণে মাদ্রাসা এবং মহিলা মাদ্রাসার জন্ম হয়েছে। এখানকার শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীরা তাদের বেশভূষায়, আচার-আচরণে একটা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক অবয়ব গ্রহণ করেছে। বোরকা-হিজাবের অন্তরালে তারা শুধু যে নিজেদের আড়াল করেছে তা নয়, তাদের জীবনের আকাঙ্ক্ষাকেও বিসর্জন দিয়েছে।

আজ থেকে এক শ বছরের অধিক সময়ের আগে বেগম রোকেয়া নারী স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। ‘সুলতানাস ড্রিম’ নাটকে তিনি নারীদের আকাঙ্ক্ষার কথাও ব্যক্ত করেছেন। সে সময় নারী স্বাধীনতার জন্য অন্তঃপুরবাসিনীদের মধ্যেও একটা জাগরণ হয়েছিল। মুসলিম পরিবারগুলোয় শিক্ষার একটা প্রবল আগ্রহের কথাও জানতে পারি, যার সাক্ষী কলকাতার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল। পাকিস্তান আন্দোলন সে আকাঙ্ক্ষাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। সেকালের কলকাতা বা দিল্লিকেন্দ্রিক স্কুল-কলেজগুলোয় মুসলিম নারীদের শিক্ষা-ভাবনাও প্রত্যক্ষ করা যায়। ইতিমধ্যেই সেসব বিদ্যায়তনে বেশ কিছু কৃতী ছাত্রীকেও আমরা দেখতে পাই।

১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পর (যাকে স্বাধীনতা বলা যায় না) পূর্ব বাংলার মানুষ যখন যথার্থই স্বাধীনতার ফাঁকি বুঝতে পারে, তারপর থেকে যখন আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই শুরু হয়, তখন থেকেই নারীদের অংশগ্রহণও বাড়তে থাকে। সীমিত আকারে মাদ্রাসাছাত্ররাও নিউ স্কিমের মাধ্যমে যে শিক্ষা গ্রহণ করে প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এমনকি বামধারার আন্দোলনেও তারা অংশগ্রহণ করেছে। ভাষা আন্দোলন এবং তৎকালীন রাজনীতির লড়াই-সংগ্রামে নারীদের অবদান সে সময় উল্লেখযোগ্য।

সাংস্কৃতিক আন্দোলন একসময় রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী বছরগুলোয় প্রভাতফেরিতে বিপুলসংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গভীর শিকড় নিশ্চিত করেছিল। একটি রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যখন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তারপর থেকেই সংকটের শুরু। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ব্যর্থতার কারণে মৌলবাদী শক্তি এবার ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করতে থাকে। একাত্তরের পুরো সময়টাতে তারা পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থনে বাঙালির মেধা নির্মূল এবং নিরীহ বাঙালিদের হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছিল। এবারে তারা মুসলিম বাংলার জিগির ধরে কিছুটা অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করে। মধ্য আগস্টের হত্যাকাণ্ড তাদের দ্রুতই সুযোগ এনে দেয়।

সেনাবাহিনী সব সময়ই ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাদের সেই সুযোগ এসে যায়। প্রথমেই ধর্মনিরপেক্ষতা—যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সাংবিধানিক স্বীকৃতি—তার ওপর আঘাত করে বসে। দীর্ঘদিনের লালিত সে আকাঙ্ক্ষা কিছুটা নিবৃত্ত হয়। এই সুযোগে তারা একটা প্ল্যাটফর্ম গড়ার সুযোগ পায় এবং তাদের সাংস্কৃতিক ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করতে থাকে। এ সময় বড় দেশগুলোর লেজুড়বৃত্তি করে করে তাদের ভাবনা শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বড় ধরনের কোনো রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। তাই তারা শিক্ষাব্যবস্থা, পারিবারিক আচরণ থেকে সামাজিক জীবনে ধর্মকে টেনে আনে। বিরাট সব ওয়াজ-মাহফিল, ধর্মসভা, ইসলামি জলসা– এসব করে গ্রাম থেকে বড় শহরে একটা সাংস্কৃতিক আবহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।

এই সময়ে দুর্নীতিও ক্রমে ক্রমে সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোয় জনপ্রিয় হতে থাকে। অর্থের লেনদেনে সরকারি অফিসগুলো ক্রমেই চঞ্চল টাকাকে নিজেদের পকেটে নিতে সক্ষম হয়। আইনের শাসন যখন এই প্রবণতাকে থামাতে পারছে না, তাই সেই আলগা বাঁধনে এই প্রবণতা বাড়তেই থাকে। এ সময় দুর্নীতির ঢাল হিসেবে ধর্মকে একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ এসে যায়। ধর্মের মুখোশ পরে কিছু আচার-আচরণের ব্যবহার করে দুর্নীতির কাজটিও সহজ হয়ে পড়েন। বড় বড় ধর্মীয় উৎসবের আগে এই দুর্নীতির মাত্রা বেড়ে যায়। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তো বটেই, জনপ্রতিনিধিরাও এই কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাষ্ট্রীয় অর্থের লুটেরারা নির্বাচনের আগে গ্রামে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করে টুপি-দাড়ি নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষী হয়ে পড়ে; বিশেষ করে ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা, সাবেক শিক্ষকেরাও তাঁদের দুর্নীতির টাকার ঝাঁপিটা খুলে দিয়ে জনগণের কাছে ভোট প্রার্থনা করে। এই প্রতিযোগিতায় অবশ্য সবাইকে হারিয়ে দিয়ে ব্যবসায়ীরা এগিয়ে যায়।

আমি এমন অনেক সংসদ সদস্যকে দেখেছি, যারা কোনো অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক চর্চাকে সমর্থন তো করেই না; বরং ১৬ ডিসেম্বর এবং পয়লা বৈশাখে ইসলামি জলসার আয়োজন করে। প্রতিবছর তারা হজে যায়, নামাজ-রোজা করে, লুণ্ঠিত অর্থ বিতরণ করে ইসলামের ধ্বজাধারী হয়ে যায়। তাদের তথাকথিত ধর্মপ্রীতি, পেশিশক্তি ও লুটেরা অর্থ (যার কোনো জবাবদিহি নেই) নিয়ে মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। এ সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মীরা যারা দীর্ঘ সময় ধরে সমাজকে প্রগতির পথে নিয়ে আসার সংগ্রামে নিয়োজিত রয়েছে, তারা ক্রমেই শক্তিহীন হয়ে পড়ে ঢাকার শহীদ মিনার, টিএসসি, শাহবাগের মোড় আর ঢাকার বাইরে ছোট-বড় শহরে শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে মৃদু কিছু সাংস্কৃতিক চর্চায় নিয়োজিত রয়েছে। পত্রিকায় বা টেলিভিশনে বিস্তর সংবাদ ও আলোচনা হলেও শিক্ষিত সম্প্রদায় এ নিয়ে কোনো ধরনের আন্দোলন গড়ার প্রচেষ্টায় থাকছে না। তাই তাদের একমাত্র আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায় ফেসবুক। ফেসবুকও এখন টিকটক আর স্থূল শারীরিক চিকিৎসার মুখপত্র হয়ে উঠেছে। ব্লগারদের মধ্যেও যে ঝাঁজ দেখা যেত তা আর নেই; বরং ব্যক্তিগত প্রচারের একটা অস্ত্র হয়ে উঠেছে ফেসবুক এবং অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যম। তবে এখানেও মৌলবাদ ও ধর্মব্যবসায়ীরা খুবই সক্রিয়। ওয়াজ মাহফিলের সচিত্র প্রতিবেদনে ভরা ফেসবুক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সভ্যতার এবং সংস্কৃতির গতিপ্রবাহকে থামিয়ে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার মৌলবাদী পদ্ধতি নতুন নয়। ইতিহাসের দীর্ঘ সময় ধরেই এ লড়াই চলে এসেছে পৃথিবীব্যাপী।

সংস্কৃতির মূল কাজই হচ্ছে মানুষের চোখ-কান খুলে দেওয়া, মানুষকে অরাজকতা-অন্যায় সম্পর্কে প্রতিবাদী করে তোলা। মানুষ স্বভাবতই সম্পদলোভী, অযৌক্তিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তাকে নিবৃত্ত করতে পারে একমাত্র সংস্কৃতি। সেই সাংস্কৃতিক চর্চা যদি ইতিহাসের নিয়মকে উপেক্ষা করে উল্টো পথে চলতে থাকে, তাহলে দুর্নীতির অগ্রগমনকে রোধ করা যাবে না। সাম্প্রতিককালের ছাগলকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। লুটেরা–দুর্নীতিবাজেরা যে কতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন হতে পারে, এ তারই প্রমাণ। এই শিক্ষা তাদের কে দেবে যে এত সম্পদ গড়ার পর মৃত্যুতে সে একাকীই প্রস্থান করবে। সম্পদ যাদের জন্য করা হলো, তাদের পাহারা দেবে কে? তার চেয়ে সমাজটাকে নিরাপদ করাই শ্রেয় না?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত