Ajker Patrika

কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা দেবে কে?

শ্যামল আতিক
আপডেট : ০৫ মে ২০২৩, ১০: ০৪
কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা দেবে কে?

বেশ কিছুদিন আগের একটি মন খারাপ করা খবর: চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে নিখোঁজের সাত দিন পর ডোবা থেকে ১১ বছরের শিশু আঁখির বস্তাবন্দী অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বিড়ালছানা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সবজি বিক্রেতা রুবেল ধর্ষণের পর শিশুটিকে হত্যা করেন। বিবেকবান মানুষের অন্তরকে ব্যথিত করার জন্য এ রকম একটি ঘটনাই যথেষ্ট। শিশুটির বাবা হয়তো তাকে ঈদের জামা উপহার দিয়ে খুশি হতেন, অথচ কাফনের কাপড় পরিয়ে তাকে আর্তনাদ করতে হয়েছে। কী নির্মম বাস্তবতা!

এ তো গেল একটিমাত্র ঘটনা। এ রকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। পত্রিকার পাতা ওলটালেই দেখতে পাই কন্যাশিশুদের ধর্ষণের পর হত্যার বহু খবর। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, এ ধরনের অপরাধ যারা করছে, তারা পরিচিতজন অথবা খুব কাছের মানুষ। অপরিচিত কেউ যখন ধর্ষণ করে, তখন সে অপরাধ করেই পালিয়ে যায়। কিন্তু পরিচিত কেউ এ ধরনের অপরাধ করলে সে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় না, হত্যাও করে। ধর্ষকদের মনস্তত্ত্ব হচ্ছে—ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে সমাজে সে আর মুখ দেখাতে পারবে না। তাই ধর্ষণের পর হত্যা।

অপরাধীরা যখন পরিচিতজন অথবা কাছের মানুষ, উদ্বেগের বিষয়টা এখানেই। আপনি নিজেও হয়তো জানেন না কোন ভদ্রবেশী শয়তান আপনার কন্যাশিশুর ক্ষতি করার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় আছে। বাস্তব সত্য হচ্ছে, কন্যাশিশুদের অধিকাংশই নিজ পরিবারে অথবা নিকট আত্মীয় অথবা পরিচিত মানুষ দ্বারা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। অনেক ক্ষেত্রেই নিপীড়ক হচ্ছে আপন মামা, চাচা, চাচাতো ভাই, দারোয়ান, অন্য কেউ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাদকাসক্ত পিতা।

অধিকাংশ শিশুই লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পারে না অথবা বয়স এতটাই কম থাকে যে নিজেও বুঝতে পারে না এবং মা-বাবাকেও বোঝাতে পারে না। অনেক সময় বললেও উল্টো মা-বাবার কাছ থেকে অপবাদের শিকার হতে হয়। আবার অনেক মা-বাবা বিষয়গুলো জানলেও শিশুর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চেপে যান।

ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, এই অভিজ্ঞতাকে ধামাচাপা দিলেও শিশুর অবচেতন মনে তা ট্রমা বা ক্ষত হিসেবে থেকে যায়। এটা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। পরিণত বয়সেও এই ট্রমা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। পরিণত বয়সে নারীদের আচরণগত সমস্যা ও দুর্বল ব্যক্তিত্বের একটি বড় কারণ হচ্ছে শৈশবের যৌন নিগ্রহ। কাউকে বলতে পারলেও এই দুঃসহ স্মৃতিগুলো নীরবে নিঃশেষ করে দেয় একজন নারীর অসীম সম্ভাবনা এবং সাবলীল জীবনযাপনকে।

প্রশ্ন হলো, ভদ্রবেশী এসব ধর্ষক থেকে কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা দেবে কে? এরা তো আপনার শিশুর চারপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে, সুযোগের অপেক্ষায় ওত পেতে আছে। রাষ্ট্র কি পারবে আপনার কন্যাশিশুর নিরাপত্তা দিতে? সহজ উত্তর হলো, রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে পারবে না। বড়জোর অপরাধ সংঘটনের পর অপরাধীর বিচার করতে পারবে। তাহলে এসব ভদ্রবেশী হায়েনার কাছ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

এখানেই সঠিক প্যারেন্টিংয়ের প্রাসঙ্গিকতা এসে যায়। শুধু আইন প্রয়োগ করে এসব অপরাধ কমানো যায় না। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অভিভাবকদের সচেতনতা। কন্যাশিশুদের লালন পদ্ধতি একটু ব্যতিক্রম। এ ক্ষেত্রে মা-বাবাকে অনেক জিনিস খেয়াল রাখতে হয়, যা ছেলেশিশুদের ক্ষেত্রে না রাখলেও চলে। কিন্তু অধিকাংশ মা-বাবাই বুঝতে পারেন না, এ ক্ষেত্রে বাড়তি কী ধরনের সতর্কতা নেওয়া প্রয়োজন।

মা-বাবার প্রথম দায়িত্ব শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সুবিধা হলো: শিশু যেকোনো বিষয়ই আপনার সঙ্গে শেয়ার করবে, আপনি দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারবেন। তবে সবচেয়ে ভালো পন্থা হচ্ছে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, যার প্রথম ধাপ হলো স্পর্শের রকমফের শিশুকে বুঝিয়ে দেওয়া।

কোনটা ভালো স্পর্শ, কোনটা মন্দ স্পর্শ এটা শিশুকে জানানো। তাকে জানাতে হবে—যে স্পর্শের কথা কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না, সেটাই মন্দ স্পর্শ। কেউ স্পর্শ করার পর সে যদি কাউকে এ কথা বলতে মানা করে, বুঝতে হবে এটা মন্দ স্পর্শ। কেউ যদি ঠোঁটে, বুকে অথবা নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত স্পর্শ করে, সেটাও মন্দ স্পর্শ।

কেউ যদি এ ধরনের স্পর্শ করে, তাহলে প্রথম সুযোগেই মা-বাবাকে জানাতে হবে—এ কথা শিশুকে জানিয়ে রাখতে হবে। পাশাপাশি কিছু প্রতিরক্ষামূলক কৌশলও শিখিয়ে রাখতে হবে। ‘আমি এটা পছন্দ করছি না’ কথাটি যেন কন্যাশিশু বলতে পারে, তা শিখিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া অপরিচিত কেউ যদি তাকে চকলেট বা বিস্কুট দিতে চায়, সে যেন তা গ্রহণ না করে।

পরিবারের নিকটাত্মীয় বা পরিচিতজন দ্বারা শিশু মন্দ স্পর্শের শিকার হচ্ছে কি না—এটা বোঝার একটি উপায় হচ্ছে, তাকে দেখলে শিশু কাছে যেতে চাইবে না, কুঁকড়ে যাবে ইত্যাদি। তবে এগুলো ঘটলেই যে মন্দ স্পর্শের শিকার হয়েছে, এটা বলা ঠিক হবে না। তার পরেও আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। বাসায় মেহমান এলে শিশুকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেহমানের কোলে তুলে দেবেন না। কম বয়সী শিশুকে রাতে অনিরাপদ কারও কাছে ঘুমাতে দেবেন না। ডাক্তারের চেম্বারে শিশুকে যখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে, সঙ্গে মা-বাবাকে থাকতে হবে।

শিশু কিছুটা বড় হতে থাকলে আশপাশের বখাটে দ্বারা টিজ বা বাজে মন্তব্যের শিকার হতে পারে। তাকে জানিয়ে রাখতে হবে, সে যেন এগুলোকে পাত্তা না দেয়, কোনো প্রকার বিতর্ক বা প্রতিক্রিয়া না দেখায়। তবে অবশ্যই মা-বাবাকে জানাতে হবে। এ ছাড়া স্কুলে বা অন্য কোথাও বাথরুমে আটকে গেলে শিশু যেন জোরে চিৎকার দেয়। তিন বছর থেকেই শিশুকে এই প্রশিক্ষণগুলো দেওয়া শুরু করতে হবে, যাতে সে আরেকটু বড় হলে তা ভালোভাবে রপ্ত করতে পারে।

কন্যাশিশুর বয়ঃসন্ধিকালে অভিভাবকদের বাড়তি সতর্কতা দরকার। বিকাশের এই পর্যায়ে কন্যাশিশুরা যৌন সক্ষমতা অর্জন করে। রজঃস্রাব শুরু হয়। এই স্বাভাবিক পরিবর্তন সম্পর্কে শিশুকে জানাতে হয়। অভিভাবক হিসেবে আপনার দায়িত্ব এসব বিষয়ে লুকোচুরি না করা। আপনার কাছ থেকে সঠিক তথ্য না পেলে বন্ধুবান্ধব বা অন্য কোনো উৎস থেকে জানার চেষ্টা করবে। বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে বেড়ে উঠলে পরে তাদের জীবনে নানা ধরনের যৌন জটিলতা (ব্যভিচার, যৌন বিকৃতি, দাম্পত্য অসংগতি ইত্যাদি) দেখা দিতে পারে।

এ সময় কিশোরীদের মন-মেজাজ ও আবেগ খুব ওঠানামা করে। ঝোঁক বা উত্তেজনার বশে অনেক কিছু করে ফেলে, যার জন্য পরে চরম মূল্য দিতে হয়। এ সময় শিশু ভালো-মন্দ, করণীয়-বর্জনীয় ইত্যাদি যথাযথ বুঝতে পারে না। অনেক সময় শোনা যায়, মিথ্যা প্রলোভনের শিকার হয়ে মেয়েরা ধর্ষকদের লালসার শিকার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে আপনার খেয়াল রাখতে হবে শিশু যেন বিপরীত লিঙ্গের কারও সঙ্গে কথাবার্তা এবং মেলামেশার ক্ষেত্রে নৈতিক সীমা কোনোভাবেই অতিক্রম না করে। বিশেষ করে অবাধ যৌনতার ভয়াবহ পরিণাম (অকাল গর্ভধারণ, গর্ভপাত, যৌনবাহিত রোগ ইত্যাদি) এবং এর ফলে শিক্ষাজীবনসহ ভবিষ্যৎ জীবন কীভাবে দুঃসহ হয়ে ওঠে, তা শিশুকে বুঝিয়ে বলতে হবে।

বাস্তবতার আরেকটি শিক্ষা কন্যাশিশুকে জানিয়ে রাখতে হবে। ছেলেশিশুদের তুলনায় মেয়েশিশুরা মানসিক পরিপক্বতায় কমপক্ষে দুই বছর এগিয়ে থাকে। অর্থাৎ, ছেলেদের তুলনায় সমবয়সী মেয়েদের সহজাত বিচারবুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞান বেশি থাকে। তাই কন্যাশিশুদের প্রতি অভিভাবকদের পরামর্শ থাকবে, কোনো ছেলেবন্ধু যখন তাকে কোনো মতামত বা প্রস্তাব দেবে, সে যেন সতর্ক থাকে এবং যাচাই-বাছাই করে।

এ ছাড়া প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারে তারা যেন খুব সাবধান থাকে। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামসহ সব সামাজিক মাধ্যমে যেন ব্যক্তিগত ছবি কিংবা তথ্য শেয়ার না করে। কেননা, এ ক্ষেত্রে সামান্য ভুল তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে।

এ ধরনের সচেতনতা হয়তো কন্যাশিশুদের নিপীড়ন পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবে না। তবে যৌন নিগ্রহ থেকে আপনার কন্যাশিশুকে বহুলাংশে নিরাপদ রাখতে পারবেন।

শ্যামল আতিক, প্যারেন্টিং গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পদোন্নতি দিয়ে ৬৫ হাজার সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা: ডিজি

দিনাজপুরে হিন্দু নেতাকে অপহরণ করে হত্যা: ভারত সরকার ও বিরোধী দল কংগ্রেসের উদ্বেগ

সমালোচনার মুখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের নিয়োগ বাতিল

মির্জা ফখরুলের কাছে অভিযোগ, ১৬ দিনের মাথায় ঠাকুরগাঁও থানার ওসি বদলি

আজ থেকে ৫০০ টাকায় মিলবে ১০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত