Ajker Patrika

মহানায়কের উত্তম মন্ত্র

খায়রুল বাসার নির্ঝর, ঢাকা
মহানায়কের উত্তম মন্ত্র

উত্তমকুমার ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে। তাই সংসার চালানোর দায়িত্ব তুলে নিতে হয়েছিল কাঁধে। তখনো অভিনয় করে সংসার চালানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। কলকাতা পোর্ট কমিশনারসে অল্প বেতনে কেরানির চাকরি করতেন। সঙ্গে চলছিল মঞ্চে অভিনয়। ‘মায়াডোর’ নামের এক হিন্দি সিনেমা দিয়ে প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। তবে কখনো মুক্তি পায়নি মায়াডোর।

এরপর তিনি সুযোগ পান নীতিন বসুর ‘দৃষ্টিদান’ সিনেমায়। এটি দিয়ে নিজেকে প্রথম রুপালি পর্দায় দেখার সৌভাগ্য হলেও আশাহত হয়েছিলেন উত্তমকুমার। কারণ, সিনেমার টাইটেল কার্ডে তাঁর নামই ছিল না। এরপর ‘কামনা’ (১৯৪৯) সিনেমায় প্রথম দেখা গেল তাঁর নাম—উত্তম চ্যাটার্জি। সিনেমাটি একেবারেই চলেনি। তাই পরের সিনেমা ‘মর্যাদা’য় নাম বদলে হলেন ‘অরূপ কুমার’। আরও কয়েকবার নাম বদলে ‘সহযাত্রী’ (১৯৫১) সিনেমায় এসে হলেন ‘উত্তমকুমার’।

ওই সময় ‘ফ্লপ মাস্টার জেনারেল’ বলেই বিদ্রূপ করা হতো তাঁকে। কারণ, তাঁর অভিনীত ‘দৃষ্টিদান’ থেকে ‘সঞ্জীবনী’—পরপর সাতটি সিনেমা ব্যবসায়িকভাবে আলোর মুখ দেখেনি। চরম ব্যর্থতার সিলমোহর তখন নায়কের গায়ে। প্রতিদিন ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হতে হতে একপর্যায়ে অভিনয় ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন।

উত্তমকুমারকে সেই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করেন পরিচালক নির্মল দে। ১৯৫২ সালে মুক্তি পায় নির্মল দে পরিচালিত সিনেমা ‘বসু পরিবার’, শ্রেষ্ঠাংশে উত্তমকুমার। মহানায়কের পায়ের নিচে সাফল্যের প্রথম সিঁড়িটা তৈরি হয় ‘বসু পরিবার’ দিয়ে। এ সিনেমার সাফল্যের পর নির্মল দে তাঁর পরের দুটি কাজেও উত্তমকুমারকে নিয়েছিলেন। একটি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ (১৯৫৩), অন্যটি ‘চাঁপাডাঙ্গার বউ’ (১৯৫৪)। এরপর বাংলা চলচ্চিত্রে প্রকৃত অর্থেই শুরু হয় ‘উত্তম যুগ’।

অনেক বছর পর এসে ‘আমার আমি’ নামে একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেন উত্তমকুমার। এতে তিনি খোলাখুলি প্রকাশ করেছেন, অভিনয় করতে এসে সহকর্মীদের কাছে কী ভয়াবহ উপহাসের শিকার হতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকে ‘ওরে যাত্রী’ সিনেমার একটি ছোট চরিত্রে প্রস্তাব পান। খুশি খুশি মন নিয়ে নির্ধারিত সময়ে চলে যান ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে। কিন্তু মেকআপ রুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁকে বসিয়ে রাখা হলো। একবারের জন্যও কেউ এল না খোঁজ নিতে।

আরও অনেকক্ষণ পর ডাক পড়ল। প্রথম শট প্রভা দেবীর সঙ্গে। রিহার্সালের সময় পাশ থেকে একজন বলল, ‘এ কলির ভীমকে কোথা থেকে পেলেন!’ আরেকজন বলল, ‘একেবারে নতুন আলু আমদানি হয়েছে গাঁ থেকে...।’ বিদ্রূপ করতে ছাড়লেন না প্রভা দেবীও, ‘এ ছেলে অভিনয় করবে কি, এর তো এখন থেকেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে!’ আত্মজীবনীতে উত্তম লিখেছেন, ‘কথাগুলো বড় বিশ্রী লাগছিল। এক একটা মন্তব্যের বিষাক্ত তির মেরে ওরা যেন আমার মনটাকে ক্ষতবিক্ষত করতে বদ্ধপরিকর। নিজেকে শক্ত করলাম। মনে পড়ল সেই চিরপরিচিত তিনটি বাঁদরের কথা—কিছু শুনব না, কিছু বলব না, কিছু দেখব না।’

অভিনয়জীবনের পরবর্তী দিনগুলোতে এ কথা সব সময় মাথায় রেখেছেন উত্তমকুমার। বিদ্রূপ, সমালোচনা, উপহাস, নিন্দা—যতই আসুক, নিজের কাজে থাকতে হবে বদ্ধপরিকর। এ মন্ত্রই তাঁকে সব বাধা পেরোনোর প্রেরণা জুগিয়েছে, করে তুলেছে বাংলা সিনেমার একচ্ছত্র মহানায়ক। শুধু সিনেমায় নয়, পর্দার বাইরেও নিজের ইস্পাতকঠিন ব্যক্তিত্ব দিয়ে, ভুবনভোলানো হাসি আর আন্তরিকতা দিয়ে জয় করেছেন মানুষের মন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত