Ajker Patrika

‘সাঁতার শেখা’ কার্যক্রম বাস্তবায়ন কত দূর

আসিফ
‘সাঁতার শেখা’ কার্যক্রম বাস্তবায়ন কত দূর

সামনে আসছে বর্ষাকাল। এ সময় পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার হার বাড়তে থাকে। প্রতিবছরই এ ঘটনা ঘটে থাকে। গড় হিসাবমতে, এ সময় প্রতিদিন ৫০টির মতো করে শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এর থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কয়েক বছর (২০১৬) আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এক পরিপত্র জারি করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে সরকার দেশের সব স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষকে শিক্ষার্থীদের জন্য সাঁতার শেখার ব্যবস্থা করার কথা বলেছিল। কোনো স্কুল-কলেজে পুকুর না থাকলে পাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পুকুর ব্যবহার করার কথা বলেছিল। আর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের এসব পুকুর সংস্কার করার কথা ছিল। মালিকানা, ব্যবহার করতে না দেওয়া বা অন্য কোনো সমস্যা থাকলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তা সমাধান করার কথা ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা অবশ্যই একটা শুভ উদ্যোগ ছিল। তবে স্কুলের অন্যান্য পাঠক্রমের পাশাপাশি তা কার্যকর হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে কোনো কার্যক্রম এখন পর্যন্ত নজরে আসেনি। ব্যতিক্রম থাকতেই পারে, সেটা সার্বিক পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটায় না।

দেশটা নদীমাতৃক হলেও নগরকেন্দ্রিক জীবনে নদী-খাল একের পর এক উধাও হয়েছে। তারপরও দেশের বিভিন্ন স্থানে যত্রতত্রভাবে ছড়িয়ে রয়েছে নানা ধরনের জলাধার। এই জনপদে অনেক বাড়ির আশপাশে পুকুর কিংবা ডোবা থাকা খুবই স্বাভাবিক। আর খাল-বিল তো রয়েছেই। তাই তো পা বাড়ালেই কোনো জলাধার খুঁজতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। উপরন্তু এমন কোনো বছর নেই যে বছর বন্যা আঘাত হানে না বাংলাদেশে। আর বন্যার পানিও নিচু এলাকায় জমে থাকে কয়েক সপ্তাহ, কখনোবা মাসব্যাপী। পানির এই সহজলভ্যতার কারণেই সাঁতার না জানা শত শত শিশু প্রতিবছর পানিতে ডুবে মারা যায়। সব সময় যে সাঁতার না জানার কারণেই ব্যাপারটি ঘটে তা নয়, কখনো শিশুদের ঠিকমতো দেখে না রাখার কারণে, কখনো আশপাশের জলা-ডোবা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকার কারণেও পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, এখনো গ্রামে পানিতে ডুবে মৃত্যুকে অনেকেই কুসংস্কার হিসেবে দেখে থাকে। তারা মনে করে, এই মৃত্যু তার ভাগ্যে লেখা ছিল।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, কয়েক বছরে পানিতে ডুবে প্রায় ১ হাজার ১৩০টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তা বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ২০২০ ও ২১ সালে ৯ বছর বয়সী শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার ছিল যথাক্রমে ৬৫ ও ৭৩ শতাংশ। আর ২০২২ সালে ৯ বছরের কম বয়সী শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার বেড়ে ৮১ শতাংশ হয়েছিল। আগের বছরের তুলনায় এ হার ৮ শতাংশ বেশি। হতভাগ্য এসব শিশুর ৬১ শতাংশ চতুর্থ জন্মদিনের আগেই মারা গেছে।
শুধু ছোটদের বেলায় নয়, কিশোর-তরুণদের ব্যাপারেও কিছু উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে সাঁতার না জানায় পুকুরে ডুবে মিলন (২২) ও শিমুল (১৫) নামে মামা-ভাগনের মৃত্যু হয়েছে। দুপুরে দুজন একসঙ্গে ওই এলাকার ডোবাকৃতির ছোট্ট একটি পুকুরে গোসল করতে নামায় এ ঘটনাটি ঘটে। জানা গেছে, মিলন রংপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পাস করে ডুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন। শিমুল বাজিতপুর হাফেজ আবদুর রাজ্জাক হাইস্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। এ ছাড়া শেরপুরের নকলা, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, বরিশালের বাকেরগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের লৌহজং ও চট্টগ্রামের রাউজানে সম্প্রতি মোট আট-নয়জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে সাঁতার জানলে এ মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব। কেননা, নদী-নালা, জলাভূমি সম্পর্কে অনেক ধরনের সতর্কতা তৈরি হয় এবং মানসিকভাবে কুসংস্কারচ্ছন্ন ও অনিবার্যতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ তৈরি হয়।

ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সাঁতার না জানার কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৮ বছরের নিচে মারা যায় ১৮ হাজারের বেশি শিশু-কিশোর। ২০০৫ সাল থেকে এই হিসাবটা করা হয়েছে। এটাই বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) মতো অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠানই বলছে, সঠিক পদক্ষেপে এ মৃত্যুকে কমিয়ে আনা যেতে পারে।

বছর কয়েক আগে চীনের অন্যতম নামী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদনকারী ছাত্রছাত্রীদের বলা হয়েছে, স্নাতক ডিগ্রি পেতে হলে তাঁদের অবশ্যই আগে সাঁতার শিখতে হবে। উল্লেখ্য, শিং হুয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় প্রাচ্যের হার্ভার্ড। তাদের গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রির সঙ্গে সাঁতার শেখাকে এভাবে যুক্ত করার সিদ্ধান্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে বলেছেন, যে দেশ এখন খরা মোকাবিলা করছে, নদী বা সাগর নেই, সেখানে এই পদক্ষেপের যৌক্তিকতা কী? সে ক্ষেত্রে নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশে এ রকম পদক্ষেপের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশই নেই। তার ওপর সাঁতার একটি জীবন রক্ষাকারী দক্ষতা, শরীরচর্চার অংশ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। স্কুল যদি পুরো জীবনকে এমনভাবে গড়ে দেওয়ার অংশ হয়ে থাকে, যাতে সে সমাজের সঙ্গে সুস্থতা বজায় রেখে চলতে পারে, তাহলে শিক্ষায় মনের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি শরীরের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে জোর দেওয়া আবশ্যিক।

বাংলাদেশের সরকার এ ক্ষেত্রে প্রশংসার দাবিদার। কারণ সরকার এই প্রাণরক্ষাকারী বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। কিন্তু কেন তা বাস্তবায়নের পথে নিতে পারছে না? সে প্রশ্নের কোনো স্পষ্ট উত্তর নেই। কারণ, আমার কাছে মনে হয় বোর্ড পরীক্ষার তারিখের মতো সেনসিটিভ বিষয়গুলোকে যেভাবে আগুপিছু করেছেন, তাতে এটা বাস্তবায়ন খুব একটা কঠিন বিষয় হওয়ার কথা নয়।

তবে সাদা চোখে বর্তমানে সাঁতার শেখার ব্যাপারে কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা দেখতে পাই। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, চট্টগ্রাম শহরে যেখানে প্রায় চার হাজার পুকুর-দিঘি ছিল, সেখানে এখন শখানেকে নেমে এসেছে। ঢাকায় তা আরও কম। প্রয়োজনীয় সুইমিংপুল না থাকা এবং যা আছে তাতে খরচের কথা বিবেচনা করে ব্যক্তি পর্যায়ে সবার পক্ষে সাঁতার শেখানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলেও আজ দ্রুত থেকে দ্রুততরভাবে পুকুর-দিঘির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। প্রতিটি স্কুলে সাঁতারের ব্যাপারে সরকারের এ রকম পরিকল্পনা জোরদার করা হলে চারপাশের হাজামজা পুকুর, মৃতপ্রায় খালগুলো আবার জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে। এতে পরিবেশও সজীব হয়ে উঠবে। হাতিরঝিল, রমনা পার্ক লেক, ধানমন্ডির মতো লেকগুলো আরও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে।

প্রায়ই শুনি, একদল শিক্ষিত ছেলেমেয়ে সমুদ্রে গেল। শুধু সাঁতার না জানার কারণে দুজনকে মৃত্যুর হাতে রেখে এসে কিছুদিন দুঃখ-তাপ করল সহপাঠীরা। এটা মেনে নেওয়া খুবই বেদনাদায়ক। শুধু সাঁতার না জানার কারণেই যদি ৪৩ শতাংশ শিশু মৃত্যুবরণ করে থাকে, বিষয়টি আসলেই উদ্বেগজনক। এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপের পাশাপাশি অভিভাবক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও কিছু ভূমিকা পালন করতে পারে।

সাঁতার শেখাটা যদি জীবন রক্ষাকারী হয়ে থাকে এবং শিক্ষার অংশ হিসেবে পরিণত করা যায়, তাহলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের আওতায় একটা জলাধার থাকতে হবে অথবা কৃত্রিমভাবে সুইমিংপুলের ব্যবস্থা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজের পরিকল্পনায় জলাধার বা পুকুরের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এটা পরিবেশবান্ধব হবে, খোলা জায়গার পরিমাণও বাড়বে। ফলে বিপুলসংখ্যক সম্ভাবনাময় জীবন ক্ষয় থেকে আমরা বেঁচে যাব।

আসিফ, বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক-মহাবৃত্ত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত