Ajker Patrika

চিকিৎসার খরচ মেটাতে দরিদ্র ৫০ লাখ মানুষ

আজাদুল আদনান, ঢাকা
আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২২, ০৮: ০৯
চিকিৎসার খরচ মেটাতে দরিদ্র ৫০ লাখ মানুষ

চল্লিশোর্ধ্ব আফরোজা বেগমের বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়ায়। দুই মাস আগে পেটের ব্যথা শুরু হয়। দুই দফায় চিকিৎসা নেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। শেষমেশ কোনো উপায় না পেয়ে আসতে হয়েছে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সেখানে শয্যা না পাওয়ায় জায়গা হয়েছে বারান্দায়। আফরোজার স্বামী সায়েদুল ইসলাম দিনমজুরের কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘১০ দিন ধরে এই হাসপাতালে আছি। নানা ওষুধ ও পরীক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগই বাইরে থেকে আনতে হয়। এতে করে চিকিৎসার পেছনে সবকিছু চলে যাচ্ছে।’

হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, সীমিত আয়ের এমন বহু পরিবার চিকিৎসা ব্যয় মিটাতে হিমশিম খাচ্ছে। যদিও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতিতে উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক এখন বিশ্বের মডেল বলে দাবি করছে সরকার। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেড়েছে প্রতি বছর। সেবার মান সন্তোষজনক পর্যায়ে যাচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের গবেষণা বলছে, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতা বাড়লেও সেবার মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নয়। চিকিৎসা ব্যয়ের সিংহভাগই ব্যক্তির নিজস্ব। ওষুধের পাশাপাশি বেশির ভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয় বাইরে।

ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল হামিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, দেশের ৮১ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা পেয়ে সন্তুষ্ট নন। এতে করে বিত্তবানরা দেশের বাইরে চিকিৎসা করাতে যাচ্ছেন। খরচের সামর্থ্য থাকলে আরও বেশি মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেত।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের দেওয়া তথ্য বলছে, দুই দশকে দেশে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বেড়েছে ১২ গুণ। যতটা বরাদ্দ হচ্ছে, তার যথেষ্ট ব্যবহার করতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।

দুই দশক আগে দেশে জনসংখ্যা কম ছিল। হাতের কাছে সেবাকেন্দ্র না পাওয়ার চিকিৎসার প্রতি আগ্রহ ছিল কম। বর্তমানে নতুন-পুরোনো রোগ মিলে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার হার কয়েক গুণে বেড়েছে।

সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট বলছে, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনবল নিয়োগের পরও দেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া যাচ্ছে না, যা স্বাস্থ্য খাতে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি বেশির ভাগ হাসপাতালেই চিকিৎসকের তুলনায় রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেন না চিকিৎসকেরা। ফলে অসন্তুষ্টি বাড়ছে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে ৮৬ লাখের বেশি মানুষের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। এর মধ্যে ৫০ লাখের বেশি চলে যাচ্ছে দারিদ্র্যসীমার নিচে।

এমন সংকটাবস্থা নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যক্তির ওপর চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ কমাতে হবে।

২০১২ সালে ২০১২-৩১ সাল মেয়াদি একটি কৌশলপত্র তৈরি করে সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। এতে বলা হয়, ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে ২০৩২ সালে ৩২ শতাংশে আনা হবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টো। ওই সময়ে ব্যক্তির ব্যয় যেখানে ছিল ৬৪ শতাংশ, ২০২০ সালে এসে তা পৌঁছেছে ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশে।

চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ার পেছনে কোন হাসপাতাল বা কার কাছ থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে সেটিও নির্ভর করে বলে জানান চিকিৎসকেরা।

বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ তুলনামূলকভাবে কম। তারপরও দেশের মাত্র ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ মানুষ এসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন। অর্থাৎ, ৮৬ ভাগই যাচ্ছে বেসরকারি খাতে। কারণ, সেবার মানের পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালে চাহিদামতো ওষুধ মিলছে খুবই কম। চাহিদার মাত্র তিন শতাংশ ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে সেখানে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল মনে করেন, স্বাস্থ্য খাতে প্রধান সংকট ব্যবস্থাপনায়। বরাদ্দ বাড়লেও তহবিলের বরাদ্দ ও তদারকি ঠিকমতো হচ্ছে না। ফলে ওষুধও ঠিকমতো পাচ্ছে না মানুষ। এমন হলে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে বরাদ্দ অর্থের যথোপযুক্ত ব্যবহার, সরকারি হাসপাতালে সেবার মান বাড়ানো, ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহার, জনবল বৃদ্ধি, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা হালনাগাদকরণ এবং বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে নজরদারি বাড়ানো জরুরি।

সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহাদৎ হোসেন দাবি করেন, স্বাস্থ্যসেবার মান একেবারের কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না পৌঁছাতে পারলেও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত সেবা পৌঁছেছে। জেলা পর্যায়ে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রসহ (আইসিইউ) অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে। প্রতিটি মেডিকেল কলেজে বার্ন ইউনিট হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত