Ajker Patrika

স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার

রাশেদ নিজাম, ঢাকা
আপডেট : ০৯ জুলাই ২০২২, ১০: ২৪
স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার

পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাসে বসেছেন আশরাফ। ঢাকায় চাকরি করেন। ঈদে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছেন। ছোট ভাইটা বিদেশে, মা থাকেন সেই সাতক্ষীরা। সুন্দরবন লাগোয়া শ্যামনগর উপজেলায়। ইউনিয়নের নামটা সুন্দর– পদ্মপুকুর। ঢাকায় থাকেন মিরপুরের শাইনপুকুর এলাকায়। জন্মস্থান আর বাসস্থানের সঙ্গে কি সুন্দর মিল।

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আলাপ শুরু করতেই আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন আশরাফ। ফিরে গেলেন আড়াই যুগ আগে।

‘জানেন ভাই, এই যে আমার ছেলেটাকে দেখছেন, ওর সামনে আঠারো হবে। বাবার সঙ্গে প্রথম ঢাকায় এসেছিলাম ওই বয়সে। কী যে উত্তেজনা! কিন্তু সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় আসার পথে ভ্যান, বাস, তারপর ফেরিতে পদ্মা পার হওয়ার কী যে কষ্ট ছিল। এখনো মনে আছে। সেই পদ্মার ওপর সেতু হয়েছে। এবার সরাসরি নদী পার হয়ে বাড়িতে যাব, সময় কম লাগবে। মায়ের সঙ্গে দেখা হবে। ভাবতেই মনটা জুড়িয়ে যাচ্ছে।’

একগাদা স্বপ্ন নিয়ে গল্পের ঝাঁপি খুললেন মধ্যবয়সী মানুষটি। পরিবারের বাকি তিনজন মোবাইল ফোনে ব্যস্ত। তাঁর স্ত্রী কথা বলছেন ইতালির ভেনিসে থাকা ছোট দেবরের স্ত্রীর সঙ্গে। কানে এল, ‘তোমরা আসলে ভালো করতা। সবাই মিলে এবার ঈদটা একসঙ্গে করতাম। আম্মা অনেক খুশি হতেন।’

ওপাশ থেকে উত্তর এল, ‘ছুটি মেলেনি ভাবি। প্রতিদিনই আম্মার সঙ্গে ভিডিওকলে কথা বলি। এখন তো বোঝাই যায় না এত দূরে থাকি আমরা।

আম্মাকে কোরবানির পশু কেনার টাকাও পাঠিয়েছি গতকাল। আপনারা কিন্তু পৌঁছে ছবি পাঠাবেন।’

আশরাফ বলেন, ‘বাবা মারা গেলেন তিন বছর হলো। সেবারও ছোট ভাইটা আসতে পারেনি। আমরা প্রতিটি মুহূর্ত ওকে ছবি/ভিডিও পাঠিয়ে জানিয়েছি। জানাজায়ও অংশ নিয়েছে ভিডিও কলে। কি যুগ এল ভাই। মনেই হয় না কেউ কাছে নেই।’

মনে পড়ে গেল গ্রামীণফোনের প্রথম দিককার বিজ্ঞাপনের একটা লাইন—দূরত্ব যতই হোক কাছে থাকুন। ঢাকা জাগার আগে গতকাল ভোরে কল্যাণপুরে তখন হাজারো মানুষ যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বের হয়েছেন। কেউ ঈদ করতে, কারও কাছে তা পরিবারের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার ছুটি। কারও কাছে বাবা-মায়ের মুখটা দেখার উপলক্ষ। তাকালেই দেখা যায়, মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে অন্তত ৭০ ভাগ যাত্রী। কেউ সহযাত্রীকে ফোন দিচ্ছেন, কেউ বাসের নম্বর খুঁজছেন, কেউ বাসায় ফোন দেওয়ার অপেক্ষায়। বলবেন, ‘এই তো বাসে উঠব।’

ফিরে এলাম আশরাফ সাহেবের ফোনের রিং টোনে। মোবাইলের স্ক্রিনে তাঁর মায়ের ছবি। উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কি রে বাবা, রওনা দিছিস? কতখন লাগবে? ভাই-বোনেরা কী করে? আমার ফোনে এমবি নেই, পারলি পাঠাই দে।’

মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর এক ছেলে, বাসের সিটে বসা এক বাবা হাসিটা চওড়া করে বললেন, ‘মা, তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। আমরা আসতেছি।’

কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদের কথায়, একজন মানুষকে সত্যিকারভাবে জানার উপায় হচ্ছে তার স্বপ্নটা জানা। আশরাফের স্বপ্নটা মাকে একনজর দেখা, তাঁর সঙ্গে কাটানো সময়টাকে উপভোগ করা।

দুই দিন ধরে ঢাকা ছাড়ার গল্পগুলো এমনই। প্রতিটি গল্পই আলাদা এবং স্বপ্নে ভরপুর। কেউ ঈদে বাড়ি গিয়ে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করবেন। কারও চোখে নবজাতক সন্তানকে আদরের প্রচণ্ড ইচ্ছা। কেউ টাকা জমিয়েছেন বাড়ি ফিরে একটা গরু কেনার স্বপ্ন, কারও একখণ্ড জমি কেনার স্বপ্ন। দুঃসংবাদ ছাড়া প্রতিটি বাড়ি ফেরাতেই কিছু স্বপ্ন থাকে। যার বীজ বোনা হয় ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে, পূরণ হয় প্রত্যন্ত গ্রামে, মফস্বলে।

সাধারণত রোজার ঈদের চেয়ে কোরবানির ঈদে মানুষের ঢাকা ছাড়ার সংখ্যা কম থাকে। কিন্তু যে যেভাবে পারছেন ঢাকা ছাড়ছেন। সেই চিত্র করোনার সময় ছাড়া আগের মতোই। এবার মোটরসাইকেল চলাচল নিয়ন্ত্রণ করায় অনেকে বিপদে পড়েছেন। সেই চাপ পড়ছে বাস, ট্রেন, লঞ্চে। কারও হয়তো স্বপ্ন ছিল পদ্মা সেতু দিয়ে বাইক হাঁকিয়ে বাড়িতে যাবেন। এবারের বাস্তবতায় তা সম্ভব হয়নি। কিন্তু স্বপ্নটা জিইয়ে রেখেছেন ঠিকই। মনের গহিনে, বিধিহীন এক সকালের আশায়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত