Ajker Patrika

বিদ্যালয়টি শিশুদের নেশার মতো টানে

কামাল হোসেন, কয়রা
আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২২, ১১: ৫২
বিদ্যালয়টি শিশুদের নেশার মতো টানে

বাচ্চাদের স্কুলে ছুটির ঘণ্টা পড়লে শিশুদের উল্লাস, হুল্লোড়। এরপর একটু খেলাধুলা, নয়তো বাড়ির দিকে দে ছুট। দেশের প্রায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র তো এমনই। কিন্তু সেখানে ব্যতিক্রম খুলনার কয়রা উপজেলার হড্ডা ডি এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছুটির ঘণ্টা পড়লেই শিক্ষার্থীদের মুখ যেন ভার হয়ে যায়। এর আগে সকালে নেশার মতো টেনে এনেছে যে প্রাঙ্গণ, তা ছেড়ে যাওয়া তাদের জন্য সহজ নয়।

শিক্ষার্থীদের জন্য তেমন কিছুর ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষ করতে পেরেছে বলেই অনন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এটি। তারই স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর জেলার মধ্যে ঝরে পড়ার হার কমাতে সক্ষম শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখায় জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক ২০২২ প্রতিযোগিতায় তারা পেয়েছে এ স্বীকৃতি। গত ৬ সেপ্টেম্বর খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এটি প্রকাশ করা হলেও সম্প্রতি বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।

খুলনা শহর থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের সুন্দরবন লাগোয়া দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামটির নাম হড্ডা। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল বনজীবী। সেই অজপাড়াগাঁয়ের একটি বিদ্যালয়ের এমন সাফল্যে বিদ্যালয়টি এখন শিক্ষানুরাগীদের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। 

গতকাল সোমবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, সাদামাটা একটি গ্রাম হড্ডা। অথচ হড্ডা ডি এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ সুন্দর ও মনোরম। কিছু শিশু মনের আনন্দে খেলা করছে বিদ্যালয়ের নিচের ফাঁকা জায়গায়। বিদ্যালয়টির ভেতরের দৃশ্যও নান্দনিক। দেয়ালে দেয়ালে আঁকা রয়েছে স্বাধীনতার মহান পুরুষ ও শহীদদের প্রতিকৃতি, কবি-সাহিত্যিক, বাঘ, ভালুক, ময়ূর, চিত্রা হরিণ, খরগোশ, হাতি, বক, কুমিরসহ বিভিন্ন প্রাণীর ছবি। তা ছাড়া শিশুদের জন্য বিভিন্ন খেলনাসামগ্রী দিয়েও শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। এর মধ্যে সুশাসন ও শুদ্ধাচার সততা স্টোর, রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কর্নার, মানবতার দেয়ালও উল্লেখযোগ্য। প্রতিটা শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পাঠদান পরিচালনা করা হচ্ছে।

জানা গেল, বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০৬। রয়েছেন পাঁচজন শিক্ষক-শিক্ষিকা। বিদ্যালয়ের নিজ উদ্যোগে অভিভাবকদের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে দুপুরের খাবার (মিড ডে মিল)। হড্ডা ডি এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অরুণ কুমার সানা জানান, শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের আনন্দঘন পরিবেশের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ায় ছুটির পরেও বাড়ি যেতে চায় না। শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করতে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা করেন তাঁরা।

বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ঝুম্পা মণ্ডল জানান, এলাকায় অভাব-অনটনের কারণে একটা সময় অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে খুব একটা হাজির হতো না। বিষয়টি নিয়ে ভাবনায় পড়েন তাঁরা। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করা এবং ঝরে পড়া রোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেসব নিয়ে ভাবতে থাকেন। এরপর বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি, শিক্ষক, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও অভিভাবকদের নিয়ে মতবিনিময় সভা ডাকলেন। এরপর শিক্ষার্থীদের মন কাড়তে নেওয়া হয় নানা পদক্ষেপ। পড়ালেখায় শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখতে বিদ্যালয়ে ‘মিড ডে মিল’ চালুর পরিকল্পনার কথা জানালেন তাঁদের। এই পরিকল্পনায় সবাই সম্মতি দিলেন। গ্রামের লোকজনকে নিয়ে দরিদ্র এই এলাকার স্কুলে মিড ডে মিল চালু করা হলো।

বিদ্যালয়টির পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সেঁজুতি ঢালী বলল, ‘স্কুলে দুপুরের খাবার না পেলে আমার হয়তো স্কুলেই আসা হতো না। স্কুলের খাবার সবাই একসাথে খাই। বাড়ির চেয়ে স্কুলের খাবার ভালো লাগে।’  

সহকারী শিক্ষিকা চায়না সরকার বলেন, ‘আমরা বাচ্চাদের বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ দিয়ে পাঠদান করি। ফলে তারা পাঠে আনন্দ পায় এবং মনোযোগী হয়।’ কয়রা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হাবিবুর রহমান বললেন, হড্ডা ডি এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উপজেলার অন্যতম বিদ্যালয়। সেখানে সৃজনশীল অনেক কিছু আছে, যা শিক্ষার্থীদের মনকে দোলা দেয়। বিদ্যালয়টি দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে।

বিদ্যালয়টি শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে আদর্শ মডেল অভিহিত করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রোকুনুজ্জামান বলেন, বিদ্যালয়টি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ব্যতিক্রমী যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত