Ajker Patrika

মতপার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক ব্যাপার

মতপার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক ব্যাপার

রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দপ্তর সম্পাদক এবং মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্বে আছেন। ১৯৮৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে তিনি ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলন, ভিসা নীতি এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ বিষয়ে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানার সঙ্গে।

আজকের পত্রিকা: আন্দোলনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করা কি সম্ভব? 
রুহুল কবির রিজভী আহমেদ: সম্ভব। যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত কোনো দাবি কখনো ব্যর্থ হয় না। পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম কোনো দৃষ্টান্ত নেই। ন্যায়সংগত দাবি সব সময়ই আদায় হয়। একটু সময় লাগতে পারে। তবে নিঃসন্দেহে এ দাবি আদায় হবে।

আজকের পত্রিকা: দাবি না মেনে সরকার যদি নির্বাচনে যায়, তখন বিএনপি কী করবে?
রুহুল কবির রিজভী: সরকার দাবি না মানা পর্যন্ত বিএনপি আন্দোলন অব্যাহত রাখবে এবং সমমনাদের সঙ্গে নিয়ে মিছিল-মিটিংয়ে ঢাকাসহ সারা দেশ উত্তাল করে তুলবে।

আজকের পত্রিকা: অতীতে বিএনপির আন্দোলনে সাফল্যের নজির আছে কি? 
রুহুল কবির রিজভী: আন্দোলন সব সময় একই ধারায় এগিয়ে যায় না। যেকোনো ধরনের আন্দোলনের উত্থান ও পতন থাকে। এভাবে আন্দোলন করতে করতেই একসময় স্বৈরশাসনের অবসান হয়। স্বৈরশাসক বাধ্য হন জনগণের দাবির কাছে মাথা নত করতে।

আজকের পত্রিকা: নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলন কি বিএনপি করতে পারবে? ভিসা নীতি তো একধরনের বাধা? 
রুহুল কবির রিজভী: ভিসা নীতি বাধা হিসেবে দাঁড়াবে তাদের জন্য, যারা গণতন্ত্রকে অবরুদ্ধ এবং বন্দী করে রেখেছে। সেই বন্দী গণতন্ত্রকে উদ্ধার করার জন্য আমরা আন্দোলন করছি। এটা আমাদের জন্য বাধা হিসেবে দাঁড়ানোর কোনো কারণ দেখি না। বড় বিষয় হচ্ছে, গোটা জাতি আজ সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। অবৈধ সরকার, বিনা ভোটে এবং নিশিরাতে ভোট করে ক্ষমতা জোর করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। সুতরাং ভিসা নীতি হোক আর অন্য যেকোনো বিষয় হোক না কেন, সবচেয়ে বড় বিষয়টা হচ্ছে, মানুষের অধিকার এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা। এটা কোনো দেশ হতে পারে কি যে দেশে অনেক বছর ধরে কারও মুখ থেকে প্রতিবাদের ভাষা উচ্চারিত হচ্ছে না? আবার নির্বিচারে গুলি করে, গুম করে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হচ্ছে আন্দোলনকামী ছাত্র-যুবক ও সাধারণ মানুষকে। এটা তো কোনো স্বাভাবিক দেশ হতে পারে না। এটা কোনো আধুনিক, সভ্য দেশ হতে পারে না। যারা ক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে তাদের প্রতিহত, পরাজিত করাই হচ্ছে গণতন্ত্রকামী মানুষের মুখ্য উদ্দেশ্য।

আজকের পত্রিকা: অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশিদের নাক গলানো বিএনপি কেন পছন্দ করছে?
রুহুল কবির রিজভী: পৃথিবীর দেশে দেশে স্বাধীনতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য যখন জনগণ আন্দোলন করে, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের সমর্থন দেয়, পক্ষে দাঁড়ায়। ইতিহাস বলে, যারাই যখনই স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে, তখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের প্রতি সংহতি জানিয়েছে এবং নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। যেকোনো ন্যায়সংগত আন্দোলন, সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি জানানো এবং পাশে থাকা, এটা তো একটা আন্তর্জাতিক রীতিনীতির বিষয়।

আজ দেশের মানুষ গণতন্ত্রহারা, মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা নেই এবং তারা ভয়ংকর আতঙ্কের মধ্যে দিন যাপন করছে। দেশের মানুষ একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছে, সেখান থেকে উত্তরণের জন্য তাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের মানুষ যদি আমাদের এই সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানায়, তাতে তো অসুবিধার কিছু নেই। এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার।

আজকের পত্রিকা: জনগণের দৈনন্দিন সমস্যা নিয়ে বিএনপিকে তেমন কোনো আন্দোলন করতে দেখা যায় না বলে অভিযোগ আছে। আপনি কী বলবেন? 
রুহুল কবির রিজভী: এই অভিযোগ অবচেতন মানুষেরা করতে পারে। কোনো রাজনৈতিক সচেতন মানুষ এ কথা বলতে পারে না। কারণ সম্প্রতি আমাদের যে কর্মসূচিগুলো পালিত হলো, সম্পূর্ণ গণদাবির ওপর ভিত্তি করে। জনগণ যেসব কারণে দুঃখ-কষ্ট পাচ্ছে, সেই দাবিগুলো নিয়েই আমরা আন্দোলনে আছি। দাবিগুলো হচ্ছে—অসহনীয় লোডশেডিং, বিদ্যুৎ খাতে যে সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে এবং তা বৈধতা দেওয়ার জন্য ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে, এসবের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন চলছে। সারা দেশে পুলিশের বাধার মুখে, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সহিংস বাধার মুখেও আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত আছে। এসব তো হচ্ছে গণদাবি। এগুলো নিয়েই ইতিমধ্যে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছি।

আমাদের দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তিনি তো জনগণের জনপ্রিয় নেত্রী। তাঁর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করাও তো জনগণের পক্ষেরই কাজ। এটা জনগণের বিরুদ্ধের কোনো কাজ না। জনগণের দাবির পক্ষে এবং জনগণের দুঃখ-কষ্ট নিবারণের জন্য সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের যে সংগ্রাম-দাবি, সেসব আমরা অব্যাহত রেখেছি। 

আজকের পত্রিকা: সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের একটা সমঝোতার কথা শোনা যাচ্ছে। এ নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?
রুহুল কবির রিজভী: এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। বিষয়টা আমরা আরও সামনের দিকে দেখব, শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর এ বিষয়ে আমরা কথা বলতে পারব।

আজকের পত্রিকা: বিএনপির সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের যৌথ কর্মসূচি পালনের কথা ছিল। কিন্তু মাঝপথে সেটার একটা টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। কী কারণ?
রুহুল কবির রিজভী: কে থমকে গেল আর কার অগ্রযাত্রা হলো, সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে যে রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন, সংহতি জানিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে যুক্ত হবে, তারা সবাই আমাদের বন্ধু হিসেবে বিবেচিত হবে।

আজকের পত্রিকা: আন্দোলনের পাশাপাশি বিএনপির নির্বাচনের প্রস্তুতি আছে কি?
রুহুল কবির রিজভী: এ কথা তো ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নিতে অনড়, অবিচল সিদ্ধান্তে আছি আমরা। শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়, কেউ যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়, তার বিরুদ্ধেও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় যেমন রাজশাহী, গাজীপুর, বরিশাল, সিলেট, যেখানে নির্বাচন হয়েছে এবং হচ্ছে, সবখানে আমরা কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছি।

আজকের পত্রিকা: ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীর মুখ সামনে না দেখালে বিএনপি আন্দোলনে সাফল্য পাবে কি?
রুহুল কবির রিজভী: ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশনেত্রী খালেদা জিয়াই প্রধানমন্ত্রী হবেন। তিনি বর্তমানে অসুস্থ ও 
বন্দী। তিনি যখন মুক্ত হয়ে চিকিৎসা করাবেন, তখন তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। তিনিই হলেন আমাদের দলের প্রধান। নেতৃত্বের যে সিরিয়াল ও ধারাবাহিকতা তাঁর অবর্তমানে পরবর্তী নেতা হবেন দেশনায়ক তারেক রহমান। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে তারেক রহমানই যে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেটাও কারও অজানা নয়। এটাই তো আমাদের দলের জন্য স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। 

আজকের পত্রিকা: বিভিন্ন সময় আপনাদের জোটবদ্ধ আন্দোলনে দ্বন্দ্ব-বিরোধ দেখা যায়। এর কারণ কী?
রুহুল কবির রিজভী: দ্বন্দ্ব-বিরোধ কোন দলে নেই, আওয়ামী লীগের মধ্যেও কি নেই? রাশেদ খান মেনন বলেছেন, দিনের ভোট রাতের বেলা হয়েছে। মানুষ ভোট দিতেই যায়নি। তার বিপরীতে শেখ হাসিনা বলেছেন, পরিপূর্ণভাবে দেশে গণতন্ত্র চলছে। আসল ব্যাপার হলো, মতপার্থক্য থাকতেই পারে। আর মতপার্থক্য যে দলে বা জোটে থাকে না, সেটা তো বদ্ধ দল। তাহলে সেটা তো ভয়ংকর অটোক্রেটিক দল। আর বিএনপি তো একটা গণতান্ত্রিক দল। সেখানে অনেক মতপার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু প্রত্যেকেই আবার নিজের মত প্রকাশ করার পরেও দলের নীতি, আদর্শ ও শৃঙ্খলার প্রতি তারা অবিচল, সেটাকে তারা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকে।

আজকের পত্রিকা: বাংলাদেশের রাজনীতি ভবিষ্যতে কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছে? 
রুহুল কবির রিজভী: বাংলাদেশের রাজনীতি সেদিকেই যাবে, যেদিকে গণতন্ত্রের বিজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। মুক্ত বাতাস গ্রহণের জন্য অন্ধকার রাতের শেষে ভোরের দিকেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এ দেশের ত্রিশ লাখ মানুষ একাত্তর সালে জীবন দিয়েছেন এবং অসংখ্য মা-বোন তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন, তাঁদের ঋণ পরিশোধের জন্য দেশের মানুষ সংগঠিত হয়ে আজকের এই গণবিরোধী, ধিক্কৃত, ফ্যাসিস্ট ও জুলুমবাজ সরকারের কাছ থেকে অধিকার ফিরিয়ে নিয়ে আনার জন্য সংগ্রাম করছে। এই ধারায়ই এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের রাজনীতি।

আজকের পত্রিকা: আপনাকে ধন্যবাদ। 
রুহুল কবির রিজভী: আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত