Ajker Patrika

রমনা পার্ক ও সচেতন সুস্থ নাগরিক

তাপস মজুমদার, সাংস্কৃতিক সংগঠক
রমনা পার্ক ও সচেতন সুস্থ নাগরিক

বাড়িয়েছি হাত/ দিও না ফিরিয়ে,
আর কিছু না হোক/ যেও দুদণ্ড বেড়িয়ে।

এই খুদে কবিতাটি সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার লিখেছেন সম্ভবত রমনা পার্কের হয়ে। এই আহ্বানধ্বনিতে সাড়া দিয়ে কেউ যদি একবার রমনা পার্কে আসেন—কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি রমণীয় হবেন। তিনি এ-ও নিশ্চিত জানবেন যে ওই আহ্বান কিছুমাত্র ব্যর্থ হয়নি।
বড় বড় শহরে জনপরিসর ক্রমেই কমে আসছে। আমাদের রাজধানী ঢাকায় এ অবস্থা আরও প্রকট। শিশুকিশোর এবং বয়স্ক নাগরিকদের যে বিনোদনের প্রয়োজন, লেখাপড়া বা কর্মের ফাঁকে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা দরকার, একটু ছুটি কাটানো আবশ্যক, এসবের কোনো সুযোগ থাকছে না।

সম্প্রতি একদিন রমনা পার্কে গেলাম। আমি ঢাকা শহরের বাসিন্দা নই। তাই নিয়মিত যাওয়া হয় না। তবে যখনই ঢাকায় থাকি, সুযোগ পেলেই ভোরে মাঝে মাঝে রমনা পার্কে যাই। সেদিন গিয়ে পার্কের ভেতরে ঢুকেই শুনতে পেলাম এক জায়গায় সমবেত কণ্ঠস্বর, ‘পনেরো-ষোলো-সতরো’। আরেক জায়গায়, ‘লেফট-রাইট, লেফট-রাইট’। অন্যত্র ‘হা হা’ হাসির রোল, এ রকম কত-কী! বলা নিষ্প্রয়োজন, দলে দলে একেক জায়গায় ব্যায়াম চলছে। দল শুধু পুরুষের নয়। নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার। সেই দল ছোট, বড়, মাঝারি—নানা রকমের।
গোটা পার্ক হাঁটতে হাঁটতে নজরে পড়ল বয়সী মানুষগুলো বিপুল উৎসাহে নিবেদিত হয়ে দল বেঁধে ব্যায়াম করছেন। তাঁরা একেকটি চমৎকার নাম দিয়েছেন তাঁদের দলের। উৎস, লেক ভিউ, আলফা ইয়োগা, ব্যাংকার্স চত্বর, শতায়ু অঙ্গন, মহিলা অঙ্গন ইত্যাদি। দল ছাড়াও ব্যক্তি, পরিবার ভিন্ন ভিন্নভাবে দুহাত দুলিয়ে অবিরাম হেঁটে চলেছেন। বয়সভেদেনির্বিশেষে নারী-পুরুষ সবাই। হাঁটাহাঁটি শেষে ব্যায়াম করছেন। অনেকে এসেছেন শিশুসন্তানকে হাতে ধরে। শিশু-কিশোরেরা তায়কোয়ান্দো, কুংফু শিখছে পার্কের আরেক দিকে। চমৎকার ওয়াকওয়ে করা হয়েছে হাঁটার জন্য। হাঁটা সেরে কেউ কেউ টলটলে জলের সুবিস্তৃত লেকের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন জিরিয়ে নিতে; মনকে আরও শান্ত কোমল করতে।

আমি যখন রমনায় গিয়েছি, তার কয়েক দিন আগে বেশ বাড়াবাড়ি বৃষ্টি হয়েছে। আর বৃষ্টি হলে অপরূপ হয়ে ওঠে রমনা। টইটম্বুর লেক। সবুজে সবুজ বনানী। ঘাসের মাথায় সূর্যের আলো পড়ে ঝিলমিল করে ওঠে। বৃষ্টি শেষের মৃদুমন্দ হাওয়া হৃদয় মনকে উদাস করে দেয়।

কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পার্ক ব্যবহারে কিছু নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়েছে। যেমন পরিবেশদূষণ এড়ানোর জন্য পার্কে সিগারেট খাওয়া নিষেধ। সেখানে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা নিষেধ। ভিখারির ভিক্ষা করা মানা। গাছের ফুল ছেঁড়া নিষেধ। কেউ খাবার নিয়ে পার্কের ভেতর প্রবেশ করতে পারবে না। কেননা খাবারের উচ্ছিষ্ট পরিবেশ নষ্ট করে।

পার্কের বিভিন্ন এলাকায় সার্বক্ষণিকভাবে বেশ কয়েকটি ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। তাতে রমনা পার্ককে প্রশান্তির একটি স্থান হিসেবে বর্ণনা করে ৬৮ দশমিক ৫ একর জমির ওপর অবস্থিত পার্কটি সম্পর্কে প্রাঞ্জল ভাষায় ও সুন্দর উচ্চারণে অনেক তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করতে স্বাধীন বাংলাদেশের ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে বৃক্ষরোপণ করেন বঙ্গবন্ধু। ২০১৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে আবারও উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। নিরাপত্তা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, নির্মল বায়ু সঞ্চালনের জন্য লেক কাটা, লাল রঙের ওয়াকওয়েসহ নানা রকম আয়োজনে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হয়েছে পার্কটিকে।

চারটি আধুনিক টয়লেট। টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য সার্বক্ষণিক কর্মী নিযুক্ত আছেন। শিশু চত্বর, আধুনিক কফি কর্নার, বসার বেঞ্চ, এলইডি ডিসপ্লে, সন্ধ্যায় উজ্জ্বল আলোর ব্যবস্থা রয়েছে। লেকের ওপরে কাঠের সেতু নান্দনিক শোভাবর্ধনে সহায়ক। সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এর তত্ত্বাবধান করে থাকে। নির্দেশনায় পার্কের নানা রকম নিয়মকানুনের পাশাপাশি যথাস্থানে ব্যায়াম করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। রাস্তায় বা মানুষের চলাচলের পথে ব্যায়াম না করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।

সবুজ সতেজ নানা রকম গাছ-গাছালিতে সমৃদ্ধ রমনা পার্ক। গাছ দেখে অবাক হতে হয়। সেখানে অনেক কম পরিচিত অথবা দুর্লভ প্রজাতির অজস্র বৃক্ষ রয়েছে। অঞ্জনগাছ, রক্ত কাঞ্চন, বুদ্ধ নারিকেল, বাউ বাব, নাগলিঙ্গম, মালি আমগাছ, শতবর্ষী বটগাছ, রুদ্র পলাশ, অর্জুনগাছ, পান্থপাদপ, বোতল পাম, এরিকাপাম—জানা-অজানা এমন অনেক নাম। অধিকাংশ গাছের নিচে গাছগুলোর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য একটি ইস্পাতের সুদৃশ্য প্লেটে নাম লেখা রয়েছে। বিভিন্ন গাছের উৎপত্তিস্থল, এর বৈশিষ্ট্য; বিশেষ করে ঔষধি গুণ সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় যে গাছের যত্ন নেওয়া উচিত, সেটা উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বৃক্ষবন্দনা কবিতা মনে পড়ে যায়:
হে নিস্তব্ধ, হে মহাগম্ভীর,/ বীর্যেরে বাঁধিয়া ধৈর্যে শান্তিরূপ 
দেখালে শক্তির।

কর্তৃপক্ষ পার্কের পরিছন্নতায় যথেষ্ট মনোযোগী, বেশ বোঝা যায়। কিছুটা দূরে দূরে চমৎকার ঢাকনাওয়ালা ডাস্টবিন রাখা আছে ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য।

ঘুরতে ঘুরতে দেখি একজন বাউল একতারায় গান শোনাচ্ছেন, ‘কন্যা আগা নায়ে ডুবুডুবু পাছা নায়ে বইসো...’। ভোরের হাওয়ায় মাটির সুরের সে গান অন্তরের গভীরে আনন্দের খোরাক জোগায়।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখা হয়ে গেল ব্যাংকার্স চত্বরের সভাপতি মাহতাব আলী রাশেদীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, চাকরি থেকে অবসর নেওয়া প্রায় অর্ধশত সদস্যের এই দলে অধিকাংশই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মী। তবে অন্য পেশারও কেউ কেউ আছেন, যাঁদের কেউ সচিব ছিলেন, কেউবা ব্যবসায়ী। তিনি জানালেন, প্রায় আধা ঘণ্টা তাঁরা হাঁটেন। অতঃপর শরীরচর্চা করেন। শরীরচর্চা ও হাঁটার মধ্য দিয়ে চমৎকার সময় কাটে তাঁদের। শরীর-মন দুটোই ভালো থাকে। ভালো লাগল জেনে যে এই দলে একজন প্রশিক্ষকও আছেন; তাঁর নাম রেজাউল হক। দলের সাধারণ সম্পাদক মো. আওরঙ্গজেবও একজন সাবেক ব্যাংকার।

অনেক ভালোর মধ্যে আমার এই দুষ্টু চোখ কোনো না-ভালোর দিকে নজর না দিলেই পারত। তবু নজর গেল—রমনা পার্কে ভুল বানানে কিছু নির্দেশক রয়েছে। কর্তৃপক্ষ সেগুলোতে একটু নজর দিলে ভাষার প্রতিও শ্রদ্ধা দেখানো যায়।

অবিরল সবুজ, নির্মল বাতাস—রমনা পার্ক ঢাকার ফুসফুস, বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার জায়গা। সচেতন সুস্থ নাগরিক তৈরির অন্যতম কারখানা। সব সময় চালু থাকুক এই কারখানা। সেখান থেকে উদ্দীপনা নিয়ে জেলায়, উপজেলায়, গ্রামে এমন কারখানা তথা পার্ক তৈরি হোক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চকরিয়া থানার ওসিকে প্রত্যাহারের নির্দেশ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার

হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজের আগেই বের হয়ে যেতে বলা হয় জেলেনস্কিকে

‘আমাদের অনুমতি ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করলে থানা ঘেরাও করব’, সরকারি কর্মকর্তার বক্তব্য ভাইরাল

এনসিপির কর্মীদের ঢাকায় আনতে সরকারের বাস রিকুইজিশন, সমালোচনার ঝড়

সিরিয়ায় রাশিয়ার ঘাঁটি রাখতে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের তদবির

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত