Ajker Patrika

তামাকচুল্লিতে পুড়ছে বনের কাঠ

আক্তার হোসেন, দীঘিনালা (খাগড়াছড়ি)
আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২২, ১১: ৫৭
Thumbnail image

খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় এ বছর ৪১৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টর জমির তামাক পোড়াতে একটা তামাকচুল্লি তৈরি করা হয়। এই হিসাবে উপজেলায় এখন চার শতাধিক চুল্লিতে তামাক পোড়ানো হচ্ছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। এসব চুল্লির বিষাক্ত ধোঁয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি করেছে। এ ছাড়া তামাক পোড়াতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার কবাখালী ইউনিয়নের হাচিনসনপুর এলাকায় তামাকচুল্লিতে অভিযান চালিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে চার ব্যবসায়ীকে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

তাঁদের মধ্যে তামাক উৎপাদনকারী জয়নাল আবেদীনকে ১০ হাজার টাকা, ইউনুস মিয়াকে ২৫ হাজার, নুরুল আবসারকে ২৫ হাজার ও দেলোয়ার হোসেনকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

দীঘিনালা পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, ‘প্রতি হেক্টর জমির তামাক পোড়াতে একটা চুল্লি তৈরি করা হয়। প্রতিটি তামাকচুল্লিতে বছরে ৬০০ থেকে ৭০০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়। এতে যে পরিমাণ বনায়ন ধ্বংস করা হচ্ছে, তাতে এখানকার পরিবেশ হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম চলমান থাকলেই এই অঞ্চলে তামাক উৎপাদন নিরুৎসাহিত করা সম্ভব। পরিবেশ সুরক্ষায় তামাক উৎপাদন বন্ধ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর দীঘিনালায় ৪১৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ৪৩০ হেক্টর। কর্মকর্তারা মনে করেন, ভুট্টা চাষে কৃষকদের প্রণোদনা, বিনা মূল্যে বীজ ও সার বিতরণের ফলে তামাক চাষ কমেছে।

এদিকে উপজেলায় মাইনী নদীর দুই তীর ছাড়াও ছোট মেরুং, হাজাছড়া, ইয়ারাংছড়ি, বড় মেরুং, বেতছড়ি, মধ্য-বোয়ালখালী, কবাখালী, হাচিন সনপুর, আমতলী এলাকায় ব্যাপক হারে তামাক চাষ করা হয়েছে। উৎপাদিত তামাক পোড়াতে নিয়মনীতি না মেনেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য চুল্লি। এসব চুল্লির অধিকাংশই উর্বর ফসলি জমি, রাস্তার ধার ও বিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত। জ্বালানি চুল্লির বিষাক্ত ধোঁয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি করেছে। এ ছাড়া তামাক পোড়াতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মৌসুম শুরু হওয়ায় চুল্লিগুলোতে সব সময়ই তামাক পোড়ানো হচ্ছে। এই বিষাক্ত ধোঁয়া বাসাতে আশপাশের বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও ঢুকে পড়ছে। তামাক পোড়া নিকোটিনের বিষাক্ত গন্ধে ঘরে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া চুল্লি থেকে যেকোনো সময় বসতবাড়িতে আগুন লাগার আশঙ্কাও রয়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তনয় তালুকদার জানান, তামাক মূলত হৃৎপিণ্ড, লিভার ও ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ধূমপানের ফলে হার্ট অ্যাটাক, ব্রেন স্ট্রোক, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজের (সিওপিডি) ঝুঁকি তৈরি করে। এ ছাড়া ফুসফুসের ক্যানসার, প্যানক্রিয়াসের ক্যানসার, ল্যারিংস ও মুখগহ্বরের ক্যানসারের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়।

ডা. তনয় তালুকদার বলেন, ‘তামাক মৃত্যু ঘটায়—এটি এখন কথার কথা নয়, প্রমাণিত সত্য। ধূমপান শুধু ব্যবহারকারীর ক্ষতিই করে না, তাদের আশপাশে থাকা মানুষ এই ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকে না। পরোক্ষ ধূমপান সংক্রামক ও অসংক্রামক উভয় রোগ সৃষ্টি করে। ধূমপান না করেও নারীর স্বাস্থ্য ও গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হয়। এখনই আমাদের তামাক বাদ দেওয়া উচিত। তা না হলে তামাকের ক্ষতির প্রভাব থেকে আমরা কেউ বাঁচতে পারব না।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নুরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘কৃষকদের তামাকবিমুখ করতে হলে আমাদের বেশ কিছু বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথমত স্থানীয়ভাবে বাজার সৃষ্টি করতে হবে। দ্বিতীয়ত উৎপাদিত পণ্য মজুত করে রাখার জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে হিমাগার তৈরি করতে হবে, যাতে কৃষকেরা পণ্যের উপযুক্ত মূল্য পান। তামাকচাষিদের কীভাবে কৃষিমুখী করা যায়, সে জন্য আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’

অভিযান শেষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা মুস্তফা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে তামাকচুল্লি স্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো সুস্পষ্ট বিধিবিধান নেই। এসব তামাকচুল্লিতে বনায়ন ধ্বংস করে বিষাক্ত তামাক পোড়ানো হচ্ছে। এতে করে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। তা ছাড়া বায়ুদূষণও হচ্ছে। তামাকচুল্লিতে উপজেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত