Ajker Patrika

বড়লেখার বনেও নিরো!

ইয়াহ্ইয়া মারুফ, পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে ফিরে 
আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২৩, ১২: ১৫
বড়লেখার বনেও নিরো!

মৌলভীবাজারের বড়লেখায় সংরক্ষিত বনে আগুনের খবর জানানোর ছয় দিন পর সেখানে যান বন কর্মকর্তা। এর আগেই পুড়ে খাক প্রায় ৪০ হেক্টরের গাছ-উদ্ভিদ। এ যেন ‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল’—বহুল প্রচলিত প্রবাদের নতুন সংস্করণ!

রোমবাসীর ধারণা ছিল, নিজের স্বর্ণগৃহ বানাতে রোমান সাম্রাজ্যের পঞ্চম সম্রাট নিরোই শহরে আগুন দিয়েছিলেন। আর বড়লেখার সংরক্ষিত বনের আশপাশের মানুষের অভিযোগ, বন কর্মকর্তার মদদে শ্রমিকদের দিয়ে এ আগুন দিয়েছেন স্থানীয় উপকারভোগীরা। হাতি তাড়াতে, কৃত্রিম বনায়ন ও পান চাষের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয়। বনের বৈশিষ্ট্য বদলাতে এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে বন বিভাগের দাবি, সিগারেটের অবশিষ্টাংশ থেকে আগুনের সূত্রপাত। এতে তেমন ক্ষতিও হয়নি।

বাংলাদেশ-ভারতের আন্তসীমান্তব্যাপী ছয়টি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের একটি মৌলভীবাজারের বড়লেখার পাথারিয়া হিলস রিজার্ভ ফরেস্ট। বড়লেখা রেঞ্জের সমনভাগ এলাকায় বনের আয়তন ১ হাজার ৮৫০ হেক্টর। এটি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের নির্বাচনী এলাকায়। বনটিতে চারটি বিলুপ্ত প্রজাতির বন্য হাতিসহ ২০০ প্রজাতির প্রাণীর বসবাস বলে ধারণা করা হয়। সম্প্রতি ১১ দিনের আগুনে এই বনের ধলছড়ি, মাকাল জোরা, আলামবাড়ির ১২টি ছোট-বড় টিলাসহ প্রায় ৪০ হেক্টর জায়গার সব গাছ, প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো বিভিন্ন উদ্ভিদ পুড়ে গেছে।

ছবি: আজকের পত্রিকা

গত মঙ্গলবার টিলা-পাহাড়ের দুর্গম এই বনাঞ্চল ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্য হাতির অন্যতম খাবার বাঁশ। হাতি তাড়ানোর কৌশল হিসেবে ধলছড়ি, মাকাল জোরা, আলামবাড়ির মুলি ও মাকাল বাঁশ কেটে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে পাশেই কৃত্রিম বনায়নে লাগানো পান বাগান সম্পূর্ণ অক্ষত। বনে বাঁশ কাটতে আসা মোকাম চা-বাগানের শ্রমিক রমেন, দিলীপ ও মহাবীর বলেন, বাঁশ কাটার পর জুম (পানের বাগান) বানানো হবে। খাসিয়ারা পান চাষ করে। পূর্বজুড়ি ইউনিয়নের জুমকান্দির আব্দুল ও আব্দুর রহমান তাঁদের সর্দার। 

বিলাসী, গুনমনি, বিপুলা ও আলোমনিরা বলেন, প্রায় ১৫ দিন ধরে আগুন জ্বলেছে। তাঁরা ১২০ টাকা রোজে কাজ করেন। খাসিয়া মহাজন টাকা দেন। বড়লেখা ও ঢাকায় তাঁদের নাম গেছে। তাঁরা বন বিভাগের সদস্য। সুমন নামের আরেক শ্রমিক বলেন, বন বিভাগের লোকের মাধ্যমে পান বাগানে কাজ পেয়েছেন। তাঁরাই বাগান করতে দিয়েছেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বন বিভাগ ও বিট কর্মকর্তা নুরুল ইসলামের মদদে কয়েকজন বনে বাঁশ কাটান। দক্ষিণবাগ ইউনিয়নের কামাল মেম্বারের নাম এলেও তিনি অস্বীকার করেছেন।কাসেমনগরের আনোয়ার মোল্লা ও পূর্বজুড়ী ইউনিয়নের জামকান্দির আব্দুর রহমান বলেন, মাকাল জোরা নয়, তাঁদের অন্য এলাকায় বনায়নের কথা চলছে।

মাধব এলাকার ৫ নম্বর পানপুঞ্জির পাইলট মারলিয়া মাকাল জোরার পাশে ২০০৯ সালে বনায়ন শুরু করেন। গাছ বড় হওয়ার পর পান চাষ করছেন। ১ মার্চ অ্যাঞ্জেল মোখিমসহ তাঁর কয়েকজন প্রতিবেশী প্রথমে আগুন দেখেন। বিষয়টি মোবাইল ফোনে পাইলট ও বিট কর্মকর্তা নুরুল ইসলামকে জানান। বিট কর্মকর্তা না গেলেও পাইলট মারলিয়া ঘটনাস্থলে লোক পাঠান। তিনি বলেন, হাতির ভয়ে বাঙালি ও চা-শ্রমিকেরা সেখানে কাজ করতে চায় না বলে হাতি তাড়ানোর কৌশল হিসেবে প্রাণীটির প্রধান খাদ্য বাঁশ কেটে পোড়ানো হয়। অ্যাঞ্জেল মোখিমসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, মাকাল জোরায় আগুন লাগার স্থানে চা-বাগানের কয়েকজন শ্রমিক কাজ করেন।

ছবি: আজকের পত্রিকামঙ্গলবার সন্ধ্যায় জামকান্দি বাজারে চায়ের দোকানে কথা হয় এলাকার কয়েকজন যুবক-বৃদ্ধের সঙ্গে। প্রথমে বিট কর্মকর্তা ও সুবিধাভোগীদের ভয়ে কেউ কথা বলতে চাননি। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তাঁরা বলেন, যারা বনে বাগান করতে চায় তারাই আগুন দিয়েছে। হাতিসহ বন্য প্রাণী তাড়াতে বাঁশঝাড়সহ বন উজাড় করা হচ্ছে। হাতি বনে খাবার না পেয়ে লোকালয়ে কলাবাগান খেয়ে যাচ্ছে। ঘরবাড়ির ক্ষতি করছে। প্রতিবাদ করলে মামলায় পড়তে হয়। এক যুবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘কী লাভ এসব বলে? গত বছর আগুন দেওয়ার প্রতিবাদ করায় আমার বাবা বিট কর্মকর্তার মিথ্যা মামলার আসামি হন। বন কর্মকর্তাদের সহায়তায় প্রভাবশালীরা বন ধ্বংস করেন।’

অ্যাঞ্জেল মোখিম ১ মার্চ ফোনে বিট কর্মকর্তা নুরুল ইসলামকে আগুনের খবর দেওয়ার কথা জানালেও তিনি আগুন নেভাতে যান ৭ মার্চ। তিনি এ ব্যাপারে ১১ মার্চ বড়লেখা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এতে উল্লেখ করা হয়, সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ থেকে আগুনের সূত্রপাত। মাত্র দুই হেক্টর জায়গা পুড়ে গেছে। একটি সূত্র নুরুল ইসলামকে ওএসডি করার কথা জানালেও মঙ্গলবার নিজ কার্যালয়ে তিনি বলেন, তাঁকে বড়লেখা রেঞ্জ কর্মকর্তার অফিসে ডেকে পাঠানো হয়েছে।

বড়লেখা রেঞ্জ কর্মকর্তা শেখর রঞ্জন দাস মঙ্গলবার পরিদর্শন করে জিপিএস মেশিনে মাপার কথা জানিয়ে দাবি করেন, ৪ দশমিক শূন্য ৫ একর জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কে বা কারা সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ ফেলে আগুন ধরিয়েছে। সামান্য যে ক্ষতি হয়েছে, তা আমরা পুষিয়ে নেব। নুরুলকে হয়তো ওএসডি করা হতে পারে। গত বছর বনের অন্যদিকে আগুন লেগেছিল। সেদিক এখন ঠিক হয়ে গেছে। কারা লাগিয়েছে সেটা তদন্তে জানা যায়নি।’ তিনি বলেন, তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। জনবলসংকট থাকায় ঠিকমতো দেখাশোনা করা যায় না। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত