Ajker Patrika

রাজনীতির মানুষ খসরু ভাই

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১: ৫০
Thumbnail image

শেখ হাসিনার ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিএনপির যে ধারাবাহিক সংগ্রাম তাতে অনেকের সঙ্গে নানাভাবে হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল দলটির এখনকার স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে। তাঁর পিতা মাহমুদুন্নবী চৌধুরী ছিলেন ব্যবসায়ী। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর বাংলার নেতারা যুক্তফ্রন্ট গঠন করে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিলে মাহমুদুন্নবী চৌধুরী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের হাত ধরে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে এমএলএ নির্বাচিত হন এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিযুক্ত হন। 

নবী চৌধুরী ষাটের দশকে সর্বদলীয় নেতা হিসেবে চট্টগ্রামে বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেন। তিনি চট্টগ্রামের চারটি ট্রেড বডিকে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি ঐক্যবদ্ধ সংগঠনে রূপান্তরিত করতে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে উদ্যোগ নেন। তিনি পরে চেম্বারের সভাপতি নিবাচিত হন। তাঁর দুই পুত্র আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরীও বাংলাদেশ আমলে চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি নির্বাচিত হন। 

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী হচ্ছেন নবী চৌধুরীর দ্বিতীয় ও মেজ পুত্র। তিনি চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্রলীগ করতেন এবং দলের অন্যতম নেতা ছিলেন। খসরু পরে উচ্চতর লেখাপড়ার জন্য বিদেশে চলে যান। বিদেশ থেকে লেখাপড়া শেষ করে দেশে এসে তিনি পারিবারিক ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। আমীর খসরু স্বাধীনতার পরে চট্টগ্রাম চেম্বারের সঙ্গে যুক্ত হন। আশির দশকে চেম্বারের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন এবং চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়া এক্সচেঞ্জ ফেডারেশনের প্রথম সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। 

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাজনীতি শুরু করলে তাঁর রাজনীতির সঙ্গে আমীর খসরু তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার সাযুজ্য খুঁজে পান। তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন এবং চট্টগ্রাম বিএনপির রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে থাকেন। 

দলীয় রাজনীতিতে আমীর খসরু খুব দ্রুত উন্নতি করেন। চট্টগ্রামে আবদুল্লাহ আল নোমান, কর্নেল অলি, মোরশেদ খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী—এই চারজনই বিএনপির রাজনীতিতে বড় নেতা। অলি বিএনপি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন তিনজন—খসরু, মোরশেদ খান ও নোমান। প্রথম দিকে দলীয় রাজনীতিতে খসরুর চেয়ে অন্যদের প্রভাব ও গুরুত্ব ছিল বেশি। ব্যবসায়ী ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসার কারণে খসরু নিজেও হয়তো প্রথম দিকে রাজনীতিটা তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। কিন্তু ক্রমান্বয়ে তিনি সিরিয়াস হতে থাকেন। তিনি প্রথমে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক হলেন। পাশাপশি কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও অংশ নিচ্ছিলেন। ওয়ান ইলেভেনে মাইনাস ওয়ান, টু, সংস্কারপন্থী ইত্যাদি হুজুগ চলার মধ্যে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি নেতারা একে একে মামলায় আটক এবং কারও কারও সাজা হতে থাকে। মোরশেদ খানের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তিনিও ফেরার হয়ে যান। নোমান অসুস্থ হয়ে পড়েন। এটাই খসরুকে দলীয় নেতৃত্বে শক্ত ও পাকাপোক্তভাবে বসে যাওয়ার জন্য মোক্ষম সুযোগ এনে দেয়।

এই সময় খসরু ব্যক্তিগত জীবনের ওপরও ঝুঁকি নেন। তিনি তো বড়লোকের ছেলে, নিজেও ব্যবসা-বাণিজ্য করে বিত্তশালী হয়েছিলেন; পিতা নবী চৌধুরী যেমন তাঁর রাজনীতির একপর্যায়ে ড্রয়িংরুম থেকে মাঠে নেমে এসেছিলেন; খসরুও তেমনি মাঠের রাজনীতিতে নেমে গিয়েছিলেন। প্রায় প্রথম থেকেই তিনি মাঠে-ময়দানে, রাজপথে মিটিং-মিছিলে বজ্রমুষ্টি উত্তোলন করে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিতে দিতে রাজনীতিতে তোলপাড় সৃষ্টি করেন। কীভাবে তিনি গায়ে ধুলাবালি, কাদা লাগানোর রাজনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। পোশাকে ধোপদুরস্ত, চলাফেরায় কেতাদুরস্ত সেই মানুষটি রাতারাতি নিজেকে পাল্টে ফেলে আমজনতার কাতারে মিশে গেলেন। হিসাববিজ্ঞানের মাথা দিয়ে তাঁর বুঝতে কষ্ট হয়নি যে সময় পাল্টাচ্ছে। তিনি বেশ বুঝতে পারলেন রাজনীতিতে এক নতুন দিনের আগমনী হাওয়া এসেছে; বিএনপির রাজনীতিতে নতুন যুবরাজের রাজ্যাভিষেক ঘটে গেছে। তারেক রহমানের হাতেই আগামী দিনের বিএনপির নেতৃত্ব, ম্যাডামের বয়স হয়ে গেছে, রোগব্যাধিতে জর্জরিত শরীর। 

তো চট্টগ্রামের গর্বিত সন্তান খসরু ভাই তারেক রহমানের নেতৃত্বের প্রতি তাঁর পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করে ঢাকায় গত কয়েক বছরের কঠিন সময়টা পাড়ি দিতে দলের হাল ধরে ছিলেন শক্ত হাতে। ভাবতে অবাক লাগে, সুন্দর মানুষটি কতবার পুলিশের মার খেয়ে একবার প্রিজন ভ্যানে করে জেলে, একবার আদালত করতে করতে যন্ত্রণাবিদ্ধ দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দিলেন। শরীরে পুলিশ ও সন্ত্রাসীর নির্যাতনের মারের দাগ শুকায়নি এখনো; অমানুষিক পরিশ্রম, অপরিসীম ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মানুষটিই আজ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। শেখ হাসিনার পতন ঘটানোর পর কোনো বিশ্রাম না নিয়ে তিনি আবার রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে এবং নির্বাচনের প্রস্তুতিতে লেগে গেছেন। তাঁর সঙ্গে চট্টগ্রামে যাঁরা রেসে ছিলেন, তাঁদের অনেক দূরে ফেলে এসেছেন তিনি। 

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে উপর্যুপরি তিনবার চট্টগ্রাম-৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

লেখক: নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত