Ajker Patrika

বস্তির ময়লা পড়েই থাকে

সাইফুল মাসুম, ঢাকা
আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০২২, ১৩: ৩০
Thumbnail image

হাজারীবাগের বউবাজার এলাকার আকবরের বস্তি। বস্তির পাশেই রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) একটি বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র (এসটিএস)। হাজারীবাগের বিভিন্ন এলাকার বর্জ্য প্রতিদিন এখানে এনে জমা করা হয়। অথচ পাশের আকবরের বস্তি, বউবাজার বস্তি ও বালুর মাঠ বস্তির ময়লা-আবর্জনা ঠিকমতো অপসারণ করা হয় না। ফলে দূষিত পানি ও দুর্গন্ধময় বায়ুর কারণে বস্তির মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে। জীবন-জীবিকাতেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব।

আকবরের বস্তির বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন ও মুর্শেদা বেগম দম্পতি। মুর্শেদা বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। আর স্বামী নাজিম উদ্দিন দিনমজুরের কাজ করেন বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্রটিতে। তাঁদের দুই সন্তান মাহিয়া ও মাহিম জন্ম থেকে চর্মরোগে ভুগছে। সারা শরীর ফোসকায় ভরে রয়েছে বলে জানালেন। চার বছর বয়সী সন্তান ফারিয়া মিমসহ একই বস্তিতে বসবাস করেন রিকশাচালক আব্দুল হেকিম ও গৃহকর্মী ফাতেমা দম্পতি। আব্দুল হেকিম বলেন, ‘আমার মেয়েটা ময়লার স্তূপে খেলাধুলা করে। কিছুদিন আগেও তার ডায়রিয়া হইচে।’

ডিএসসিসি এলাকার পাশাপাশি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বস্তিগুলোতেও একই চিত্র। মিরপুর ১২-এর মোল্লার বস্তিতে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে বসবাস করেন মো. উজ্জল মাহবুব। উজ্জল মাহবুব বলেন, ‘আশপাশের আবাসিক এলাকা থেকে সিটি করপোরেশনের লোকজন ময়লা নিয়ে যায়। কিন্তু বস্তির ভেতরে সিটি করপোরেশনের লোক যায় না। সারা বছর পরিবেশ খুব নোংরা থাকে।’

কড়াইল বস্তি উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ময়লা সংগ্রহ করি। ভ্যান-সংকটের কারণে সব সময় সব ময়লা সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। অনেক সময় ময়লা সংগ্রহ করার পর এসটিএসে দিলেও তারা নিতে চায় না। টাকা দাবি করে। টিঅ্যান্ডটি কলোনি ও মহাখালীর এসটিএসে এ ধরনের সমস্যা হচ্ছে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ‘বস্তিতে শুমারি ও ভাসমান লোকগণনা ২০১৪’-এর তথ্য অনুসারে, দেশে বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৮টি। এসব বস্তিতে সাড়ে ২২ লাখ মানুষ বসবাস করে। আর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে বস্তি রয়েছে ৩ হাজার ৩৯৪টি। এতে সাড়ে ছয় লাখ মানুষ বসবাস করে। তবে বেসরকারি হিসাব বলছে, ঢাকায় প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি বস্তি রয়েছে। এতে প্রায় ৪০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। তাদের অধিকাংশ শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ।

বস্তিবাসীর অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেন কোয়ালিশন ফর দ্য আরবান পুওরের (কাপ) নির্বাহী পরিচালক খোন্দকার রেবেকা সান ইয়াত। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঢাকার অধিকাংশ বস্তি থেকে বর্জ্য অপসারণ করা হয় না। সিটি করপোরেশন ময়লা সংগ্রহে আলাদা ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছে। তারা বস্তি এলাকা থেকে ময়লা নেয় না।

বস্তিবাসীর অধিকার সুরক্ষা কমিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি হোসনে আরা বেগম রাফেজা বলেন, ‘ঢাকায় ৫ হাজারের বেশি বস্তিতে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বাস করে। ময়লা-আবর্জনার কারণে এই মানুষগুলো সব সময় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে।’

মহাখালীর সাততলা ও কড়াইল বস্তি ঘুরে দেখেছেন ডিএনসিসি অঞ্চল-৩-এর সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আজিজুন নেছা। তিনি বলেন, ময়লার দুর্গন্ধে বস্তিতে টেকা যায় না। বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে বস্তির অনেকে যক্ষ্মা, ত্বকের সমস্যা, শ্বাসকষ্টে ভুগছে। বস্তির অনেক লোক শহরের বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ও বাসাবাড়িতে কাজ করে। তাদের মাধ্যমে পুরো শহরে রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘বস্তিতে যে মানুষ রয়েছে। তারা সিটি করপোরেশনের সেবা পাওয়ার অধিকার রাখে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যে প্রক্রিয়া এটা বস্তি গুলোতেও পৌঁছানো উচিত। নইলে বস্তির পাশাপাশি আশপাশের এলাকায়ও পরিবেশগত সংকট তৈরি হবে।’

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘ঢাকার মতো বর্জ্য অব্যবস্থাপনা পৃথিবীর খুব কম শহরেই আছে। এখানে বস্তির মানুষেরা পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় বসবাস করে। বর্জ্য একটা সম্পদ, এটা থেকে বায়োগ্যাস, সার ও বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব। বর্জ্যকে যত দিন সম্পদ হিসেবে ভাবা হবে না, তত দিন কোনো সমাধান আসবে না।’

জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম রেজা বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ১০ বছরে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। বস্তির বর্জ্য সমস্যাও নিরসন করা হবে।

ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘আবাসিক হোক কিংবা বস্তি, এলাকা ধরে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। বস্তিতে এমন সমস্যা থাকার কথা নয়, বিষয়টি দেখব।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত