অর্ণব সান্যাল
‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজকাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।’
প্রায় ৫০ বছর আগে সদ্য জন্ম নেওয়া একটি দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক বিন্যাস নিয়ে লিখতে বসে শুরুতেই এমন মন্তব্য করেছিলেন কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং সর্বতোভাবে একজন স্বাধীন চিন্তক আহমদ ছফা। ১৯৭২ সালে তিনি লিখেছিলেন, ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হওয়ার পর এ নিয়ে বইও বের হয়েছিল। এই রচনাটির ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে চলতি বছর। সে উপলক্ষেই চলুন একটু পেছন ফিরে এ দেশের বুদ্ধিবৃত্তির আদি ধারা অবলোকন করা যাক এবং অবশ্যই তার পাশাপাশি বর্তমান ধারার একটি তুলনামূলক আলোচনাও থাকবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আহমদ ছফার ৫০ বছর আগের দেওয়া বক্তব্য আমরা কি নিঃসন্দেহে গ্রহণ করে নেব? যেমন আপত্তি জানানো যেতেই পারে, তেমনি ছফার বেশ কিছু বিশ্লেষণ যুক্তির বিচারে গ্রহণ করে নেওয়াই শ্রেয়। ছফা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিবৃত্তির তৎকালীন বিন্যাসকে আতশ কাচের নিচে নিয়েছিলেন। তাতে ক্ষুরধার সমালোচনা ছিল। হ্যাঁ পাঠক, সত্যিই সেই সমালোচনায় ধার ছিল, মরচে নয় এবং তাতে অনেকের আঁতে ঘা লেগেছিল এবং এখনো নিশ্চিতভাবেই লাগে।
১৯৭২ সালে লেখা ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ রচনায় আহমদ ছফা তৎকালীন বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের ‘পাকিস্তানি’ মানসিকতার সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদ। ছফার কথায়, বাংলাদেশের উন্মেষকালে এখানকার বুদ্ধিজীবীরা রবীন্দ্র সাহিত্যের ওপর হামলা বা বর্ণমালা সংস্কার প্রচেষ্টার প্রশ্নে কিছু ‘পোশাকি’ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবাদ করার কারণে বুদ্ধিজীবীদের কাউকে চাকরি হারাতে হয়েছে বা জেলে যেতে হয়েছে—এমন কোনো মানুষের নাম জানার সৌভাগ্য হয়নি বলে দাবি করেছিলেন ছফা। তাঁর আরও অনুযোগ ছিল যে শিল্প, সংস্কৃতি এবং সমাজের ‘অনেক গভীর, বিকট হাঁ করা’ প্রশ্নের বিষয়ে এক-দুজন ব্যতীত কোনো ‘প্রতিষ্ঠাবান’ বুদ্ধিজীবীই উচ্চবাচ্য করেননি। এসবের কারণ হিসেবে ছফা যেমন সাংস্কৃতিক এলিট শ্রেণির সুবিধাবাদী মনোভাবকে দায়ী করেছেন, তেমনি তৎকালীন শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের অপরিণত ভূমিকা এবং স্নায়ুযুদ্ধের কবলে পড়া বিশ্বের বিভিন্ন অক্ষশক্তির (যেমন মার্কিন ডলার) হয়ে কাজ করাকেও দায়ী করেছেন। এসেছে ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের দৃষ্টির সংকীর্ণতা ও দূরদর্শিতার অভাবের দরুন ধীরে ধীরে সংস্কৃতি এবং রাজনীতি একে অপরের পরিপূরক না হয়ে দুটি আলাদা জলঅচল কুঠুরিতে পরিণত’ হওয়ার বিষয়টিও।
মজার বিষয় হলো, ৫০ বছর পরও আমাদের বুদ্ধিজীবীরা সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন বললে অত্যুক্তি হয় না। সমস্যা সেই সুবিধাবাদই। এ দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর সজোরে আওয়াজ তোলেননি। যে ব্যক্তিকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে পুরো বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পটপরিবর্তন হলো, তাতেও খুব জোরালোভাবে একযোগে প্রতিবাদ আসেনি এ দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় থেকে। হয়তো তখনকার ভয়ের আবহকে কারণ হিসেবে দেখাতে চাইবেন অনেকে, কিন্তু যেকোনো ভয়ের জাল ছিঁড়ে আত্মপ্রকাশ করাই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মূল কাজ। তবে হ্যাঁ, এ দেশে আনুষ্ঠানিক সামরিক শাসনামলের শেষের দিকে আমরা তার কিছুটা দেখতে পেয়েছি। সে সময় কেউ কেউ যেমন বিক্রিও হয়েছেন, অনেকেই আবার গণতন্ত্রে ফিরতে প্রতিবাদে মুখরও হয়েছেন।
কিন্তু গণতন্ত্রে ফেরার পরই সেই একমুখী প্রতিবাদ, বহুমুখী সুবিধাবাদে ফের আটকে যায়। ১৯৯১ সালের পর থেকে এ দেশে বুদ্ধিজীবীদের (কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী প্রমুখ) নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব আমরা দেখেছি এবং এখনো দেখতে পাই। যতক্ষণ পর্যন্ত না এসব বুদ্ধিজীবীর একদম নিজের ঘরের চালায় আগুন না লাগে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা মুখ খোলেন না। এ দেশে এখন কবি-সাহিত্যিকদের চেয়েচিন্তে পুরস্কার নিতে দেখা যায়। সাংবাদিকেরা নিরপেক্ষতার ভিত্তিমূল ভেঙেচুরে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শের বয়ানে নিজেদের পেশাভিত্তিক সংগঠনকে দুই ভাগ করে এক জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বা ভেতরে আলাদা আলাদা সমাবেশ করেন। কেউ বলেন, দেশ ভালো চলছে। কেউ আবার সমালোচনা করতে গিয়ে ভালো-মন্দের বিচারক্ষমতা আর বজায় রাখেন না। এই দুই পক্ষ প্রেস বিজ্ঞপ্তির মতো নিজেদের রাজনৈতিক পথের সুপ্রশংসা করে যান, তাতে যুক্তি থাকুক আর না-ই থাকুক! আর যাঁরা এসবে নেই, তাঁরা কেউ কেউ করপোরেট গোলামি করছেন। কিন্তু কয়জন আর শুধু সাংবাদিকতার মূলনীতির নিরিখে সাংবাদিকতা করছেন? সংখ্যাটা বোধ হয় আঙুলের কর গুনেই বের করা সম্ভব হবে। আর এসবের মূল কারণ সর্বতোভাবে সে-ই কলাটা-মুলোটা।
একই অবস্থা দেখা যাবে শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী প্রমুখের মধ্যে। শিক্ষকদের মধ্যে কেউ সাদা, কেউ নীল। দলবাজি এতটাই করুণ অবস্থায় গেছে যে ভিন্নমতের কারও ছায়াও মাড়াতে চান না কেউ, যুক্তি দিয়ে সমালোচনা তো দূরের কথা। তাঁদের মধ্যে অনেকেই নিরপেক্ষভাবে শিক্ষাদানটাও করতে পারেন কি না, সন্দেহ। কীভাবে পারবেন? কেউ কেউ যে রাজনৈতিক দলের কৌশল নির্ধারণের কান্ডারির ভূমিকাও নিচ্ছেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলি। প্রায় ৮-১০ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু বলতে পারি যে আজকালকার শিক্ষকদের মধ্যে কিয়দংশই মেরুদণ্ড সোজা রেখে হক কথাটা কইতে পারেন না। কেউ কেউ শ্রেণিকক্ষে ‘সেক্যুলারিজম’-এর সঠিক অর্থটি বলতেও ভয় পান! দু-একজন যে একদম নেই, তা নয়। কিন্তু তাঁর গলায় আমরাই পরাচ্ছি জুতার মালা। ফলে হাজার হাজারের সত্যের অপলাপের বিপরীতে দু-একজনের সত্যকথন একসময় প্রলাপে পরিণত হচ্ছে।
অন্যদিকে সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে ছেলেখেলা করার শুরুটা নব্বইয়ের দশকের আগে থেকে সরকারনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন—তারের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল। ভিন্নমতের অনেককেই পাঁচ বছর অন্তর অন্তর সাদা তালিকা থেকে কালো তালিকায় ঢুকতে বা বেরোতে দেখা গেছে এবং একসময় সেটিই হয়ে গেল জনপ্রিয় ‘সংস্কৃতি’! এভাবেই এ দেশের সংস্কৃতিতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাও পক্ষপাতযুক্ত হয়ে গেল। সেটা এতটাই যে এখন কোনো উদ্যোগে সরকারি অনুদানের খবর পেলেই আমরা তাতে পক্ষ-বিপক্ষের গন্ধ শুঁকি! কারণ সংস্কৃতির দুনিয়ায় এ দেশে বাস্তবানুগ (বাস্তবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু) কোনো কিছু পাওয়া এখন ডুমুরের ফুল হয়ে গেছে। ফলে এ দেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে (নাটক, সিনেমা, গানসহ) ভাবমূর্তির সংকট দেখা দিয়েছে। এই ভাবমূর্তি ও তার সংকট আবার উভমুখী। কখনো ভাবমূর্তির কারণে সংকটের মুখে পড়েন কেউ কেউ, আবার কখনো কখনো সংকটই ভাবমূর্তিকে বিপদাপন্ন করে ফেলছে।
এই পরিস্থিতি কি এক দিনে সৃষ্টি হয়েছে? উত্তরটি অবশ্যই ‘না’। আমাদের আগের কয়েক প্রজন্মের ব্যর্থতাই আমরা বয়ে চলেছি।পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা অধুনা বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে উপযুক্ত পরিবর্তন না আসার পেছনেও এতদঅঞ্চলের বুদ্ধিজীবীদের অকর্মণ্যতাকেই দায়ী করেছিলেন আহমদ ছফা। তাঁর ভাষায়, ‘তেইশ-চব্বিশ বছর বড় কম সময় নয়। এই সিকি শতাব্দী পরিমাণ সময়ের মধ্যে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির ভিত্তিটি স্থাপিত হওয়া উচিত ছিল। বাংলাদেশের সাহিত্যে দু-তিনটি কবিতার বই, দু-তিনটি উপন্যাস, দু-তিনটি প্রবন্ধের সংকলন, দুটি কি তিনটি উল্লেখ করবার মতো নাটক বা অ-নাটক এই-ই তো আমাদের মোটামুটি মানস ফসল। এই সাহিত্য নিয়ে বিশ্বের দরবারে হাজির হওয়া দূরে থাকুক, সামগ্রিক বাংলা-সাহিত্যের উৎকর্ষের নিরিখে এ আর এমন কি! কালজয়ী এবং দেশজয়ী হওয়ার স্পর্ধা রাখে এমন কোনো সাহিত্য এ দেশে রচিত হয়নি।’
বাহাত্তরের বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস ও বর্তমান: ২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজকাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।’
প্রায় ৫০ বছর আগে সদ্য জন্ম নেওয়া একটি দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক বিন্যাস নিয়ে লিখতে বসে শুরুতেই এমন মন্তব্য করেছিলেন কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং সর্বতোভাবে একজন স্বাধীন চিন্তক আহমদ ছফা। ১৯৭২ সালে তিনি লিখেছিলেন, ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হওয়ার পর এ নিয়ে বইও বের হয়েছিল। এই রচনাটির ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে চলতি বছর। সে উপলক্ষেই চলুন একটু পেছন ফিরে এ দেশের বুদ্ধিবৃত্তির আদি ধারা অবলোকন করা যাক এবং অবশ্যই তার পাশাপাশি বর্তমান ধারার একটি তুলনামূলক আলোচনাও থাকবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আহমদ ছফার ৫০ বছর আগের দেওয়া বক্তব্য আমরা কি নিঃসন্দেহে গ্রহণ করে নেব? যেমন আপত্তি জানানো যেতেই পারে, তেমনি ছফার বেশ কিছু বিশ্লেষণ যুক্তির বিচারে গ্রহণ করে নেওয়াই শ্রেয়। ছফা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিবৃত্তির তৎকালীন বিন্যাসকে আতশ কাচের নিচে নিয়েছিলেন। তাতে ক্ষুরধার সমালোচনা ছিল। হ্যাঁ পাঠক, সত্যিই সেই সমালোচনায় ধার ছিল, মরচে নয় এবং তাতে অনেকের আঁতে ঘা লেগেছিল এবং এখনো নিশ্চিতভাবেই লাগে।
১৯৭২ সালে লেখা ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ রচনায় আহমদ ছফা তৎকালীন বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের ‘পাকিস্তানি’ মানসিকতার সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদ। ছফার কথায়, বাংলাদেশের উন্মেষকালে এখানকার বুদ্ধিজীবীরা রবীন্দ্র সাহিত্যের ওপর হামলা বা বর্ণমালা সংস্কার প্রচেষ্টার প্রশ্নে কিছু ‘পোশাকি’ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবাদ করার কারণে বুদ্ধিজীবীদের কাউকে চাকরি হারাতে হয়েছে বা জেলে যেতে হয়েছে—এমন কোনো মানুষের নাম জানার সৌভাগ্য হয়নি বলে দাবি করেছিলেন ছফা। তাঁর আরও অনুযোগ ছিল যে শিল্প, সংস্কৃতি এবং সমাজের ‘অনেক গভীর, বিকট হাঁ করা’ প্রশ্নের বিষয়ে এক-দুজন ব্যতীত কোনো ‘প্রতিষ্ঠাবান’ বুদ্ধিজীবীই উচ্চবাচ্য করেননি। এসবের কারণ হিসেবে ছফা যেমন সাংস্কৃতিক এলিট শ্রেণির সুবিধাবাদী মনোভাবকে দায়ী করেছেন, তেমনি তৎকালীন শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের অপরিণত ভূমিকা এবং স্নায়ুযুদ্ধের কবলে পড়া বিশ্বের বিভিন্ন অক্ষশক্তির (যেমন মার্কিন ডলার) হয়ে কাজ করাকেও দায়ী করেছেন। এসেছে ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের দৃষ্টির সংকীর্ণতা ও দূরদর্শিতার অভাবের দরুন ধীরে ধীরে সংস্কৃতি এবং রাজনীতি একে অপরের পরিপূরক না হয়ে দুটি আলাদা জলঅচল কুঠুরিতে পরিণত’ হওয়ার বিষয়টিও।
মজার বিষয় হলো, ৫০ বছর পরও আমাদের বুদ্ধিজীবীরা সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন বললে অত্যুক্তি হয় না। সমস্যা সেই সুবিধাবাদই। এ দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর সজোরে আওয়াজ তোলেননি। যে ব্যক্তিকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে পুরো বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পটপরিবর্তন হলো, তাতেও খুব জোরালোভাবে একযোগে প্রতিবাদ আসেনি এ দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় থেকে। হয়তো তখনকার ভয়ের আবহকে কারণ হিসেবে দেখাতে চাইবেন অনেকে, কিন্তু যেকোনো ভয়ের জাল ছিঁড়ে আত্মপ্রকাশ করাই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মূল কাজ। তবে হ্যাঁ, এ দেশে আনুষ্ঠানিক সামরিক শাসনামলের শেষের দিকে আমরা তার কিছুটা দেখতে পেয়েছি। সে সময় কেউ কেউ যেমন বিক্রিও হয়েছেন, অনেকেই আবার গণতন্ত্রে ফিরতে প্রতিবাদে মুখরও হয়েছেন।
কিন্তু গণতন্ত্রে ফেরার পরই সেই একমুখী প্রতিবাদ, বহুমুখী সুবিধাবাদে ফের আটকে যায়। ১৯৯১ সালের পর থেকে এ দেশে বুদ্ধিজীবীদের (কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী প্রমুখ) নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব আমরা দেখেছি এবং এখনো দেখতে পাই। যতক্ষণ পর্যন্ত না এসব বুদ্ধিজীবীর একদম নিজের ঘরের চালায় আগুন না লাগে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা মুখ খোলেন না। এ দেশে এখন কবি-সাহিত্যিকদের চেয়েচিন্তে পুরস্কার নিতে দেখা যায়। সাংবাদিকেরা নিরপেক্ষতার ভিত্তিমূল ভেঙেচুরে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শের বয়ানে নিজেদের পেশাভিত্তিক সংগঠনকে দুই ভাগ করে এক জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বা ভেতরে আলাদা আলাদা সমাবেশ করেন। কেউ বলেন, দেশ ভালো চলছে। কেউ আবার সমালোচনা করতে গিয়ে ভালো-মন্দের বিচারক্ষমতা আর বজায় রাখেন না। এই দুই পক্ষ প্রেস বিজ্ঞপ্তির মতো নিজেদের রাজনৈতিক পথের সুপ্রশংসা করে যান, তাতে যুক্তি থাকুক আর না-ই থাকুক! আর যাঁরা এসবে নেই, তাঁরা কেউ কেউ করপোরেট গোলামি করছেন। কিন্তু কয়জন আর শুধু সাংবাদিকতার মূলনীতির নিরিখে সাংবাদিকতা করছেন? সংখ্যাটা বোধ হয় আঙুলের কর গুনেই বের করা সম্ভব হবে। আর এসবের মূল কারণ সর্বতোভাবে সে-ই কলাটা-মুলোটা।
একই অবস্থা দেখা যাবে শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী প্রমুখের মধ্যে। শিক্ষকদের মধ্যে কেউ সাদা, কেউ নীল। দলবাজি এতটাই করুণ অবস্থায় গেছে যে ভিন্নমতের কারও ছায়াও মাড়াতে চান না কেউ, যুক্তি দিয়ে সমালোচনা তো দূরের কথা। তাঁদের মধ্যে অনেকেই নিরপেক্ষভাবে শিক্ষাদানটাও করতে পারেন কি না, সন্দেহ। কীভাবে পারবেন? কেউ কেউ যে রাজনৈতিক দলের কৌশল নির্ধারণের কান্ডারির ভূমিকাও নিচ্ছেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলি। প্রায় ৮-১০ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু বলতে পারি যে আজকালকার শিক্ষকদের মধ্যে কিয়দংশই মেরুদণ্ড সোজা রেখে হক কথাটা কইতে পারেন না। কেউ কেউ শ্রেণিকক্ষে ‘সেক্যুলারিজম’-এর সঠিক অর্থটি বলতেও ভয় পান! দু-একজন যে একদম নেই, তা নয়। কিন্তু তাঁর গলায় আমরাই পরাচ্ছি জুতার মালা। ফলে হাজার হাজারের সত্যের অপলাপের বিপরীতে দু-একজনের সত্যকথন একসময় প্রলাপে পরিণত হচ্ছে।
অন্যদিকে সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে ছেলেখেলা করার শুরুটা নব্বইয়ের দশকের আগে থেকে সরকারনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন—তারের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল। ভিন্নমতের অনেককেই পাঁচ বছর অন্তর অন্তর সাদা তালিকা থেকে কালো তালিকায় ঢুকতে বা বেরোতে দেখা গেছে এবং একসময় সেটিই হয়ে গেল জনপ্রিয় ‘সংস্কৃতি’! এভাবেই এ দেশের সংস্কৃতিতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাও পক্ষপাতযুক্ত হয়ে গেল। সেটা এতটাই যে এখন কোনো উদ্যোগে সরকারি অনুদানের খবর পেলেই আমরা তাতে পক্ষ-বিপক্ষের গন্ধ শুঁকি! কারণ সংস্কৃতির দুনিয়ায় এ দেশে বাস্তবানুগ (বাস্তবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু) কোনো কিছু পাওয়া এখন ডুমুরের ফুল হয়ে গেছে। ফলে এ দেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে (নাটক, সিনেমা, গানসহ) ভাবমূর্তির সংকট দেখা দিয়েছে। এই ভাবমূর্তি ও তার সংকট আবার উভমুখী। কখনো ভাবমূর্তির কারণে সংকটের মুখে পড়েন কেউ কেউ, আবার কখনো কখনো সংকটই ভাবমূর্তিকে বিপদাপন্ন করে ফেলছে।
এই পরিস্থিতি কি এক দিনে সৃষ্টি হয়েছে? উত্তরটি অবশ্যই ‘না’। আমাদের আগের কয়েক প্রজন্মের ব্যর্থতাই আমরা বয়ে চলেছি।পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা অধুনা বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে উপযুক্ত পরিবর্তন না আসার পেছনেও এতদঅঞ্চলের বুদ্ধিজীবীদের অকর্মণ্যতাকেই দায়ী করেছিলেন আহমদ ছফা। তাঁর ভাষায়, ‘তেইশ-চব্বিশ বছর বড় কম সময় নয়। এই সিকি শতাব্দী পরিমাণ সময়ের মধ্যে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির ভিত্তিটি স্থাপিত হওয়া উচিত ছিল। বাংলাদেশের সাহিত্যে দু-তিনটি কবিতার বই, দু-তিনটি উপন্যাস, দু-তিনটি প্রবন্ধের সংকলন, দুটি কি তিনটি উল্লেখ করবার মতো নাটক বা অ-নাটক এই-ই তো আমাদের মোটামুটি মানস ফসল। এই সাহিত্য নিয়ে বিশ্বের দরবারে হাজির হওয়া দূরে থাকুক, সামগ্রিক বাংলা-সাহিত্যের উৎকর্ষের নিরিখে এ আর এমন কি! কালজয়ী এবং দেশজয়ী হওয়ার স্পর্ধা রাখে এমন কোনো সাহিত্য এ দেশে রচিত হয়নি।’
বাহাত্তরের বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস ও বর্তমান: ২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪