তৌহীদ রেজা নূর
জেনোসাইডের স্বীকৃতি অর্জনের কাজটি মসৃণ নয়। যেহেতু আইনি সংজ্ঞার দ্বারা জেনোসাইড সংজ্ঞায়িত, তাই ঘটে যাওয়া অথবা ঘটমান অপরাধসমষ্টিকে কেউ ইচ্ছে হলেই জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে ঘোষণা দিতে পারেন না। ইতিহাসের আলোকে নানা কার্যকারণ বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি আইনের কষ্টিপাথরে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় এ ব্যাপারে। জেনোসাইড নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন, এ বিষয়ে যাঁরা পড়ান, আইনি লড়াই লড়েন, তাঁরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পূর্বাপর বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করেন কোথাও জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে কি হয়নি।
২৪ এপ্রিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্সের (আইএজিএস) পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে যে সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটির মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ রেজল্যুশন’ গৃহীত হয়েছে, যার মাধ্যমে আইএজিএস স্বীকৃতি দিচ্ছে যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে। জেনোসাইড স্কলাররা একযোগে দ্বিধাহীনভাবে বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের স্বীকৃতি দিক—এই বাসনা আমরা দীর্ঘদিন লালন করে আসছি। সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো। তবে সুন্দর বৈশিষ্ট্যময় এই দিনটিতে এসে পৌঁছানোর পথটি মসৃণ ছিল না মোটেই; বরং পদে পদে কখনো আইএজিএসের গঠনতন্ত্রে থাকা বিধি-উপবিধিজনিত প্রতিবন্ধকতা, কখনো বা বোঝাপড়াজনিত প্রতিবন্ধকতায় শ্লথ হয়েছে এই রেজল্যুশন বিষয়ে আইএজিএসের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া। পুরো ব্যাপারটি খোলাসা করে লিখছি।
স্পেনের বার্সেলোনায় ২০২১ সালের ১৮ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্সের (আইএজিএস) দ্বিবার্ষিক কনফারেন্স হয়েছিল। করোনা অতিমারির জন্য পুরো কনফারেন্স হয় ভার্চুয়ালি। সে বছর ছিল বাংলাদেশের জন্মের ৫০তম বছর। সেই হিসাবে বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইড এবং মুক্তিযুদ্ধেরও ৫০ বছর। বিশ্বখ্যাত জেনোসাইড বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এডাম জোন্সকে সেশন চেয়ার রেখে আমি সেই কনফারেন্সে ‘ফিফটি ইয়ারস অব বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড আফটারম্যাথস’ শীর্ষক এক প্যানেল সেশনের প্রস্তাব করেছিলাম, যেখানে আমিসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিদ্যায়তনে গবেষণারত বাংলাদেশের মোট চারজন গবেষণা পেপার উপস্থাপন করেছিলাম। আমি বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বিষয়ে উপস্থাপন করি এবং এই আইএজিএস যেন বাংলাদেশে একাত্তর সালে যে জেনোসাইডের অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার স্বীকৃতি দিয়ে এই কনফারেন্স থেকে একটি রেজল্যুশন প্রকাশ করে সে দাবি উত্থাপন করি, যা অধ্যাপক এডাম জোন্স পূর্ণ সমর্থন করেন। কনফারেন্সের শেষ দিন আইএজিএসের বিজনেস মিটিংয়ে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্মকর্তাদের গোচরে আনা হলে তাঁরা গঠনতন্ত্র মোতাবেক ড্রাফট রেজল্যুশন জমা দিতে পরামর্শ দেন। তখন থেকেই মূলত সূচনা হয় এই রেজল্যুশন ড্রাফট করার প্রক্রিয়া। আমার প্রস্তাবকে সমর্থন করেন অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যান্টন, ড. হেলেন জার্ভিস, অধ্যাপক এডাম জোন্স, মফিদুল হক, অধ্যাপক এলিসা ভন জোয়েডেন-ফর্জে, ড. শাহরিয়ার ইসলাম ও ইমরান আজাদ। রেজল্যুশন ড্রাফট করার ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের মধ্যে বার্তা আদান-প্রদান করি। পরে ২ আগস্ট ২০২১ বাংলাদেশের শহীদদের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে আইএজিএসে ড্রাফট রেজল্যুশন জমা দিই।
আইএজিএসের নির্বাহী কমিটি আমার প্রস্তাবিত ড্রাফট ডকুমেন্টটি গ্রহণ করার পরে বিধি মোতাবেক প্রেরণ করে রেজল্যুশন কমিটির কাছে। এর সাড়ে চার মাস পরে ১৭ ডিসেম্বর রেজল্যুশন কমিটি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের দিক থেকে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়, যা রেজল্যুশনে যুক্ত করে রিভাইজড ডকুমেন্টটি তাদের কাছে পাঠাই ২৬ ডিসেম্বর। এর তিন দিন পর তারা আমাকে রেজল্যুশনের সংযুক্তি হিসেবে সেকেন্ডারি বিভিন্ন দলিলের তালিকা দিতে জানায়, যার ভিত্তিতে তারা ভেরিফাই করে এই রেজল্যুশন ভোটে দেওয়ার উপযোগী কি না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আমি ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রয়োজনীয় সংযুক্তি পাঠাই। রেজল্যুশন কমিটি জমা দেওয়া সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে এবং তা গ্রহণ করে নির্বাহী কমিটিতে ভোটাভুটির জন্য পাঠায়।
আইএজিএসের পক্ষ থেকে ২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রেজল্যুশনটি সব সদস্যের কাছে ইলেকট্রনিক্যালি ভোটের জন্য পাঠানো হয়। ভোট দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার কথা ১ মার্চে, কিন্তু ভোট চলাকালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ২১ ফেব্রুয়ারি টাউন হল মিটিং নামক এক বিশেষ ইভেন্টের আয়োজন করে (যা অন্য রেজল্যুশনের ক্ষেত্রে করতে দেখিনি), যেখানে আইএজিএসের অংশগ্রহণকারী সদস্যরা প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ রেজল্যুশন’-এর পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলার সুযোগ পাবেন। যে বিষয়ে নির্বাচন হচ্ছে তা চলমান থাকা অবস্থায় কীভাবে ওই বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হতে পারে, তা আমাদের বোধগম্য ছিল না। এই ইভেন্টে প্রস্তাবক হিসেবে আমাকে সংক্ষিপ্তভাবে সূচনা বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। আমার বক্তব্যে আমি বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের বিপুল তথ্য ও নজির থাকা সত্ত্বেও জেনোসাইড লিটারেচারে এর উল্লেখ খুব নগণ্য বলার পরে দেশব্যাপী নিযুত মানুষকে হত্যার পাশাপাশি আমার পিতা শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাতক দল আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্য কর্তৃক অপহৃত হওয়া এবং আর ফিরে না আসার বিষয়টিও তুলে ধরি অল্প কথায়।
আইএজিএস আর্মেনিয়াসহ অন্যান্য দেশে জেনোসাইডের ক্ষেত্রে রেজল্যুশন প্রকাশ করেছে। একইভাবে বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দিয়ে আমি রেজল্যুশন প্রকাশ করার আহ্বান জানাই। সর্বশেষে আমি প্রস্তাবিত এই রেজল্যুশন আমার পিতা শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন এবং জেনোসাইডের শিকার নিযুত শহীদের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করি। এই ইভেন্টের আলোচনার সময় দু-একজন গবেষক শর্মিলা বোসের ভ্রান্তিপূর্ণ গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশে সংঘটিত নারকীয়তাকে জেনোসাইড বলা যাবে কি না প্রশ্ন তোলেন, যা অন্যান্য বিজ্ঞ জেনোসাইড এক্সপার্ট ও স্কলার জোর কণ্ঠে নাকচ করে দেন। এর বাইরে জেনোসাইড বিষয়ে কিছু আইনগত টার্ম আলোচনায় উত্থাপিত হলে বাংলাদেশ কেসের ক্ষেত্রে তা যে প্রযোজ্য, সে বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন এই রেজল্যুশনের সমর্থনকারী এক্সপার্টরা।
ভোটাভুটি শেষ হলে আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষিত হয় ৩ মার্চ। গঠনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী রেজল্যুশন পাস হওয়ার জন্য ৩৫২ জনকে ভোট দিতে হবে, কিন্তু ভোট দিয়েছিলেন মাত্র ১৪৩ জন। তবে অংশ নেওয়া ভোটারের ১৩৩ জনই এই রেজল্যুশনের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। গঠনতন্ত্রের বাধ্যবাধকতা থাকায় অংশগ্রহণকারী ভোটারের ৯৩ শতাংশ পক্ষে ভোট দিলেও বিধান অনুযায়ী এই রেজল্যুশন গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিয়মে পরিবর্তন আনার বিষয়টি নির্বাহী কমিটির গোচরে আনা হলে তাঁরা নিজেরা আলাপ করে বিধিতে পরিবর্তন এনে সে ব্যাপারে সাধারণ সদস্যদের অভিমত নেওয়ার জন্য প্রস্তাবিত নিয়ম ভোটে দেন, যা সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয় ২২ অক্টোবর।
বাংলাদেশ রেজল্যুশন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আমি নভেম্বর মাসে আবারও সব ডকুমেন্ট জমা দিই। আবারও যাচাই-বাছাই করে শেষে ২৩ মার্চ এই রেজল্যুশন ভোটের জন্য সদস্যদের কাছে বিতরণ করা হয়। এক মাস ভোট গ্রহণ শেষে ২৪ এপ্রিল আইএজিএসের কমিউনিকেশন অফিসার কেরি হুইগহ্যাম ভোটের ফলাফল প্রকাশ করেন। মোট ভোট পড়েছে ২১৮টি, এর মধ্যে ২০৮ জন ভোট দিয়েছেন পক্ষে, ৪ জন বিপক্ষে এবং ৬ জন ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। ফলে প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৯৫ ভাগ পড়েছে বাংলাদেশ রেজল্যুশনের পক্ষে, যা আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়েছে। ফলে ২০২১-এর জুলাই থেকে শুরু হয়েছিল যে উদ্যোগ, তা নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে ইতিবাচক সমাপ্তির মুখ দেখল।
এই প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী জেনোসাইড এক্সপার্ট ও স্কলারদের প্রতিষ্ঠান আইএজিএস দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা দিচ্ছে যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে নারকীয়তা সংঘটিত হয়েছিল, তা ছিল মূলত জেনোসাইড। বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে এই ঘোষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অর্জন। এই রেজল্যুশন উত্থাপিত হওয়া থেকে শুরু করে সিদ্ধান্ত পর্যন্ত আমাকে যাঁরা সার্বক্ষণিক সমর্থন এবং যথাযথ সহযোগিতা দিয়ে গেছেন তাঁরা হলেন অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যান্টন, ড. হেলেন জার্ভিস, অধ্যাপক এডাম জোন্স, মফিদুল হক, অধ্যাপক এলিসা ভন জোয়েডেন-ফর্জে, ড. শাহরিয়ার ইসলাম ও ইমরান আজাদ। এর বাইরে আইরিন ভিক্টোরিয়া ম্যাসিমিনো এবং থেরেসা ল্যাং নানাভাবে সহায়তা করেছেন। তাঁদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আইএজিএসের কর্ণধার ও সদস্যরা, বিশেষ করে যাঁরা নির্বাচনে অংশ নিয়ে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে মূল ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের জানাই আন্তরিক সাধুবাদ। এ ছাড়া অনেক আগে থেকেই অনেকে এ ব্যাপারে চেষ্টা করছেন। তাঁদের সবার প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ।
সবশেষে পুনরুল্লেখ করছি, প্রস্তাব পাসের প্রক্রিয়ায় কাঙ্ক্ষিত এই রেজল্যুশন উৎসর্গ করেছি আমার পিতা শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে জেনোসাইডের শিকার শহীদদের—আইএজিএসের এই ঘোষণার মাধ্যমে যা পরিপূর্ণতা পেল। এই ঘোষণা আমাদের স্বীকৃতি আদায়ের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে অনেক শক্তি জোগাবে নিঃসন্দেহে।
তৌহীদ রেজা নূর, লেখক, গবেষক
জেনোসাইডের স্বীকৃতি অর্জনের কাজটি মসৃণ নয়। যেহেতু আইনি সংজ্ঞার দ্বারা জেনোসাইড সংজ্ঞায়িত, তাই ঘটে যাওয়া অথবা ঘটমান অপরাধসমষ্টিকে কেউ ইচ্ছে হলেই জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে ঘোষণা দিতে পারেন না। ইতিহাসের আলোকে নানা কার্যকারণ বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি আইনের কষ্টিপাথরে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় এ ব্যাপারে। জেনোসাইড নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন, এ বিষয়ে যাঁরা পড়ান, আইনি লড়াই লড়েন, তাঁরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পূর্বাপর বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করেন কোথাও জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে কি হয়নি।
২৪ এপ্রিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্সের (আইএজিএস) পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে যে সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটির মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ রেজল্যুশন’ গৃহীত হয়েছে, যার মাধ্যমে আইএজিএস স্বীকৃতি দিচ্ছে যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে জেনোসাইড সংঘটিত হয়েছে। জেনোসাইড স্কলাররা একযোগে দ্বিধাহীনভাবে বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের স্বীকৃতি দিক—এই বাসনা আমরা দীর্ঘদিন লালন করে আসছি। সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো। তবে সুন্দর বৈশিষ্ট্যময় এই দিনটিতে এসে পৌঁছানোর পথটি মসৃণ ছিল না মোটেই; বরং পদে পদে কখনো আইএজিএসের গঠনতন্ত্রে থাকা বিধি-উপবিধিজনিত প্রতিবন্ধকতা, কখনো বা বোঝাপড়াজনিত প্রতিবন্ধকতায় শ্লথ হয়েছে এই রেজল্যুশন বিষয়ে আইএজিএসের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া। পুরো ব্যাপারটি খোলাসা করে লিখছি।
স্পেনের বার্সেলোনায় ২০২১ সালের ১৮ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্সের (আইএজিএস) দ্বিবার্ষিক কনফারেন্স হয়েছিল। করোনা অতিমারির জন্য পুরো কনফারেন্স হয় ভার্চুয়ালি। সে বছর ছিল বাংলাদেশের জন্মের ৫০তম বছর। সেই হিসাবে বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইড এবং মুক্তিযুদ্ধেরও ৫০ বছর। বিশ্বখ্যাত জেনোসাইড বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এডাম জোন্সকে সেশন চেয়ার রেখে আমি সেই কনফারেন্সে ‘ফিফটি ইয়ারস অব বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড আফটারম্যাথস’ শীর্ষক এক প্যানেল সেশনের প্রস্তাব করেছিলাম, যেখানে আমিসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিদ্যায়তনে গবেষণারত বাংলাদেশের মোট চারজন গবেষণা পেপার উপস্থাপন করেছিলাম। আমি বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বিষয়ে উপস্থাপন করি এবং এই আইএজিএস যেন বাংলাদেশে একাত্তর সালে যে জেনোসাইডের অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার স্বীকৃতি দিয়ে এই কনফারেন্স থেকে একটি রেজল্যুশন প্রকাশ করে সে দাবি উত্থাপন করি, যা অধ্যাপক এডাম জোন্স পূর্ণ সমর্থন করেন। কনফারেন্সের শেষ দিন আইএজিএসের বিজনেস মিটিংয়ে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট নির্বাহী কর্মকর্তাদের গোচরে আনা হলে তাঁরা গঠনতন্ত্র মোতাবেক ড্রাফট রেজল্যুশন জমা দিতে পরামর্শ দেন। তখন থেকেই মূলত সূচনা হয় এই রেজল্যুশন ড্রাফট করার প্রক্রিয়া। আমার প্রস্তাবকে সমর্থন করেন অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যান্টন, ড. হেলেন জার্ভিস, অধ্যাপক এডাম জোন্স, মফিদুল হক, অধ্যাপক এলিসা ভন জোয়েডেন-ফর্জে, ড. শাহরিয়ার ইসলাম ও ইমরান আজাদ। রেজল্যুশন ড্রাফট করার ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের মধ্যে বার্তা আদান-প্রদান করি। পরে ২ আগস্ট ২০২১ বাংলাদেশের শহীদদের পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে আইএজিএসে ড্রাফট রেজল্যুশন জমা দিই।
আইএজিএসের নির্বাহী কমিটি আমার প্রস্তাবিত ড্রাফট ডকুমেন্টটি গ্রহণ করার পরে বিধি মোতাবেক প্রেরণ করে রেজল্যুশন কমিটির কাছে। এর সাড়ে চার মাস পরে ১৭ ডিসেম্বর রেজল্যুশন কমিটি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের দিক থেকে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়, যা রেজল্যুশনে যুক্ত করে রিভাইজড ডকুমেন্টটি তাদের কাছে পাঠাই ২৬ ডিসেম্বর। এর তিন দিন পর তারা আমাকে রেজল্যুশনের সংযুক্তি হিসেবে সেকেন্ডারি বিভিন্ন দলিলের তালিকা দিতে জানায়, যার ভিত্তিতে তারা ভেরিফাই করে এই রেজল্যুশন ভোটে দেওয়ার উপযোগী কি না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আমি ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রয়োজনীয় সংযুক্তি পাঠাই। রেজল্যুশন কমিটি জমা দেওয়া সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে এবং তা গ্রহণ করে নির্বাহী কমিটিতে ভোটাভুটির জন্য পাঠায়।
আইএজিএসের পক্ষ থেকে ২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রেজল্যুশনটি সব সদস্যের কাছে ইলেকট্রনিক্যালি ভোটের জন্য পাঠানো হয়। ভোট দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার কথা ১ মার্চে, কিন্তু ভোট চলাকালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ২১ ফেব্রুয়ারি টাউন হল মিটিং নামক এক বিশেষ ইভেন্টের আয়োজন করে (যা অন্য রেজল্যুশনের ক্ষেত্রে করতে দেখিনি), যেখানে আইএজিএসের অংশগ্রহণকারী সদস্যরা প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ রেজল্যুশন’-এর পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলার সুযোগ পাবেন। যে বিষয়ে নির্বাচন হচ্ছে তা চলমান থাকা অবস্থায় কীভাবে ওই বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হতে পারে, তা আমাদের বোধগম্য ছিল না। এই ইভেন্টে প্রস্তাবক হিসেবে আমাকে সংক্ষিপ্তভাবে সূচনা বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। আমার বক্তব্যে আমি বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের বিপুল তথ্য ও নজির থাকা সত্ত্বেও জেনোসাইড লিটারেচারে এর উল্লেখ খুব নগণ্য বলার পরে দেশব্যাপী নিযুত মানুষকে হত্যার পাশাপাশি আমার পিতা শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাতক দল আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্য কর্তৃক অপহৃত হওয়া এবং আর ফিরে না আসার বিষয়টিও তুলে ধরি অল্প কথায়।
আইএজিএস আর্মেনিয়াসহ অন্যান্য দেশে জেনোসাইডের ক্ষেত্রে রেজল্যুশন প্রকাশ করেছে। একইভাবে বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দিয়ে আমি রেজল্যুশন প্রকাশ করার আহ্বান জানাই। সর্বশেষে আমি প্রস্তাবিত এই রেজল্যুশন আমার পিতা শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন এবং জেনোসাইডের শিকার নিযুত শহীদের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করি। এই ইভেন্টের আলোচনার সময় দু-একজন গবেষক শর্মিলা বোসের ভ্রান্তিপূর্ণ গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশে সংঘটিত নারকীয়তাকে জেনোসাইড বলা যাবে কি না প্রশ্ন তোলেন, যা অন্যান্য বিজ্ঞ জেনোসাইড এক্সপার্ট ও স্কলার জোর কণ্ঠে নাকচ করে দেন। এর বাইরে জেনোসাইড বিষয়ে কিছু আইনগত টার্ম আলোচনায় উত্থাপিত হলে বাংলাদেশ কেসের ক্ষেত্রে তা যে প্রযোজ্য, সে বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন এই রেজল্যুশনের সমর্থনকারী এক্সপার্টরা।
ভোটাভুটি শেষ হলে আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষিত হয় ৩ মার্চ। গঠনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী রেজল্যুশন পাস হওয়ার জন্য ৩৫২ জনকে ভোট দিতে হবে, কিন্তু ভোট দিয়েছিলেন মাত্র ১৪৩ জন। তবে অংশ নেওয়া ভোটারের ১৩৩ জনই এই রেজল্যুশনের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। গঠনতন্ত্রের বাধ্যবাধকতা থাকায় অংশগ্রহণকারী ভোটারের ৯৩ শতাংশ পক্ষে ভোট দিলেও বিধান অনুযায়ী এই রেজল্যুশন গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিয়মে পরিবর্তন আনার বিষয়টি নির্বাহী কমিটির গোচরে আনা হলে তাঁরা নিজেরা আলাপ করে বিধিতে পরিবর্তন এনে সে ব্যাপারে সাধারণ সদস্যদের অভিমত নেওয়ার জন্য প্রস্তাবিত নিয়ম ভোটে দেন, যা সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয় ২২ অক্টোবর।
বাংলাদেশ রেজল্যুশন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আমি নভেম্বর মাসে আবারও সব ডকুমেন্ট জমা দিই। আবারও যাচাই-বাছাই করে শেষে ২৩ মার্চ এই রেজল্যুশন ভোটের জন্য সদস্যদের কাছে বিতরণ করা হয়। এক মাস ভোট গ্রহণ শেষে ২৪ এপ্রিল আইএজিএসের কমিউনিকেশন অফিসার কেরি হুইগহ্যাম ভোটের ফলাফল প্রকাশ করেন। মোট ভোট পড়েছে ২১৮টি, এর মধ্যে ২০৮ জন ভোট দিয়েছেন পক্ষে, ৪ জন বিপক্ষে এবং ৬ জন ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। ফলে প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৯৫ ভাগ পড়েছে বাংলাদেশ রেজল্যুশনের পক্ষে, যা আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়েছে। ফলে ২০২১-এর জুলাই থেকে শুরু হয়েছিল যে উদ্যোগ, তা নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে ইতিবাচক সমাপ্তির মুখ দেখল।
এই প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী জেনোসাইড এক্সপার্ট ও স্কলারদের প্রতিষ্ঠান আইএজিএস দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা দিচ্ছে যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে নারকীয়তা সংঘটিত হয়েছিল, তা ছিল মূলত জেনোসাইড। বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে এই ঘোষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অর্জন। এই রেজল্যুশন উত্থাপিত হওয়া থেকে শুরু করে সিদ্ধান্ত পর্যন্ত আমাকে যাঁরা সার্বক্ষণিক সমর্থন এবং যথাযথ সহযোগিতা দিয়ে গেছেন তাঁরা হলেন অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যান্টন, ড. হেলেন জার্ভিস, অধ্যাপক এডাম জোন্স, মফিদুল হক, অধ্যাপক এলিসা ভন জোয়েডেন-ফর্জে, ড. শাহরিয়ার ইসলাম ও ইমরান আজাদ। এর বাইরে আইরিন ভিক্টোরিয়া ম্যাসিমিনো এবং থেরেসা ল্যাং নানাভাবে সহায়তা করেছেন। তাঁদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আইএজিএসের কর্ণধার ও সদস্যরা, বিশেষ করে যাঁরা নির্বাচনে অংশ নিয়ে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে মূল ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের জানাই আন্তরিক সাধুবাদ। এ ছাড়া অনেক আগে থেকেই অনেকে এ ব্যাপারে চেষ্টা করছেন। তাঁদের সবার প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ।
সবশেষে পুনরুল্লেখ করছি, প্রস্তাব পাসের প্রক্রিয়ায় কাঙ্ক্ষিত এই রেজল্যুশন উৎসর্গ করেছি আমার পিতা শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে জেনোসাইডের শিকার শহীদদের—আইএজিএসের এই ঘোষণার মাধ্যমে যা পরিপূর্ণতা পেল। এই ঘোষণা আমাদের স্বীকৃতি আদায়ের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে অনেক শক্তি জোগাবে নিঃসন্দেহে।
তৌহীদ রেজা নূর, লেখক, গবেষক
আধুনিক যুগের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোর একটি হচ্ছে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক রত্নসম্ভার। গতকাল বুধবার হংকংয়ে বিখ্যাত আর্ট নিলাম কোম্পানি সাদাবি’স-এর এক নিলামে এগুলো তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
৭ দিন আগেপাকিস্তানে ভারতের হামলার সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনও এই হামলাকে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘও। উত্তেজনা যেন আরও না বাড়ে, সে জন্য দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ। এদিকে ভারতের অবস্থানকে সমর্থন করেছে...
৭ দিন আগেভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে দুই চিরবৈরী প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমেই চড়ছিল। তা তুঙ্গে উঠল এবার পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামের ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা দিয়ে। পাশাপাশি সীমান্তেও দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে...
৭ দিন আগেঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫