Ajker Patrika

ঘর হারানোর ভয়ে জীবনের ক্ষয়

অর্চি হক, ঢাকা
ঘর হারানোর ভয়ে জীবনের ক্ষয়

২০১৫ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল সাজনা বেগমের। নতুন সংসারে যেখানে আনন্দধারা বয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে শুরুতেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। বিয়ের পরপরই নেমে আসে স্বামীর অমানুষিক নির্যাতন। তবু সব সহ্য করে সংসার চালিয়ে যান সুনামগঞ্জের এই নারী। একে একে তিন সন্তানের মা হন। কিন্তু সব নির্যাতন মুখ বুজে সয়ে যাওয়াটাই কাল হয় সাজনার জন্য। বিয়ের আট বছর পর গত ২৮ আগস্ট স্বামীর নির্যাতনে মৃত্যু হয় তাঁর।

শুধু সাজনা বেগম নন, আশ্রয় হারানোর ভয়ে সব সইতে গিয়ে এভাবে নীরবে জীবন ক্ষয়ে যায় অসংখ্য নারীর। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, দেশে গত ৫ বছরে (২০১৮-২০২২) স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ১ হাজার ৮১ জন নারী। আর পারিবারিক সহিংসতার কারণে গত তিন বছরে (২০২০-২০২২) ৩৪০ জন নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

মানবাধিকারকর্মী ও মনোবিদেরা বলছেন, স্বামীর হাতে স্ত্রী খুনের বিষয়টি খুব কম ক্ষেত্রেই আকস্মিকভাবে ঘটে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন স্ত্রী দিনের পর দিন নির্যাতন সয়ে যাওয়ার পর একপর্যায়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ স্ত্রী যদি শুরুতেই নির্যাতনকারী স্বামীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন, অথবা আলাদা হয়ে যেতেন, তাহলে তাঁকে খুন হতে হতো না। কিন্তু আশ্রয় হারানোর ভয়ে নারীরা সংসার চালিয়ে যান। একপর্যায়ে মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করে নিতে হয় তাঁদের।

আসকের পরিচালক ও মানবাধিকার আইনজীবী নীনা গোস্বামী বলেন, ‘আমাদের সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের কাছে বাবার বাড়ি মানে বাবার বাড়ি, আর ছেলেদের কাছে বাবার বাড়ি মানে নিজের বাড়ি। এ কারণে স্বামীর বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হলেও বেশির ভাগ নারী সেখানে মুখ বুজে পড়ে থাকেন।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৫ সালের জরিপ অনুযায়ী, ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ বিবাহিত নারী জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে স্বামীর কাছে নির্যাতনের শিকার হন। আর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ১ হাজার ৬৭৩ জন নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। নারী অধিকারকর্মীরা জানান, পারিবারিক সহিংসতার যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েক গুণ বেশি। কারণ, নির্যাতনের শিকার নারীদের খুব কমসংখ্যক তাঁদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সহিংসতার ঘটনা প্রকাশ্যে আনেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর মিরপুরের এক গৃহিণী বলেন, ‘স্বামী মাদকাসক্ত। এটা নিয়ে কথা বলতে গেলেই মারধর করে। বাবার বাড়িতে আমার ভাই-ভাবি থাকেন। সেখানে তাঁরা আমাকে থাকতে দেবেন না। স্বামীর বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার তো জায়গা নাই।’

সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে ৫ দিনের ঠাঁই সহিংসতার শিকার নারীদের সাময়িক আশ্রয় ও মামলাসংক্রান্ত কাজ তদারক করে বাংলাদেশ পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। তবে নিয়মানুযায়ী এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে কেবল পাঁচ দিন থাকতে দেওয়া হয় ভুক্তভোগী নারীকে। এরপর তাঁকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়, নয়তো বিভিন্ন এনজিওর তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘নারীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের তীব্র সংকট রয়েছে। সরকারি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে মাত্র পাঁচ দিন থাকা যায়। বেসরকারি সংস্থার আশ্রয়কেন্দ্রও অপর্যাপ্ত। সরকারিভাবে আরও বেশি আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা উচিত।’

উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে থাকা ডিএমপির উপকমিশনার হুমায়রা পারভিন বলেন, ‘নিয়মানুযায়ী আমাদের এখানে ভিকটিমরা পাঁচ দিন থাকতে পারে। তবে কারও যদি এর বেশি থাকার প্রয়োজন হয়, সেটাও আমরা বিবেচনা করি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত