Ajker Patrika

এড়াব কী করে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
এড়াব কী করে

আমাদের সামগ্রিক অবস্থাটা যে ভালো নেই, সেটা মোটেও অস্পষ্ট নয়। যেদিকে তাকাই দেখি, ঝুঁকি ওত পেতে আছে। জরিপ বলছে, বাংলাদেশের শতকরা ৯৭ জন মানুষই এখন কোনো না কোনো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কারণ কী? উন্নতি তো হচ্ছে—জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, উদ্ভাবনায়, চিকিৎসায় বিশ্ব অনবরত এগোচ্ছে। আমরাও পিছিয়ে নেই। আমাদের জন্য বিদ্যুৎ ক্রমেই দুর্মূল্য হচ্ছে বটে, কিন্তু তবু তো আমরাও ডিজিটাল হয়েছি। অ্যানালগে নেই। আমাদের দেশেও রোবট এসেছে। মাশ আল্লাহ্ আরও আসবে। এমনকি সব ধরনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে পারমাণবিক যুগেও সসম্মানে প্রবেশ করে ফেলেছি। তাহলে অসুবিধাটা কোথায়? অসুবিধার কারণই-বা কী? কারণটা না বুঝলে করণীয় কী, তা ঠিক করা যাবে না।

অনেকে আছেন যাঁরা একেবারেই নিশ্চিত যে কারণটা হচ্ছে আমাদের নৈতিক অবক্ষয়। তাঁদের ভ্রান্ত বলা যাবে না। কিন্তু নৈতিকতা জিনিসটা তো আকাশে থাকে না, মনের ভেতরেই সে থাকে। এটা যখন মেনে নিই, তখন এটাও তো কোনোমতেই অস্বীকার করতে পারি না যে মন চলে বস্তুর শাসনে। গল্প আছে দুজন ভিক্ষুক কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে। একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করেছে, তুই যে লটারির টিকিট কিনলি, টাকা পেলে কী করবি? টিকিট কেনা ভিক্ষুকটি বলেছে, টাকা পেলে সে একটা গাড়ি কিনবে। পরের প্রশ্ন, গাড়ি দিয়ে কী করবি? ভিক্ষুক বলেছে, ‘গাড়িতে চড়ে ভিক্ষা করব, হেঁটে হেঁটে ভিক্ষা করতে ভারি কষ্ট।’

ভিক্ষুকেরও মন আছে, কিন্তু সেই মন ভিক্ষাতেই আটকে গেছে, তার বাইরে যেতে পারেনি। পারবেও না। জীবন যার অনাহারে কাটে, স্বর্গে গিয়ে সে কোন সুখের কল্পনা করবে, পোলাও-কোরমা খাওয়ার বাইরে? কিন্তু বড়লোকের স্বর্গ তো ভিন্ন ধরনের। কোটিপতির ছেলে জন্মের পর থেকেই গাড়িতে চড়ে বেড়ায়; জন্মের আগে থেকেই চড়ে। তার স্বপ্ন তো গাড়িতে চড়ে ভিক্ষা করার নয়, তার স্বপ্ন গাড়িতে চড়ে এয়ারপোর্টে যাওয়ার। এয়ারপোর্ট হয়ে আমেরিকায় উড়ে যাওয়ার। ভিক্ষুক ও কোটিপতি একই দেশে জন্মগ্রহণ করেছে, একই সময়েরই মানুষ তারা; কিন্তু তারা কে কোথায়? আকাশ-পাতাল ব্যবধান।

অন্য সব দেশের মতোই বাংলাদেশও ভালো নেই। রোগে ভুগছে। তার উন্নতিটা অসুস্থ। এই উন্নতি শতকরা ৫ জনের, ৯৫ জনকে বঞ্চিত করে। কেবল বঞ্চিত নয়, শোষণ করেও। তাই যত উন্নতি হচ্ছে, ততই বৈষম্য বাড়ছে। কোটিপতিরা কোটি কোটির পতি হচ্ছে; উল্টো দিকে সংখ্যা বাড়ছে ভিক্ষুকেরও। দূরত্ব বাড়ছে মাঝখানের।

গরিবের বিপদ তো সব দিক দিয়েই, তবে বিত্তবানেরাও যে নিরাপদে আছেন তা নয়। ১০০, ২০০ নয়—১৫ হাজার বিজ্ঞানী স্বাক্ষর করে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। তাতে তাঁরা বলছেন যে বিশ্ব এখন গভীর সংকটে পড়েছে। সংকটের লক্ষণগুলোও চিহ্নিত করেছেন। যেমন বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব, সমুদ্রপৃষ্ঠের ফুলে-ওঠা, যাতে ধরিত্রীর নিম্নাঞ্চল ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা। পাশাপাশি আবার মহাসমুদ্রগুলোর একাংশকে মৃত্যুদশায় পাওয়া। বলেছেন, বনাঞ্চলের ধ্বংস ক্রমবর্ধমান গতিতে ঘটে চলেছে। বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ তো আছেই। ধরিত্রী যে তপ্ত হচ্ছে, জলবায়ুতে যে বিরূপ পরিবর্তন ঘটছে, তার দুর্ভোগ এখন বিশ্বের সব অঞ্চলের মানুষের জন্যই। সব মিলিয়ে মানুষের সভ্যতা তো বটেই, মানুষের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়েছে বলে তাঁরা জানাচ্ছেন। ওই বিজ্ঞানীরা বিশ্ববাসীকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে যেটা তাঁরা করেননি, করলে ভালো করতেন সেটা হলো, রোগের প্রকৃতি-নির্ধারণ। বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিকভাবেই বলতে পারতেন যে রোগটা হলো পুঁজিবাদ। বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই, তাঁরা উদারনীতির দ্বারা শাসিত। বলেন, আবার বলেনও না।

বিজ্ঞানীরা এটাও বলেননি যে বিশ্বের সব মানুষ নয়, অল্প কিছু মানুষই মানবসভ্যতার এবং ধরিত্রীর এই ঐতিহাসিক মহাবিপদের জন্য দায়ী। বলতে পারতেন যে কর্তৃত্বে-প্রতিষ্ঠিত এই বিপদ সৃষ্টিকারীরা পুঁজিবাদী। এরা মুনাফা চেনে, অন্য কিছু চেনার আগে। এদের মুনাফা লোলুপতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যে পুঁজিবাদী আদর্শে তারা দীক্ষিত, তাদের কাছে মানুষ, মনুষ্যত্ব, প্রকৃতি, প্রাকৃতিক প্রাণী—কোনো কিছুরই কোনো মূল্য নেই। পুঁজিবাদী লোলুপতা সবকিছু গ্রাস করে ফেলছে, এমনকি মানুষকেও। পৃথিবীর ৯৫ জন মানুষ এই ৫ জন ধনীর তুলনায় দুর্বল। তারা তাই বঞ্চিত ও শোষিত হয়।

ঈশপের গল্পে নেকড়েটি যেমন মেষশাবকটিকে খাবেই, কোনো যুক্তি মানবে না, পুঁজিওয়ালাদের আচরণটাও হুবহু সে রকমেরই। নেকড়ের ক্ষুধার তবু নিবৃত্তি আছে; খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে ঘাসে-পানিতে মুখ মুছে সে ঘুমিয়ে পড়ে অথবা বনের ভেতর মনের সুখে ঘুরে বেড়ায়। পুঁজিওয়ালাদের ওই রকমের কোনো তৃপ্তি নেই, সংযম নেই। যত পায়, তত খায়, খাবার কেবলই সংগ্রহ করতে থাকে এবং যত খায়, ততই তার ক্ষুধা যায় বেড়ে। কারণ ভক্ষণের প্রক্রিয়ায় তার পাকস্থলীর স্ফীতি ঘটে এবং সেটিকে খাদ্যে ভরপুর না করতে পারলে অতৃপ্তির তো অবশ্যই যন্ত্রণারও অবধি থাকে না। মুনাফালোলুপ মানুষেরা জগতের সব প্রাণীর অধম, তথাকথিত ইতর প্রাণীরাও অত ইতর নয়।

বর্বরতার নিকৃষ্টতম উন্মোচন ঘটে ধর্ষণে। এটা ভোগবাদিতার চরম লক্ষণ। এ হচ্ছে প্রবলের নিষ্ঠুরতম অত্যাচার, দুর্বলের ওপর। ধর্ষণ থেকে প্রাপ্ত মুনাফার জন্য কোনো বিনিয়োগের দরকার পড়ে না, এমন মুনাফা পুঁজিবাদের জগতেও দুষ্প্রাপ্য। ধর্ষণ আগেও ছিল, এখন তার প্রকৃতি ও পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গণধর্ষণ চলে এসেছে। আর সেটা যে কী আকার ও রূপ পরিগ্রহ করতে পারে, তার অতিশয় উজ্জ্বল নিদর্শন পাওয়া গেছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা বিতাড়নের ক্ষেত্রে।

সেখানে গণহত্যা চলছে। রোহিঙ্গা নামের কোনো মানুষ আরাকান রাজ্যে থাকতে পারবে না, তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে। বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে, খেতখামার, দোকানপাট সব দখল করে নিয়েছে, পুরুষদের হত্যা করেছে এবং আর যা করেছে তা বলা যায় কল্পনাতীত। সেটি হলো, পাইকারি হারে গণধর্ষণ। গণধর্ষণ একাত্তর সালে বাংলাদেশে ঘটেছে। হানাদারেরা করেছে ওই কাজ। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদারেরা যা করতে পারেনি তা করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তারা অন্য দেশে গিয়ে সে দেশের মানুষের ওপর আক্রমণ চালায়নি, অত্যাচার চালিয়েছে নিজের দেশের মানুষের ওপরই। আরাকানে রোহিঙ্গারা ভিন্ন দেশের মানুষ নয়, তারা ওই দেশেরই মানুষ। শত শত বছর ধরে রোহিঙ্গারা ওখানে বসবাস করে আসছে।

আরাকানের বৌদ্ধ রাজসভায় একসময় বাংলাভাষী গুণী মুসলমানদের স্থান ছিল, কবি আলাওল ওই রাজসভায় বসেই তাঁর ‘পদ্মাবতী’ কাব্য রচনা করেছিলেন। মিয়ানমারের সেনারা স্বদেশবাসী একটি জনগোষ্ঠীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, নেকড়ের চেয়েও হিংস্ররূপে এবং বন্দুকের জোরে নির্বিচারে নারীদের ধর্ষণ করেছে। শুধু তা-ই নয়, স্থানীয় অ-রোহিঙ্গাদেরও তারা লেলিয়ে দিয়েছে ওই জঘন্য কাজে। এমনটা পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। যে বৌদ্ধরা অহিংসার জন্য জগদ্বিখ্যাত, তাদের একাংশ দেখা গেল বন্দুকধারীদের উসকানিতে উন্মাদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যোগ দিয়েছে লুণ্ঠনে ও ধর্ষণে মহোৎসাহে।

নৃবিজ্ঞান বলছে, আমাদের এই অঞ্চলের অনেক মুসলমানের পূর্বপুরুষই একসময় বৌদ্ধ ছিল, ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে তারা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছে। বৌদ্ধরা মাথায় চুল রাখত না, তাদের ভেতর থেকে মুসলমানেরা বের হয়েছে—এই সুবাদেই বাংলার ব্রাহ্মণরা মুসলমানদের ‘নেড়ে’ বলে ডাকত, এমন ধারণা প্রচলিত আছে। মিয়ানমারে গণহত্যার ব্যাপারটা মোটেই সাম্প্রদায়িক নয়। রোহিঙ্গারা সবাই যে মুসলমান এমনও নয়, তাদের ভেতর অ-মুসলিমও আছে; গণহত্যায় নিয়োজিত সামরিক কর্তৃপক্ষও এ কথা বলেনি যে তারা মুসলমান মারছে। বলেছে, তারা অস্থানীয়দের দমন করছে। কারণ ওই অস্থানীয়রা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে।

নির্ভুলরূপে নেকড়ের যুক্তি মেষশাবক ভক্ষণ করার জন্য। রোহিঙ্গারা বিদ্রোহ করেনি; এমনকি স্বায়ত্তশাসনও চায়নি। তেমন শক্তি তাদের নেই। তারা একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, সর্বসাকল্যে লাখ বিশেক হবে। তারা অকল্পনীয় বঞ্চনার শিকার। নাগরিক অধিকার নেই, লেখাপড়ার সুযোগ নেই, চলাফেরার স্বাধীনতা নেই, তাদের এক অংশকে আগেই বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের কোনো মুখপাত্রও নেই, কোনো প্রকাশনা পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের কথা তারা নিজেরা বলবে, এমন শক্তিও তাদের নেই।

একটা সময় ছিল যখন এ রকমের ঘটনা ঘটলে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ও চীন জোর গলায় বিরোধিতা করত। আক্রান্তদের পাশে আছে বলে তারা জানাত, জনমত সৃষ্টি করত। ফলে আক্রমণকারীরা কিছুটা সংযত হতো। কিন্তু এখন সেসব নেই। রাশিয়া তো পুঁজিবাদী হয়ে গেছেই, চীনও ওই পথ ধরে বেপরোয়া গতিতেই ছুটে চলেছে। এই সেদিনও চীন রাশিয়াকে ‘নামে সমাজতন্ত্রী কাজে সাম্রাজ্যবাদী’ বলে গলা ফাটিয়ে গালাগাল করত। এখন সে নিজেই রাশিয়ার অধঃপতিত ভূমিকায় নেমে পড়েছে। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে চীন বলেছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। টের পাওয়া যাচ্ছিল যে তার রকমসকম সন্দেহজনক; জাতীয়তাবাদী পথে পুঁজিবাদী হওয়ার তালে আছে। যে জন্য গণহত্যাটা দেখেও সে দেখেনি। এবার একেবারে নাকের ডগায় গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তবু তার ওই একই আওয়াজ।

জাতিসংঘের মহলগুলো থেকে নিন্দার যেসব প্রস্তাব উঠছে, চীন সেগুলোর প্রতিটিতে ভয়ংকরভাবে বাধা দিচ্ছে। কারণ মুনাফার সুঘ্রাণ পেয়ে গেছে। সুযোগ-সুবিধা আগেও পাচ্ছিল, এখন গণহত্যায় সমর্থন দিচ্ছে, যাতে করে বিপদের বন্ধু হিসেবে আরও সুবিধা আদায় করে নিতে পারে। চীনের এই পুঁজিবাদী অধঃপতন সাবেকি পুঁজিবাদীদের লজ্জায় ফেলে দেবে। প্রবাদে যে কথিত আছে, সদ্য-ধর্মান্তরিতরা সাবেকি ধার্মিকদের চেয়ে অধিক তেজি হয়, সেই কথাটাকে মিথ্যা বলার সাধ্য কোথায়?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

অরকার আক্রমণে তরুণী প্রশিক্ষকের মৃত্যু, ভাইরাল ভিডিওটি সম্পর্কে যা জানা গেল

অস্থিরতার সামান্য ইঙ্গিত পেলেই আমরা চলে যাব

ভারতকে পাকিস্তানি সেনাপ্রধানের পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র

প্লট–ফ্ল্যাট বরাদ্দে সচিব, এমপি, মন্ত্রী, বিচারপতিসহ যাঁদের কোটা বাতিল

জর্ডান-মিসরকে নিয়ে বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করতে চান নেতানিয়াহু

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত