Ajker Patrika

বনসাইপ্রেমী শাহজাদি সুলতানা

আল-আমিন রাজু, ঢাকা
বনসাইপ্রেমী শাহজাদি সুলতানা

ওভারব্রিজটা ভেঙে ফেলার পর ফার্মগেটের এই জায়গাটা বেশ ফাঁকা লাগে। অভ্যাস বশে ওপরের দিকে তাকালে দেখা যায় মেট্রোরেলের বিরাট কাঠামো। ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের উল্টোদিকে হলি রোজারি চার্চ ওরফে পবিত্র জপমালা রানির গির্জা অথবা আমাদের ব্যাপক পরিচিত তেজগাঁও গির্জা। এই গির্জা ছাড়িয়ে কয়েক কদম এগিয়ে একটি বাড়িতে থাকেন শাহজাদি সুলতানা।

শাহজাদি সুলতানার তৈরি করা বনসাইএই মেগাসিটির কোটি কোটি মানুষের একজন হয়েই হয়তো জীবন পার হয়ে যেত শাহজাদি সুলতানার। কিন্তু সেটি হয়নি। আর হয়নি বলেই তাঁকে খুঁজে বের করে ঠিকানা নিয়ে তাঁর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হই আমরা। তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় একটি বনসাই মেলায়। হাজারো বনসাইয়ের ভিড়ে রুট ওভার রক টাইপের বনসাই দেখে আকৃষ্ট হই। তারপর আলাপ। তারও কয়েক দিন পর তাঁর দেওয়া ঠিকানা ধরে হাজির হয়ে যাই তাঁর বাসায়। আলাপ হয় অনেকক্ষণ।

শাহজাদি সুলতানার তৈরি করা বনসাইশৈশব থেকেই গাছ ভালোবাসতেন শাহজাদি সুলতানা। ভালোবাসা মানে গাছ লাগানো, পরিচর্যা করা—এই সব। সেটা বড়বেলায়ও ছিল। কিন্তু বিশাল বিশাল গাছ যে ছোট্ট টবে লাগানো যায় আর সেটা হয়ে উঠতে পারে এক শিল্প, সে বিষয়ে শাহজাদির কোনো ধারণা ছিল না। বিয়ের পর ঢাকায় এসে দেখতে পান বিশাল বিশাল বৃক্ষ টবে লাগানো! তাজ্জব তো হনই, সেই সঙ্গে আগ্রহীও হয়ে ওঠেন বনসাইশিল্পের শিল্পিত ভুবনের প্রতি। এরপর বনসাই তৈরি শুরু করেন শাহজাদি সুলতানা। ১৯ বছর ধরে শত শত বনসাই তৈরি করছেন তিনি। সঙ্গে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বনসাইপ্রেমী শত শত তরুণ-তরুণীকে। আর ঢাকার ফার্মগেটে নিজের বাসার ছাদে বনসাই বাগান করেছেন।

দুই সন্তানের মা শাহজাদি মূলত গৃহিণী। বনসাই বানানোর পাশাপাশি শখের বশে আঁকেন ছবি। সেটিও সেই ছোটবেলার ইচ্ছাকে বাস্তব করতেই। বনসাই বানানোতে প্রশিক্ষণ নিলেও ছবি আঁকার বিষয়ে তাঁর কোনো প্রশিক্ষণ নেই। ছোটবেলার ভালো লাগা আর বড়বেলার অনুশীলন—এই দুই-ই তাঁকে শিল্পী বানিয়ে দিয়েছে।

শাহজাদি সুলতানার তৈরি করা বনসাইআলাপচারিতায় শাহজাদি সুলতানা জানান, বিয়ের পর ঢাকায় এসে ২০০০ সালে একটি বনসাই প্রদর্শনীতে গিয়ে এর প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। সেই আগ্রহ বাস্তব রূপ দিতে বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটি থেকে ২০০৩ সালে একটি কোর্স শেষ করেন। বনসাইশিল্পী হিসেবে তাঁর বিশেষত্ব হলো, রক বা পাথরের ওপর বনসাই করা। রুট ওভার রক টাইপের বনসাইশিল্পী হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় দেখা পছন্দসই প্রাকৃতিক দৃশ্য ফুটিয়ে তোলেন বনসাইয়ের মাধ্যমে।

শাহজাদি বলেন, ‘বনসাই নিয়ে জানার শেষ নেই। বনসাই এমন একটি সুন্দর শিল্প, যেখানে প্রাণ আছে। নিজের ইচ্ছেমতো প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তুলতে পারা যায়। এটা আনন্দের বিষয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের শিশুরা পড়াশোনা আর প্রযুক্তিতে আটকে গেছে। এখন শিশুরা প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে পারে না। তাদের আকৃষ্ট করতে বনসাই হতে পারে ভালো উপায়। অনেক গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া গাছগুলোর বনসাই করলে সেগুলো টিকে থাকবে। চেনাও হবে।’

শাহজাদি সুলতানা শিশুদের জন্য বনসাই তৈরি করতে চান বলে জানান। তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে বাচ্চারা বনসাই দেখলে কাছে পেতে চায়। ওদের জন্য বনসাই তৈরি করতে চাই। তারা দেখবে, কাছে রাখবে।’

প্রতিনিয়ত বনসাই তৈরি করে চলেছেন শাহজাদি। সে ক্ষেত্রে রাখার জায়গার সংকট তৈরি হচ্ছে। নিজের কাছে সব রেখে দেওয়ার উপায় নেই। নতুন গাছ করার জন্য পুরোনো গাছগুলো বিক্রি করে দিতে হয়। হিসাব রাখেননি কী পরিমাণ গাছ তিনি বিক্রি করেছেন। প্রতিবছর তিনি ১৫ থেকে ১৬টি বনসাই বিক্রি করেন। তিনি জানান, প্রতিটি গাছের একেকটি নিজস্বতা আছে। ডেপথ, অ্যাপেক্স, গাছের ডালগুলোকে সাজানো, অর্থাৎ সুন্দর একটি ফর্মুলা আছে বনসাইয়ের।

বনসাই তৈরি সময়সাপেক্ষ কাজ। শাহজাদি জানান, একদম ছোট একটি বনসাই করতে কমপক্ষে তিন বছর সময় লাগে। অনেক সময় কোনো কোনো গাছ বনসাই করতে সাত থেকে আট বছর সময় লেগে যায়। প্রতিটি গাছই প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে চায় বলে বনসাই ঘরে রাখলেও বেশির ভাগ সময় রোদের কাছাকাছি রাখতে হবে বলে জানান শাহজাদি।

বনসাইয়ের শুধু শিল্পগুণই আছে, তা নয়। এটি মানুষের মুডও ভালো রাখতে পারে। শাহজাদি মনে করেন, বিষণ্নতা কাটাতে বনসাইয়ের একটি ভূমিকা আছে। সে জন্য তিনি সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন, প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে। তাতে অনেক মানসিক রোগের মতো ডিপ্রেশনও দূরে থাকবে।

অনেকক্ষণ আলাপ হয় শাহজাদি সুলতানার সঙ্গে। ছবি তোলা হয় ফাঁকে ফাঁকে। ফিরে আসতে আসতে ভাবি, এই মেগাসিটিতে একজন নারী বুনে চলেছেন একরাশ বনসাই স্বপ্ন। সে স্বপ্ন ক্ষুদ্র নয়। অথচ ‘বনসাই’ শব্দটিকে আমরা ‘ক্ষুদ্র’ অর্থে ব্যবহার করি। ব্যবহারিকভাবে শব্দের অর্থ কতভাবে বদলায়! 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত